স্মৃতিতে তোমার বন্দনা পর্ব ১০

#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_১০
#Saji_Afroz
.
.
-কি খারাপ খবর?
.
ক্ষীণস্বরে নয়নতারা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
-আমাদের স্কুলটা ভাঙা হবে ।
-মানে?
-জায়গাটা বিক্রি করা হচ্ছে । ওখানে নাকি দোকান হবে ।
.
মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়লেন আফিয়া জান্নাত । বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন তিনি ।
নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে নয়নতারা ।
নিজেকে স্বাভাবিক করে ছোঁয়া বললো-
অন্য কোনো ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে আপু । তুমি ভেঙে পড়োনা । আমি যাই, চুলোয় রান্না বসিয়েছিলাম ।
.
.
আকাশের রঙ নীল । কিন্তু আজ আকাশটাকে পরশের কাছে অনেক বেশিই নীল মনেহচ্ছে । গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় তার, ততদূর তাকিয়ে আছে সে ।
হঠাৎ তার মা এসে বললেন-
নিশি মেয়েটা বড্ড বোকা । তাই তোর মতো ছেলেকে হাত ছাড়া করলো ।
-ওর বাসায় কিছু জানিয়েছো?
-হ্যাঁ । আশাহত হয়েছেন তারা ।
-হুম ।
-বিকালে তৈরী হয়ে থাকিস ।
-কেনো?
-নিশির চেয়েও সুন্দরী মেয়ে ছেলের বউ করে আনতে হবেনা? আরেকটা পাত্রীর সন্ধ্যান পেয়েছি আমি ।
-কিন্তু…
-কোনো কিন্তু না ।
.
একটা শেষ না হতে আরেকটা! তার মা একেবারে উঠেপড়ে লেগেছে । এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় একমাত্র ছোঁয়া । কখন পাবে সে ছোঁয়ার দেখা!
.
.
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুম দিয়েছিলো নয়নতারা । তাকে বেঘোরে ঘুমোতে দেখে ছোঁয়াও ডাকলোনা । কান্নাকাটি করে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে ।
বাবা মারা যাওয়ার পর এই স্কুলটায় তাদের চলার সম্বল ছিলো । বেতন হিসেবে যা টাকা পেতো, তা দিয়েই সংসার খরচ হয়ে যেতো ।
এমনটা না হলেও পারতো । এই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তার বোন কি আদৌ কোনো ভালো কাজ পাবে?
কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো ছোঁয়ার । সামনে যে অনেক কঠিন সময় আসতে চলেছে উপলব্ধি করতে পারছে সে । শক্ত থাকতে হবে তাকে,ভেঙে পড়লে চলবেনা ।
.
.
প্রায় পনেরো দিন কেটে গেলো । শীত শেষ হতে চলেছে । দিন দিন গরমের তীব্রতা বাড়তে চলছে । তবে অন্য দিনের তুলনায় আজ যেনো গরমটা বেশিই লাগছে নয়নতারার । হয়তোবা অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে সে তাই!
আজকেও একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছে সে । তবে এই শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য আবারো বের হয়ে যেতে হলো । হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে বাসায় পৌঁছে গেলো সে । তাকে দরদর করে ঘামতে দেখে ছোঁয়া পানি নিয়ে এলো ৷ ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেললো নয়নতারা ।
নয়নতারার মুখটা ঘেমে ধুলো-বালিতে মলীন একটা ভাব চলে এসেছে । ছোঁয়া নিজের উড়না দিয়ে বোনের মুখটা মুছে দিয়ে বললো-
ঠিক হয়ে যাবে সব ।
-আজও ব্যর্থ হলাম আমি । না বলতেই বুঝে ফেলেছিস তা । কপালে কি ব্যর্থতার ছাপ বোঝা যাচ্ছেরে ছোঁয়া?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলো ছোঁয়া । এরইমাঝে আগমন ঘটলো নয়নতারার ছাত্রীর মা ।
তিনি বললেন-
শিক্ষক হিসেবে আপনি অনেক ভালো ম্যাডাম । কিন্তু যে স্কুলে আমার মেয়েকে ভর্তি করিয়েছি ওখানের শিক্ষকের কাছে না পড়লে ফেইল করিয়ে দেয় । আমার তো দুইদিকে পড়ানোর মতো অবস্থা নেই । তাই বলছিলাম কি…
-আমি বুঝেছি আন্টি ।
-যতোদিন পড়িয়েছেন ততদিনের টাকাটা রাখেন ।
.
নয়নতারার হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে চলে গেলেন তিনি ।
নয়নতারার কাছে যারা টিউশনি পড়তো, স্কুল বন্ধ হবার পর নানাকারণ দেখিয়ে অনেকেই পড়া বন্ধ করেছে ।
নয়নতারা ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-
আমি তো কোনোদিন এমন মনোভাব নিয়ে কাউকে পড়াইনি বা কাউকে পড়তে বাধ্য করিনি । আমার সাথেই কেনো এসব হতে হলো!
.
