স্বামী পর্ব ৩১+৩২

#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৩১

সোহান কিছু না বলেই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল। মেজাজ পুরো গরম। বুঝতে পারল ওকে নিয়ে হয়তোবা কোন সমালোচনা হচ্ছে। তবুও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও কোন জবাব দিল না। তাছাড়া কী জবাব দিবে? কার কাছেই বা দিবে? এটা তার শ্বাশুড়বাড়ি নিজের বাড়ি নয় তাই সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় সামলাতে হবে।

সোহান সোজা রুমে গিয়ে বিছানার উপরে পা ঝুলিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পরে জান্নাত রুমে থেকে সোহানকে আড়চোখে দেখছে। জান্নাত আবারও সোজা দিকে হাঁটতে শুরু করল। সোহান জান্নাতকে দেখে কোন কথা বলল না। জান্নাত গিয়ে ড্রেসিন টেবিলের সামনে রাখা টুলের উপরে বসে চুল আচড়াচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে সোহানকে দেখছে। একটুপরে সোহান বিছানা দিয়ে নেমে ধীরে ধীরে জান্নাতের পিছনে এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এদিক ওদিক তাকিয়ে জান্নাতের কাঁধের উপরে থুঁতনিটা রেখে বলল,
– তোমার কী মন খারাপ? এমন দেখাচ্ছে কেন? তাছাড়া কালকে সকালের বাসে তো আমরা বাসায় ফিরে যাচ্ছি। তাই যত ইচ্ছে সবার সাথে সময় কাটাও। আর কবে না কবে দেখা হয় ঠিক নেই।
– সত্যি কালকে যাবেন?
– হ্যাঁ, সত্যি।
– ঠিকাছে।
– জান্নাত আমার জন্য এক কাপ দুধ চা বানিয়ে নিয়ে আসো। একদম কড়া লিকার দিয়ে চিনি কম।
– হুমম।

জান্নাত চিরুনিটা রেখে উঠতে শুরু করলে সোহান বাঁধ সাধল।
মুখটা ঘুরিয়ে জান্নাত বলল,
– কিছু বলবে?
– চায়ের সাথে মুড়ি নিয়ে আসবে। দুধের চা দিয়ে মুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা।
– আচ্ছা পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করেন আমি যাব আর আসব। কথাটা বলতে বলতে জান্নাত চলে গেল। রান্নাঘরে ঢুকে চুলোয় চায়ের কেটলিটা চাপিয়ে দিয়ে বাটা দিয়ে মুড়ি ঢেলে প্লেটে রাখল। চা হয়ে এলে নামিয়ে দুধ, চিনি দিয়ে নেড়ে কাপে ঢেলে রুমে নিয়ে গেল।
চায়ের মগটা সোহানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– নিন আপনার গরম গরম চা। তাড়াতাড়ি শেষ করে কাজ করেন।
– তুমি খাবে না?
– না।
– কেন?
– বারবার চা খাওয়া পছন্দ না।
– ওহ্।
– আপনি খেয়ে নিন।

চায়ের মগে চুমুক দিয়ে বলল, জান্নাত চিনিটা অনেক কম হয়েছে। তাই আমার মগে তুমি একটা চুমুক দাও তো তাইলে চা টা খুব মিষ্টি হয়ে যাবে।
– এত ঢং আপনি পান কোথায়?
– এগুলো তোমার ঢং মনে হয়?
– ঢং নয়তো কী? বিয়ের এতদিন পরে আপনি কখনও এসব বলেননি তাইলে এখন কেন বলছেন?
– বাহ্ রে, এতদিন বলিনি বলে কী এখনো বলা যাবে না? এটা কেমন কথা?
– জানি না।
– তুমি জানো না তো কে জানে বলো?
– কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মগটা দিন।
– তোমাকে কোন কথা বললে তুমি রাগ হচ্ছো কেন? কথা কী সহ্য হচ্ছে না।

সোহানের হাত থেকে মগটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় জান্নাত।
– সোহানের মেজাজ পুরো বিগড়ে গেল। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলছে।

