হঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছি পর্ব ৩৫+৩৬

#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-35

কাঠপোড়া রোদ উঠেছে আজ।

প্রীতি বাপের বাড়ি এসেছে।নীলাভ অফিসে। হঠাৎ করে রাফিয়া আহসান প্রীতিকে ফোন করে ডেকে পাঠান। স্নেহার শরীর খারাপ। ভীষণ অসুস্থ সে।সকাল থেকে ক্রমাগত বমি করছে।তা দেখে রাফান স্নেহাকে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে।

একটু আগেই রিপোর্ট নিয়ে এসেছে রাফান।রিপোর্টে লেখা স্নেহা মা হতে চলেছে।দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। সবাই মিনিট পাচেক নিরব ছিলো।
সেই নিরব কাটিয়ে রাফান চিল্লিয়ে উঠলো।ও পারে না তো খুশিতে নাচতে।

রাফান সবার সামনেই স্নেহার পেটে হাত রেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে, ‘এখানে?বাবু আছে?’

স্নেহা ছলছল চোখে হেসে মাথা নাড়ায়।পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ আজ পেয়েছে।প্রীতি তো বাচ্চার নাম ঠিক করা নিয়ে পড়েছে।প্রনয় আহসান সারা মহল্লায় মিস্টি বিতরন করছেন।তার ঘরে প্রথম নাতী/নাতনী আসবে?এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে।রাফিয়া আহসান রান্না করছেন।আজ মন ভরে বউমার সব পছন্দের খাবার তিনি রান্না করে খাওয়াবেন।

স্নেহা নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে।শরীরের সমস্ত ভর রাফান এর উপরে ছেড়ে দিয়েছে । রাফান পরম যত্নে স্ত্রীকে বুকে নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।

প্রীতি দরজা ঠেলে রাফানদের ঘরে এলো।স্নেহার মাথার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-এখন কেমন লাগছে?

স্নেহা দুর্বল হেসে বলে,
-ভালো।

রাফান শাসিয়ে বলে,
-কোনো কাজ যেনো করতে না দেখি তোমাকে।বাবু কষ্ট পাবে তাহলে।

স্নেহা হেসে মাথা নাড়ায়।প্রীতি স্নেহাকে একবার জড়িয়ে ধরে।স্নেহা হেসে দেয়।এতোক্ষনের সবার ভিড়াভিড়িতে প্রীতি ঠিক মতো স্নেহার কাছে আসতেই পারে নি।প্রীতি স্নেহাকে জড়িয়ে উৎফুল্ল গলায় অস্থির হয়ে বলে,

-আমি ফুফি হবো?কীভাবে বল তো?আমি বিশ্বাস ই করতে পারছি না।স্বপ্ন লাগছে।ইশশ…আমার বেস্টফ্রেন্ড আমার ভাইয়ের সন্তানের মা হতে চলেছে।কিছুদিন পর ছোটো একটা বাচ্চা এসে হেসে হেসে খেলবে। ফুফি ফুফি বলে সারা ঘর মাতাবে।আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে স্নেহা।কি করে বুঝাই তোকে।

স্নেহা হেসে বলে,

-কিছুদিন পর যখন তোর হবে তখন তো খুশিতে তুই আরো পাগল হয়ে যাবি।

প্রীতি লজ্জায় স্নেহাকে চিমটি কাটলো।ইশারায় বুঝালো ‘ভাইয়া আছে’।স্নেহা ঠোঁট টিপে হাসলো।রাফান এর মনোযোগ ফোন এর দিকে।প্রীতি অস্বস্থিতে পড়েছে বুঝতে পেরেই রাফান ফোন হাতে নিয়েছে।

_________________________________

প্রায় দু মাস পর,,,,,

-আমিও বেবি নিতে চাই।

নীলাভ প্রীতির মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো।আর এক হাত দিয়ে ফোনে কাজ করছিলো।কিন্তু বউয়ের এমন কথা শুনে নীলাভ থেমে গেলো।ভ্রু কুচকে প্রীতির দিকে তাকালো।প্রীতি ঠোঁট উলটে ফেলল।নীলাভ ভ্রু কুচকেই বলে,

