হৃদপূর্ণিমা পর্ব -১৫

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৫ |

আবছা অন্ধকার ঘরের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে আপনমনে ফুঁপিয়ে চলেছে রথি। তার আঁখিপল্লব অশ্রুসিক্ত! সে একমনে কাঁদছে। রথির ভাবী কিছুক্ষণ আগেই তাকে এই ঘরে বন্দি করে গেছে। রথি এখন গাজীপুরে আবিরের ফ্ল্যাটে আছে। এখানে ঘরোয়াভাবে রথি এবং আবিরের বিয়ের ব্যবস্থা করেছে চাচী আর ভাবী।
বিয়ের কথা শুনতেই রথির কেমন সব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। কোনো এক জায়গা থেকে কেউ চিৎকার করে বলছিলো এই বিয়ে করলে তুই ভালো থাকবি না, কারণ তুই অন্যকাউকে ভালোবাসিস। তাকেই তোর লাগবে। রথি অমত জানায় সে বিয়ে করবে না এবং সে এই মুহূর্তে বাড়ি চলে যাবে!
এই কথা শুনতেই ভাবী জোর করে তাকে বদ্ধ ঘরে বন্ধ করে দেয়, রথির ফোনটাও সুইচড অফ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। এই বদ্ধ ঘরে বন্দি হতেই রথি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলো তার নাশিদকে প্রয়োজন। নাশিদ তার প্রিয়জন, সে ছাড়া অন্য কাউকে কখনোই মেনে নিতে পারবে না।
জীবনটা কীভাবে যেন নতুন ঝামেলায় মোড় নেয়। একে একে বুঝতে পারলো তার ভাবী কেন একান্তই তাকে নিয়ে এই গাজীপুরে এসেছে। রথি তার ভাবীর প্রতি ঘৃণায় নাক সিটকালো। এই মানুষটাকে সে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না।

কিছুক্ষণ বাদে হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো মার্জান। রথির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে শুধুমাত্র নাশিদ এবং নাশিদের স্মৃতিগুলো ভাবতে মগ্ন। মার্জান পা ভেঙ্গে ফ্লোরে বসে খাবার এগিয়ে শক্ত গলায় বললো,

-‘খাবারটা খেয়ে নে!’

-‘খাবো না, চলে যাও এখান থেকে।’

মার্জান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেঝেতে প্লেটটা রেখে খুবই শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-‘দেখ রথি, আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি রাজি হয়ে যা। আবির ভালো ছেলে, তোকে ভালো রাখবে!’

-‘আমার তোমার ভালোর প্রয়োজন নেই? তুমি যাবে?’
চিৎকার করে বললো রথি। মার্জান আরও কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু রথি মার্জানের কোনো কথাই কানে নেয়নি। মার্জান নিরাশ হয়ে তপ্তশ্বাস ফেললো। অতঃপর খাবার রেখেই চলে গেলো। রথি এখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
তার মধ্যে চলছে চরম হাহাকার, মারাত্মক হাহাকার। কেন সে বুঝতে দেরী করলো, নাশিদকে সে একান্ত ভাবে চায়? কেন আগে উপলব্ধি করেনি? এমন হবে জানলে সে আগেই নাশিদকে তার জীবনে প্রবেশ করাতো। সব তো ঠিকই ছিলো তাহলে কেন সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো?
নাশিদের মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভাসছে আর প্রতিনিয়ত ভেতরটা পুড়ছে, ভয়াবহভাবে।
রথির কাঁদতে কাঁদতে পুরোটা দিন চলে গেলো। খাবারটা আগের জায়গাতেই পরে রইলো।

সন্ধ্যায় মার্জান যখন চাচীর কাজে হাত লাগাতে ব্যস্ত তাতান তখন চুপিচুপি রুমে গিয়ে রথির ফোনটা নিয়ে অন করলো। অতঃপর ডায়াল লিস্টে ‘পুলিশম্যান’ নামটা দেখে তাতান কিছু না ভেবেই সেই নম্বরে কল দিলো। দুই তিনবার রিং হতেই তাতান চটজলদি বলতে লাগলো,

-‘আমার ফুপ্পিকে ওরা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে, আমার ফুপ্পি অনেক কান্না করছে!’

