হারিয়েছি নামপরিচয় পর্ব -০৫

#হারিয়েছি_নামপরিচয়
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা মনি

মেঘলার জীবনে সমস্যা যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে। গতকাল রাতে লেন্স পরার ব্যাপারটা কোনরকমে ম্যানেজ করতে পারলেও আজ এসে গেল আরেক নতুন সমস্যা।

রিফাত মেঘলাকে আজ সকাল সকালই বলে দিয়েছে,
‘তুমি ফ্যাশন ডিজাইনিং খুব ভালোবাসো সেটা আমি জানি। আমি কিন্তু সেইরকম স্বামী না যে বিয়ের পর তোমাকে আর পড়াশোনা করতে দেব না। তুমি যদি চাও তাহলে অবশ্যই ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়বে। আমি এই ব্যাপারে তোমাকে সাপোর্ট করব। আমার আম্মুও সেরকম শাশুড়ি নয়। তিনিও তোমাকে সাপোর্ট করবেন।’

মেঘলা এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে যে সে তো মেডিকেল স্টুডেন্ট। ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে তার কোন ধারণা নেই। এছাড়া রোদেলা হয়ে এই বাড়িতে আছে কেউ সেটা বুঝতে পারছি না। কারণ এখানে কেউ রোদেলার ব্যাপারে তেমন কিছু জানে না। কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনিং ইনিস্টিউটের রোদেলার বন্ধু বান্ধবেরা তো রোদেলাকে খুব ভালো করেই চেনে জানে। তারা যদি ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে কি হবে সেটাই বুঝতে পারছে না মেঘলা।

এসব ভাবনার মধ্যেই বুদ ছিল মেঘলা। রিফাত যে কখন রুমে এসেছে সেটা সে খেয়ালই করেনি। মেঘলার চিন্তিত মুখ দেখে রিফাতও ভাবনায় পড়ে যায়। মেঘলার কাধে হাত দিয়ে তাকে প্রশ্ন করে,
‘কি এত ভাবছ তুমি?’

মেঘলা রিফাতের আচমকা এই স্পর্শে হচকচিয়ে যায়। বুকে থু থু দিয়ে বলে,
‘তেমন কিছু না।’

রিফাত মেঘলার এমন কাণ্ড দেখে না হেসে পারেনা।

‘আমি তো শুনেছিলাম তুমি অনেক স্মার্ট। এই তার নমুনা।’

মেঘলা মাথা চুলকে বলে,
‘আসলে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম তো তাই,,,’

‘আমি বুঝতে পেরেছি তোমার মন ভালো নেই৷ কোন ব্যাপার না তোমার মন ভালো করার উপায় আছে তো আমার কাছে।’

রিফাত নিজের কাবার্ড থেকে একটা গিফট বক্স বের করে মেঘলার হাতে দেয়। মেঘলা বলে,
‘এটাতে কি আছে?’

‘তোমার গিফট। খুলে দেখো তো পছন্দ হয় কিনা।’

মেঘলা গিফটটা খুলে দেখে ভেতরে অনেক দামী একটা লেন্স। মেঘলা রিফাতের দিকে তাকায়। রিফাত হাসিমুখে বলে,
‘এই লেন্সটা ব্যবহার করো। এটাতে অনেক সুবিধা আছে। যেখানে সেখানে পড়েও যাবে না।’

‘ধন্যবাদ আপনাকে।’

‘আমাকে আর যাই বলো ধন্যবাদ বলিও না। আচ্ছা ভালো কথা আজকে তো আমরা তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি ১২ টার মধ্যে রেডি হয়ে থেকো আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।’

বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে মেঘলার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার কোন ইচ্ছা নেই ঐ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার। মেঘলাকে চুপ থাকতে দেখে রিফাত তার মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বলে,
‘কি হলো কিছু বলছ না যে?’

‘আজ না গেলে হয়না।’

মেঘলার কথা শুনে রিফাত হতবাক হয়ে যায়।

‘তোমাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। একে তো নিজের বাড়ি ছেড়ে আসার দিন কাদলে না। এখন আবার নিজের বাড়িতে যেতেও চাচ্ছ না। সবকিছু আমার ভীষণ স্ট্রেঞ্জ লাগছে।’

মেঘলা কোনকিছু না বলে বেলকনিতে চলে যায়। রিফাতও নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ে।

৯.
মেঘলা এই বাড়ির রান্নাঘরে এসে সবথেকে বেশি অবাক হয়। রান্নাঘর দুই ভাগে বিভক্ত।

মেঘলা কোনদিকে যাবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। একটু পর মেহের সেখানে আসে। মেঘলাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
‘এভাবে দাড়িয়ে আছ কেন? ঐদিকে যাও ওটা তোমাদের রান্নাঘর।’

মেঘলা মেহেরের কথামতো সেইদিকেই যায়। অল্প কিছুক্ষণ পর রোজিয়াও রান্নাঘরে চলে আসে। মেঘলাকে রান্নাঘরে দেখে বলে,
‘তুমি এখানে কি করছ?’

