হৃদপূর্ণিমা পর্ব -২১

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২১ |

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এই কয়েকদিনে রথি যেন অতিরিক্ত জেদীতে পরিণত হয়েছে৷ রথি নাশিদের সঙ্গে অর্পিকে একদমই সহ্য করতে পারে না। এ নিয়ে রথি হুটহাট-ই রেগে যায়, নাশিদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। নাশিদ না পেরে রথিকে জিজ্ঞেস করে,

-‘তুমি এক্সেটলি কী চাচ্ছো?’

-‘বিয়ে করতে! বিয়ে না করে একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে রেখেছেন কেন? ওই চুন্নির জন্য? আপনি যদি আমায় বিয়ে না করেন তাহলে আমিও এই বাড়িতে থাকবো না!’

হ্যাঁ! বিয়ে বিয়ে করে রথি এখন নাশিদের মাথা খাচ্ছে। নাশিদ নিজেকে যথেষ্ট কান্ট্রোল করে বলতো তাকে কিছুটা সময় দিতে, সে মানসিকভাবে খানিকটা বিধ্বস্ত! কিন্তু রথি কিছু শোনার পাত্রী নয়। এখন নাশিদ পরেছে মহা ফ্যাসাদে! রথি তার গলায় এমনভাবে বেজেছে যে না পারে গিলতে, না পারে ফেলে দিতে।

নাশিদ রথির চিন্তা করতে করতে সবে বিছানায় শুয়ে তখনই নাফিসা দৌড়ে নাশিদের ঘরে এসে বললো,

-‘ভাইয়া, রথিকে খুঁজে পাচ্ছি না!’

নাশিদ লাফ দিয়ে উঠে বসলো এবং নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,

-‘কী বলছিস এসব?’

-‘সত্যি ভাই! রুমে না পেয়ে সারা বাড়ি খুঁজেছি ইভেন গার্ডেনে অবধি গিয়েছি। আমার ভয় করছে ভাই!’ ভয়ার্ত কন্ঠে বললো নাফিসা।

-‘তুই ঘরে যা৷ আমি দেখছি!’

নাফিসা বিনা-বাক্যে ঘরে চলে গেলো। নাশিদ নাফিসার কথাগুলো মনে করে। কী যেন ভেবে ছাদে চলে গেলো। যা ভেবেছিলো ঠিক তাই! রথি ম্যাম রেলিং এ হাতদুটো প্রসারিত করে চন্দ্রবিলাসে মগ্ন। এবার নাশিদের রাগ তার ধরা-ছোয়ার বাইরে চলে গেলো। নাশিদ লম্বা লম্বা পা ফেলে রথির কাছে গিয়ে রাগ দমিয়ে মৃদু সুরে বলে উঠলো,

-‘এখানে কী করছো?’

-‘আপনাকে বলতে বাধ্য নই!’ আনমনে উত্তর দিলো রথি।

নাশিদ রাগ দমাতে না পেরে রথির গায়ে হাত তোলার জন্য হাত উঠাতেই রথি চোখ-মুখ খিঁচে রইলো। নাশিদ চড় না মেরে নিজের মাথার পিছে হাত দিয়ে রাগ কান্ট্রোল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে রথি গালে কোনো স্পর্শ না পেয়ে রথি পিটপিট করে তাকালো। মুহূর্তেই তার চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। এই মানুষটা তার গায়ে হাত ওঠাতে নিচ্ছিলো ভাবতেই রথি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফোঁপানোর শব্দে নাশিদ পিছে ফিরে তাকালো। নাশিদ রথিকে ধমকে বললো,

-‘এই মেয়ে! কাঁদছো কেন? তোমায় কী আমি মেরেছি? এন্সা মি.. ড্যাম ইট!’

নাশিদের ধমকে রথির কান্নার স্বর আরও বেড়ে গেলো! নাশিদ দ্রুত রথির সামনে গিয়ে রথির মুখ চেপে ধরলো। যতোই হোক এখন রাত। রথির কান্নার শব্দ নিচে গেলে সর্বনাশ!

-‘সমস্যা কী? চুপ থাকতে বলেছি না?’ দাঁতে দাঁত চেপে বললো নাশিদ। রথি নাশিদের থেকে দূরে সরে বললো,

-‘আপনি অনেক খারাপ পুলিশম্যান! আপনি কথায় কথায় শুধু ধমকান! আমাকে খেয়ালও করেন না।’ কেঁদে হেঁচকি তুলে বললো।

নাশিদ পরেছে মহা ঝামেলায়। রথির এমন বিহেভিয়ার তার মাথা দিয়েই ঢুকছে না। হুটহাট রথি কেন পল্টি নিচ্ছে?