-তো নেও।

প্রীতি তেতে উঠলো।তেজি গলায় দাতে দাত চেপে বলে উঠে,

-আমি একা একাই নিবো?স্নেহার ও তো চার মাস হয়ে এলো।

নীলাভ হেসে ফেলল।প্রীতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

-নিজেই একটা বাচ্চা আবার সে না কি বাচ্চা সামলাবে।

প্রীতি নীলাভের হাতের উপর হাত রেখে নরম সুরে বলে,

-আমি বাচ্চা না। একটা বেবি হলে কি হবে?কত সুন্দর করে বেবি খেলবে আমি দেখবো।আধো আধো গলায় ‘মা’ বলে ডাকবে আমাকে।ছোটো ছোটো হাত দিয়ে আমাকে ধরবে।আমার সাথে ঘুমাবে।বেড়াতে যাবে।আমার চোখের সামনে বড় হবে।উফফ.. ভাবতেই পারছি না আমি।জীবন টাই অন্যরকম হয়ে যাবে আমার।

নীলাভ প্রীতির দিকে চেয়ে প্রীতির কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-আচ্ছা পরে দেখা যাবে নি।শোনো,

-হম বলেন।

-তাহসিন, লিনার কথা বলেছিলো না?

-হম।

-ভাবছি, তাহসিনের ইন্টারনি তো শেষ। এখন তো ও ফুল ডাক্তার। চেম্বারেও বসবে।তো লিনার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে পাঠিয়ে দেই বাবা মাকে?

-ভালো কথা বলছেন তো।সত্যি তো। পাঠিয়ে দেন তাহলে প্রস্তাব নিয়ে।

-তাহলে কথা বলি কাল সকালে মার সাথে।

-হম।উফফ..আমার তো ভাবতেই ভালো লাগছে দু বান্ধবী আমরা এক ই বাড়িতে।কি যে মজা হবে।

-হমম।দুটো মিলে সারাদিন বাদরামো করবে।

-বেবি দেন।তাহলে বেবি নিয়ে বিজি থাকবো।

-ঘুমাও তো।কি বেবি বেবি শুরু করেছো।

,

তৌফিক চৌধুরী আর নীলা চৌধুরী মিলে তাহসিন আর লিনার বিয়ের ডেট ঠিক করে এসেছেন।আর এক মাস পরে ডেট ফেলানো হয়েছে।

,

নীলা চৌধুরী এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন।অনেক কাজ জমে আছে তার।সামনে আরো বিয়ে।বিয়ের তোরজোর নিয়ে নানান কাজে ব্যস্ত সে।

এখন বিকাল।নীলাভ আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে।ড্রইংরুম দিয়ে যাওয়ার পথেই নীলা চৌধুরী নীলাভকে দেখে ডাক দেন।নীলাভ থেমে গিয়ে বলে,

-কিছু বলবে মা?

নীলা চৌধুরী প্লেট গ্লাস সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলেন,

-হ্যা।

-হম বলো।

-বলছিলাম যে তোদের বিয়ের তো প্রায় ৩-৪ মাস হয়ে এলো।তো প্রীতিকে নিয়ে তো এখন ও কোথাও ঘুরতে গেলি না।আর সামনে তাহসিনের বিয়ে। দূরে কোথাও যেতেও পারবি না।তাই বলছিলাম যে,এই আশেপাশে কোথাও প্রীতিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।

নীলাভ নীলা চৌধুরীর কথা মন দিয়ে শুনে মিনিট দুয়েক ভাবলো।তারপর বলে, সে যাবে প্রীতিকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে।

,

নীলাভ টাই টা ঢিল করলো।কোট টা হাতে নিলো।এটা ওর রোজকার অভ্যাস।

নীলাভ দরজা ভিড়িয়ে ঘরে ঢুকতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।।হকচকিয়ে গেলো। বড় বড় চোখে সে প্রীতির দিকে তাকিয়ে আছে।মুখটা হা হয়ে গেছে।অবাকতায় নীলাভের চোয়াল টা যেনো এখনি ঝুলে পড়বে।

আর এদিকে প্রীতি মুখ দিয়ে একবার হিরো আলমের,

‘তুমি হলে বাবু..আমি তোমার হিরো’
করলে তোমায় টেলিফোন
বলবে ‘বাবু তুমি খাইছো’

আবার,

‘ও বেবি কাম কাম কাম কাম কাম কাম টু মি’
‘ও বেবি কাম কাম কাম কাম কাম কাম টু মি'(ii)
‘আমি তোমার হিরো হলে তুমি সুপার হিট’

এই গানগুলো গেয়ে উল্টো ফিরে নাচছে।

নীলাভ তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বলদের মতো তাকিয়ে আছে প্রীতির দিকে।ওর রীতিমতো হেচকি উঠে গেছে।ও একবার ঢোক গিলল।এরপর এক ধমক দিলো প্রীতিকে,

-এসব কি আবোল তাবোল গান বলছো আর বাদরের মতো নাচছো হে ?মাথা খারাপ হয়ে গেছে না কি?

