হিয়ার মাঝে পর্ব -০২

#হিয়ার_মাঝে
#পর্বঃ২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩,
হিয়ার মুখের উপর থেকে হাত টা সরিয়ে ফেললো ছেলেটি। হিয়া বার কয়েক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বিছানায় গিয়ে ধপ করে পরলো। ছেলেটি ততক্ষণে ফোনে কিছু একটা করছে। কিন্তু হিয়া ক্রমাগত নাক টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। তার যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। ছেলেটি এবার ভ্রুকুটি করে তাকালো হিয়ার দিকে। এরপর বললো,

“আমি এতোটাও শক্ত করে আপনার মুখ চেপে ধরিনি, যে এভাবে হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাস নিচ্ছেন। ”

হিয়ার ছেলেটির কথায় রা”গ লাগলেও আপাতত ঝগড়া করার ইচ্ছে তার নেই। সে ধীরেসুস্থে উত্তর দিলো,

” আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। ”

হিয়ার কথা ফুরোতেই ছেলেটি ছোট্ট করে বলে,

” স্যরি। ”

স্যরি বলতেই হিয়া তাকালো সেই পুরুষের প্রতি, যাকে সে এতোক্ষণেও ভালো করে লক্ষ্য করেনি যে কে ইনি! সে নিরলস ভাবে উত্তর দিলো,

” আপনি বরের কি হোন? ”

হিয়া প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর পেলো না। দরজায় কারোর নক করার শব্দে সে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলতেই আনিকা হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করলো। হিয়া আনিকাকে দেখেই বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। আনিকার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো,

” এটা কার রুমে রেখে গিয়েছিলেন আপু? এই অ’সভ্য লোক এসে রীতিমতো আমায় শ্বা”সরোধ করে মা”রতে বসেছিলো। ”

হিয়ার এমন কথায় ভেবাচেকা খেয়ে যায় আনিকা। সাথে ছেলেটিও। এখানে হলো কি! আর হিয়া বারিয়ে বলছে কি! সে হিয়ার দিকে তে’ড়ে গিয়ে বলে,

” একদম নিজের দোষগুলো ঢেকে আমায় দো’ষী সাবস্ত্য করবেন না। নয়তো থা”প্পড় একটাও মাটিতে পরবে না। ”

হিয়া ছেলেটির কথায় চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে আনিকার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো,

” এভাবে আপনাদের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন হয় আপু? দেখলেন কিভাবে থা”প্পড় মা’রবে বলছে! ”

আনিকা ছেলেটির কাধে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফিরালো। শাসানো কন্ঠে বললো,

” কি হচ্ছে কি ইহসাস? এ কেমন আচরণ তোমার? ”

” তুমি ওনাকে বলে দাও ভাবীমনি, আবরার ইহসাসকে এভাবে মিথ্যা ব্লেম দিলে সে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। ”

ইহসাসের কথায় হিয়া আনমনে ভাবে, ‘ এই গোমড়ামুখোর নাম তবে আবরার ইহসাস। কিন্তু রায়া আপুর সম্পর্কে হয় কি!’ আনিকা আনমনে যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত। আনিকা হিয়ার হাত ধরে বলে,

” আমার রুমে চলো। সেখানেই তুমি আপাতত ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করবে। ”

” আমি ফ্রেশ হয়েছি আপু। ”

হিয়া আনিকার কথার উত্তর দিতেই ইহসাস বলে,

” তাড়াতাড়ি এনাকে নিয়ে বিদায় হও ভাবীমনি। একরাত বাসায় ছিলাম না, আর একটা মেয়েকে আমার রুমে থাকতে দিলে! এটা যদি আমার ফিউচার ওয়াইফ জানতে পারে, যে সে আসার আগেই একটা মেয়ে আমার রুমে থেকেছে। কি ভাববে বুঝেছো? ”

আনিকা এবার ইহসাসের দিকে তাকায়। চোখ পা’কিয়ে বলে,

” অতিথির সামনে এসব আবোল-তাবোল কম ব’কো ইহসাস। মেয়েদের দেখতে পারো না, আবার বউ বউ বলে দুনিয়ার জল্পনা-কল্পনা করে ফেলো। ”

” চিন্তা করবেন না ভাবী। কোনো মেয়ে এনার কপালে জুটবেনা। যে নিমপাতার মতো ব্যবহার। পুরাই তিতা। ”

হিয়া মুখ ফস্কে কথাটা বলে আনিকা আর ইহসাসের দিকে তাকায়। ইহসাস একরকম বিস্ময়কর চাহনীতে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে। আনিকা হিয়ার হাত ছেড়ে কপালে হাত দিয়ে বসে। এবার না দুজনের মা’ঝে ঝগড়া লেগে যায়। হিয়া হাত ছাড়া পেতেই একদৌড়ে ইহসাসের রুম থেকে বেরিয়ে পরে। হিয়া বেরিয়ে যেতেই ইহসাস আনিকাকে প্রশ্ন করে,

