হারিয়েছি নামপরিচয় পর্ব -০৭

#হারিয়েছি_নামপরিচয়
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা মনি

রিফাত বলে,
‘কে আপনি? নিজেকে রোদেলা বলে দাবি করছেন কেন? আমি রোদেলার স্বামী রিফাত। আমার স্ত্রী তো রান্নাঘরে।’

রোদেলা রিফাতের গলা শুনে ঘাবড়ে যায়। সে যেহেতু সবটা জানে তাই ভাবল যে করেই হোক কথা ঘুরিয়ে নিতে হবে।

‘আমি রোদেলা নই আমি মেঘলা। আম্মুকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম দুলাভাই। আসলে আম্মু আমাদের দুই বোনকে চিনতেই পারে না। যেহেতু আমাদের গলার স্বরের অনেক মিল।’

রিফাত একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
‘ও তাহলে তুমি আমার একমাত্র শা’লী। বিয়ের দিন তো আসলা না। কবে আসবা তুমি?’

রোদেলা মিনমিনে স্বরে বলে,
‘খুব শীঘ্রই।’

‘আচ্ছা তুমি দাড়াও আমি ফোনটা তোমার আম্মুকে দিচ্ছি।’

‘না দুলাভাই। আমার তেমন জরুরি কোন কথা ছিল না। আমার এখন খুব আর্জেন্ট একটা ক্লাস আছে। পড়া কথা বলি। ভালো থাকবেন আর আমার বোনটার একটু খেয়াল রাখবেন।’

রোদেলা ফোনটা রেখে দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়।
‘আজ আরেকটু হলেই সবকিছু শেষ হয়ে যেত। মেঘ তোর জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। যে কারণে আমি বিয়েটা করতে চাইনি সেটা যদি কোনভাবে তোকে বলতে পারতাম। হয়তো তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। তবে আমি খুব শীঘ্রই আসছি। আমার জন্য যত সমস্যা তৈরি হয়েছে সবকিছুর সমাধানও আমিই করবো।’

১৩.
রিফাত মেঘলাকে রোদেলার ফোন দেওয়ার ব্যাপারটা বলছিল,
‘জানো তোমার বোন মেঘলা কল দিয়েছিল। প্রথমে আমায় বলল ও নাকি রোদেলা। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে বলল মজা করেছে।’

মেঘলা ভীষণ অবাক হয়ে যায় কথাটা শুনে,
‘কি বললেন রো,,, মানে মেঘলা ফোন করেছিল। কখন? কি বলল ও?’

‘তেমন কিছু বলেনি। বলল খুব শীঘ্রই নাকি আমাদের দেখা হবে।’

মেঘলা স্বস্তি পায়। যাক কোন কিছু ধরা পড়েনি। মেঘলাকে কোন ভাবনায় বুদ থাকতে দেখে রিফাত তার সামনে এসে চুটকি বাজায়।

‘আজ কি এখানেই থাকবে নাকি চলে যাবে আমার সাথে? কাল থেকে তুমি ফ্যাশন ডিজাইনিং ইনিস্টিউটে যেতে পারো।’

‘না আমি থাকবো না। আপনার সাথেই চলে যাব।’

‘তাহলে এখানে তোমার যত প্রয়োজনীয় জিনিস আছে নিয়ে নাও। কাল থেকেই কিন্তু তোমাকে যেতে হবে। অনেক ছুটি কা’টিয়েছ।’

মেঘলা মাথা নাড়ায়। তার মনের মাঝে হাজারো দুঃশ্চিন্তা ঘুরছিল। রিফাতের বাড়িতে না হয় সবকিছু সামলাতে পেরেছে। ফ্যাশন ডিজাইনিং ইনিস্টিউটে কিভাবে সবকিছু সামলাবে? রোদেলার সাথে কথা বলতে পারলে একটু সুবিধা হতো।

মেঘলা চলে যায় তার মায়ের কাছে। মুনিয়া টিভিতে সিরিয়াল দেখছিল। মেঘলা সামনে গিয়ে বলে,
‘আম্মু আজ রোদেলা ফোন করেছিল।’

মুনিয়া চমকে উঠে বলে,
‘কি!!!!’

