#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০৭
#Eshika_Khanom
“আচ্ছা তাহলে আপনি কার মিসেস আয়াত?”
আয়াত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে একটু গম্ভীর গলায় বলল,
“দেখুন মিস্টার আদ্রাফ, আমি একজন বিবাহিতা নারী। তাই আমি আমার স্বামীরই হয়ে থাকব। এটা একদম সাধারণ ব্যাপার।”
আদ্রাফ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি তো আমাকে বিয়েই করতে চাওনি আয়াত। আবার স্বামী হিসেবে স্বীকারও কর?”
আয়াত আদ্রাফের দিকে ঘুরে গেল। তারপর বলল,
“ইসলামিক শরিয়তে আপনি আমার স্বামী। হ্যাঁ আমার বিয়েটা করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, এমনকি এখনও আছে। স্বপ্নটা শুধু আমার একার নয়, আমার বাবারও। বাবা আমাকে একজন সফল ডাক্তার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তবে আমার ভাগ্য, সেই স্বপ্নই আর পূরণ হলো না। আমি জানি স্বপ্নটা আর কখনোই পূরণ হবেনা। তাই যে মানুষটা আমায় ভালোবাসে তাকেই ভালোবেসে মরতে চাই।”
আদ্রাফ জিজ্ঞেস করলো,
“তোমাকে কে বলেছে আমি তোমায় ভালোবাসি?”
আয়াত বলল, “ভালোবাসা জানতে হয় না, বিষয়টা উপলব্ধি করতে হয়। যে মানুষটা রোজ ফুচকাওয়ালাকে টাকা দিয়ে রাখতো যাতে আমি মন ভরে ফুচকা খেতে পারি, আমার কাছে রিকশাভাড়া না থাকলে আগেই রিকশাওয়ালাকে টাকা দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিত, মাঝরাতে লুকিয়ে লুকিয়ে পাইপ বেয়ে আমার রুমের জানালার কার্নিশে বসে আমায় দেখার চেষ্টা করত সেই ভালোবাসাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই।”
আদ্রাফ অবাক হয়ে গেল। আয়াতের দুই বাহু ধরে একবার ঝাকি দিয়ে প্রশ্ন করল,
“মানে? তুমি জানতে এসব আমি করি?”
আয়াত বলল, “মেয়েদের মধ্যে এমন একটা শক্তি আছে যা তাকে ভালো করে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে কে কখন তার জন্যে কি করছে। তার ব্যাপারে কি মন্তব্য করছে? আমিও এর ব্যতিক্রম নই।”
আদ্রাফ বলল, “মানে তুমি প্রথমেই আমায় চিনতে পেরেছিলে?”
আয়াত ভাব নিয়ে বলল, “ব্যাপারিটা খুব কঠিন ছিল না।”
আদ্রাফ মাথায় হাত দিয়ে হেসে ফেললো। আয়াত বলল,
“তবে কি করে জানতাম সেই মানু্ষটাই আমার স্বপ্নপূরণে এতো বড় একটা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। বিয়ের রাতে খুব ঘৃণা হচ্ছিল আমার আপনার উপর। তবে যখন আপনার এমনটা করার কারণ বুঝতে পারলাম তখন সেই ঘৃণাটাও উধাও হয়ে গেল।”
আদ্রাফ বলল, “মাঝে মাঝে রাগ উঠেনা তোমার? ভয় হয়না, আমি যদি তোমার সাথে কিছু করে ফেলি তাহলে তুমিও আমার মতো…”
আদ্রাফের কথাটা শেষ করার আগেই আয়াত আদ্রাফকে থামিয়ে বলল,
“আপনি কিছু করবেন না আমি জানি। আর আমার মরার ভয় নেই। আপনি আমার জীবনের নতুন রুপ দিয়েছেন। তাছাড়া আপনার কারণে আজ আমি প্রতিবাদ করতে পেরেছি। তাই আপনার জন্যে যদি আমার জীবনটাও যায়, আমার তাতে সমস্যা নেই। একদিন তো মরতেই হবে।”
আদ্রাফ হঠাৎ আয়াতের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আয়াত পিছতে লাগলো আদ্রাফের এগিয়ে আসতে থাকতে দেখে। একদম দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গেল আয়াতের। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আদ্রাফ। আদ্রাফ আয়াতের মুখে একটা ফুঁ দিল। চোখ বন্ধ করে নিল। আদ্রাফ বিমোহিত হয়ে পড়ল আয়াতের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো দেখে। বাম হাতটা এগিয়ে এনে যত্নসহকারে আয়াতের কপালের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে নিল। আয়াত তখনো তার নয়নজোড় বন্ধ করেই রেখেছিল। আদ্রাফ নিঃশব্দে আয়াতের রুম থেকে প্রস্থান করল, আয়াত টেরও পেলো না। অনেক সময় অতিবাহিত হলো। আয়াত আদ্রাফের আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ মেলে তাকালো। আদ্রাফকে দেখতে পেল না , একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।
.