-‘তোমার খেয়াল কবে করিনি?’

-‘করলে বিয়ে কেন করছেন না?’

-‘উফফ! আবার সেই বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে! এই মেয়ে তুমি বিয়ে নিয়ে এতো মাথা ঘামাও কেন হ্যাঁ?’

-‘করবেন না তো বিয়ে? ঠিক আছে আমি চলে যাবো এখান থেকে। এই বাড়িতে আমি কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। যেখানে আমার নিজের পরিচয় নেই সেখানে থেকে আমি কী করবো? আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমার যথেষ্ট সেল্ফরেসপেক্ট আছে। শুধু আপনার জন্য, আপনার জন্য এতদিন চুপ করে ছিলাম। কারণ, মনে হতো ভালোবাসায় সব জায়েজ। কিন্তু এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি তো আমায় ভালোই বাসেননি শুধু দায়িত্ববোধ ভেবেছেন। আপনি থাকুন আপনার ওই অর্পি চর্বিকে নিয়ে!’

বলেই রথি চলে যেতে নেয় ওমনি নাশিদ ওর হাত ধরে আটকে নিজের কাছে টেনে নিলো। আবছা আলোয় নাশিদের রক্তিম মুখশ্রী দেখে রথি একটু না অনেকটা ঘাবড়ে গেলো। রথি মুখ দিয়ে টু-শব্দও করার সাহসটা পাচ্ছে না। নাশিদ অতি ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘তোর বিয়ে করা লাগবে তাইতো? তাহলে চল, তোরে বিয়ে করে, বাসর করে প্রমাণ দিয়ে দেই তুই আমার কাছে কী! তোর কাছে তো বিয়ে জরুরি, বিয়ের সাথে আফকোর্স বাসরও সংযুক্ত! এতদিন ভালো কথা বলে বুঝিয়েছি কিন্তু তুই তো ভালো কথা শোনার মানুষ না। ওয়েল, আমার খারাপটার সাথেই নিজেকে এডজাস্ট করে নে!’

বলেই রথিকে টেনে-হিঁচড়ে ছাদ থেকে নামিয়ে আনলো। এদিকে রথি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে নাশিদের হাত থেকে ছাড়ানোর কিন্তু নাশিদ যে এখন ক্ষ্যাপা বাঘ হয়ে গেছে। রথিকে সে কিছুতেই ছাড়ছে না। নাশিদ কোনো দিকে না তাকিয়ে সদর দরজা খুলে রথিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মনিকা তখন পানি খেতে ডাইনিং এ এসেছিলো। ধস্তাধস্তির শব্দে সে সদর দরজার দিকে তাকায়। কিন্তু আবছা আলোয় বুঝতে পারলো না ওরা কারা। সে দ্রুত হেঁটে সেই অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ওরা চলে যায় গাড়ির গ্যারেজে।
মনিকা কাউকে না পেয়ে সেও বেরিয়ে আসে। নাহ কাউকে পেলো না। হতাশ হয়ে মনিকা ভেতরে চলে আসে।

-‘দেখেন! পাগলামি করবেন না! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায় এতো রাতে?’

-‘কেন তোকে বিয়ে করতে? তুই না বিয়ের জন্য হাঁপাচ্ছিস! তোর বিয়ে করার সখ মিটিয়ে দিতে হবে না?’ নাশিদ ড্রাইভিং করতে করতে বললো। নাশিদের তুই-তুকারিতে বেশ বোঝা যাচ্ছে রাগ এখনো কমেনি। রথি মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডাকছে। এখন সে কী করবে? এভাবে বিয়ে তো সে চায়নি! চাওয়া তো দূরে থাক কল্পনাও অবধি করেনি।
নাশিদ ড্রাইভ করতে করতে ফোনে কিসব করলো। মাঝরাত হওয়ায় রাস্তা প্রায় ফাঁকা। রথি অনেক ভাবে নাশিদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু নাশিদ তার বুঝের সীমানার বাইরে আছে। মহা কেলেঙ্কারি লাগছে এই নাশিদকে। অবশেষে ওরা থানায় পৌঁছালো।
নাশিদকে থানার সামনে গাড়ি থামাতে দেখে রথি খানিক বিস্মিত হলো। রথি ভাবনা-চিন্তা করার আগেই নাশিদ তাকে টেনে-টুনে গাড়ি থেকে নামিয়ে থানার ভেতর নিয়ে গেলো। নাশিদ সোজা তার কক্ষে ঢুকে পরলো। সেখানে নয়নসহ নাশিদের দুজন বন্ধু আর কাজী সাহেব রয়েছে।
কাজী ঘুমে ঢুলছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাজীকে তার বাসা থেকেই তুলে আনা হয়েছে। কাজীও মুখে কুলূপ দিয়ে আছে কারণ, যতোই হোক পুলিশের বিয়ে। পুলিশের অমতে যাওয়া মানে নিজের প্রাণভোমরা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। রথি নাশিদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো দেখে নাশিদ রথিকে দেয় এক ধমক।
সেই ধমকে কাজী লাফিয়ে উঠে আর চোখের চশমা ঠিক করে এদিক সেদিক তাকিয়ে ভয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,