আফিয়া জান্নাত এসে বললেন-
এই মুহুর্তে রাফসানকেও জানাতে পারছিনা কিছু । তার মা নিষেধ করেছেন না জানাতে ৷ এই মহিলার কি আসলেই আমাদের সাথে আত্নীয়তা করার ইচ্ছে আছে! যদি থাকতো তার ছেলেকে বলে বিয়েটা সেরে নিলেই পারতো আগে ।
.
ছোঁয়া বললো-
রাফসান ভাইয়ার ভালোর জন্যই বলতে নিষেধ করেছেন । তাছাড়া ক্যারিয়ার বলতে একটা কথা আছে । তার মনেহয়নি এটা সঠিক সময়, তাই বিয়েতে রাজি হননি তখন ।
-হলে তো অন্তত নয়নতারা কে নিয়ে আমার ভাবতে হতোনা! ও সুখী থাকতো । তাছাড়া ওর বিয়েটা হলে তোরও…
-আমরা যা চাই তাই হতে হবে বলে কথা নেই মা । ভেবোনা এতো ৷ আল্লাহ ঠিক রাস্তা দেখাবেন আমাদের ।
.
.
আবারো এক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে পরশ ।
তার সামনে বসে আছে মলি নামের এক মেয়ে । শ্যামবর্ণের এই মেয়েটি দেখতে খারাপ না ।
অবশ্য তার মা পাত্রী হিসেবে সুন্দরী মেয়েদের সাথেই দেখা করিয়েছেন ।
এই পর্যন্ত বেশ কয়েকজন মেয়েকে দেখতে গিয়েছে পরশ । প্রতিবারের মতো এবারও মলির উদ্দেশ্যে বললো-
দেখুন আমি মায়ের কথায় এসেছি এখানে । আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি । আপনি আমাকে পছন্দ হয়নি বললে ভালো হয় । আসলে আমার মা যদি জানতে পারেন, আমি তার জন্য অপেক্ষা করে আছি চিন্তা করবেন আমার জন্য ।
.
পরশের কথা মেনে নিলো মলি । এই পর্যন্ত সব মেয়েই পরশের কথা রেখেছে । এটাকে সৌভাগ্যও বলা যায়!
.
.
পরেরদিন সকালে উঠে উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছিলো পরশ । হঠাৎ শুনতে পেলো সে তার বান্ধবী তোহার কণ্ঠস্বর ।
অবাক হয়ে পরশ বললো-
এতো সকালে তুই?
.
পরশের দিকে সাফিনা আহম্মেদ এগিয়ে এসে বললেন-
আমি এনেছি ওকে । একটা বিশেষ কারণে ।
-কি কারণ?
-তোহার সাথে আমি তোর বিয়ে দিতে চাই ।
-মানে?
-মানে আমি সেদিন তোর আর নিশির কথা শুনেছি আড়াল থেকে । তুই যে সব কিছু নিজেই ভেস্তে দিচ্ছিস তাও জানি । তবুও আমার চেষ্টা আমি করেছি । ভেবেছি কোনো একটা মেয়েকে যদি তোর মনে ধরে! না তোর ধরছে না । কার জন্য এমন করছিস তুই এটা জানার জন্য তোহার কাছে গিয়েছি । আমি জানতাম ও সব জানবে । অনেক অনুরোধের পর সবটা বললো ও । এটা কেমন ভালোবাসা পরশ? কোনোদিন মেয়েটিকে দেখবি কিনা সন্দেহ । আর তার জন্যই অপেক্ষা!
-মা শুনো..
-তুই যদি আমাকে একটু হলেও ভালোবাসিস, তোহার সাথে বিয়েতে রাজি হবি । দেখ পরশ, মেয়েটি যেই হোক মেনে নিতে আমার অসুবিধে ছিলোনা । কিন্তু তুই যেটা করতে চাচ্ছিস এসব পাগল ছাড়া কেউ করেনা । জাস্ট পাগলামি । একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হয়ে ছেলেমানুষী কিভাবে করতে পারিস তুই! যাক তোহার মাও রাজি আমার প্রস্তাবে । ওর বাবা দেশের বাইরে থেকে আসবে মাসখানেকের মধ্যে । তারপরেই তোদের বিয়েটা হবে । এর বাইরে আমি আর কিছু শুনতে চাইনা ।
.
হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন সাফিনা আহম্মেদ ।
তোহা বললো-
সরি পরশ । আমি আসলে আন্টিকে কিছু জানাতে চাইনি । কিন্তু উনি যেভাবে মাথায় হাত দিয়ে..
-থাক তোহা ৷ আমি জানি তুই কেমন ।
.
পরশের মলীন মুখের দিকে তাকিয়ে তোহা বললো-
মাঝেমাঝে ভাগ্যকে মেনে নিতে হয়রে ।
-মেনে নিতে বলছিস?
-হু । তবে হাতে এখনো একমাসের মতো সময় আছে । এর মাঝে ছোঁয়ার দেখা পেয়েও যেতে পারিস ।
-তখন তুই কষ্ট পাবিনা?
-মোটেও না । আমি তোকে সেই চোখে কখনো দেখিনি । আর কথা দিচ্ছি, দেখবোও না । কিন্তু বাবা না আসা অবধি ।
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পরশ বললো-
আমার ভালোবাসা সত্যি হলে ওর দেখা আমি পাবোই …
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here