#হারিয়েছি_নামপরিচয়
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা মনি
মেঘলা খুব ভয় পেয়ে যায় রিফাতের মুখে নিজের নাম শুনে। শুধু মেঘলা নয় তার মা বাবাও নিজেদের মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়ে ছিল। মেঘলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিফাত বলে,
‘তোমার যমজ বোন মেঘলাকে তো কোথাও দেখছি না। কোথায় সে?’
রিফাতের কথা শুনে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন,
‘মেঘলা কিছু জরুরি কাজে শহরের বাইরে গেছে।’
রিফাতসহ সেখানে উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হয় কথাটা শুনে। রোজিয়া জিজ্ঞেস করেন,
‘কি এমন জরুরি কাজ যে নিজের বোনের বিয়েতে থাকতে পারল না?’
আমিনুল হক বেশ বিরক্ত ছিলেন। এমনিতেই বিয়েটায় সে খুশি হয়। এখানে থাকতেও আর ভালো লাগছিল না। তাই তিনি বলেন,
‘এসব আলাপ কি খুব জরুরি? বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন আর এখানে থেকে কি হবে? ছেলে আর ছেলের বউ নিয়ে ফিরে চলো।’
রোজিয়া কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় আমিনুল হকের রাগী চাহনিতে। রিফাতও আমিনুল হকের তালে তাল মিলিয়ে বলে,
‘হ্যা এখন আমাদের যাওয়া উচিৎ। রোদেলা চলো।’
মেঘলার আর এসব ভালো লাগছিল না। সবার মুখে “রোদেলা” “রোদেলা” শুনতে শুনতে মেঘলা নিজের নামটাই ভুলে যাচ্ছিল। মেঘলার ইচ্ছা করছিল সবার সামনে সব সত্য বলতে। সে নিরুপায় ছিল। তাই সবকিছু মেনে নিতে হয়।
মুনিয়া শেষবারের মতো তাকে চুপিচুপি বলে,
‘শোন তুই কিন্তু এখন থেকে আর মেঘলা না এটা মনে রাখিস। এখন থেকে তুই রোদেলা। তাই রোদেলার মতো ব্যবহার করবি। কেউ যাতে সন্দেহ না করে। আর হ্যা তুই তো জানিস রোদেলা কতটা চঞ্চল আর স্মার্ট। তোকেও ঐরকম হতে হবে। সবসময় এর চুপচাপ আর গম্ভীর মুখ করে বসে থাকলে চলবে না।’
মেঘলার ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যায়। সে বলে ওঠে,
‘তোমাদের জন্য আমি নিজের নাম,পরিচয় সব হারিয়েছি। আর তোমরা এখনো কিভাবে এত বড় গলায় কথা বলছ আমার সাথে? আমার যা ইচ্ছা আমি করব। তোমাদের আর আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’
‘মেঘলা তুই এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। এমন ভাব করছিস যেন এই বিয়ে হয়ে তোর খুব লস হয়ে গেছে। এত বড়লোক বাড়ির বউ হওয়ার জন্য কত মেয়ে মুখিয়ে থাকে। সেখানে তোকে তো মাত্র পরিচয় বদল করতে হয়েছে এটা আর এমন কি।’
নিজের মায়ের কথা শুনে মেঘলা কি উত্তর দেবে এটাই ভেবে পাচ্ছিল না। শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
‘যদি কোনদিন রোদেলা ফিরে আসে তখন কি হবে আম্মু? একবার ভেবে দেখেছ?’
মেঘলার কথা শুনে অজানা ভয় কাজ করতে থাকে মুনিয়ার মনে। তবে এটা প্রকাশ না করে তিনি বলেন,
‘যা হবে দেখা যাবে। আপাতত তুই তোর কাজ চালিয়ে যা। এমন নিখুত অভিনয় করবি যাতে কেউ সন্দেহ না করে যে তুই মেঘলা।’
৩.
