হৃদমাঝারে পর্ব -০৪+৫

#হৃদমাঝারে – [০৪+০৫]

৪,
কফিশপে একটা মেয়েকে দেখে হা হয়ে যায় পলাশ। গালে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। ওর সামনে বসে আছে ফারহান। ফারহান কফি খাচ্ছে আর মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। খানিকক্ষণ বাদে মোবাইল থেকে মাথা তুলে যখন পলাশের দিকে তাকায় ফারহান তখন লক্ষ্য করে পলাশ অবাক হয়ে কিছু দেখছে। পলাশের দৃষ্টি অনুসরণ করে ফারহান ও তাকায় সেদিকে। তখন ওর দৃষ্টি পরে একটা মেয়ের উপর। দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। ফারহানের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো মেহরিমা।
– স্যার, আপনি চিনেন এই ফুলপরিকে?

– ফুলপরি। একটু অবাক হয়েই জিগ্যেস করলো ফারহান।

-হ্যা। ওকে দেখে তো আমার দিলে প্রেমের রেডিও বেজে উঠেছে। স্যার একটু লাইনটা করে দিননা।

পলাশের কথা শুনে অধর চেপে হাসে ফারহান। অতঃপর বলে,

– তুমি চাইলে লাইনটা করতেই পারো। তবে এতে আমার কোন সাহায্য পাবে না। আর আমি তোমাকে মানাও করবো না। তারপর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে,

-এবার আমাদের যাওয়া উচিৎ। তুমি চাইলে থাকতে পারো। আড় চোখে মুনের দিকে তাকিয়ে বলল ফারহান। পলাশের এই দৃষ্টি বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে মুনের দিকে তাকালো। আর ফারহান সে ততক্ষণাৎ সেখান থেকে প্রস্থান করলো। পালশ উঠে মুনের দিকে পা বাড়াবে তখনি একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে। ছেলেটাকে দেখে মুনের ঠোঁটে আপনাআপনি হাসি ফুটে উঠে। আর সে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে। ছেলে মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

– কেমন আছিস পাগলী?

মুন ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

– তোকে ছাড়া ভালো থাকি কেমনে বলতো।

তারপর দুজনে দুই চেয়ারে বসে কথোপকথন করতে লাগলো। আর এদিকে ছেলেটাকে দেখে পলাশ দাড়িয়ে পরেছে। ওর মাথায় এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটা কে? এদিকে ছেলেটার সাথে মুন হেসে কথা বলছে। হঠাৎ ছেলেটার একটা কথায় মুনের হাসি থেমে যায়।

– বাড়ি ফিরছিস কবে?

– কোন বাড়ি?

– তোর নিজের বাড়ি।

– আমার কোন বাড়ি নেই। আমি একজন আশ্রিতা। যে অন্যের আশ্রয়ে বেঁচে আছে।

– এভাবে কেন বলছিস তুই।

– তুই কেন বুঝতে পারছিস না আমি ও বাড়িতে যেতে পারবো না। যতদিন না ওই লোকটাকে আমি শাস্তুি দিতে পারবো। ওনার ভালোমানুষি মুখোশ আমি সবার সামনে খুলে ফেলবো। তারপরেই আমি ও বাড়িতে পা রাখবো। যদিও আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই।

– এভাবে কেন বলছিস মুন। বারবার ওই লোকটা বলে সম্বোধন কেন করছিস। বাবা হয় তোর।

– বাবা, তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো মুন। তারপর বলল, কবে সে আমার বাবা ছিলো। বলতে পারবি, বাবা হওয়ার কোন দায়িত্বটা পালন করেছে ওই লোকটা। উনি কারো বাবা হতে পারেন না। না হতে পেরেছে ভালো বাবা আদর্শবান স্বামী এবং সুসন্তান। কি করেন না ওনি। মেয়ে পাচার থেকে শুরু করে জাল ওষুধের ব্যবসা। নিজের কুকর্ম ঢাকতে গিয়ে নিজের মাকে খুন করলেন। অথচ উনার সব কুকীর্তির দায় এসে পড়লো আমার গায়ে। একটা নবজাতক কি করে কারো প্রান নিতে পারে। একটা কেউ ভাবে নি। এমনকি যে আমাকে জন্মদিলো সেও ভাবে নি। আমি ইমরান খানের শেষ দেখেই ছাড়বো। রাগে হাত দুটো মুষ্টি বন্ধ করে নিল মুুন। অপর পাশে থাকা ছেলেটা মুনের হাতের উপর হাত রাখল অতঃপর বলল,

