হৃদপূর্ণিমা পর্ব -২৬

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২৬ |

সেই ঘটনার পর থেকে নাশিদ মনিকার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া সামনাসামনিও হয় না। এতে মনিকার খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নাফিসাকে নিয়ে খুশি। তবে নাফিসাও মনিকাকে আগের মতো রেসপেক্ট করে না। নিজের ভাইকে চোখের সামনে গুটিয়ে নিতে দেখছে সে, সেখানে মনিকার সামান্য চিন্তাটুকুও নেই যা নাফিসাকে অসন্তুষ্ট করেছে। তাও সে মুখে কোনকিছুই প্রকাশ করে না। অর্পিতা নাশিদের বিয়ের কথা শুনে পরেরদিনই চলে যায়। নাশিদের সকলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হলেও সে মনিকার দিকে ফিরেও তাকায় না। একপ্রকার দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। মনিকা নাশিদের ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও সে ডিরেক্ট বলে দিয়েছে রথির মতো সমাজছাড়া মেয়েকে সে এই বাড়ির ছায়াও মারাতে দিবে না। এতে নিয়মিত বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব চলছেই।

নাশিদ রথির সাথে তাদের বিয়ের রাতের ছবিগুলো দেখছিলো আর ভাবছিলো কীভাবে সে রথিকে তার বাড়ি তুলবে। তখনই নয়ন কিছু চিঠি নিয়ে হাজির হয়! নাশিদ কোণা চোখে নয়নের দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘হাতে ওগুলা কী?’

-‘লাভ লেটার স্যার!’ দাঁত কেলিয়ে বলে নাশিদ।

নাশিদের এবার গা জ্বলে উঠলো। নয়নের দিকে অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

-‘আমি এদিকে আমার সংসারের আগুন নিভানোর চিন্তায় আছি আর তুমি আছো এই থার্ডক্লাস চিঠি-পত্র নিয়ে? জলদি এগুলা নিয়ে বিদায় হও নয়তো গাল লাল হতে মিনিটও লাগবে না!’

নয়ন দাঁত কেলানো বন্ধ করে ভ্রুযুগল কুচকে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলো। নাশিদ মাথায় একটা চাপড় দিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দেয়। রথির কোচিং ছুটির সময় হয়ে এসেছে। নাশিদ দেরী না করে জুনিয়র অফিসারদের কয়েকটা ফাইল বুঝিয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে গেলো।
_________________________________

রথি ক্লাস সেরে টিচার্সরুমে আসতেই ফাহাদের মুখোমুখি হলো। ফাহাদ প্রথমেই অমায়িক হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

-‘ক্লাস কেমন হলো?’

-‘জ্বী ভালো।’

-‘আপনার মা ভালো আছেন?’

-‘সকালেই তো জিজ্ঞেস করলেন, এখন আবার..’

-‘ও সরি। রথি, তোমার সাথে আলাদাভাবে কথা বলা যাবে? আই মিন কিছু কথা বলতে চাই, একান্তে!’

রথির তখনই আতিক স্যারের দিকে চোখ যায়। আতিক স্যার ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। তার এদিকে খেয়াল নেই! রথি পরিস্থিতি সামাল দিতে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো,

-‘অন্য একদিন স্যার। আজ আমার তাড়া আছে!’

বলেই আর বিড়ম্ব করলো না৷ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দ্রুত উল্টোপথে পা চালালো। ফাহাদ স্যার সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। হয়তো রথির কথাগুলো বুঝতে তার খানিকটা সময় লেগেছে। রথির অবাক লাগছিলো এই ভেবে ফাহাদ স্যার একেক সময়ে একেক রূপ নেয়। যেমন কখনো ‘আপনি’ তো আবার কখনো ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। এই আপনি, তুমির সংমিশ্রণে রথির মনে নানা দুশ্চিন্তা খেলে যায়। ইদানীং নাশিদ নামক মানুষটা ব্যতীত কাউকেই বিশ্বাস করতে তার মন সায় দেয় না। প্রতিদিনের ফোনালাপে রথি, নাশিদের দূরত্বটা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে রথি এখন কিছুটা চিন্তিত। তার মা তার বিয়ের কথা বলছে আর এদিকে নাশিদের ঘাড়ের উপর এতো চাপ। নাশিদকে সে চেয়েও বলতে পারে না। মার্জান পরেরদিনই তার বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিলো। সারাদিন তাতানের চোখে জল ছিলো। ওদের সামলাতে আর নাশিদকে সামলাতে গিয়ে রথি বেশ হিমশিম খাচ্ছে। তাও দিনশেষে উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করছে উনি যেন তাকে সবটা সামলানোর ধৈর্য দেয়।

