#স্ত্রী
পর্বঃ ২
লেখিকাঃ #তাওহীদা
গাড়ি এসে একটা ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে থামলো।রায়ান জিনাতকে নিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাড়ালো।
–চোখের পানি মোছো,,যার জন্য তোমায় এতো কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ে করে আনলাম ,,তার সামনে কি চোখের পানি নিয়ে দাঁড়াবে।চোখ মোছো জলদি!! আর খবরদার!! যদি কোনো বেয়াদবি করেছো,,তবে আমিও তোমার বাবা মার সাথে আদব বজায় রাখতে পারবো না।বুঝতে পেরেছো???(নিচু গলায় শাসিয়ে বললো রায়ান)
জিনাত মাথা নাড়লো।
রায়ান কলিং বেল চাপ দিলো।একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিলো।
–আরে ভাইজান,,,এইডা কেডা?আমাগো ভাবি নি!
— হ্যাঁ, ঠিকি ধরেছিস শিমু।মা কোথায়?(ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো রায়ান)
-আম্মা তো শুইয়া পরছে,,তয় ঘুমায় নাই মনে হয়,,ইট্টু আগেই শুইছে।
-আচ্ছা,,তুই তোর ভাবির সাথে এখানে থাক,,আমি মাকে ডেকে আনছি।
রায়ান ওর মায়ের রুমে ঢুকে দেখলো,,কলিং বেলের আওয়াজে ওর মা আগেই উঠে পরেছেন।
-কি ব্যাপার? আজ সূর্য কোন দিয়ে উঠলো যে আমার ছেলে যে ১১ টার মধ্যেই বাসায় এসে পরলো !!
-তোমার জন্য একজনকে নিয়ে এসেছি মা।
-কাকে?
-চলো দেখবে, চলো!
রায়ান ওর মায়ের হাত ধরে বসার ঘরে নিয়ে এলো।জিনাত রায়ানের মাকে দেখে সালাম দিলো। জিনাতকে দেখে রায়ানের মা একটু চমকে গেলেন,,কিন্তু অবাক হলেন না।কারন উনি জানতেন,,তার ছেলে কেমন।উনি রায়ানের কান টেনে ধরে বললেন,,,,
আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম,,আমার বাদর টা এমনই কিছু একটা করবে।
-কেনো করবো না বলো মা,,,যে জিনিসটা তোমার পছন্দ হয়েছে,,সেটা আনতে গিয়ে সোজা আঙুলে কাজ না হলে,,তবে আঙুল বাকাতে তো হবেই।আমার মা কিছু চেয়েছে,,আর তা আমি এনে দিতে পারি নি,এমন কি কখনো হয়েছে?
-কিন্তু তুই ওকে এভাবে বিয়ে করে ঠিক করিস নি।ওর বাবা মাকে আরো একটু বোঝানোর চেষ্টা করতে পারতি।
–কি যে বলো না মা,,ওনারা হলেন মহা ভদ্রলোক!!! গুন্ডা মাস্তান কি আর তাদের মনে ধরে!!দেখলে না,,তোমাকে কিভাবে অপমান করলো।আর জানো,, আমাদের কাছে ভেবে দেখবার জন্য সময় চেয়েছিলো,,অথচ আজ দিব্যি মেয়েকে দূরে পাঠিয়ে দেবার ফন্দি আটছিলো!কতোবড় ধোকাবাজ!!
-এভাবে বলেনা বাবা,,ওনারা তোমার মুরুব্বি না,,,
জিনাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মা ছেলের দিকে।এ কেমন মা,,ছেলে গুন্ডামী, মাস্তানি করে বেড়ায়,, আর উনি তা জেনেও কিছু বলেন না!আবার ছেলে এতোবড় একটা অপরাধ করে ঘরে এসেছে,,তারপরও উনি এতো স্বাভাবিক কিভাবে??