– ওকে, ওকে কাম ডাউন। এত হাইপার কেন হসছিস।

মুন তার চক্ষুদ্বয় বন্ধকরে নিলো। বেশ জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে এখনি ঝড় উঠে আসবে। ছেলেটার দিকে চোখ মেলে তাকাতেই সে বলে উঠলো,

– আংকেল, ভদ্র মুখোশের আড়ালে থাকা একটা শয়তান।

– তুই বিশ্বাস করিস আমাকে?

– নিজের থেকেও বেশী।

মুন আর কিছু বলে না সে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। আর ছেলে মুনের একহাত জড়িয়ে ধরে মুনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর এদিকে পলাশ ভাঙা মন নিয়ে বুকের পা পাশে তার হাতটা রেখে চেয়ারে বসে পরে। নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়। এই তুই নাকি বসন্তের প্রতীক। তাহলে তোর জিবনে বসন্তের আগমের আগেই কেন গ্রীষ্মের কালবৈশাখী ঝড়ের আভাস এলো। কে এই ছেলেটা। ফুলপরির সাথে ছেলেটার সম্পর্ক কি? কেন তারা একে অপরের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে। না আর কিছু ভাবতে পারছে না পলাশ। স্যারকে জানাতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফারহানকে কল করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

– স্যার, মাই হার্ড ইজ ব্রোকেন।

– মানে?

– স্যার ফুলপরির বয়ফেন্ড আছে। সে এখন তার সাথেই আছে। আমি কি করবো?

– ওয়েট আমি আসছি। কল কেটে দেয় ফারহান। আর পলাশ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে মুন আর সেই ছেলেটা দুইজনেই কফি খাচ্ছে। ছেলেটা এবার বলে উঠলো,

– এত নার্সিংহোম থাকতে আংকেলের নার্সিংহোমে তোকে জয়েন করতে হলো। তুই ভালো করেই জানিস ওখানে তোর বিপদ অনিবার্য।

– পারবে না। ইমরান খান আমার কোন ক্ষতি করবে না। আমার কাছে যতদিন ওই ভিডিওটা আছে ততদিন সে আমার কোন ক্ষতিই করবে না।

– সাবধানে থাকিস। আমার তো খুব ভয়ই হচ্ছে তোকে নিয়ে।

– ধর পাগল আমার কিচ্ছু হবে না। তাছাড়া আংকেল ও তার দলবলতো আছেই। তারা আমাকে ঠিক প্রটেক্ট করবে।

– আমারও বাবার উপর বিশ্বাস আছে।

এদিকে ছেলেটার সাথে মুন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কখন যে ফারহান এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই নেই কারোর। ফারহান তখন মুনকে দেখে কফিশপের বাইরে চলে গিয়েছিলো। আবার পলাশের কল পেয়ে ভিতরে আসে। মুনের সাথে ছেলেটাকে দেখে স্মিত হাসে সে। তারপর তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুনের যখন মনে হলো কেও ওদের দেখছে তখন সে পাশ ফিরে তাকায়। আর ফারহানকে দেখে বড়সড় শক খায়। ছেলেটাও ওকে দেখে বেশ অবাক হয়। অধোরে স্মিত হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে হাতটা বাড়িয়ে দে হ্যান্ডশেক করার জন্য। কিন্তু ফারহান সে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকে মুনের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসি অতঃপর বলে,

– এখনো সত্যিটা স্বীকার করবে না। অবশ্য তোমাদের কাছ থেকে সত্যি কথা আশা করাই ভুল। মিস্টার আকাশ তালুকদার কোথায় ছিলে এতদিন? নাকি মেহরিমার সাথে সাথে তুমিও লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলে।