এসব ভাবতে ভাবতেই রথি কোচিং সেন্টারের বাইরে এসে দাঁড়ালো। মিনিটখানেকের মধ্যে পরিচিত গাড়ি এসে তার সামনে ব্রেক কষলো। রথি প্রথমে হতবিহ্বল হলেও পরমুহূর্তে চিনতে অসুবিধা হয় না। রথি ভাবনার মাঝেই তার কাক্ষিত পুরুষটি গাড়ি থেকে নেমে রথির সামনে দাঁড়ায়। নাশিদকে দেখে রথির ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। নাশিদ বিনাবাক্যে রথিকে জড়িয়ে ধরলো। রথিও পরম আবেশে চোখ বুজে নাশিদের বুকে লেপ্টে রইলো। পরক্ষণে রথি নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,

-‘পাবলিক প্লেস এটা! কী করছেন এসব?’

-‘ভুল কী করলাম? আনম্যারিড কোনো মেয়েকে তো জড়িয়ে ধরিনি! ইউ আর মাই ওয়াইফ! চাইলে মসজিদে মাইক দিয়ে সবাইকে ঢোল পিটিয়ে বলে দিবো।’

-‘আপনি না…’

-‘জ্বী আমি-ই! আমি-ই আপনার পেয়ারি সোয়ামী!♥️’ রথির কথায় ফোড়ন কেটে বললো নাশিদ।

নাশিদের কথাগুলোতে রথি না হেসে পারলো না। তৎক্ষনাৎ কেউ পেছন থেকে বলে উঠলো,

-‘এই তাহলে তোমার তাড়া?’

রথি হকচকিয়ে পিছে ফিরে তাকালো। যা ভেবেছিলো তাই। ফাহাদ দাঁড়িয়ে আছে। নাশিদ ভ্রু কুচকে ফাহাদের উদ্দেশ্যে বললো,

-‘হু আর ইউ?’

-‘সেটা আপনার না জানলেও চলবে, জনাব। রথি, কতদিনের রিলেশন?’

নাশিদ রথির হাত ধরে দৃঢ় স্বরে বলে উঠলো,

-‘শি ইজ মাই ওয়াইফ! আপনি ওকে বারবার এসব বলছেন কেন?’

ফাহাদ যেন আকাশ থেকে পরলো। সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন ফাহাদ কোনো প্রকার পতিক্রিয়া দেখালো না তখন নাশিদ রথি হাত ধরে গাড়িতে বসালো এবং অজানা পথে রওনা হলো। আর ফাহাদ সেখানেই ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। শকটা একটু বেশি করেই বদহজম হয়েছে।

———————————

-‘ছেলেটা কে ছিলো?’

-‘আমার কলিগ!’

-‘ও আচ্ছা। থাক টেনশন নেই, তুমি তো আমার বউ তাই কেউ আর নজর দিবে না!’

-‘এতো প্রসেসিভ কেন আপনি?’

-‘নিজের জিনিস নিয়ে প্রসেসিভ হওয়া দোষের কিছু না।’

-‘তা হঠাৎ আমার কথা মনে পরলো?’

নাশিদ চট করে রথির কোলে মাথা রেখে বললো,

-‘প্রশান্তির জন্য!’

শহর থেকে নির্জন একটা দীঘির পাশে বসে আছে দুজন। নাশিদ সাধারণত এই জায়গাটা বেশ পছন্দ করে। তাই রথিকে নিয়ে চলে এসেছে। বড় বৃক্ষের আবস্তনে বসে শীতল হাওয়াও অনুভব করা গেলো সাথে প্রিয় মানুষটার সাথে কাটানো মুহূর্তটাও সুখে বিরাজমান রইলো। নাশিদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে থমথমে গলায় বললো,

-‘উনি আমার মা নন, রথি!’

রথি বিস্মিয়, বিমূঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো নাশিদের পানে। নাশিদের এই ছোট বাক্যটি-ই তাকে অধিকমাত্রায় ভাবিয়ে তোলে। রথি অস্ফুটস্বরে বললো,

-‘মানে?’