‘হ্যা। রিফাত ফোনটা রিসিভ করেছিল। কোনরকমে সবকিছু ফাস হওয়া থেকে বেচে গেছি। কিন্তু এভাবে আর চলবে না। রিফাত আমায় বলেছেন কাল থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং ইনিস্টিউটে যেতে। আমি কি করব এখন? আমার তো এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই। তার উপর রোদেলার বন্ধু বান্ধবের কাছে যদি ধরা পড়ে যাই।’

মুনিয়া বেগম দুঃশ্চিতায় পড়ে যান। কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবেন।

‘তুই একটা কাজ কর কাল তুই রোদেলার মতো সেজে যাবি। ওর মতো কথাবার্তা বলবি সবার সাথে। তাহলে আর কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।’

‘তা নাহয় করলাম কিন্তু তারপরেও তো একটা আশঙ্কা থেকে যায় ধরা পড়ার।’

‘না তোকে ধরা পড়লে চলবে না। সবকিছু ভালো ভাবে ম্যানেজ করবি। আমি দেখছি কি করা যায়।’

মেঘলা নিরাশ হয়ে রুমে ফিরে আসে। সবকিছু গোছগাছ করে নেয়। রিফাত আচমকা মেঘলাকে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে। মেঘলা চমকে ওঠে। রিফাত মেঘলাকে অবাক করে বলে,
‘এখনো কি তোমার মনে হয় রোদেলা, আমার থেকে ভালো অন্য কেউ তোমায় বাসতে পারত।’

মেঘলা কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। সেদিন তো রিফাত বলেছিল, রোদেলা অনেক আগে একবার দেখেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। এদিকে এই দুই দিনে মেঘলার মনেও রিফাতের জন্য অনুভূতি জন্ম নেওয়া শুরু হয়েছে। রিফাতের এত ভালোবাসা, এত কেয়ার মেঘলাকে বাধ্য করেছে রিফাতকে ভালো লাগার জন্য। তাই তো মেঘলা চাইছিল রিফাতকে সব সত্য বলে দিতে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। এখন মেঘলার মনে আরো একটা ভয় হানা দিয়েছে। রিফাত যদি সব সত্য জেনে তাকে ত্যাগ করে। তখন মেঘলা কিভাবে থাকবে?

এতসব ভাবনার মাঝে মেঘলা খেয়ালই করে নি রিফাত তার উত্তরের আশায় ব্যাকুল হয়ে আছে। বিষয়টা খেয়াল করতেই মেঘলা বলে,
‘আপনার থেকে বেশি কেউ ভালোবাসতো কি না জানিনা, কিন্তু এখন আমি আপনি ছাড়া আর কারো কথা ভাবতে চাইনা।’

রিফাত মৃদু হেসে বলে,
‘আমি জানি এভাবেই একদিন তুমি আমায় ভালোবেসে ফেলবে। সেদিন আমি তোমায় আপন করে নেব। নিজের সাথে মিশিয়ে নেব। এখন চলো আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।’

‘হ্যা চলুন।’

১৪.
আজ বেশ সকাল সকাল মেঘলার ঘুম ভেঙে গেছে। বলতে গেলে সবকিছুতে এলার্মের যাদু। রিফাত মেঘলাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে মুচকি হাসে।

‘উঠে গেছ, গুড। এখন তৈরি হয়ে নাও। তোমার টাইম তো হয়ে যাচ্ছে।’

মেঘলা উঠে পড়ে। ফ্রেশ হয়ে নেয়। নিজের ফোনটা বের করে রোদেলার একটা ছবি দেখে নেয়। আজ রোদেলার মতো করেই সাজতে হবে তাকে।

মেঘলা একটা হলুদ কালারের সালোয়ার সাথে ব্লু জিন্স পড়ে নেয়। সাথে হাই হিল। চড়া মেকআপ করে নেয়। আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখে তাকে একদম রোদেলার মতোই লাগছে। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কিন্তু হাই হিল পড়ে হাটার সময় মেঘলা বারবার পড়ে যাচ্ছিল। শেষে বিরক্ত হয়ে বলে,
‘রোদ এইসব হিল পড়ে কিভাবে চলত। আমি তো একদম পারছি না।’