– তুমি ভুল করছো ফারহান। এখনো সময় আছে সত্যিটা তুমি নিজে খুজে বের করো।

– কোন সত্যি কিসের সত্যি হ্যা। কি খুজে বের করবো। আমার রুচি এতটাও খারাপ নয় এরকম একটা থার্ড ক্লাস চরিত্রহীন মেয়ের বিষয়ে জানার কোনো আগ্রহ নেই আমার। কথাগুলো বলেই মুনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে যায় ফারহান। আর পলাশ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের চলে যাওয়ার দিকে।

– এটা ফারহান? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আকাশ।

– এটা ক্যাপ্টেন ফারহান। গ্রামে আমার সেই ফারহান আর আজ ক্যাপ্টেন ফারহানের সাথে আকাশ পাতাল তফাৎ। বড় করে শ্বাস ফেলে মুন। আর আকাশ তাকিয়ে থাকে মুনের মুখের দিকে।

রাতে বেলকনিতে বসে চাঁদ দেখছে মুন। বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। ফারহানের এমন রুড আচরন সে মানতে পারে না। ও কথাগুলো যে মুনকে কতটা পুড়ায় সেটা কি জানে না সে। তাহলে কেন? কেন ফারহান ওকে এতটা কষ্ট দেয়। হ্যা মানছে আমার ভুল হয়েছে তাই বলে কত শাস্তুি দিবে। ছয় বছর কি কম সময় ছিলো। কেন ফারহানের রাহ কমেনা। আকাশ পানে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিলো মুন। রাতের আধার নামার সাথে সাথে ক্লান্ত শহর টা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। মাথার উপরে থাকা চাঁদ ও তাকে ঘিরে থাকা চন্দ্র গুলোর আলোয় আলোকিত হচ্ছে যেন পুরো শহর। বেলকনি ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে আর তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিলে আকাশের নাম দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো সে। বন্ধুরা বোধহয় এমনি হয়। সবাই ছেড়ে চলে গেলে বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে থাকে। মুন কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো একটা মিষ্টি সুর।

– মন খারাপ করে বসে আছিস তাইতো?

– নারে। ভাল্লাগছে না কিছু।

– ফারহানকে সত্যিইটা জানিয়ে দেয়।

– ও বিশ্বাস করবে না আমায়। বলবে আমি আবার নাটক করছি। আবার অপমান করবে।

ওপাশ থেকে কিছু বলল না। দুজনেই চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর আওয়াজ এলো,

– কাল নার্সিংহোমে যাচ্ছিস?

– হুম।

– তাহলে দেখা হচ্ছে। এখন রাখি।

আকাশ কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। আর মুনের ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া ওর বুকের মাঝে একরকম ঝড় তুলে দিয়েছিল। তাই তাড়াতাড়ি কলটা কেটে দিলো।

পরেরদিন নার্সিংহোমে আকাশ আসে। মুন ওর সাথে প্রায় সারাটাদিন কাটিয়ে দেয়। হঠাৎ ওর একটা কাজ পরে যাওয়ায় ও চলে যায়। দিন শেষে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছে মুন। এমন সময় একটা গাড়ি ওর সামনে দিয়ে ফুল স্পিডে চলে যায়। যার ফলে রাস্তায় জমে থাকা ময়লা পানি গিয়ে পরে মুনের গায়ে। মুন চিৎকার করে উঠলে গাড়িটা ব্রেক করে। গাড়িয়ে ভিতর থেকে একটা যুবক নেমে আসে যাকে দেখে মুনের রক্তচক্ষু নিমিষেই শীতল হয়ে যায়।

#হৃদমাঝারে – [০৫]

ফারহানকে এগিয়ে আসতে দেখে মুনের চক্ষু শীতল হয়ে যায়। সে নির্বিকায় তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। ফারহান মুনের কাছে এসে পকেটে হাত গুজে দাঁড়ায়। তারপর মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। মুন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। তবে কি ফারহান ইচ্ছে করেই ওর গায়ে কাদা ছিটিয়ে দিয়েছে। মুন মৃদু সূরে বলল,

– আপনি এখানে?

ফারহান মুনের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না ওকে পা থেকে মাথা অব্দি অবলোকন করে মৃদু হেসে প্রস্থান করে। ফারহানের মনে আজ কিছুটা হলেও শান্তি মিলেছে। মুন শুধু তাকিয়ে থাকে ফারহানের চলে যাওয়ার দিকে। এটা কি ফারহান নাকি অন্যকেউ?