-‘সত্যি বলছি।’

বলেই নাশিদ একে একে সব সত্যি খুলে বললো নাশিদকে। মনিকার বলা কথাটাও জানালো। রথি মিনিটখানেকের মতো নীরবতা পালন করলো। অতঃপর স্মিত হেসে বলে,

-‘আমার বড় প্রাসাদের প্রয়োজন নেই পুলিশম্যান। আপনাকে সঙ্গে পেলে ছোট চিলেকোঠায় থাকতেও আমার কোনোরূপ দ্বিধা নেই!’

-‘কিন্তু আমি এখন কী করবো রথ? মা আমায় ডিরেক্ট বলে দিয়েছে তোমায় ঘরে তুলতে পারবো না। তুমি বাড়িতে প্রবেশ করলেই আগুন লাগাতেও পিছপা হবে না। রোজকার বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব, ঝগড়া দেখতে দেখতে আমি হাঁপিয়ে গেছি। শান্তির প্রয়োজন আমার রথ!’

-‘সব ঠিক হয়ে যাবে পুলিশম্যান! এতো টেনশন নিবেন না!’

আবারও কিছুক্ষণের জন্য দুজনের মধ্যে নীরবতা চললো। অতঃপর রথি তার নানান সংকোচ নিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

-‘ম…মা আমার বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছে।’

নাশিদ কর্ণকাচে এই বাক্যটি কড়াঘাত করতেই নাশিদ উঠে বসলো। মিনিটখানেক চিন্তা করে সে এক বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। নাশিদ থমথমে গলায় বলে উঠলো,

-‘আমি কালই তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছি। তোমায় নিয়ে আলাদা থাকবো, তাও রোজকার অশান্তিতে থাকতে চাই না। তুমি আমার হৃদপূর্ণিমা, আমার হৃদপূর্ণিমাকে আমি নিজের সাজানো স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যাবো। সে হোক বড় প্রাসাদ বা দুইরুমের দুইটি রুমের ফ্ল্যাট! সুখ তো আর প্রাসাদ দেখে আসে না।’

———————————

নাশিদের কথামতো সে এখন মায়ের সামনা-সামনি বসে আছে। নাশিদের পাশে আছে বাবা, নেওয়াজ ভাই এবং ভাবী। মা তাদের প্রস্তাব পেয়ে খুশিমনে রাজি হলেও আড়ালে সাইফকে জিজ্ঞেস করে,

-‘নাশিদের ব্যাপারে খোঁজ লাগা। যতোই হোক সে পুলিশ। শুনেছি পুলিশরা ঘুষ খায় বেশি!’

-‘নিশ্চিন্তে থাকো মা, আমি আগেই খবর নিয়েছি। এছাড়া নাশিদ যে খারাপ ছেলে তা তোমার এই কয়েক মাসের পরিচয়ে মনে হয়েছে?’

-‘নাহ! আদর্শ পরিবারের ছেলে-মেয়ে তারা। তাও মেয়ের মা বুঝিস-ই তো। চিন্তা থাকতেই পারে!’

নাশিদ যেন মায়ের সংকোচটা ধরতে পেরেছিলো। তাই সে মুচকি হেসে বললো,

-‘চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আমার আমানত এবং ভালোবাসা হয়েই থাকবে আজীবন। তার মায়াবী আঁখিতে কখনো জল আসতে দিবো না। কারণ আমি নিজেও জানি ওই চোখে কান্না নয়, চঞ্চলতা মানায়!’

সেদিনের কথায় মা এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলো যে তার চোখের কোণ ভিঁজে গেছিলো। সে নাশিদের হাতদুটো ধরে কান্না গলায় বললো,

-‘আমার মেয়েকে তোমার হাতে আমি চোখ বুজে তুলে দিতে রাজি আছি বাবা। আমার মেয়েটাকে সুখে রেখো!’

পর্দার আড়াল থেকে রথি সবটাই দেখছিলো। তার নয়ন অশ্রুসিক্ত! এই অশ্রুপাত দুঃখের নয়, বেদনার নয় শুধুমাত্র আনন্দের! কতো প্রতিক্ষার পর ভালোবাসার মানুষটাকে পুণরায় নিজের করে পাচ্ছে। এ চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে? সেদিনই রথি এবং নাশিদের এঙ্গেজমেন্ট হয়। বাবা এবং রথির মা মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আগামীকালই বিয়ের দিন ধার্য্য করা হবে। তাতান তো সেই খুশি। তার ফুপির বিয়ে খাবে বলে কথা!

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here