” এ কে ভাবীমনি? বাড়িতে এতো রুম থাকতে আমার রুমই পেয়েছিলে ওনাকে থাকতে দিতে! ”

” ও তোমার নতুন ভাবীর বোন ইহসাস। বাড়িতে এতো অতিথি, ফাঁকা রুম বলতে তোমার টাই ছিলো। তোমার রুমে যে কাউকে থাকতে দিলে তু”লকালাম করবে জানা ছিলো। সেজন্য তোমার রুম লক করে রেখেছিলাম। কিন্তু হিয়াকে কোথায় থাকতে দিবো! তুমিও বাইরে ছিলে বিধায় থাকতে দিই এখানে। ভেবেছিলাম তুমি ফিরবে বিকেলে, তার আগেই হিয়াকে আমার রুমে থাকতে দিবো। কিন্তু সকালেই চলে আসলে তুমি। ”

একদমে কথাগুলো বলে আনিকা। ইহসাস তার ভাবীর কথার উত্তরে বলে,

” মেয়েটার নাম হিয়া? নতুন ভাবীর বোন? ”

” হ্যাঁ। ”

” সম্পর্কে তো হয় বিয়াইন সাহেবা। এবার বুঝবে মজা।”

” ফা’জলামো করবেনা ইহসাস। তোমার বড় ভাইয়া জানলে রে’গে যাবে কিন্তু। আর এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে যে? তোমার তো বিয়ে বাড়ির হইচই পছন্দই হয়না! সেজন্য কাল বরযাত্রী বেরুনোর আগেই লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলে? রাতে থাকলে কোথায় বলো তো? ”

” দুইমাত্র বড় ভাইয়ের বিয়ে ভাবী। আজ বৌভাত, ভাবলাম একটু মজা করি। রাতে বন্ধুর বাসায় ছিলাম। আপাতত আমি ফ্রেশ হবো। তুমি চলে যাও। ”

আনিকা ইহসাসের কথাশেষে ইহসাসকে একবার সন্দেহের চোখে দেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে বিরবির করে বলে, ‘ কে জানে এই ছেলের মাথায় কি ঘুরছে। হিয়া আবার কোথায় গেলো! বাড়ির তো কিছু চিনেনা। একে আবার খুজতে হবে। ”

৪,
পার্লারের মেয়েরা রায়া-কে বউভাতের জন্য তৈরি করছে। হিয়া তার রুমে বসে নখ কা’মড়াচ্ছে আর বোনের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। তার পরির মতো বোনকে শুধু শুধু মেকআপের আস্তরণে সাজাচ্ছে এরা, ন্যাচারালিই তার বোন অনেক সুন্দর। রায়া-কে শাড়ি পরিয়ে চুল বেধে মেকআপ করানো শেষ হতেই রায়ার শ্বাশুড়ি মিসেস সেলিনা আর তার চাচী শ্বাশুড়ি মিসেস
কল্পনা একসঙ্গে রায়ার রুমে প্রবেশ করেন৷ হিয়া তাদের দেখে উঠে দাড়ায়। কাল রাতেই উনাদের পরিচয় জেনেছে হিয়া। রায়া শ্বাশুড়ি আর চাচী শ্বাশুড়িকে সালাম দেয়। কাল রাতে পরিবারের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে রায়ার সাথে। মিসেস সেলিনা সালামের উত্তর নিয়ে বলেন,

” তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো আম্মু? কাল তোমাকে একটু বেশিই টায়ার্ড লাগছে বলে তেমন বিরক্ত করিনি। ”

রায়া মলিন হাসে শ্বাশুড়ির কথায়। কষ্ট চেপে হাসার য’ন্ত্রণা ক’জনই বা পারে সহ্য করতে৷ হিয়ার মনের মধ্যিখানে বোনের মলিনতায় অজানা এক চিনচিনে ব্যথা চে’পে ধরে। রায়া ধীর গলায় উত্তর দেয়,

” না, তেমন সমস্যা হচ্ছে না। ”

মিসেস কল্পনা এবার হাতে থাকা গহনার বক্সগুলো ড্রেসিং টেবিলে রাখতে রাখতে বলেন,

” তোমার ভাগে তোমার দাদী শ্বাশুড়ির যে গহনা গুলো পরেছে, সেগুলো পরিয়ে দিতেই আমাদের এখানে আসা। তোমার দাদী শ্বাশুড়ি মা’রা যাবার আগে আর তিন নাতীর বউদের জন্য আর আর তার একমাত্র নাতনীর জন্য গহনা ভাগ করে দিয়ে গেছেন। ”

রায়া উনার কথার উত্তরে কিছু বলে না, মিসেস কল্পনা এসে রায়াকে গহনা গুলো পরিয়ে দিতে শুরু করেন। মিসেস সেলিনা দুহাতে স্বর্ণের চিকন চুড়িগুলো পরিয়ে দিচ্ছেন। পার্লারের মেয়েগুলো তাদের কাজ শেষ হওয়ায় চলে যায়৷ হিয়া জানে তার দুলাভাইয়ের একটা মাত্র বড় ভাই আছে, যার বউ আনিকা আপু। ২য় জন হলো তার বোন, এখন এই তিন নম্বর নাতী টা আবার কে? হিয়া নিজের কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে মিসেস সেলিনাকে প্রশ্ন করে,