‘আন্টি আমি আসলে কফি বানাতে এসেছিলাম।’

‘আমাকে আন্টি বলছ কেন? আজ থেকে আমাকে আম্মু বলে ডাকবে ঠিক আছে? আর তোমাকে কিছু করতে হবে না। এই বাড়িতে আমাদের রান্না করার জন্য কাজের লোক আছে। আমি ওকে ডাকছি ও কফি তৈরি করে দিবে। তুমি বাইরে এসো।’

মেঘলা রান্নাঘর তগর বেরিয়ে আসে। মেহের বলতে থাকে,
‘যতসব ঢং। আমি জানি তো এসব কথা আমাকেই শুনিয়ে বলা হয়েছে। আমার কাজ করার মতো লোক যে নেই। অসুবিধা নেই, আমি গ্রামের মেয়ে। ছোট থেকে সব কাজকর্ম শিখেছি। আমি একাই সব করতে পারব।’

আচমকা মাছ ভাজতে গিয়ে গরম তেল ছিটকে এসে মেহেরের হাতে পড়ে। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে সে আহ করে ওঠে। মেঘলার কানে সেই আওয়াজ পৌছায়। মেঘলা মেহেরের কাছে এসে দেখে তার হাতে বেশ খানিকটা যায়গায় তেল এসে পড়েছে।

তাই মেঘলা তৎক্ষণাৎ একটি ওষুধ এনে সেখানে লাগিয়ে দেয়। মেহের বলে,
‘ছাড়ো এসব লাগবে না। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এরকম কতবার পু’ড়তে হয়েছে।’

মেঘলা সুন্দরভাবে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিল।
‘এগুলোকে সাধারণ ভেবে ভুল করবেন না। অনেক সাধারণ ক্ষতও অনেক সময় ইনফেকশন সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়।’

‘এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি ডাক্তার।’

মেহেরের কথাটা শুনে মেঘলার মন খারাপ হয়ে যায়। আসলেই তো মেঘলার কত ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার। আজ বাস্তবতা তাকে এভাবে আঘাত না করলে হয়তোবা তার স্বপ্নটা পূরণ হতে পারত। মেঘলার অজান্তেই তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল পড়ে।

মেহেরের অলক্ষ্য হয়না সেগুলো। মেহের বেশ চিন্তিত হয়ে যায়।

‘এই মেয়ে তুমি কাদছ কেন?’

মেঘলা সন্তপর্ণে তার চোখের জলগুলো হাত দিয়ে মুছে নেয়। মেহের ভালোভাবে তাকায় মেঘলার দিকে। মেয়েটার মায়াবী মুখের দিকে তাকাতেই ভীষণ মায়া হয় তার। মেহের মনে মনে বলে,
‘এই মেয়েটাকে দেখলে কেন জানি রাগ করে থাকতে পারি না। ভুলে যাই ও রোজিয়ার ছেলের বউ। সেই রোজিয়া যে আমার জীবনটাকে,,,’

মেঘলা ওষুধ লাগানো শেষ করে মেহেরকে নিজের যত্ন নিতে বলে চলে যায়। মেহের কোন অজানা ভাবনায় ডুব দেয়।

১০.
ঘড়ির সময় অনুযায়ী এখন দুপুর ১২ টা। মেঘলা খুব সাদামাটাভাবে তৈরি হয়ে নিয়েছে। নীল রঙের একটি সুতির শাড়ি, হাতে সামান্য গহনা। তবে এই সামান্য সাজেই মেঘলাকে অনেক রূপসী লাগছে।

রিফাত নিজের কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরেই প্রথমে মেঘলাকে দেখে। মেঘলার আকর্ষণীয় রূপের মাঝেই যেন হারিয়ে যায় সে। তার চোখের পলকই পড়ছিল না।

রিফাতকে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘলার ভীষণ লজ্জা হয়। রিফাত ধীরে ধীরে মেঘলার কাছাকাছি চলে আসে। মেঘলা নিজের দুইচোখ বন্ধ করে নেয়।

‘এত অল্প সাজেই তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে রোদেলা। না জানি আরো বেশি সাজলে কতোটা সুন্দরী লাগত।’

মেঘলা চোখ খুলে তাকায়। এই রোদেলা নামটা শুনলেই আজকাল ভীষণ রাগ হয় তার। মনে পড়ে যায় সে নিজের নামপরিচয় হারিয়ে ফেলেছে।

মেঘলা গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। রিফাত অনেকটা ঠাট্টার স্বরে বলে,
‘আমি তো জানতাম ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনার জন্য তোমার ফ্যাশন সম্পর্কে অনেক ধারণা থাকবে। এখন তো দেখছি এই ব্যাপারে তোমার একটুও ধারণা নেই। আচ্ছা তুমি কি সত্যি রোদেলা? আমার তো অনেক সন্দেহ হচ্ছে এখন।’

‘ঠিকই ভেবেছেন আপনি। আমি রোদেলা নই।’

‘কি??’

‘যা শুনলেন তাই আমি রোদেলা নই।’

রিফাত অবাক হয়ে যায়। মেঘলাকে শক্ত করে ধরে বলে,
‘তাহলে কে তুমি?’

মেঘলা বলে,
‘আমি,,,’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here