হঠাৎ_হাওয়া পর্ব শেষ

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ২০(অন্তিম পর্ব)

সন্ধ্যাবেলায় নিরু আর ফারহান রাত্রির বিয়ের জন্য শপিং করতে গেল। আজকেই সময় আছে৷ কালকে থেকে তো ফারহানের অফিস শুরু। ভালোই হয়েছে বিয়ে শুক্রবারে। নাহলে ফারহানের ছুটি পেতে অসুবিধা হতো। পেতোই না। আর না গেলে ফারিয়া রাগ করতো।

ওরা শপিং মল থেকে বেরোবে এমন সময় হঠাৎ নিধি আর সিয়ামের সাথে দেখা।

নিধি ওদের দেখে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললো, “কেমন আছিস নিরু? কেমন আছেন ভাইয়া?”

ওরা দুজনেই একসাথে উত্তর দিল, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

নিরু ইশারা করে বোঝালো, “সব ঠিকঠাক?”

নিধি সহাস্য মুখে সায় জানালো।

নিরুর ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠলো। হাসিমুখেই প্রশ্ন করলো, “কার জন্য শপিং করতে এসেছিস? তোদের জন্য না-কি বাবুর জন্য?”

নিধি লজ্জামিশ্রিত হেসে বললো, “সব মিলিয়েই আরকি।”

নিরু খেয়াল করলো সিয়াম একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানও ততক্ষণে খেয়াল করেছে বিষয়টা।

ফারহান সিয়ামের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “কী অবস্থা সিয়াম ভাই?”

সিয়াম এবার ফারহানের দিকে তাকালো। তার চোখে-মুখে অপরাধবোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবুও প্রতিত্তোরে বললো, “এইতো ভালো। তোমার?”

“ভালো।”

ফারহান আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সিয়াম কিছু বলতেও সংকোচ বোধ করছে।

নিরু ওদের দেখে ভাবলো ভালোভাবে কথা বলা উচিত। কোনো সংকোচ, অপরাধবোধ থাকলে সম্পর্কটা এককালে ফিকে হয়ে যাবে। কিন্তু সে তো কোনো ভাবেই চায় না যে নিধির সাথে তার সম্পর্কটা নষ্ট হোক। নিধি তার বান্ধবীর চেয়েও বোন বেশি।

তাই নিধিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “চল, আমরা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। অনেকদিন হলো কথাবার্তা তো হয়-ই না। একটু আড্ডা দেয়াও হয়ে যাবে।”

নিধি সায় জানাতেই ওরা দুজন আগে আগে চলে গেল। ফারহান আর সিয়াম ওদের পেছনে আসছে।

ওরা শপিং মলের নিচতলার রেস্টুরেন্টে এসে বসলো। নিধি আর নিরু টেবিলের একপাশে আর অপরপাশে সিয়াম আর ফারহান।

নিরুর একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তবুও সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো, “কেমন আছেন ভাইয়া?”

সিয়াম অপরাধবোধ নিয়ে বললো, “পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়।”

নিরু চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “কোনোকিছুই তো তাড়াতাড়ি সম্ভব না ভাইয়া। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন একদিনও আসবে যেদিন হয়তো আমি চাইলেও আপনার প্রতি রেগে থাকতে পারবো না। আপনি শুধু নিধিকে ভালো রাখবেন। আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরে যে সব ঠিক করে নিয়েছেন এই অনেক। আপনাদের এবং আপনাদের বাচ্চার উভয়ের জন্যই ভালো। আপনি এ নিয়ে আর এখন কিছু ভাববেন না। সময়ই সব ঠিক করে দেবে।”

ফারহান প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো, “তোমরা থামো তো। কতদিন পর আবার একসাথে হলাম৷ খাবার অর্ডার করি আগে। খেতে খেতে আড্ডা দেয়া যাবে।”

ফারহানের কথায় সবাই সায় জানালো।

ফারহান বাইরে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে প্রথমে রাগ হচ্ছিলো। সিয়াম যতোই এখন ভালো হয়ে যাক না কেন একবারের জন্য হলেও তার বউয়ের দিকে অন্য নজরে তাকিয়েছিল। কিন্তু এখন এসব বলে কোনো লাভই নেই। উল্টো ঝামেলা ঠিক হওয়ার বদলে বাড়বে। তারচেয়ে সব ঝামেলা একপাশে রেখে বর্তমানটাকে উপভোগ করা উচিত।

বিভিন্ন ধরনের কথা বলে, ডিনার করে রাত নয়টার দিকে বাড়িতে ফিরলো ওরা।

নিরু এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। সকালে এতটা পথ জার্নি করে আসা আবার সন্ধ্যা বেলায়ই শপিংয়ে যাওয়া বেশ ঝামেলা। নিরু শুয়ে শুয়ে ভাবলো ফারহানেরও নিশ্চয়ই এখন তার মতো এত নাজেহাল অবস্থা।