রিফাত মেঘলাকে নিয়ে নিজের গাড়িতে ওঠে। তার মা-বাবা তাকে বিদায় দেওয়ার সময় খুব কাদছিল, সেখানে মেঘলার চোখে একফোটা জলও নেই। রিফাত ভীষণই চমকিত হয় এটা দেখে।
মেঘলার খুব হাসি পাচ্ছিল তার মা-বাবাকে এভাবে কাদতে দেখে। সে মনে মনে বিদ্রুপ করে বলে,
‘আমার জীবন নিয়ে এরকম খেলা করে তোমরা এখন মায়াকান্না কাদছ। সবাই তো বিয়ের পর নিজের পরিবার,পরিজন, বাড়ি, চেনা যায়গা ছেড়ে যায়। আর আমি এখানে ছেড়ে যাচ্ছি নিজের নাম পরিচয়। আজ এখানে মেঘলাকে ক’বর দিয়ে রোদেলা হয়ে যাচ্ছি।’
রিফাত মেঘলাকে একমনে কিছু ভাবতে দেখে কাশে। রিফাতের কাশি শুনে মেঘলা তার দিকে তাকায়। রিফাত শুকনো ঢোক গিলে বলে,
‘আজ মনে হয় আমি অষ্টম আশ্চর্যের সাক্ষী হলাম।’
‘মানে?’
‘আজ অব্দি সব মেয়েকেই বিদায়ের সময় কাদতে দেখলাম। শুধুমাত্র মিসেস রোদেলা বাদে।’
মেঘলা কি করে রিফাতকে বোঝাবে তার মনের অবস্থাটা। তবে অষ্টম আশ্চর্যের সাক্ষী তো সে হয়েছেই। মেঘলাই বোধহয় ইতিহাসে প্রথম মেয়ে যে বিয়ের পর নিজের নাম পরিচয় সব হারিয়ে ফেলতে চলেছে।
মেঘলার থেকে কোন উত্তর না পেয়ে রিফাত বলে,
‘আমি তোমাকে আগেও দেখেছিলাম রোদেলা। তুমি তো খুব বেশি কথা বলো। আজ এত চুপচাপ কেন?’
‘আসলে,,,’
‘বুঝতে পেরেছি। তোমার আমার সাথে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক যেভাবে বিয়েটা হলো। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হবে। আমরা তো এখন স্বামী-স্ত্রী। আমাদের মধ্যে একটু বোঝাপড়া তো দরকার।’
মেঘলার খুব ইচ্ছা করছিল সব সত্য রিফাতকে বলে দিতে। কোন অজানা ভয় তাকে বাধা দিচ্ছিল। মেঘলা নিজের মন আর মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। মন বলতেছে,
‘এভাবে মানুষকে ঠকানো ঠিক না। আমার উচিৎ সব সত্য বলে দেওয়া। এভাবে মিথ্যা পরিচয়ে জী’বন কা’টাতে পারবনা। রোদেলার অভিনয় করে কতদিন থাকব আমি? আমার তো নিজের স্বপ্ন, নিজের পরিচয় আছে।’
আবার মস্তিষ্ক বলছে,
‘আমার রোদেলা হয়েই থাকা উচিৎ। যদি এখন আমি সব সত্য বলে দেই তাহলে উনি আমাকে কখনো মেনে নেবে না। ওনার বাবা আমার বাবার সব সম্পত্তি দখল করে নেবে। পথে বসবো আমরা সবাই। আমাদের যাওয়ার আর কোন যায়গা থাকবে না। তার তগর ভালো আমি রোদেলা হওয়ার অভিনয় করে যাই।’
মেঘলা নিজের এসব ভাবনা নিয়ে কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিল। শেষে সিদ্ধান্ত নেয়,
‘আমি রোদেলা হয়েই থাকব!’
৪.
মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে কফিশপে প্রবেশ করে রোদেলা। তাকে দেখে খুব চিন্তিত লাগছিল। কফিশপে রোদেলায় অপেক্ষায় বসে ছিল তার বান্ধবী প্রেনা। রোদেলাকে দেখে হাত নাড়ায় প্রেনা। রোদেলা গিয়ে প্রেনার পাশে বসে৷ প্রেনা রোদেলাকে ভালো করে পরখ করে নেয়। জিন্স, টপস পরিহিত রোদেলাকে খুব মোহময়ী লাগছিল। সচরাচর রোদেলাকে এরকম পোশাকে দেখা যায়না। প্রেনা জিজ্ঞেস করে,
‘আজ তো তোর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল৷ তুই বিয়ে ছেড়ে এখানে কি করছিস?’
‘আমি পালিয়ে এসেছি।’
‘কি????’
‘শান্ত হ। আমার পুরো কথা শোন। অনেক ভেজাল হয়ে গেছে। জানিস আমি বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে আসার পর আমার পরিবারের লোক মেঘলাকে আমার পরিচয়ে বিয়ে দিয়েছে।’
‘কি বলছিস এসব তুই রোদ? ও মাই গড। এবার কি হবে?’
‘আমি জানিনা। এখন আমাকে আগে এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। আমি এখানে থাকলে অনেক সমস্যা হতে পারে।’
‘আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না তুই বিয়েটা ছেড়ে এভাবে পালিয়ে এলি কেন।’
‘কারণ আছে তাই পালিয়েছি। শোন তুই বলেছিলি না তোর বড় বোন খুলনায় থাকে। আমাকে তোর বোনের ঠিকানাটা একটু দিবি। আমাকে কুমিল্লায় যেতে হবে। বেশিদিন না মাত্র দুইদিন সেখানে থাকব। তারপর,,’
‘তারপর কি?’
‘কিছুনা। তুই তোর বোনের ঠিকানাটা দে। আর তোর বোনকে জানিয়ে দিস আমি ওখানে গিয়ে দুদিন থাকব। আশা করি কোন অসুবিধা হবে না।’
✨
কফিশপ থেকে বেরিয়ে একটি ক্যাব বুক করে নেয় রোদেলা। এখান থেকে বাসস্ট্যান্ডে যাবে। বাসে করে খুলনা।
২০ মিনিটের মধ্যে ক্যাব চলে আসে। রোদেলা ক্যাবে উঠে পড়ে। ক্যাব চলতে শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর জ্যামে আটকে যায় ক্যাব।
মেঘলা ও রিফাতের গাড়িও সেইখানে জ্যামের মধ্যে আটকে যায়। ক্যাব ও তাদের গাড়ি ঠিক পাশাপাশি দাড়িয়ে ছিল।
মেঘলা আনমনে বাইরের দিকে তাকাতেই রোদেলাকে দেখতে পায়। রোদেলাও আনমনে বাইরে তাকিয়ে মেঘলাকে দেখতে পায়। দুই বোনের চোখাচোখিতে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়। রিফাত গানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে। তার এইদিকে খেয়াল নেই। এরমধ্যে জ্যাম কে’টে গিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করে। মেঘলা চেয়েছিল গাড়ি থেকে নেমে রোদেলার মুখোমুখি হতে। তাকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল কেন সে পালিয়ে গেল। আজ শুধুমাত্র রোদেলার জন্য মেঘলাকে এমন মিথ্যা পরিচয় নিয়ে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু মেঘলা কিছুই করতে পারে না।
বিপরীত দিকে রোদেলা মেঘলার কথাই ভাবতে থাকে। বলে,
‘আমি জানি তুই হয়ত আমার উপর রাগ করবি। আর রাগ করাটাই স্বাভাবিক। আমার যে কিছু করার ছিলনা, এই বিয়েটা আমি করতে পারতাম না। আমার পালিয়ে আসার কারণে যে এইভাবে তোকে ব’লির পাটা হতে হবে আমি ভাবতেও পারিনি।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