একটু পরেই রিফাত চলে আসে। মেঘলাকে এই রূপে দেখে বিমোহিত হয়ে যায়।

‘আজ একদম তোমাকে রোদেলা রোদেলা লাগছে। এই ক’দিন তো তোমাকে চিনতেই পারছিলাম না।’

রোদেলা মৃদু হাসে। রিফাত মনে মনে বলে,
‘কেন জানিনা রোদেলাকে এইভাবে দেখে আমার ভালো লাগছে না। গত কয়েকদিন যেভাবে ছিল সেভাবেই ওকে ভালো লাগত। এই সাজে, এত মেকআপ করে ওকে কেমন জানি লাগছে।’

রিফাতের সাথে ফ্যাশন ডিজাইনিং ইনিস্টিউটের জন্য বেরিয়ে পড়ে রোদেলা। গাড়িতে ওঠার সময় মুন্নি আচমকা আসে তাদের কাছে। বলে,
‘ভাইয়া তুমি তো ভাবিকে নিয়ে যাচ্ছ আমার কলেজও তো ঐদিকে। আমাকেও নিয়ে চলো।’

রিফাত খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,
‘বাড়িতে তো আরো গাড়ি আছে। এমনি দিন তো একাই যাস। আজ তাহলে তোকে নিয়ে যেতে হবে কেন?’

মুন্নির মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায়। তবে সে সেটা প্রকাশ না করে বলে,
‘আজ তোমাদের সাথে যেতে ইচ্ছা করল। ঠিক আছে তোমাদের যদি ভালো না লাগে তাহলে আমি একাই চলে যাবো।’

মুন্নি চলে যেতে চাইলে মেঘলা তার হাতটা ধরে ফেলে।

‘তুমি আমাদের সাথেই চলো মুন্নি। আমাদের কোন অসুবিধা নাই।’

রিফাত বেশ বিরক্ত হয়েই গাড়িতে বসে পড়ে। সে সামনের সিটে বসে ছিল ড্রাইভারের সিটে। মেঘলা ও মুন্নি পিছনের সিটে বসে বিভিন্নরকম গল্প করছিল। রিফাত গাড়ির লুকিং গ্লাসে বারবার মেঘলাকেই দেখছিল। মেঘলার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নেয়।

মেঘলা মৃদু হাসে। মুন্নির সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে তার। মেয়েটা এত মিষ্টি করে কথা বলে যে তার সাথে কথা না বলে থাকা যায়না। মেঘলা এই ক’দিনে বুঝে গেছে রিফাত এবং তার মা তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানদের ভালো চোখে দেখে না। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও মেঘলার কেন জানিনা তাদের ভালোই লাগে। মুন্নির কলেজে চলে আসায় সে নেমে পড়ে।

একটু পর রোদেলার ফ্যাশন ডিজাইনিং ইনিস্টিউটও চলে আসে। রিফাত মেঘলাকে নামিয়ে দিয়ে বলে,
‘বেস্ট অফ লাক। ভালো করে ক্লাস করো। ছুটির পর আমি তোমাকে নিতে আসব।’

কথাটা বলেই রিফাত গাড়িতে করে চলে যায়। মেঘলা বোকার মতো সেখানে দাড়িয়ে থাকে। রোদেলার ক্লাস যে কোনদিকে সেটাই তো সে জানে না। আচমকা একটা মেয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘রোদ তুই এসে গেছিস। শুনলাম তোর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। আমাকে একবার জানালিও না। আমার কিন্তু ট্রিট চাই।’

মেঘলা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এই মেয়েটাকে তো সে চেনেও না। তখনই প্রেনা সেখানে চলে আসে। মেঘা প্রেনাকে চেনে। রোদেলার বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে অনেকবার প্রেনা তাদের বাড়িতে গেছে। তাছাড়া রোদেলার থেকেও প্রেনার ব্যপারে অনেক কিছু শুনেছে। প্রেনা এসে বলে,
‘রোদ তুই আয় আমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। তোর সাথে পরে কথা হবে সুইটি।’

সুইটি চোখ পাকিয়ে তাকায়। প্রেনা মেঘলাকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলে,
‘আমি জানি তুমি রোদেলা নও মেঘলা।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here