রনি তার মেয়ে ও বউকে নিয়ে মার্কেটে এসেছে। অনেক দিন হলো অনন্যার কিছু কেনা হয়না। আসলে রনি সময় খুব একটা পায়না। ভালো কাজ করলে মানুষ সময় পায় কিন্তু যারা অন্যায় করে ভুল পথে উপার্জন করে তাদের প্রতিটা কাজই রিক্স, সময় স্বল্প। সময়ের অভাব। আবার সে অনন্যাকে একা ছাড়তেও ভয় পয়। যদি অনন্যা তাকে ছেড়ে চলে যায়। অনন্যাকে যে ভালোবেসেছে রনি। কিন্তু অনন্যা সে দিন দিন রনি ওর মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভালোই ছিলো পাচ বছর আগে যখন অনন্যার সাথে রনির বিয়ে হয়। গ্রামের মেয়ে অনন্যা। চাকরির সন্ধানে সে এসেছিল শহরে আর সেই সূত্রেই দেখা হয় রনির সাথে। তারপর দুজনের মধ্যে প্রনয়ের সম্পর্ক ও বিয়ে। বিয়ের প্রথম বছর ভালই কাটছিল তাদের জিবন। মিষ্টি আসে তাদের কোল জুড়ে। খুব খুশি ছিল প্রথম ছয় মাস খুব ভালো কাটছিল তাদের সংসার। কিন্তু তারপর থেকে বদলে যেতে লাগল রনি। রোজ রাতে ড্রিংক করে বাড়ি ফেরা অন্য মেয়েদের সংস্পর্শে যাওয়া। অনন্যা রনির হঠাৎ বদলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিল না বারবার জানতে চেয়েছিল কেন হঠাৎ করে বদলে গেল রনি। কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে ওর সামনে এমন কিছু সত্য আসে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় অনন্যা। ঘৃণা করতে শুরু করে রনিকে। রনির থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইলেও সেটা হতে দেয় না রনি। যেহেতু মিষ্টি রনির অংশ নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রনির বাবা মা অনন্যার এই ব্যাপার নিয়ে কথা বললে সে তাদের সোজাসাপ্টা বলে দেয়, অনন্যাকে নিয়ে কোন কথা বললে তবে সে তার বউ বাচ্চা নিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। শাড়ির দোকানে চুপচাপ বসে আছে অনন্যা আর রনি মিষ্টি দুজনে মিলে শাড়ি চুজ করছে। কিন্তু মিষ্টির কোন শাড়িই পছন্দ হচ্ছে না। তাই সে তার বাবাকে নিয়ে অন্য দোকনে চলে যায়। অনন্যা এখানে একা বসে থাকে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরেই যখন রনি ফিরছিলো না তখন অনন্যা বাহিরে গিয়ে হাটতে থাকে। আর তখনি তার সাথে দেখা হয় একটা মেয়ের। জিন্স প্যান্ট আর কুুর্তির পরে গলায় উড়নাটা পেচিয়ে রেখেছে। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে এপ্রোন। তার পাশেই আছে একটা ছেলে যে মেয়েটার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসছে। অনন্যার মনে হলো এরা দুজন ভালেবাসার মানুষ। তাই তার চোখটা ছলছল করে উঠলো। রনির সাথে যে তার এমনও হাজর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পরক্ষনেই মনে হলো রনি তাকে ঠকিয়েছে। চোখ বন্ধকর কোন রকমে চোখের জল আটকে নেয় অনন্যা। ছেলেমেয়ে দুটো এদিকেই আসছিলো। হঠাৎ অনন্যার মুখোমুখি হতেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে যায়। আসলে অনন্যার এমন নিঃপাপ মুখের মায়ার পরে যায় মেয়েটা। তারপর স্মিত হেসে মেয়েটা চলে যায়। অনন্যা শুধু তাকিয়ে থাকে মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে।

– বলছিতো আমার কিছু লাগবে না, তবুও কেন এত জেদ করছিস আকাশ?