.
.
পুরো ঘর অন্ধকার করে মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে রয়েছে নুহাশ। চোখে জমে রয়েছে অশ্রু। একদিকে প্রিয় বন্ধুকে হারাতে হবে এই বেদনা, অপরদিকে নিজের সেই বন্ধুর স্ত্রীর প্রেমে পড়ে যাওয়া। এ যেন এক মহাপাপ করে ফেলেছে সে। প্রথম দেখাতেই আয়াতকে ভালো লেগে যায়। অতঃপর যখন শুনতে পারে সে আদ্রাফের কাজিন তখন একটা আশা মনের কোণে জাগে, যা দাদীর কথা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায়। এক প্রকার হতাশ হয়ে পড়েছে সে। জীবনে প্রথম কারো প্রেমে পড়েছে, তাও আবার বন্ধুর ভালোবাসা বন্ধুর স্ত্রীর। প্রথম প্রেমেই হার মানতে হবে তাকে। নাহ এতোকিছু ভাবতে পারছে না সে। উঠে পড়ল সে বিছানা থেকে। ওয়াশরুমে গিয়ে অযু করে নিল। মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে দুই রাকাআত নফল নামাজ আদায় করল সে। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইলো, সকল বিপদ ও ঝামেলা থেকে মুক্তি চাইলো। সাথে চাইলো আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। আদ্রাফের জন্যে বিশেষভাবে দুয়া করল সে।
.
.
.
ভোরের স্নিগ্ধ আলো পরিবেশে এক ধরণের শুভ্রতা ফুটিয়ে তুলেছে। এমন শুভ্রতা যা মুছড়ে যাওয়া হৃদয়কে নতুন করে বাঁচার শক্তি প্রদান করে। ধীরস্থির ভাবে দৃঢ় মনোবলে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যম প্রকাশ করে। আসলেই আমরা যতদিন বাঁচি না কেন, মন ভরে, প্রাণ ভরে, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালো থাকার চেষ্টা করা উচিত। অন্যদের মধ্যেও জাগিয়ে দেওয়া উচিত বেঁচে থাকার নতুন প্রয়াস। তবেই না জীবন সার্থক!
আজ বাগানে সকাল থেকেই দাদী বসে আছেন, হাতে রেখেছেন একটা বই। আসলেই তিনি একজন বইপোকা। আয়াত এসে দাদীর সামনের টেবিলে এক কাপ চা রাখে। দাদী চোখ মেলে তাকায় আয়াতের দিকে। আয়াত বলে,
“দাদী আপনার চা।”
দাদি বললেন, “তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে এক কাপ কেন? তুই খাবি না?”
আয়াত বলল, “না দাদী আমার চা ওতোটা ভালো লাগেনা চা।”
দাদী বইটা টেবিলে রেখে হাতে সেই চায়ের কাপ তুলে নিয়ে আয়াতকে বললেন,
“এই তুই বসলি না যে?”