সাথে সাথে প্রীতি নাচা অফ করে পিছন ফিরে তাকালো।প্রীতি বিছানার একদম কিনারায় এসে পড়েছিলো।নীলাভের কথা শুনে পিছনে ঘুরতেই প্রীতি উলটে পড়ে যেতে নিলো।

নীলাভ দৌড়ে এসে প্রীতিকে ঝাপটে ধরলো।প্রীতি চোখ মুখ কুচকে বন্ধ করে রেখেছে।পড়ার ভয়ে না নীলাভের বকা খাওয়ার ভয়ে।

নীলাভ নিজের বুকে হাত দিয়ে বার কয়েক শ্বাস টেনে নিয়েই কটমট করে তাকালো প্রীতির দিকে।প্রীতি এক চোখ খুলে নীলাভের মুখ দেখলো।এক ঢোক গিলল। দাত বের করে হেসে প্রীতি ভয়ে ভয়ে নীলাভের গলা জড়িয়ে ধরলো।নীলাভ প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলে,

-ঝামেলা।ক্যারেক্টারলেস মেয়ে একটা।

নীলাভের কথা শুনে প্রীতি গরুর চোখের মতো বড় বড় করে তাকালো।সাথে সাথে নীলাভ বলে উঠে,

-সরি ক্যায়ারলেস হবে।

প্রীতি নাক ফুলিয়ে বলে,

-কথাই বলতে পারে না নিজে।একটা বলতে আরেকটা বলে।আবার আমাকে ঝামেলা বলে।

নীলাভের হাত এখনো প্রীতির কোমড়ে। ও খামচে ধরলো প্রীতির কোমড়। প্রীতি হালকা আর্তনাদ করে উঠলো।নীলাভ দাতে দাত চেপে বলে,

-তোমাকে এগুলা গান কে শিখাইছে?এসব ফালতু গান।ছিঃ কি গানের সুর।

প্রীতি দাত বের করে হেসে নীলাভের গলা ভালো মতো জড়িয়ে ধরলো।নীলাভ প্রীতির কোমড়ে আস্তে করে ধরে এবার।প্রীতি বলে উঠে,

-এগুলা হিরো আলমের গান।আপনি এসব চিনবেন না।গোমড়ামুখোরা এসব বড় বড় সেলিব্রেটি দের চিনে না।

নীলাভ প্রীতিকে ছেড়ে দিলো।প্রীতি পড়ে যেতে নিলো।আয়ায়া..করে শব্দ করলো।সাথে সাথে নীলাভ হেসে আবার প্রীতিকে আকড়ে ধরে।সোজা করে দাড় করালো।আর বলে উঠলো,

-এই সব ফালতু লজিক ছাড়া গানের জন্য এটা শাস্তি ছিলো তোমার।

প্রীতি নীলাভকে ছেড়ে মুখ টানা দিয়ে বলে,

-হিরো আলম তো আমার ক্রাস🐸আমার ভা..

আর বলতে পারলো না। নীলাভের দিকে তাকিয়েই প্রীতি পরপর কয়েকবার ঢোক গিলল।ভয়ে কাপতে কাপতে বলল,

-রাগেন কেন?আমি তো মজা করছিলাম?হিরো আলম রে ক্রাস বানাবো আমি?পাগল হয়ে গেছেন?না কি আমি পাগল হইছি?আমার ক্রাস তো আপনি।

নীলাভ প্রীতিকে পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,

-রেডি হও বাইরে ঘুরতে যাবো ।অফিস থেকে এসে বসতেও পারলাম না যত্তসব আজব কান্ড। ঝামেলা একটা।

প্রীতি তখনি গলা উচু করে চিল্লিয়ে বলে উঠে,

-তা ঝামেলা মেয়ে বিয়ে করছেন কেনো?