দুপুরবেলা জান্নাতের মা এসে সোহানকে ডাকল।
– বাবা সবাই তোমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে খাবে চল।
– আপনার কষ্ট করে ডাকা লাগছে কেন? তাছাড়া আমার ক্ষিদেও নেই।
– কী বলছ তুমি? এতবেলা হয়ে গেল আর একটুপরে বিকাল হয়ে যাবে অথচ তুৃমি বলছ ক্ষিদে নেই।
– সত্যি বলছি আমার ক্ষিদে নেই।
– আমি কোন কথা শুনতে চাচ্ছি না তাড়াতাড়ি এসো।
– ঠিকাছে, এত করে যখন বলছেন আমি অবশ্যই খাব।
– হুম।
– জান্নাত কোথায় আন্টি?
– আন্টি?
– আসলে চমকানোরই কথা আমি আমার মা ছাড়া কাউকে মা বলে ডাকতে পারব না। আমার নিজের তো মা আছে তাই আপনাকে মা বলে ডাকাতে আমার লজ্জা লাগছে।
– মা না বলো আম্মা তো বলতে পার। তাছাড়া কেউ যদি আন্টি ডাকটা শুনে ফেলে তাইলে অন্য কিছু মনে করবে।
– ওহ্ আন্টি চলেন আমি যাচ্ছি। সোহান বিষয়টা এড়িয়ে ডাইনিং রুমে বসল।

জান্নাতের বাবা ভাতের লোকমা মাখাচ্ছেন আর সোহানকে দেখছেন। সোহান টেবিলে বসে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। বিষয়টা জাহিদুল সাহেব বুঝতে পারেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে মুখ খুলে সোহানকে জিজ্ঞেস করল,
– কী খুঁজছো বাবা?
– ইয়ে মানে! আর কোন কথা বলতে পারল না।
– তুমি কী জান্নাতকে খুঁজছো?
– না বাবা আমি ওকে খুঁজছি না।
– হুম। শিরিন জান্নাতকে ডেকে আনতো।
– জি।

শিরিন চেয়ারটা পিছনের দিকে ঠেলা দিয়ে উঠতে যাবে তখনি সোহান বাঁধ সাঁধল।
– কী ভাইয়া?
– তুমি এখানে বসো জান্নাতকে ডাকা লাগবে না। তাছাড়া জান্নাত এসে কী করবে?
– শিরিন সোহানের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার পিছনে ফিরল। কথা শেষ না হতেই জান্নাত ডাইনিং রুমে ঢুকল।

সখিনা বেগম বলল, ওই তো জান্নাত চলে এসেছে।

জান্নাত এসে দেখে সবার মুখের চেহারা এলোমেলো হয়ে গেছে। কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল,
– কী ব্যাপার সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? সামনে ভাত রেখে এভাবে কথা বলাটা কিন্তু ঠিক না।
জান্নাতের কথাশুনে সবাই খাওয়া শুরু করল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে গেল।

পুরো বিছানা জুরে দিয়ে সোহান শুয়ে আছে। জান্নাত রুমে ঢুকে এমন দৃশ্য দেখে তার মেজাজ আরও গরম হয়ে যায়। বিছানার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সোহান খবরের কাগজ মুখের উপরে চেপে ধরে পায়ের উপরে পা তুলে নাড়ছে। জান্নাতের দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। বিছানার উপরে এককোণে বসে কোনভাবে শুয়ে পরল জান্নাত। হঠাৎ জান্নাতের কোমড় জড়িয়ে ধরল। সোহানের হাতের স্পর্শে জান্নাতের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। তবুও সোহানকে সেটা বুঝতে না দিয়ে গাপটি মেরে বালিশে মাথা লুকিয়ে রাখল। সোহান এবার জান্নাতের পিঠের উপরে নাক রেখে ঘষতে লাগল।
একটুপর জান্নাত রাগান্বিত স্বরে বলল,
– আপনার সমস্যা কী? এভাবে করছেন কেন?
সোহান কোন উত্তর না দিয়ে জান্নাতের পিঠে চুমো খেতে লাগল।

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ হলে জান্নাত বসা ছেড়ে উঠে দরজাটা খুলে দিয়ে দেখে শিরিন দাঁড়িয়ে আছে।
– কিছু বলবি?
– জাকির ভাই তোমাকে ডাকছে কী যেন বলবে?
– কোথায় সে?
– বাহিরে অপেক্ষা করছে।
– ঠিকাছে তুই যা আমি যাচ্ছি।
– হুম।