আয়াত সাথে সাথে বসে পড়ল। দাদী এক চুমুক দিলেন চায়ের কাপে। আয়াত কিছুটা উসখুস করছে। দাদী এক ভ্রু উচিয়ে আয়াতের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,
“আজ চায়ের স্বাদ একটু অন্যরকম। কে বানিয়েছে? তুই?”
আয়াত মাথা নেড়ে বলল, “হুম দাদী।”
দাদী বললেন, “বেশ ভালো চা বানাতে পারিস তো তুই। একটা আবদার করি তোর কাছে, রাখবি?”
আয়াত বলল, “আদেশ করুন দাদী।”
দাদী হেসে দিলেন। তারপর বললেন,
“এখন থেকে রোজ সকালে তুই আমার জন্যে চা বানাতে পারবি?”
আয়াত বলে, অবশ্যই দাদী। ইনশাআল্লাহ রোজ বানাবো আপনার জন্যে চা।”
দাদী বললেন, “ধন্যবাদ রে সতীন। তা আচ্ছা তুই আর আদ্রাফ হানিমুনে যাওয়ার কোনো প্ল্যান করেছিস?”
আয়াত মাথা নিচু করে নিল। এসব তো তারা চিন্তাই করেনি। আয়াত মাথা নিচু রেখেই বলল,
“না দাদী।”
দাদী যেন কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেন। একজন সার্ভেন্টের মাধ্যমে আদ্রাফকে ডেকে পাঠালেন। আদ্রাফ তো এলোই, সাথে সাথে নুহাশও এলো। আসলে তারা দুইজন একসাথে কথা বলছিল, সার্ভেন্ট আদ্রাফকে ডাকায় সাথে সাথে নুহাশও আসে। আয়াতকে দেখে নুহাশের দৃষ্টি আয়াতের পানে নিবদ্ধ হয়। আবার মূহুর্তেই সে নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। আদ্রাফের দাদী আদ্রাফের সাথে নুহাশকে দেখে বলেন,
“ভালো হয়েছে তুইও আসলি নুহাশ। দেখ আমার হাতে তো এতো জোর নাই, তুই একটু আদ্রাফের পিঠে একটা কিল বসা তো!”
নুহাশ চমকে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আয় হায় দাদী কেন?
দাদীর কথা শুনে আয়াত, আদ্রাফ এবং নুহাশ প্রত্যেকেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। আদ্রাফের আদী নুহাশকে এরপর বললেন,
” তুই আগে মার দে একটা ওকে তারপর আমি বলি।”
আদ্রাফ ভাব মেরে বলে, “ইস নুহাশ আমাকে মারবে? ওর এতো জোর আছে নাকি দাদী?”
সাথে সাথেই নুহাশ ধপ করে একটা কিল বসিয়ে দেয় আদ্রাফের পিঠে। তারপর বলে,
“কি বললি আমার হাতে জোর নাই? এই নে আরেকটা কিল।”
আবারও একটা কিল আদ্রাফের পিঠে বসিয়ে দেয় নুহাশ। আদ্রাফ অসহায় চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এইযে আয়াত দেখ তোমার সামনে তোমার বরকে মারে সবাই।”
নুহাশের হাস্যজ্জ্বল মুখে আবার আধার নেমে আসে। আদ্রাফের দাদী বলেন,
“ও কি বলবে রে আদ্রাফ? তুই এই দুইদিনে হানিমুনের প্ল্যানও করলি না?”
আদ্রাফ কি বলবে খুজে পেল না। সে তো আর বাঁচবেই না, আবার কিসের হানিমুন?
আদ্রাফের দাদী বললেন,
“যাহ নুহাশ আর আমি মিলে তোর আর আয়াতের হানিমুনের ব্যবস্থা করব। ঠিক আছে না নুহাশ?”।
নুহাশ অবনত স্বরে বলে, ” জ্বি দাদী। দাদী আমি আসছি এখনই।
নুহাশ এটা বলে আর কিছুর অপেক্ষা না চলে গেল।
#চলবে
[