নীলাভ ওয়াশরুম থেকে উত্তর দেয়,

-এক চরে তব্দা করে ফেলবো।সব সময় শুধু এক কথা।বিয়ে করছি কেনো বিয়ে করছি কেনো?বিয়ে মানুষ কেনো করে জানো না?এতো ঝামেলা না করলেই তো আর কিছু বলি না।

প্রীতি আবার গলা উচু করে বলে,

-আমি সারাজীবন ই ঝামেলা করবো।হুহ….

নীলাভ ওয়াশরুম থেকে আবার উত্তর দেয়,

-তো আমিও সারাজীবন এসব বলেই ডাকবো।

প্রীতি রাগের চোটে হিরো আলমের গান জোড়ে সাউন্ড বক্স দিয়ে বাজিয়ে দিলো,

‘আমি তোমাদের হিরো আলম,আমি তোমাদের হিরো আলম (ii)
‘ভালোবাসা চাই তোমাদের এভাবে সারাজীবন’

নীলাভ ওয়াশরুম থেকে চেচিয়ে বলে উঠে,

-প্রীতি আমি যদি একবার যাই।তোমার হিরো আলমের চৌদ্দ গুষ্টিরে আজ বের করবো।ভালোবাসা লাগবো না?ভালোবাসা একদম গিলায় দিবো হিরো আলম রে।এটা গান না কি জীবিত মানুষকে মারার নতুন ওষুধ?এ বেডা কি খায়ে গান গাইছিলো?কয় বছরের মেয়াদ বিহীন গাজা খেয়ে গান গেয়েছিলো?
#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-36

চারিদিকে হৈ হুল্লোড়। উৎসবমুখর পরিবেশ। আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছে ছোট ছোটো বাচ্চা কাচ্চারা।মহিলারা সবাই ব্যস্ত তাদের নানান কাজে।

আজ তাহসিন আর লিনার বিয়ে।বেশ জাকজমক ভাবেই আয়োজন করা হয়েছে।চারিদিকে হরেক রকমের ফুল লাইট পর্দা দিয়ে খুব সুন্দর করে পুরো বাড়ি সাজানো।

প্রীতি খোপায় ফুল লাগাতে লাগাতে তড়িঘড়ি করে বাগানের দিকে যাচ্ছিলো।সে সময় নীলা চৌধুরী ডেকে উঠে।প্রীতি পেছন ফিরে তাকিয়ে ব্যস্ততার সহীত রান্না ঘরে এসে দাঁড়ায়।নীলা চৌধুরী হাত তাড়াতাড়ি চালিয়ে বলে,

-এই মটরশুঁটি গুলো ছাড়িয়ে দে মা।

প্রীতি মুচকি হেসে বাটি টা হাতে নিলো।মটর শুটি গুলো ছাড়াতে লাগলো।বেশ কয়েকটা মটরশুটি ছাড়ানোর পর ও টের পেলো।ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে চারিদিকে অন্ধকার দেখছে।ইদানিং প্রায় ই এমন হচ্ছে প্রীতির।মাথা টা ঘুরছে।কেমন বমি বমি পাচ্ছে।না আর থাকা যাচ্ছে না।প্রীতি মটরশুঁটি গুলো অনেক কষ্টে সব গুলো ছাড়িয়ে যেই উঠে দাড়ালো ওমনি ওর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।সামনের সব কিছু ঝাপসা হয়ে এলো।প্রীতি মাথায় হাত রেখে ঢুলতে লাগলো।

নীলা চৌধুরী প্রীতির দিকে তাকাতেই এমন অবস্থা দেখে তিনি তাড়াতাড়ি এসে প্রীতিকে দু হাত দিয়ে ঝাপটে ধরলেন।প্রীতি নীলা চৌধুরীর উপর ই নিজের ভর ছেড়ে দিলো।নিস্তেজ হয়ে এলো পুরো শরীরটা।চোখ দুটো বুজে আসলো।নীলা চৌধুরী চিল্লিয়ে নীলাভকে ডাকলেন।