রায়ানের মা, জিনাতের দিকে এগিয়ে গেলেন,,জিনাতের মাথায় হাত রেখে বললেন,,আহারে,আমার মিষ্টি মেয়েটা কেদেকেটে চোখমুখের কি হাল করেছে!!মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে।মনে হয় অনেকক্ষণ পেটে দানা পানি কিছুই পরেনি।শিমু তুই টেবিলে খাবার দে।আর জিনাত,তুমি আমার সাথে এসো মা,,,,
জিনাত অবাক হয়েই যাচ্ছে,,বার বারই শুধু ভাবছে, এ কেমন মা?প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওর রায়ানের মায়ের উপর।ভাবছে,, নিশ্চয়ই রায়ানের মাই ওকে এইকাজ কাজ করতে বলেছে,,শুধুমাত্র এই মহিলার জেদের জন্য আজ আমার জীবনটা অন্ধকারে ডুবে গেলো।
রায়ানের মা জিনাতকে তার রুমে নিয়ে গেলেন।উনি জিনাতকে বোরখা খুলে হাতমুখ ধুয়ে নিতে বলে, রুমের বাইরে গেলেন।
জিনাতের খুব বিরক্ত লাগছে। ও ওখানেই দাড়িয়ে রইলো।রাগে গজগজ করছে ও,,কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না,,কারণ ওর বাবা মা রায়ানের হাতে বন্দি।
কিছুক্ষণ পরে রায়ানের মা এসে জিনাতকে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,,,,,
-কি হলো মা,,তুমি ওখানেই দাঁড়িয়ে আছো?ও নতুন এসেছো বলে সংকোচ হচ্ছে?সংকোচের কি আছে? এই ঘর বাড়ি সংসার সবই তো আজ থেকে তোমার।
জিনাত মনে মনে ভাবলো,,ইস!! খুব আসছে এই ঘর বাড়ি সংসার আমাকে দিতে! এই পাপের টাকার সংসার কে চায়? একটা সুযোগ পাই,,,আমার জীবনটা নষ্ট করার শোধ,,আমি আপনাদের মা,ছেলে দুজনের উপরেই তুলবো।
রায়ানের মায়ের ডাকে জিনাতের ধ্যান ভাঙলো।
-কি হলো জিনাত, যাও। বোরখা খুলে হাতমুখ ধুয়ে নাও।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিনাত হাতমুখ ধুতে চলে গেলো।
ও বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে রায়ানের মা একটা লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি আর বেশকিছু গয়না বের করে রেখেছেন।
জিনাতকে দেখেই তিনি বললেন,
-এসো মা,এসো।এখন এগুলো ঝটপট পড়ে,, একটু পরিপাটি হয়ে নাও দেখি,,,তোমাকে রাস্তায় দেখার পর থেকেই আমার শখ,,তোমাকে এই লাল টুকটুকে বেনারসিতে দেখার।তাইতো পরের দিনি এই শাড়ি গয়নাগুলো নিয়ে, তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।কিন্তু তারা তো বুঝতেই চাইলো না
আমার কোনো কথা।যাক,সেসব কথা।অবশেষে তুমি আমার ঘর আলো করে এসেছো,,এই অনেক!!আমি শিমুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি,, ও তোমাকে সাহায্য করবে।
এতোক্ষন যাও সহ্য করেছে জিনাত,,এবার ওর মেজাজ চরমে পৌছালো।
-দেখুন,,আপনার জেদ পূরন করতে গিয়ে আপনার গুনধর ছেলে এইরকম বিশ্রীভাবে আমাকে বিয়ে করেছে।আমি শুধুমাত্র আমার বাবা মায়ের মুখ চেয়ে এতক্ষণ সব সহ্য করেছি।কিন্তু এবার আমাকে ছাড়ুন।এই রাত-বিরেতে আপনার শখ পূরন করতে আমি সঙ সাজতে পারবো না।
-আচ্ছা,,, তাই নাকি সঙ সাজতে পারবে না,,,তো ঠিক আছে,,মা তো আর তোমাকে সঙ সাজতে বলেনি,,,বউ সাজতে বলেছে!!! তাই ঝটপট বউ সেজে ফেলো,,যদি ভালো চাও!!ও না না,,কথাটা ঠিক তা না,,যদি তোমার বাবা মায়ের ভালো চাও!!!(দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো রায়ান)
– উহ,,রায়ান! এভাবে মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছিস কেনো।আর তুই এখানে কি করছিস?তোকে না বললাম তৈরী হয়ে নিতে।যা এক্ষুনি যা!
-আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল মা,,যে এই মেয়ে তোমার সাথে বেয়াদবি করবে।তাই দেখতে এসেছিলাম।আর আমার ধারণাই সত্যি হলো।
– কিচ্ছু বেয়াদবি করেনি ও।যেভাবে বিয়েটা হয়েছে,,তাতে ওর এই আচরণ স্বাভাবিক। তুই যা,,ও ঠিক তৈরী হয়ে নেবে।
রায়ান চলে গেলো।রায়ানের মা জিনাতকে তৈরী হতে বলে শিমুকে ডাকতে গেলেন।
ওনারা চলে যেতেই জিনাত বিছানার উপর বসে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ভাবলো,,বিয়ে একটা মেয়ের কতই না স্বপ্ন থাকে।আর আমার বিয়েটা কিনা এভাবে হলো?আজ আমাকে বউ সাজতে হবে,,,তাও কিনার একটা ক্রিমিনালের জন্য? এই ছিলো আমার ভাগ্যে?শেষ পর্যন্ত আমার পরিচয়,, আমি একটা দাগী আসামির স্ত্রী?