বাকি কথা বলার আগেই তাতান তার মায়ের আসার শব্দ পেলো। সে জলদি কল কেটে ফোন বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিলো।
রাতে ভাবী আরেক দফা খাবার দিতে এসে দেখে রথি আগের খাবারই খায়নি। ভাবী তপ্তশ্বাস ফেলে খাবারটা দিয়েই চলে গেলো। আগের খাবারটা সে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। রথি খাবারের দিকে একমনে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আপনমনে বলে উঠলো,

-‘যেখানে মনের সুখ নেই সেখানে এই খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না গো ভাবী! নাশিদ আপনি কোথায়? আমার কথা কী একটু মনে পরছে না? একটু আমার বাসায় গিয়ে আমার খবরটা নিয়ে আসুন। পারছি না আর! পুরো একটা দিন কেটে গেলো! এর মানে কী আবিরকে আমার…’

আর ভাবতে পারলো না রথি, কেঁদে উঠলো। আজ যদি বাবা থাকতো তাহলে হয়তো এমন কিছু হতো না। বাবা থাকলে হয়তো কারো এসব করার স্পর্ধাও হতো না। এসব ভেবে কাঁদতে কাঁদতেই রথি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেলো।

মাঝরাতে হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দ পেলো। সেই শব্দতেই রথির ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। পিটপিট করে তাকাতেই কোনো মানুষের অবয়ব দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গেই রথির ঘুম পুরোপুরিভাবে কেটে গেলো। রথি চোখ গোলগোল করে অবয়বটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। অবয়বটি ধীরে ধীরে রথির দিকে এগিয়ে আসছে। রথি যেই চিৎকার দিবে অবয়বটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-‘চেঁচাবেন না। আমি আবির!’

কন্ঠস্বর শুনে রথি শান্ত হলেও পরবর্তীতে দ্বিধা তৈরি হলো তার। আবির এতো রাতে এই রুমে কেন এসেছে? আবিরের খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই তো? রথি কাঁপা গলায় বলে,

-‘কেন এসেছেন এই অসময়ে?’

-‘ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি!’

-‘সাহায্য? কিসের?’

আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। অতঃপর থমথমে গলায় বলা শুরু করলো,

-‘দেখুন কোনো এক সময় আপনাকে পছন্দ করলেও এখন একজনকে ভালোবাসি। তখন হয়তো ভালোবাসা এবং পছন্দের পার্থক্য বুঝতাম না। তবে এখন বুঝি, উপলব্ধি করি। আমি আপনার বান্ধুবিকে ভালোবাসি রথি তাই আমিও এই বিয়ে করতে চাই না। মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন।’

-‘তাহলে এখন উপায়? এই বিয়ে হলে দুটো জীবন চোখ বুজে শেষ হয়ে যাবে!’

-‘আমি তো সেজন্যই এলাম। আমি আপনাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। আপনি চলে যান, মায়েরা এখন ঘুমাচ্ছে। এখনই সুযোগ। আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি, আপনি খুব শীঘ্রই মেইন রোডে যেতে পারবেন। আর কিছু টাকাও..’

-‘টাকার চিন্তা করতে হবে না। আপনি শুধু আমায় এখান থেকে বের করুন!’

আবির মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং রথিকেও উঠতে বললো। রথি উঠে দাঁড়ালেও ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যেতে নেয় তবে সে নিজেকে সামলে নেয়। সারাদিন এভাবে না খেয়ে, কান্না করে কাটানোর ফলই হয়তো এটা! রথি কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে আবিরের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। নিচে নামতেই আবির পথ বুঝিয়ে দিলো এবং রথির মোবাইলটাও এগিয়ে দিলো।

-‘আমি আগে ভাগেই তাতানকে দিয়ে আপনার ফোনটা নিজের কাছে রেখেছিলাম। আপনি এটা নিয়ে যান!’