-‘কার বিয়ে পড়াবো? কে কাবিননামায় স্বাক্ষর করবে?’

নাশিদ রথিকে একটি চেয়ারে বসার উদ্দেশ্য করে বললো,

-‘বসো!’

রথি ঘাবড়ে বসে পরলো। নাশিদও রথির পাশে বসে বসলো। নাশিদ রথিকে একটু খেয়াল করতেই দেখলো রথির মাথায় কাপড় নেই। নাশিদ রথির মাথায় ওড়না জড়িয়ে দিলো। যা দেখে রাতে ডিউটিরত কয়েকজন মহিলা পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে হাসছিলো। নাশিদ এবার কাজীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘বিয়ে পড়ানো শুরু করুন!’

কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। একপর্যায়ে সে বলে উঠলো,

-‘আপনাদের কাগজপত্র ছাড়া বিয়ে হবে কী করে?’

নাশিদ একপলক রথির দিকে তাকালো। অতঃপর নাশিদ বললো,

-‘আপনার যা যা জানার আমাদের বলুন উত্তর দিচ্ছি। আপাতত কাগজপত্র নিয়ে আসিনি আমরা।’

-‘কিন্তু কাগজপত্র ছাড়া…’

-‘ওটা সময়মতো আপনার বাসায় পৌঁছে যাবে! আর কিছু? এখন যা করার জলদি করুন!’

কাজী আর কিছু বলার সাহস পেলো না। যাবতীয় কিছু প্রশ্ন করলো আর দুজন উত্তর দিলো। অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো। রথির চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। বিয়েটা যেভাবেই হোক, সে তার ভালোবাসাকে পবিত্ররূপে পেয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? রথি প্রশান্তিতে চোখ বুজে ফেললো। বিয়েটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা ঝড় বইলেও এখন সবকিছু কেমন শান্তি, শান্তি লাগছে। রথি যেন হাওয়ায় ভাসছে।
নাশিদ কাজীর সাথে কথা বলে কাবিননামা নিয়ে নয়নদের সাথে কথা বললো। নাশিদের এক বন্ধু হেসে বললো,

-‘তুই আর শোধরালি না! সেই কলেজ লাইফের মতো রাত করে ডেকে পাঠালি। তবে যাই বলিস, তোর বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পেরেছি এ-ই অনেক। বিয়ে মোবারক বন্ধু!’

বলেই নাশিদকে হাগ করলো। নাশিদ ওদের সঙ্গে কথা বলে রথির কাছে গেলো! রথিকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাশিদ বলে উঠলো,

-‘কী হলো? যাবে না, নাকি নিজের বাসর এই থানাতেই করার ইচ্ছে?’

রথি চোখ গরম করে নাশিদের দিকে তাকালো। তখন থেকে বাসর বাসর করেই চলেছে। শালা ঠোঁটকাটা খচ্চর পুলিশ! বিয়ে শেষ পর্যন্ত তার এই থানাতেই লিখা ছিলো? রথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-‘বিয়ে করার জন্য আর কোনো প্লেস ছিলো না? থানাই কেন?’

-‘সবাই তো কাজী অফিস গিয়ে বিয়ে করে, আমি নাহয় ইতিহাস বদলে দিলাম। হলো না, একটা ইউনিক বিয়ে? আমার নাতি-নাতনীদের গল্প শোনাবো, তাদের দিদুনকে থানায় বিয়ে করেছি!’

-‘কচু! সরেন সামনে থেকে!’

নাশিদ খপ করে রথির হাত ধরে বলে,
-‘সরি, এখন আমরা বাসায় যাচ্ছি!’

বলেই নাশিদ নয়নদের থেকে বিদায় জানিয়ে রথিকে নিয়ে চলে গেলো। ভোর পাঁচটায় ওরা বাড়ি পৌঁছালো। নাশিদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিলো তাই বাড়িতে ঢুকতে খুব বেশি অসুবিধা হলো না। বাড়িতে সাবধানে ঢুকে যে যার মতো ঘরে চলে গেলো।

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here