নীলাভ এদিক ওদিক প্রীতিকেই খুজছিলো।নীলা চৌধুরীর চিল্লানিতে সে বড় বড় পা ফেলে দৌড়ে রান্না ঘরে আসলো।প্রীতি নীলা চৌধুরীর উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।নীলাভের পৃথিবীটা মুহুর্তেই থমকে গেলো।চোখে ভাসতে লাগলো তিন মাস আগের ঘটনা।তিন মাস আগেও নীলাভ প্রীতিকে অজ্ঞান অবস্থায় এভাবে রান্নাঘরেই পেয়েছিলো।

নীলাভের পা টলছে। যেতে চাইছে না।ও অনেক কষ্ট করে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে নীলা চৌধুরীর উপর থেকে প্রীতিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।বাড়ির মেহমান রা প্রায় সবাই রান্নাঘরে এসে জড়ো হয়েছে।

নীলাভ প্রীতির মাথাটা বুকের সাথে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে বিরবির করে বলল,

-আবার রান্নাঘর।আবার প্রীতি অজ্ঞান।

নীলাভ তড়িঘড়ি করে প্রীতির পা চেক করলো একবার।নাহ..পা থেকে তো এবার রক্ত বের হচ্ছে না। তাহলে?তাহলে প্রীতি অজ্ঞান কেনো?

নীলাভ তাড়াতাড়ি প্রীতিকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে ছুটলো।ঘাম ছুটছে ওর।ও নিজেও চোখে অন্ধকার দেখছে।শরীর কাপছে ভয়ে অনবরত।

___________________________

ডাক্তার এসেছে।প্রীতিকে দেখছে।প্রীতির এখনো জ্ঞান ফিরেনি।ডাক্তার একবার প্রীতির চোখ দেখলো।

এর মধ্যে এক মুরুব্বি মহিলা বলে উঠলো,

-বউ কি পোয়াতি না হি?ওমন মাথা ঘুইরে যে পইরা গেলো?

নীলাভ চকিতেই একবার মহিলাটির দিকে তাকালো।মহিলাটিকে ও চেনা না।হয়তো দূর সম্পর্কের কোনো দাদি নানি হবে।নীলাভ চোখ সরিয়ে আবার প্রীতির দিকে তাকালো।

নীলা চৌধুরী প্রীতির এক হাত ধরে বসে আছে।এই মেয়েটাকে যখন সে বাড়িতে বউ করে আনে তখন তার বাবাকে কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো।কতো কথা দিয়ে এসেছিলো।সে বলেছিলো, প্রীতির গায়ে আচ লাগতে দেবে না।নিজের মেয়ের মতো করে রাখবে।আর মেয়েটা আসার পর থেকে একটা না একটা বিপদ ওর উপর দিয়ে যাচ্ছেই।নীলা চৌধুরী প্রীতির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।তৌফিক চৌধুরী বাইরে গেছেন।ডেকোরেশনের জন্য বাড়তি ফুল লাগবে তা আনতে।নীলাভ ই যেতো কিন্তু নীলাভের একটা অফিসের একটা ইম্পোর্টেন্ড কাজ থাকায় সে রুমে বসে কাজ করছিলো।

ডাক্তার প্রীতিকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বলে উঠে,

-না, সে প্রেগন্যান্ট না।তার লো প্রেসার।তাই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো।ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না। নীলাভ তোমার ওয়াইফকে বেশি করে মাছ মাংস দুধ ডিম খাওয়াবে।আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।

ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলো।নীলা চৌধুরী ঘর ফাকা করে দিয়ে প্রীতির জন্য দুধ গরম করতে চলে গেলেন।

নীলাভ প্রীতির মাথার কাছে বসলো।প্রীতির মাথার চুলে হাত বুলাতে লাগলো।

নীলা চৌধুরী এসে গরম দুধ দিয়ে গেলেন।

নীলাভ প্রীতির হাত ধরে বসে আছে।বেশ কিছুক্ষন পর প্রীতি পিটপিট করে চোখ খুলল।ভালো করে চোখ খুলে নীলাভকে দেখা মাত্রই সে জড়িয়ে ধরলো।নীলাভ প্রীতির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নরম কন্ঠে বলল,

-খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো কর না কবে থেকে?তাহসিনের বিয়ে নিয়ে সবাই এতোটাই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে তোমার দিকে খেয়াল ই রাখতে পারি নি।এতাটা অবুঝ হলে কি চলে বলো তো।