” আচ্ছা আন্টি আপনার তো দুই ছেলে, কিন্তু ছোটো আন্টি বললেন, তিন নাতীর কথা। আরেকজন কে? ”

” এই যে আমি, আবরার ইহসাস। একমাত্র দেবর আমার নতুন ভাবীর৷ এবাড়ির ছোটো ছেলের ছেলে, যে বড় দুভাইয়েরই ছোটো।”

মিসেস সেলিনা উত্তর দেওয়ার আগেই দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকা ইহসাস হিয়ার কথার উত্তর দেয়। মিসেস কল্পনা ছেলেকে দেখে রা’গী চোখে তাকান। রায়া আর হিয়া ইহসাসকে এখানে দেখে একেঅপরের দিকে তাকালো। হিয়া বিছানা থেকে উঠে এসে বোনের পাশে দাড়ালো। মিসেস সেলিনা আর কল্পনা দুজনই একসাথে গিয়ে ইহসাসের দুইকানে ধরে রুমের ভেতরে নিয়ে আসেন। এরপর ঝাঁজালো কন্ঠে মিসেস সেলিনা বলেন,

” বড় ভাইয়ের বিয়ে, তার ছোটো ভাই বিয়ে বাড়ি থেকে উধাও। ব্যাপারটা কি বলো তো? ”

” ছেড়ে দাও মামনি। তোমাদের ছোটো ছেলে আমার বিয়ের সময়ও হারিয়েছিলো, বিয়ের পরদিন এসে হাজির। এবারও তাই হয়েছে। ”

আনিকা রুমের ভেতর প্রবেশ করতে করতে কথাটা বলে। মিসেস কল্পনা আনিকাকে দেখে তা কথার উত্তরে বলেন,

” তুমি আর ওকে প্রশয় দিও না বড় বউমা। তোমার প্রশয়ে ও মাথায় উঠেছে। ”

” কি করবো বলুন তো ছোটো মা। ছোটো ভাই নেই, রাদ আর ইহসাসকেই তো বিয়ের পর ছোটো ভাই হিসেবে পেয়েছিলাম। তাই আদর কমাতে পারিনা। ”

আনিকার মুখে রাদ নাম শুনে রায়া ভেবে নেয় হয়তো তার স্বামীর নাম৷ কিন্তু নাম তো মনে হয় অন্য কিছু শুনেছিলো, কিন্তু কি নাম সেটাই খেয়াল নেই। বিয়েতেই যেখানে মতামত নেই, সেখানে আবার নাম মনে রাখা৷ কিন্তু লোকটা গেলো কোথায়। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর স্বামী নামক মানুষটাকে দেখেনি রায়া। এদিকে ইহসাস তার বড় ভাবীর উত্তর শুনে গিয়ে গলা জড়িয়ে মায়েদের সাথে হাসি ঠাট্টা করছে। আনিকা সেসব গুরুত্ব না দিয়ে রায়ার কাছে দাড়িয়ে জিগাসা করে,

” রাদ কোথায় কিছু বলতে পারো রায়া? সকাল থেকে ওকে নজরে পরছেনা!”

মিসেস সেলিনা এবার আনিকার কথার সাথে তাল মেলালেন৷ তিনিও আনিকার কথার সুরে জিগাসা করেন,

” সত্যিই তো। রাদকে দেখছি না যে! তুমি কিছু জানো বউ?”

” আমাকে কিছু বলে যাননি উনি। আমার ঘুম ভাঙার পর উনাকে দেখিনি। ”

” তাহলে ভাইয়া গেলো কোথায়? ওয়েট আমি একটা কল করে দেখি।”

ইহসাস সবার কথার উত্তরে কথাটা বলে। সে পকেট থেকে ফোন বের করে ভাইকে কল করে। হিয়া একটু নিচু হয়ে বোনের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

” বিয়েতে মত নেই, মানলাম। কিন্তু নতুন ভাইয়া তো কিছু দোষ করেনি। একটু খেয়াল তো রাখতে পারতি আপু। ”

” তোর দরদ লাগে তুই খেয়াল রাখ গিয়ে। ”

রায়া ঝা’ড়ি মে’রে হিয়ার কথার উত্তর দেয়।

” কি ব্যাপার! বাড়ির সব সদস্য হুট করেই আমার রুমে যে! তাও সব একসাথে! ”

রাদের গলার স্বর শুনে সবাই রুমের দরজার দিকে তাকায়৷ রাদকে দেখে রায়া একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ইহসাস সহ বাকিরাও রাদের কাছে এগিয়ে যায়। ইহসাস প্রশ্ন করে,

” সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলে ভাইয়া? ”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here