#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৪
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এলোমেলো চুলে ড্রয়ইং-রুমে যেতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। মুন নিজের চোখের ভ্রম ভেবে দুহাত দিয়ে ভালোভাবে চোখ কচলে নিল। না, এটা ভ্রম নই। মানুষটা সত্যিই এসেছে কিন্তু কীভাবে সম্ভব! এই সুদূর দেশে! মুনের আয়ত্তে আসলো না কিছুই।
তার সোফা থেকেই কিছুদূরে আরেকটা সোফায় মানুষটা আর আফজাল শেখ হেসে হেসে গল্প করছে। আফজাল শেখ বাংলায় কথা বলছে। আদ্রিন একটু-আধটু বুঝলেও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। পাশেই ইরা বসে মাঝে মাঝে আফজাল শেখের কথাগুলো অনুবাদ করে দিচ্ছে। আদ্রিন ‘হা-হু’ মাথা নাড়ছে।
মুনের আর বুঝতে বাকি রইল না। মানুষটা বাংলাদেশে! তাও বা মুনের বাসায়! এদের পাশে ইরাকে বসে থাকতে দেখে মুন বুঝতে পারল – এই সবকিছু ইরার দ্বারা’ই সম্ভব।
এই অবস্থায় মুনের রিঅ্যাকশন কেমন হওয়া উচিত -সে বুঝতে পারছে না!
তার মানে ইরা সবকিছুই জানতো। ইরা জেনেও মুনকে কিছু বলেনি।
মুনকে দেখতেই আফজাল শেখ ডাক দিল। আদ্রিনের দৃষ্টি তখন মুনের মধ্যেই আবদ্ধ।
মুন এগিয়ে যেতেই আফজাল শেখ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল,’মুন মা, চিনেছিস আদ্রিন বাবাকে?’
মুনের খটকা লাগলো। বড়ো বাবা সহজে কারো সাথে মিশেন না, মানুষ বুঝেই মিশেন। এই ব্যাটা এমন কী করলো যে বড়ো বাবা এতো উৎফুল্ল তার উপর ‘বাবা’ সম্বোধন করে কথা বলছে!
মুনকে অন্য মনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,’মুন আমাদের আদ্রিন স্যারকে চিনিস নাই?’
-‘চিনবো না ক্যান! উনিই তো সবসময় আমাকে শাস্তি দিতো, তাকে কী ভোলা যায়!’
মুনের কথা শুনে ইরার মুখ পানশুটে হয়ে গেল। আর আফজাল শেখ ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে উঠল,’কীইইই?’
মুনের কথা আদ্রিন ভালোভাবে বুঝতে পারেনি যার ফলে সে পাত্তা নে দেওয়ার ভঙ্গিতে সোফায় আগের মতোই বসে রইল কিন্তু ইরা কী করবে বুঝতে পারছে না। এখন এই বাসায় আদ্রিনকে রাখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ইরার। তার মাথায় আসছে না কী বলবে। এদিকে মুনকে ভার্সিটিতে আদ্রিন বিনা কারণে শাস্তি দিতো, সেটা শুনলে আফজাল শেখ নিশ্চিত রেগে যাবে। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরা মুনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল,’সুযোগ বুঝে কোপ’টা মারলি!’ মুন দু’হাত বুকে গুঁজে সামনে আদ্রিনের দিকে তাকালো, যার অর্থ,’এবার বুঝবে সব। আমাকে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়ার মজা।’
আদ্রিন মুনের তাকানো দেখে কী বুঝলো বোঝা গেল না। সে মুনের তাকানো’তে পাত্তা না দিয়ে মুনকে পাল্টা হাসি দিয়ে ইরার দিকে তাকালো। যার অর্থ,’এই বাসায় আমায় কীভাবে রাখবে সেটার দায়িত্ব তোমার।’
মাঝখানে পড়ে ইরা ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সে মুনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। যাতে এবারের মতো তাকে বাঁচিয়ে নেয়। আফজাল শেখ এখনো ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা ভয়ে ভয়ে বলে উঠল,’আস,,লে আঙ্কেল, মুন ক্লাসে পড়া শিখে যেত না যার ফলে আদ্রিন স্যার সবসময় শাস্তি দিতো। সেই কথা’য় বলছে মুন।’
ইরার কথা শুনে মুন রাগী দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকালো আর আফজাল শেখ উচ্চস্বরে হেসে উঠল,’ওহবে, এই কথা। এটাকেই মুন শাস্তি বলছে!’ বলে আফজাল শেখ মুনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘আরে মুন। পড়া না পারলে তো শাস্তি দিবেই। তুই এভাবে ক্যান বলছিস! আর জানিস, এছাড়াও আদ্রিন বাবা’র পরিচয় কী?’
-‘বাবা, উনি এমনিও শাস্তি দি,,,’ মুনের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আফজাল শেখ হেসে তাকে থামিয়ে দিল।
-‘তুই বাচ্চা’ই রয়ে গেলি এখনো। পড়া না পারলে শাস্তি তো দিবেই। এটা নিয়ে এতো কথা বলিস না আর। এখন আদ্রিন আমাদের মেহমান। ওকে খাতির-দারি করবি, তা না করে তুই এসব বলছিস! ছেলেটা এতদূর থেকে কাল’ই আসলো মাত্র। সকালে উঠেই তুই এসব বলছিস। আর উনি তোদের টিচার, না?’