রথি ফোনটা নিয়ে আবিরকে ধন্যবাদ জানালো। এই আবির না থাকলে সে যে এভাবে পালাতে পারতো না। রথি আবিরকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো। আর আবির নাফিসাকে কল করলো।

-‘রথিকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি নাফিসা, এখন আল্লাহ ভরসা!’

রথি দ্রুত ছুটতে লাগলো। সে এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে নাশিদের কাছে যেতে চায়। প্রাণপণে ছুটছে সে। মাঝেমধ্যে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলেও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। দিনের চেয়ে এই মাঝরাতটা পুরোই জনমানবশূন্য। সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন আর রথি নিজেকে বাঁচাতে ছুটতে ব্যস্ত। রাস্তা-ঘাট পুরো শূন্য। একটি গাড়ির চিহ্ন অবধি নেই। সেই রাস্তার মাঝে দিয়ে দৌড়ে চলেছে রথি। তার বারবার মনে হচ্ছে সে এই শহর ছাড়তে না পারলে ভাবী তাকে খুঁজে বের করে সত্যি সত্যিই আবিরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন সে আফসোস করবে কেন এই রাতে সে দ্রুত পালালো না। সারাজীবন আফসোস করার চেয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটে চলা ঢের ভালো। মাঝেমধ্যে রিস্ক না নিলে জীবনে অনেককিছুই খোয়াতে হয়, অনেককিছু।
রথির চোখের সামনে তার মায়ের চেহারাটা ভেসে উঠছে। ভাসছে তাদের সুখের সংসারের এক চিত্র। যেখানে বাবা-মা, ভাইয়া, রথি সবাই।
এসব ভাবতে ভাবতেই রথি যখন অদূরে মেইন রাস্তা দেখতে পেলো তখন খানিক থেমে হাঁপিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। অতঃপর আবার ছুটতে লাগলো। যখনই সে মেইন রাস্তায় উঠবে তখনই বাম পাশ থেকে একটা গাড়ি এদিকে আসতে লাগলো। গাড়িটি রথির খুব কাছে, খুব। রথি ভয়ে চিৎকার দিয়ে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো।

নাশিদ দৌড়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো। তার সঙ্গে নয়নও নামলো। রথির গায়ে লাগার আগেই নয়ন গাড়ি থামিয়ে ফেলেছিলো। নাশিদ ছুটে রথির সামনে আসতেই রথিকে বুকে টেনে নিলো এবং রথির গালে আলতো চড় দিতে লাগলো।

-‘এই রথি, রথি? এই? কী হলো? কথা বলছো না কেন? নয়ন! ও কেন কথা বলছে না?’ বিচলিত হয়ে বললো নাশিদ।

-‘স্যার শান্ত হোন। ম্যাম জ্ঞান হারিয়েছে, তাকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।’

নাশিদ আর ভাবতে পারলো না। রথিকে কোলে নিয়ে সে পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। নয়নও দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সারা রাস্তাতেই নাশিদ রথিকে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলো কিন্তু রথি কোনো সাড়াই দিলো না।

—————————-

-‘দেখুন মি. নাশিদ, উনি ভয় পাওয়ার কারণে জ্ঞান হারালেও মানসিকভাবে উনি অনেকটা দুর্বল। আই থিংক পেশেন্টের উপর অনেক মানসিক চাপ তৈরি করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কোনোটাই উনি ঠিকমতো করেননি।’
নাশিদ চুপ করে শুনলো কিছু বলার উত্তর পেলো না।

-‘এখন করণীয় কী ডক্টর?’

-‘আপাতত ওনার স্যালাইন করছে আর উনি এখন ঘুমাচ্ছে। ওনাকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে, কোনোরকম চাপ বা হতাশা থেকে বিরত রাখতে হবে। এই ধরণের মেন্টালি স্ট্রিস কোনো মানুষের জন্যই কল্যাণকর নয়।’

নাশিদ তপ্তশ্বাস ফেলে উঁকি দিয়ে রথিকে দেখলো। রথি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here