প্রীতি নীলাভের বুকে মুখ গুজে বলে,

-খেতে ইচ্ছা করে না তো কি করবো।
-জোর করে খেতে হবে।শরীর ঠিক রাখতে হবে না?
-কিছু হবে না আমার।আপনি আছেন তো।
-সবসময় থাকবো না।
-এমন কথা বলবেন না প্লিজ।
-আচ্ছা বলবো না।এই দুধ টুকু খেয়ে নাও।
-আমি দুধ খাই না।
-খেতে হবে।
-আরে বুঝছেন না আপনি।আমি জীবনেও দুধ খাই নাই।দুধের গন্ধে আমার বমি আসে।আর দুধ খেলে আমি সাথে সাথে বমি করে দেই।
-বমি করো সমস্যা নাই। তবুও খেতে হবে।
-বমি করো মানে?আপনি জানেন বমি করা কত কষ্ট।স্নেহাকে দেখেন নাই?ওর তো পাচ মাস চলতাছে।ওর কত কষ্ট হয়।

নীলাভ দুধ হাতে নিয়ে বলে,

-তাহলে তুমিই বুঝো , তুমি যে এতো বাচ্চা বাচ্চা করো। বাচ্চা নেওয়া কত কষ্টের দেখছো।ঘুমাতে পারে না ঠিক মতো।খেতে পারে না।বসতে পারে না উঠতে পারে না।

-তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে জীবনে বাচ্চা নিতে দিবেন না?

-আচ্ছা আগে দুধ টুকু খাও পরে হবে কথা।

প্রীতি সামনে থেকে হাত দিয়ে দুধের গ্লাস সরিয়ে বলে,

-আপনি কি আমায় মারার প্ল্যান করছেন।আরে আমি দুধ খাই না।

নীলাভ বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো।এরপর প্রীতির গাল টিপে ধরে দুধ টুকু খাইয়ে দিলো।

প্রীতি একটু খেয়ে হাপাতে লাগলো।নীলাভ সরে এলো।প্রীতি সাথে সাথে দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিলো।নীলাভ তাড়াতাড়ি গিয়ে প্রীতিকে ধরলো।ও ভেবেছিলো প্রীতি এমনি বলছে।পাত্তা দেয় নি ভালো করে।কিন্তু এখন তো দেখে সত্যি সত্যি প্রীতি বমি করে দিয়েছে।

নীলাভ প্রীতির মুখ ধুইয়ে প্রীতিকে কোলে করে নিয়ে আসলো।প্রীতির শরীর আরো বেশি খারাপ হয়ে গেছে বমি করে।নীলাভের এখন আপসোস হচ্ছে দুধ খাইয়ে।প্রীতিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নীলাভ চলে গেলো প্রীতির জন্য খাবার আনতে।

,

খাবারের প্লেট নিয়ে নীলাভ প্রীতির সামনে বসতেই প্রীতি ছিটকে দূরে সরে গেলো।নাক ছিটকে বলল,

-ইয়া…আপনি জানেন না আমি মাছ খাই না।

নীলাভ প্রীতির কবজি ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে,

-খাও না এখন থেকে খেতে হবে।

প্রীতি দু হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বলে,

-মরে গেলেও খাবো না।আপনি কি আবার আমাকে বমি করানোর প্লেন করছেন।

নীলাভ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।এই মেয়ে কিছুই খায় না।এর জন্য এর শরীরে কিছুই নাই।নীলাভ প্রীতির দিকে রাগী স্বরে বলে উঠে,

-এর জন্যই তো লো প্রেসার।ভাজি আনছি।ভাজি দিয়ে খাও।

নীলাভ প্রীতিকে খাইয়ে দিতে লাগলো।প্রীতি খেতে খেতে বলে,

-তাহসিনের আজ বিয়ে। দুপুর হয়ে এসেছে এখন। বিকালে বর যাত্রী যাবে।আর আমি কিনা এখানে এভাবে অসুস্থ হয়ে বসে আছি।আমার কত কাজ।

নীলাভ আরেক লোকমা প্রীতির মুখে দিয়ে বলে,

-তোমার কাজ করতে হবে না।মা আছে।সামলে নিবে সব।

-ভালো মা আছে তাই কি হয়েছে?আমি এ বাড়ির বড় বউ আমার কোনো দায়িত্ব নেই?