শিরিন চলে গেলে জান্নাত মাথায় ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে দিয়ে সোহানকে কিছু না বলেই রুম থেকে বের হল। দরজা থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকায়। জাকির ভাইকে দেখতে না পেয়ে আবার ঘরে ঢোকার জন্য পা বাড়াবে তখনি সে ডাক দিল। জাকির ভাইয়ের গলার আওয়াজ শুনে মুখটা ফিরে তাকায় জান্নাত।
– আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
– যেমটা তুমি রেখেছ তেমনি আছি।
– মানে?
– কিছু না।
– কী খবর ভাই? কিছু বলবেন?
– বলার তো অনেক কিছু ছিল কিন্তু ঠোঁট দিয়ে বাহিরে বের হতে পারে না।
– আপনি কী বলছেন আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
– তোমার মাথায় ঢোকানো লাগবে না। এখন বলো, তুমি নাকি কালকে চলে যাচ্ছো?
– হুম।
– কিন্তু কেন?
– কোন কিন্তু নেই। বিবাহিত মেয়েদের তো স্বামীর ঘরে তো যেতেই হবে তাই না! তাছাড়া সোহান নিজে এসেছে তাই আর রাগ করে থাকতে পারলাম না।
– তুমি তো বলেছিলে সোহানকে ডির্ভোস দিবে তাইলে কী এমন হল যে স্বামীকে পেয়ে এত সহজে মত পরিবর্তন করে ফেললে?
-“…………”
– কী হল চুপ কেন? কিছু তো বল?
-“……….”
– কী বলব বুঝতে পারছি না। কী কারণে মত পরিবর্তন হল সেটাও আমি জানি না। শুধু এটা জেনে রাখবেন আমি নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছি না, পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি। আপনাকে শুধু রিকুয়েস্ট করছি কোন কারণ জানতে চাইবেন না।
– জান্নাত তোমাকে শুধু এতটুকু বলব যদি কখনও প্রয়োজন হয় আমাকে জানাবে আমি যতটুকু পারি সাহায্য করব।
– হুম। আচ্ছা ভাইয়া আমি তাইলে যাচ্ছি সোহান রুমে আছে।
– আচ্ছা যাও।

জান্নাত কথা বলা শেষ করে ঘরে ঢুকে দরজাটা আটকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল।

এদিকে পর্দার আড়াল থেকে জান্নাত আর জাকিরের সমস্ত কথা শুনে নিল সোহান। আজকের কথাগুলো একদম বুকে এসে বিঁধেছে। তার মানে জান্নাত মন থেকে যাচ্ছে না যে কোন কারণে যাচ্ছে। তার মানে আমার থ্রেটের কারণে যাচ্ছে। আমাকে ভালোবেসে নয়।
#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৩২

জান্নাত ভেতরে ঢোকার আগে হঠাৎ চোখ পড়ল সোহান রুমের ভেতরে পায়চারী করছে। সোহান তো এতক্ষণ বিছানার উপরে শুয়ে ছিল তাইলে এখন আবার উঠে হাঁটছে কেন? কোন সমস্যা হল নাকি! ভয়ে ভয়ে রুমের ভেতরে ঢুকল। টেবিলের উপরে পানির গ্লাস আর জগ রাখা। পা টিপেটিপে এগিয়ে গিয়ে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল।
গলাটা সেরে সোহানকে বলল,
– আপনি ঘুমানো রেখে হাঁটছেন যে? কোন খবর আছে নাকি!
– নাহ্।

সোহান আর কোন কথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। জান্নাত ও কিছু জিজ্ঞেস না করে বিছানায় শুয়ে পরল। মাগরিবের আজানের ডাকে ঘুম ভাঙল তার। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে মাথার একপাশে ব্যাথা করছে। বিছানা দিয়ে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকল। পানির কল ছেড়ে দিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিল। চোখদুটো অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে আসছে। দেয়াল ধরে কোনভাবে দাঁড়িয়ে কপালে হাত দিল। গায়ে হালকা জ্বর জ্বর লাগছে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ করেই বমির বেগ আসলে পেট কচলাতে কচলাতে অবশেষে বমি করল। ভালো করে কুলি করে তারপর রুম থেকে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে পারছে না শুধু চক্কর কাটছে।

সোহান রুমে এসে জান্নাতকে অসুস্থ অবস্থায় দেখে দৌড়ে এসে বলল,
– কী হয়েছে তোমার? তুমি কী অসুস্থ?
জান্নাত কোন কথা বলছে না শুধু উুহ মা গো করছে।

সোহান জোরে চিৎকার দিলে সবাই দৌড়ে আসল। জান্নাতকে ব্যাথায় কুঁকড়াতে দেখে সখিনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
– জান্নাত এমন করছে কেন? কী হয়েছে ওর?
– আন্টি সেটা তো জানি না। আমি রুমে এসে এই অবস্থায় দেখে আপনাদের ডাক দিলাম।

সখিনা বেগম জান্নাতের মাথাটাকে কোলের ভেতরে নিয়ে চুলে বিলি কাঁটছে আর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে।
শিরিন তাড়াতাড়ি পানি ভর্তি মগ নিয়ে জান্নাতের পাশে বসল। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসল। কিছুক্ষণ বেহুশ থাকার পরে জ্ঞান ফিরে আসল জান্নাতের। আধো আধো চোখ করে তাকালো। সখিনা বেগম মেয়ের জ্ঞান ফিরে আসাতে মনের ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।