ফারহান ফ্রেশ হয়ে বারান্দার দিকে যাওয়ার আগেই নিরু বললো, “ওদিকে যাচ্ছো কেন? বিছানায় এসে শুয়ে থাকো। ক্লান্ত লাগছে না তোমার? কালকে থেকেই আবার অফিস জয়েন করতে হবে।”

ফারহান নিরুর কাছে এসে বসলো। আলতো হেসে নিরুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “এমনও দিন গিয়েছে যে ট্যুর থেকে সকালবেলা বাসায় এসে আবার তখনই অফিস জয়েন করতে হতো। অভ্যাস আছে আমার। তোমার অভ্যাস নেই তাই এত ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাও দেখবে সব ক্লান্তি দূর হয়ে সকালেই একদম চাঙ্গা হয়ে যাবে।”

নিরু ফারহানের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে বললো, “তুমিও ঘুমাও। তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার বুকে মাথা রেকে ঘুমালে আরো চাঙ্গা হয়ে যাবো।”

ফারহান ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নিরুর পাশে গিয়ে শুয়ে নিরুকে বুকের মাঝে টেনে নিল। নিরু চুপটি করে গুটিশুটি মেরে রইলো। কতটা প্রশান্তি লাগছে তা সে নিজেও ঠিক বলতে পারবে না। নিরু মনে মনে ভাবলো,

এই মানুষটাই একদিন নিরুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ‘হঠাৎ দমকা হাওয়া এলে মনের মাঝে যেমন মুগ্ধতা ছেয়ে যায়, তেমনি তোমার সাথে প্রথম দেখায় আমারো মনের মাঝে মুগ্ধতা ছেয়ে গিয়েছিল।’

নিরুর এখন বলতে ইচ্ছে করে, “তারচেয়েও বহুগুণ মুগ্ধতা আমার মাঝে কাজ করে যখন তুমি আমার পাশে থাকো। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলো, ‘ভালোবাসি নিরুপাখি।’ বক্ষপিঞ্জিরার মাঝে শক্ত করে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছা হয়। যাতে কেউ আমাদের ভালোবাসা দেখে ঈর্ষান্বিত না হয়। তোমার জন্যই তো হঠাৎ হাওয়া আমার এত প্রিয়।”

নিরুর ভাবনার মাঝেই ফারহান ওর চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে বললো, “ভালোবাসি নিরুপাখি।”

নিরু মুচকি হেসে ফারহানের হৃৎস্পন্দন অনুভব করছে। প্রতিটি স্পন্দনই হয়তো ফারহানের মতো জপ করছে, “ভালোবাসি, ভালোবাসি।”

নিরু হঠাৎ করেই মাথা তুলে ফারহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “আচ্ছা আমাদের বাবু হবে কবে?”

ফারহান আচমকা এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, “তুমি যেদিন মা হবে সেদিন।”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “আমি মা হবো কবে?”

“যেদিন আমি বাবা হবো।”

নিরু চোখ পাকিয়ে তাকালো এবার। রাগ নিয়ে বললো, “তুমি মজা করছো আমার সাথে?”

ফারহান দু’পাশে মাথা নেড়ে বললো, “ছি ছি কী বলো এসব? আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে তোমার সাথে মজা করবো?”

নিরু অভিমানী স্বরে বললো, “ঠিক হচ্ছে না কিন্তু একদম। আমি আমাদের বাবু নিয়ে কথা বলছিলাম।”

ফারহান এবার সিরিয়াস হয়ে বললো, “তুমি পড়ালেখা শেষ করো তারপরে না-হয় ভেবে দেখা যাবে। তোমার ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হবে। এখন ধরো আমাদের যদি একটা বেবি হয় তাহলে তাকে নিয়ে তোমার পড়াশোনা করতে কতটা কষ্ট হবে। সবদিক তো তুমি সামলাতে পারবে না তাই-না? আরেকটু বড় হও তারপরে।”

“যথেষ্ট বড় আমি। বিয়ে হয়েছে আর বাবু হতে পারবে না?”