এর মধ্যেই শিমু এসে বললো,,ভাবি আসেন,আপনারে শাড়ি পড়াইয়া দেই।আমি কিন্তু খুব সুন্দার কইরা শাড়ি পড়াইতে পারি।মেলা পদের খোপা বানতেও জানি।তয় ভাবি,,আপ্নে মাশা আল্লাহ যা সুন্দার,,আপনার মুখে তো সোনো, পাউডার,লিবিস্টিক কিছুই লাগবো না।শাড়িডা পড়াইলেই,পাক্কা লাল টুকটুইক্কা বউ হইয়া যাইবেন। আসেন ভাবি,,,আম্মায় তড়তড়ি করতে কইছে,,মেলা রাইত হইয়া গেছে তো,,
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও,, জিনাতকে উঠে দাড়াতে হলো,,বউ সাজার জন্য।
শিমু জিনাতকে সাজাতে শুরু করলো ।খুব সুন্দর করে শাড়ি পরালো,,সুন্দর করে খোপা বাধলো।মুখের সাজগোজ বলতে শুধু একটু পাউডার, লিপস্টিক আর কাজল।লাল বেনারসি আর হালকা গয়নায়,জিনাতকে হুরপরীর মতো সুন্দর লাগছে।কাচা সোনার মতো গায়ের রঙে লাল শাড়িটা যেনো ঝলমল করছে।
এর মাঝেই রায়ানের মা রুমে ঢুকলেন।ঢুকেই তার চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেলো।
–মাশা আল্লাহ,, মাশা আল্লাহ!! এ কাকে দেখছি আমি,,আমার মিষটি মেয়েটা এতো সুন্দর!! আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া, এমন একটা হুরপরী আমার রায়ানের বউ করে পাঠানোর জন্য।
এই কথায় জিনাতের ভালো খারাপ কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না।ও চুপচাপ বসে আছে,মলিন মুখে।ওর শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে,,যে আজ থেকে ও একটা গুন্ডার স্ত্রী!!
রায়ানের মা জিনাতকে নিয়ে বসার ঘরে এলেন।রায়ান ওর মায়ের কথায় আগেই সেভ করে, হাতমুখ ধুয়ে, নতুন ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে ওখানে বসেছিলো।ও মাথা নিচু করে মোবাইল চাপছিলো।পায়ের শব্দ পেয়ে মাথা তুলতেই ওর চোখ আটকে যায়।,,এ কাকে দেখছে ও!মনে হচ্ছে আকাশ থেকে কোনো লাল পরী নেমে এসেছে।জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে এতোটা মুগ্ধ হলো রায়ান।জিনাতকে এর আগে সবসময় কালো বোরখা হিজাবেই দেখেছে।আর মুখে কখনো কোনো সাজগোজ করেনি জিনাত।তাই ওর এই রূপ রায়ানের অচেনা।সত্যি বলতে রায়ান কখনো জিনাতকে ওভাবে খেয়ালই করেনি।শুধুমাত্র মায়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই এতোকিছু করেছে ও। কিন্তু আজ, এখন যেন ও চোখই ফেরাতে পারছে না,,জিনাতের থেকে।
ছেলেকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে,,রায়ানের মা মুচকি হাসলেন।
–এহেম,এহেম!!বাবা আমার,,একটু সরে বসো,
মায়ের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো রায়ানের।জীবনে এই প্রথম বেশ লজ্জা লাগছে মার সামনে।তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে পাশে সরে বসলো।
জিনাত মাথা নিচু করেই আছে,,কারো দিকেই তাকাচ্ছে না।
রায়ানের মা রায়ান আর জিনাতকে পাশাপাশি বসিয়ে মিষ্টিমুখ করালেন।ফারদিন, সজীব,সুমন,মনির (রায়ানের চ্যালাপেলা) ওরা রায়ান আর জিনাতের ছবি তুলতে লাগলো।
-ভাই,,আরেকটু ক্লোজ হও না,,,
-আরে ভাই,,ভাবির কাধে হাত রাখো না,,নয়তো কি কাপল পিক হয় নাকি।
-খালাম্মা,আপনি দুইজনের কাধে হাত দেন না,,,,
জিনাত বিরক্তির চরম সীমায় পৌছে গেলো এদের কার্যকলাপে।সবচেয়ে বিরক্ত তো তখন হলো,,যখন রায়ান ছবি তোলার জন্য ওর কাধে হাত দিয়েছিলো,,সারা শরীর যেনো জিনাতের রি রি করে উঠেছিলো!অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় ও।
মিষ্টিমুখ আর ছবি তোলাতুলি শেষে সবাই খেতে বসলো।
জিনাত কিছুই খেতে চাইছে না।শেষে রায়ানের মায়ের জোড়াজুড়িতে দুই লোকমা খাবার খেতেই হলো।
খাবার শেষে, শিমু এসে জিনাতের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,,ভাবি চলেন,,আপনারে বাসর ঘরে লইয়া যাই।জানেন,,ফারদিন ভাইরা ইট্টুখানি সময়ের মইধ্যে কি সুন্দার কইরা ভাইজানের ঘরখান সাজাইছে,,,চলেন,আপনেরে লইয়া যাই,,,,
শিমুর কথা শুনে জিনাতের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এতোক্ষন তো এটা ওর মাথাতেই আসেনি,,,,শেষমেষ,,ওই গুন্ডাটার সাথে বাসর!!!
(চলবে)