– জান্নাত মা তোর কী হয়েছে? কথা বল? এভাবে চুপ করে থাকিস না। দেখ সবাই তোর জন্য চিন্তায় পরে গেছে।
অপলোকভাবে মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে সমস্ত রুমের দিকে চোখ বুলিয়ে শোয়া ছেড়ে উঠার চেষ্টা করলে সোহান রাগান্বিত হয়ে বলল,
– জান্নাত একদম উঠবে না। শুয়ে থাকো। এখন কেমন লাগছে তোমার? তুৃমি ঠিকাছ তো?
– জান্নাত কাঁপা গলায় বলল, হ্যাঁ ঠিকাছি। তাছাড়া আপনার এত অস্থির হওয়া লাগবে না।
– মানে কী জান্নাত?
– মানে কিছু না। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমার মাথাটা ঘুরছে।

সখিনা বেগম সবাইকে বলল,
– তোমরা সবাই বাহিরে চল, মেয়েটা বিশ্রাম নিবে। কালকে আবার জার্নি করতে হবে।

সবাই চলে গেলে সোহান জান্নাতকে বিছানার উপরে শুতে বললে, রেগে উঠল জান্নাত। তখন বললাম না আমার চিন্তা আপনার করা লাগবে না। আপনি আপনার মতো করে থাকেন আর আমাকে দয়া করে পদে পদে হয়রানি করবেন না।
জান্নাতের কথা শুনে সোহান যতটা না চিন্তিত ততটাই অবাক হয়। জান্নাত কিছুটা আবল তাবল বলা শুরু করেছে তাই কথা না বাড়িয়ে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে পরল। জান্নাত আধো চোখে চোখমেলে তাকায়। অনেকক্ষণ টেনে চোখদুটো আবারও বন্ধ করে ফেলে।

তারপর সিগারেটের প্যাকেট খুলে বের করে আঙুলের ফাঁকে রাখল। লাইটার বের করে সিগারেটটা জ্বালিয়ে টানতে লাগল। ফোনের ভলিউম কমিয়ে দিয়ে গান শুনতে লাগল। মনটা বড্ড খারাপ লাগছে জান্নাতের জন্য। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

একটুপরে দরজায় ঠকঠক শব্দে সোহান উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সখিনা বেগম দাঁড়িয়ে আছে।
– আন্টি।
– একটু বাহিরে আসো কথা আছে।
– জি।

সোহান মায়ের পিছনে দরজা চাপিয়ে বের হয়। সখিনা বেগম সোহানের দিকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
– বাবা জান্নাতের জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। শরীরের অবস্থা এরকম থাকলে কালকে তো নিয়ে যেতে পারবে না।
– গাড়িতে গেলে তো সমস্যা নেই। বাসায় গিয়ে ডাক্তার দেখাব। তাছাড়া অনেকদিন এখানে ছিল তাই এখন আর এখানে থাকতে দেওয়া যাবে না।
– কিন্তু..!
– কোন কিন্তু নেই। আমি জান্নাতকে কালকে সকালের গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।

সখিনা বেগম আর কিছু বললেন না চুপচাপ শুনলেন।
সোহান মায়ের হাত ধরে বলল,
– মা আপনি কোন চিন্তা করবেন না। কথা দিচ্ছি এবার আর জান্নাতকে কষ্ট দিব না। সোহানের দিকে একপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুমে ঢুকল সে।

রাত ৮ টার পরে সোহান জান্নাতকে বলল,
– কিছু খাবে?
– নাহ্।
– খিদে লাগেনি?
– নাহ্।
– চল সামনে গিয়ে চা খেয়ে আসি। ঘরের ভেতরে গরম।
– আমি যাব না আপনি যান। আমার শরীর ভালো লাগছে না।
– তাইলে তুমি বিশ্রাম নাও। আমরা কালকের সকালে বাসে চলে যাব।
– আমি যাব না বলে কী আপনি যাবেন না? আপনি গিয়ে চা খেয়ে আসেন।
– নাহ্ থাক বাহিরে খাব না। আচ্ছা বাসায় কী চায়ের ব্যবস্থা আছে?
– আছে তো মনে হচ্ছে তবুও আপনি গিয়ে একবার খোঁজ নিন।
– হুম।

সোহান মায়ের রুমে গিয়ে চায়ের কথা বললে, তিনি বললেন তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর আমি চা নিয়ে আসছি।
– আচ্ছা।