“পারবে তো কিন্তু কষ্ট হবে তোমার।”

“হবে না।”

“আচ্ছা তাহলে আগে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষাটা তো দাও। তারপরে দেখা যাবে।”

নিরু ঠোঁট উল্টে বললো, “এখনও অনেক দেরি।”

ফারহান নিরুর মাথায় আবার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “এখন এত চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমাও।”

নিরুও বাধ্য মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়লো।

ফারহান নিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

________________

পেরিয়ে গেছে ছয়টি বছর। বদলে গেছে অনেক কিছু, অনেক পরিস্থিতি। তাদের জীবনের সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু মানুষ আবার কোনো মানুষ বিদায় নিয়েছে চিরতরে। নিরু আজ একজন প্রতিষ্ঠিত নারী সাথে দুই সন্তানের মা-ও।

আজ থেকে তিন বছর আগে এই দিনেই জন্ম হয়েছিল তার দুই মেয়ের। মিষ্টি আর সৃষ্টি। নামের মতো তারা দুজনেই দেখতে ভারী মিষ্টি। আধো আধো বুলিতে কথা বলে, হেসে খেলে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। একজন হয়েছে ফারহানের মতো আরেকজন হয়েছে নিরুর মতো। দুষ্টুমিতে পটু। সারাক্ষণ তাদের দাদু মনির সাথেই থাকে। দাদাভাইয়ের অভাব বুঝতেই দিতে চায় না। রায়হান সাহেব গত হয়েছেন আজ থেকে দেড় বছর আগে।

দুই মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সকাল থেকে রান্নাঘরে আছে নিরু। কোমড়ে আচল গুঁজে একাহাতে সব সামলাচ্ছে। মেয়েরা সব খেতে না পারলেও তাদের পছন্দের প্রায় সব পদই রান্না করছে। সে কারণেই তো আজ ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছে। আজকে তার ক্লাস করানোর কোনো মনমানসিকতাই নেই। তিন বছর যাবৎ সে এই দিনটায় বাড়িতেই থাকে। ফারহানের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

নিরু রান্না করছে আর ফারহান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কী হলো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? একটু তো সাহায্যও করতে পারো।”

“কী সাহায্য করবো? তুমিই তো সব একাই করছো।”

“হ্যাঁ, সেই তো। তুমি কী করবো? যাও বাচ্চাদের কাছে যাও।”

“ওরা মায়ের সাথে আছে। আমি এখানেই থাকবো। কিছু করবো না। তোমাকে দেখবো।”

নিরু মজা করে বললো, “তুমি এমনভাবে বলছো যেন আমি নতুন বউ আর তুমি আমাকে চোখে হারাচ্ছো।”

ফারহান নিরুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলরো, “তুমি সবসময়ই আমার কাছে নতুন। বুড়ি হয়ে গেলেও আমার কাছে নতুনই থাকবে।”

“আচ্ছা এখন যেখানে ছিলে সেখানে গিয়ে দাঁড়াও। গরমে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। ওরা আবার এসে পড়বে তো। ঠিকমতো কাজ করতে দাও আমাকে।”

ওদের কথা বলার মাঝেই মিষ্টি আর সৃষ্টি দৌড়ে রান্নাঘরে চলে এলো। নিরু আদুরে স্বরে বললো, “মাম্মামরা তোমরা দাদু মনির কাছে যাও। এখানে অনেক গরম সোনা।”

মিষ্টি আর সৃষ্টি একসাথে বললো, “তাহলে তোমালও অনেক গলম লাগছে মাম্মাম?”

নিরু হেসে বললো, “হ্যাঁ মাম্মাম। তোমরা থাকলে তোমাদেরও গরম লাগছে। বাবার সাথে দাদু মনির কাছে যাও। তোমাদের শান ভাইয়া আসবে একটু পরে।

শানের কথা শুনেই মিষ্টি আর সৃষ্টি খুশি হয়ে ফারহানের সাথে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। শান সিয়াম আর নিধির ছেলে। ওদের চেয়ে দুই বছরের বড়।

______________

সন্ধ্যাবেলায় কেক কাটা শেষে একত্রে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। রাতেই কেক কাটতো কিন্তু বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়বে ভেবে আগেই কেটেছে। কিন্তু তারা তো দিব্যি খেলছে।

আতিক, ফারিয়া, নিধি, সিয়াম, ফারহান, নিরু সোফায় বসে আগের দিনগুলো নিয়ে কথা বলছে। এখন আর আগের মতো দেখা হয় না সবার সাথে। সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। সিয়ামের সাথে নিরু ফারহানের সম্পর্ক একদম স্বাভাবিক। সবাই বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছে।

সবাই নিজেদের মতো হাসাহাসিতে ব্যস্ত এমন সময় ফারহান নিরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ” ভালোবাসি নিরুপাখি।”

নিরু মুচকি হেসে সবার অগোচরে বললো, “আমিও ভালোবাসি।”

ফারহানের ঠোঁটের কোণে এক বিস্তর হাসির রেখার দেখা মিললো।

#সমাপ্ত

[গল্পটা শেষ হয়েই গেল। আগেই সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি দেরি করে গল্পটা দেয়ার জন্য। পড়ালেখা নিয়ে অনেক ব্যস্ত আছি তাই এমন অনিয়ম। এসএসসি ব্যাচ ২০২২ হওয়ায় একটু চাপেই আছি। আশা করি আপনারা বুঝবেন। আর কার কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here