নীলাভ প্রীতিকে আরেক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে তাচ্ছিল্যের সহীত বলে,

-নিজের শরীরে ঠিক নাই।ঠাস ঠুস করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।আবার সে না কি বড় বউ।

প্রীতি নীলাভের শার্ট ধরে কিউট করে বলল,

-ওমন করেন কেনো?যতই হোক আমার দেবর আর আমার বেস্টুর বিয়ে।তাহসিন আমার দেবর হিসেবে যেমন এ বিয়েতে আমার অনেক দায়িত্ব আছে।তেমনি লিনা আমার বেস্টু হিসেবেও তো এ বিয়েতে আমার অনেক মজা করার শখ আছে না কি?

নীলাভ ছোট করে বলে,
-হু..এবার খাও।

_______________________________

তাহসিন রা বেরিয়ে পড়েছে।লিনাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাহসিনের সাথে প্রীতি নীলাভ আর তৌফিক চৌধুরী আর রাফান যাচ্ছে।স্নেহা আর রাফিয়া আহসান বিয়েতেই আসে নি।কারন স্নেহা অসুস্থ। প্রনয় আহসান একটা কাজে দেশের বাইরে গিয়েছে।বরযাত্রীদের বড় একটা বাসে যাচ্ছে আত্মীয় স্বজন সবাই।

প্রীতি তাহসিনকে ঢিশ মেরে বলে,

-হাইরে আমার সিঙ্গেল দেবরটা মিঙ্গেল হয়ে যাচ্ছে রে।

তাহসিন লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো।প্রীতি পিঞ্চ করে আবার বলে,

-আমার দেবর টা দেখি লজ্জা ও পায়।

নীলাভ প্রীতিকে বলে,

-কি শুরু করেছো?এমনিতেই না শরীর খারাপ।তার মধ্যে এতো কথা বলছো? বারবার বল্লাম এসো না এসো না।জোর করে আসলা।এই এতো লোকজনের মাঝে ঠিক থাকতে পারবা তো?

তৌফিক চৌধুরী – আহ! এমন করছিস কেনো মেয়েটার সাথে?এসেছে তো কি হয়েছে।ওর কি এখন ঘরে বন্দী হয়ে থাকার সময়?এ বয়েসেই তো একটু মজা করবে।

-কিন্তু ও তো অসুস্থ বাবা। এটা বুঝতে চাইছো না কেনো তোমরা?

প্রীতি নীলাভের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,

-আমি একদম সুস্থ।ফিট। একদম কিচ্ছু হয় নি আমার।আপনি তাও বকবেন না প্লিজ।

নীলাভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিয়ে প্রীতির কোমড় এক হাত দিয়ে চেপে ধরলো। প্রীতি কোমড়ে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই চমকে নীলাভের দিকে তাকালো।নীলাভ মুচকি হেসে শক্ত করে প্রীতির কোমড় ধরলো।প্রীতি সারা গাড়িতে একবার চোখ বুলালো।যে যার যার কাজে ব্যস্ত। তাদের দিকে কারোর নজর নেই।

____________________________

রাত প্রায় আট টা বাজে।নীলাভ প্রীতিকে ধরে বসে আছে।প্রীতি এসে একবার বমি করেছে।নীলাভের কিছু ভালো লাগছে না।তার মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাওয়া যায় তত তাড়াতাড়ি শান্তি। এই ভরা পরিবেশে তার অশান্তি লাগছে।চিন্তা হচ্ছে প্রীতিকে নিয়ে।

এদিকে কাজী বর আর কনেকে কবুল বলতে বললে তাহসিন আর লিনা কবুল বলে দিলো।

বিবাহ সম্পন্ন।

বিদায়ের সময় লিনা একটু ও কাদলো না।ওর তো খুশিতে আরো নাচতে ইচ্ছা করছে।ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেলো। এক সাথে বেস্টুর সাথে থাকতে পারবে তাহলে কাদবে কিসের জন্য।

লিনার বাবা মা তো টাস্কি।মেয়ে তাদের হাসছে।এমন বিদায়ের সময় কাউকে হাসতে দেখেছে বলে তাদের মনে হয় না।মেয়ের এমন কার্যকলাপে তারা নিজেরাই কাদতে ভুলে গেছে।

অবশেষে নীলাভ প্রীতিরা তাহসিন আর লিনা কে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রৌনা দিলো।এমনি অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here