একটুপরে সখিনা বেগম চায়ের মগ হাতে রুমে আসল। জান্নাত ততক্ষণে ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে।
চায়ের মগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
– নাও গরম গরম চা খাও। জান্নাত মায়ের গলার আওয়াজ শুনে শোয়া থেকে চা খেতে উঠল। চায়ের মগটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল। সখিনা বেগম চা দিয়ে চলে যেতে নিলে জান্নাত মাকে বলল,
– মা, বাবা কোথায়? কালকে তো আমি চলে যাচ্ছি তাই বাবার সাথে দেখা করাটা জরুরি।
– এখন তুই বিশ্রাম নে। তাছাড়া তোর বাবার শরীরটা ভালো না।

রাত ১২ টার সময় জান্নাতের ঘুম ভাঙল। চোখ খোলার পরে দেখে আবারও মাথা ব্যাথা করছে। উঠে বসার মতো শক্তি নেই। কোন রকমে উঠে বসল। রুমের চারিদিকে চোখ বুলায়। কাউকে দেখতে না পেয়ে একা একাই ওয়াশরুমে ঢুকল। মাথাটা এখনো চক্কর কাটছে। খানিকবাদে পুরো দমে বমি করতে লাগল। বমি করতে করতে গলাটা আটকে যাচ্ছিল। চিৎকার করছে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে গলাটা যেনো কেউ চেপে রেখেছে।
বাম হাত দিয়ে কোনভাবে পানির কলটা ছেড়ে কুলি করে দরজা ঠেলা দিয়ে রুমে ঢোকার জন্য পা বাড়াতে যাবে তখনি মাথাটা আবারও চক্কর কাটে। জান্নাত পরে যেতে নিলে সোহান এসে সামলে নিল।
জান্নাতকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল,
– তোমাকে কতবার বলেছি একা একা কোথাও যাবে না। তবুও গেছে। কিছু হয়ে গেলে তোমাকে কোথায় পেতাম।
জানো কতটা টেনশন লাগছে।
– দেখুন বেশি ন্যাকামো করবেন না। ভালো লাগছে না।
– জান্নাত তুমি এমন করছ কেন? আমি তো আমার ভুলের জন্য অনুতপ্ত।

জান্নাত কথা না বাড়িয়ে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পরল।

ফজরের নামাজের পরে জান্নাতের বাবা জান্নাতের রুমে এসে দরজায় কড়া নাড়ল। সোহানের ঘুম ভেঙে গেলে সে উঠে দরজাটা খুলে দিল। আংকেল আপনি এত সকালে?
– হ্যাঁ বাবা, মেয়েটা কেমন আছে দেখতে এলাম। রাতে শরীরটা বড্ড খারাপ থাকায় আসতে পারিনি। তোমরা কী আজকেই চলে যাবে? মেয়েটার যে শরীর ভালো না।
– হ্যাঁ আংকেল আজকেই যাব। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি বাড়ি গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাব। তেলের জিনিস অতিরিক্ত খাওয়াতে শরীরটা মনে হয় খারাপ হয়ে গেছে। পেটে বদ হজম হয়েছে।
– জান্নাত তো তেলের জিনিস যতটা পারে ইগনোর করে তবুও বমি হচ্ছে। বমিটা কিন্তু স্বাভাবিক লক্ষণ নয় তুমি একটু ভেবে চিন্তে অগ্রসর হও।
– হ্যাঁ আংকেল। আচ্ছা আংকেল দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে আসেন। আমি জান্নাতকে ডেকে দিচ্ছি। জান্নাতকে ডাক দিলে সে ঘুম থেকে উঠল। বাবাকে দেখে কেঁদে দিল। বাবা তুমি আমাকে দেখতে এসেছো? এত দেরি করে আসলে যে? কালকে যদি মরে যেতাম তাইলে তো আজকে দুইদিন হয়ে যেত।
জান্নাতকে বুকের সাথে জাপটে ধরে বলল,
– মা এমনটা বলিস না খুব কষ্ট লাগছে। আমি এমন একটা হতভাগা বাবা যে নিজের মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। মা রে পারলে তোর এই অপরাধী বাপকে ক্ষমা করে দিস। আর মাঝমাঝে কল দিস। জান্নাতও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল।

সকাল ৭.৪৫ মিনিটে নাস্তা সেরে বাসা থেকে নেমে ৮.২০ মিনিটে বাস স্টান্ডে পৌঁছাল দুজনে। ৮.৩০ মিনিটে বাস ছাড়ার কথা থাকলেও ৮.৪০ মিনিট বাস ছাড়ল। সিটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে জান্নাত। চোখে মুখে হাজারো চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।

চলবে……………
চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here