আফজাল শেখের কথায় মুনের মুখ পানসুটে আকার ধারণ করলো। সে আর কথা আগানোর সাহস পেল না, ভয়ে শুপসে গেল।
-‘এখন যা। ওর জন্য কিছু ভালো খাবার রান্না করতে বল তোর বড়ো মা’দের। আর গিয়ে বল, আদ্রিন ঘুম থেকে উঠছে – নাস্তার ব্যবস্থা করতে।’
আফজাল শেখের কথা শুনে মুন রাগী দৃষ্টিতে একবার ইরার দিকে তাকালো, যার অর্থ,’সবকিছুর মূল তুই।’ ইরা মুনের তাকানোর অর্থ বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলে। এরপর মুন রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ানোর আগে আদ্রিনের দিকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করলো।
আদ্রিন মুনের তাকানো’কে পাত্তা না দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আরেকটু আরাম করে বসে মোবাইলের দিকে দৃষ্টি দিল।
মুন আর কাউকে না পেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, বড়ো মা’রা সবাই একসাথে রান্নার কাজে ব্যস্ত। মুন গিয়ে বলে উঠল,’কে একটা জানি আসছে! উনার জন্য নাস্তা’র ব্যবস্থা করতে বলেছে বড়ো বাবা। আর আমাকেও কিছু খেতে দাও, সকালে উঠে এখনো কেউ আমাকে কিছু খেতে দেয়নি।’
মুনের কথা শুনে সবাই আদ্রিনের জন্য নাস্তা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মুন সবার এতো তাড়াহুড়ো দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমনকী তার মা’ও মুনের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আদ্রিনের জন্য নাস্তা বানাতে দৃষ্টি দিল। মুন মায়ের দিকে এগিয়ে বলে উঠল,’মাআআ, আমাকে নাস্তা দিবে না? আমি এখনো কিছু খায়নি।’
-‘ঐতো টেবিলে রাখছি। ওখানে থেকে নিয়ে খা। আমি ছেলেটার জন্য নাস্তা বানাচ্ছি, দেখছিস না?’
মায়ের এমন জবাবে মুন অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ মুনের থেকে আদ্রিন বেশি হয়ে গেল। মুন রাগী দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরের কেউই মুনের দৃষ্টিকে পাত্তা দিল না। তারা আদ্রিনের জন্য নাস্তা বানাতে দৃষ্টি দিল।
মুন ধপধপ পা ফেলে ড্রয়ইং’য়ের টেবিলে এসে নাস্তা নিয়ে খেতে বসলো। তার সামনেই আদ্রিন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আরামসে বসে মোবাইল স্ক্রল করছে। বড়ো বাবা পত্রিকা পড়ছে, ইরাকে দেখা যাচ্ছে না, হয়ত মহাশয় রুমে। মুনের ইচ্ছে করলো, এখনই গিয়ে আদ্রিনের মাথা ফাটিয়ে দিতে। এমন কে আসছে যে, বাসার কেউই মুনকে পাত্তা না দিয়ে মানুষটাকে মাথায় তুলতেছে।
মুন নাস্তা চিবিয়ে চিবিয়ে আদ্রিনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন সময় বড়ো মা’রা সবাই মিলে আদ্রিনের জন্য টেবিলে নাস্তা নিয়ে আসলো। তারা এসেই আদ্রিনকে সোফা থেকে টেবিলে নাস্তার উদ্দেশ্যে ডাকলো, সাথে আফজাল শেখকেও। আদ্রিন উঠে এসে মুনের পাশে বসতেই মুন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। এরপর নাস্তার প্লেটটা হাতে নিয়ে জোরে টেবিলে রেখে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই মায়ের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে উঠতেই থেমে গেল,’মুন এগুলো কোন ধরণের স্বভাব। এভাবে প্লেট রাখা! নাস্তা না করে কই যাচ্ছিস! কী হয়েছে তোর?’
মুন রেগে আদ্রিনের দিকে একবার তাকালো। মানুষটা নিজের খাওয়ার দিকে ব্যস্ত। মুন দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,’কিছু না। যাকে খাওয়াচ্ছ, তাকেই খাওয়াও!’ বলেই হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
আদ্রিন মুনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।’আমাকে একা ওই দেশে রেখে আসার স্বাদ নাও।’ বিড়বিড় করে আওড়ালো।
মুন রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ইরাকে শুয়ে শুয়ে কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনতে দেখে তার রাগ আরো বেড়ে গেল। মুন রাগ করেছে সেটা সবাইকে বোঝাতে হবে তো। তাই সে রুমের দরজাটা আবার খুলে সশব্দে আটকালো কিন্তু তাতেও যখন ইরা চোখ খুলল না, মুনের রাগ আরো বেড়ে গেল। সে দরজাটা আবার খুলে লাথি দিয়ে বন্ধ করলো, তবুও ইরার কোনো ভ্রূক্ষেপ না দেখে সে ইরার দিকে এগিয়ে দেখল, চোখ বন্ধ করে কানে ইয়ারফোন গুঁজা। হাত দিয়ে বুঝতে পারল, ইরা ঘুম আর কানের ইয়ারফোন নিয়ে শুনে দেখল জ্ঞান চলছে। মুনের এদিকে বারোটা বাজিয়ে আর উনি সুখের ঘুম দিচ্ছে -এটা তো হতে পারে না। তাই মুন ওয়াশরুমে গিয়ে পানি এনে ইরার মুখ বরাবর ঢেলে দিল। ইরা ধরফড়িয়ে উঠে বসে সামনে মুনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সে অন্যপাশ ফিরে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো। মুন বুঝতে পারলো না, সবাই ওকে এভাবে ইগনোর কেন করছে! সব ওই ইংরেজ ব্যাটার কারণে।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।