– লাগবে না মানে কি? রোজ রোজ তো এই একই জামাকাপড় পরে হসপিটালে যাস।

আকাশ মুনের জন্যে টপজিন্স আর কয়েকটা শার্ট বেছে নিলো।

– এগুলো কার জন্যে নিচ্ছিস তুই?

– তোর জন্যে। এগুলোতেই তোকে বেশী ভালো লাগে। ওয়েস্টার্ন ড্রেসে আরো ভালো লাগে।

– আকাশ। চোখ রাঙালো মুন। তারপর আকাশের হাত থেকে ওগুলো নিয়ে নিজের পছন্দমতো কয়েকটা কুর্তী আর চুড়িদার কিনে নেয়।

দোকান থেকে বের হতেই আবার অনন্যার সাথে দেখা হয় মুনের। মুন পাশ কাটিয়ে চলে আসতে সামনের দিকে পা বাড়াতেই থমকে যায়। রাগে হাতদুটি মুষ্টিবদ্ব করে নেয়। সামনে থাকা আগন্তুক ও মুনকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। অতঃপর বলে,

– তুই এখানে? কবে ফিরলি?

– আজকাল আমার খোজ রাখতে ভুলে যাস নাকি। তাচ্ছিল্যের হাসি মুনের মুখে। মুনের কথা শুনে ছেলেটাও স্মিত হাসলো। তারপর ওর সামনে এগিয়ে এসে বলল,

– খুজার সুযোগ দিলি কোথায়? তার আগেই তো সামনে এসে হাজির। দেশে ফিরে ভালো করেছিস, এবার অন্ততপক্ষে আমাদের কাজটা হবে।

মুন কিছু বলল না শুধু হাসলো। যে হাসির অর্থ তোদের কাজের জন্যেই তো আমাকে ফিরে আসতে হলো। তারপর রনি মুনকে অনন্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। অনন্যাকে দেখে মুন বলেই ফেলল,

– গোবরে পদ্মফুল।

– হুম বলতে পারিস এটা।

মুন ভ্রু কুচকে অনন্যার দিকে তাকালো। এরকম একটা মেয়ে কি করে রনির সাথে সংসার করছে। মেয়েটাকে দেখে ভালোই মনে হচ্ছে তাহলে এ রনির সাথে কি করে নিজেকে মানিয়ে নিলো।

৪,
আজ শিকদার বাড়ি থেকে মেহমান আসবে মুনদের বাসায়। অর্ণা আর রওনাকের বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্যে। আবার আজই ওদের আকদ। সেই হিসাবে বাড়ি আজ পুরো জমজমাট। মুনের বাবা মা আসছে। মুন একবারও তাদের সামনে যায়নি। তারাও মুনকে ডাকে নি। তবে মুনের ছোট ভাই মিঠুর সাথে মুনের খুব ভাব। আজ প্রায় সারাটাদিন দুই ভাইবোন এক সাথে কাটিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে শিকদার ফয়সাল সাদিকের পুরো পরিবার চলে আসে ওদের বাসায়। ড্রইংরুমেই সকলের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর অর্ণাকে নিয়ে আসা হল ওদের সামনে। অর্ণা আজ আকাশী কালারের একটা শাড়ি পরেছে। মুন নিজের হাতে অর্ণাকে সাজিয়েছে।অর্ণা কে সাজিয়ে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে মুন এবার নিজে রেডি হচ্ছে। এদিকে সিকদার পরিবারের সবাই যখন খাওয়া-দাওয়া করছিল ঠিক তখন মিঠুর হাত লেগে ফারহানের গায়ে দই পরে যায়। ফারহান প্রথমে রেগে গেলে পরে পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে শান্ত করে নেয়। মিঠুর বাবা ইমরান খানের নির্দেশে মিঠু ফারহানকে নিয়ে ওপরে নিয়ে যায়। উপরে তিনটা রুম। একটা অর্ণার একটা মুনের আর একটা ফাকা পরে থাকে। মিঠু ফারহানকে নিয়ে ফাকা রুমটায় যায়। তারপর ওকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়। ওয়াশরুম থেকে ফেরার সময় কারো গুণগুণ করে গানের আওয়াজ আসে ফারহানের কানে। আওয়াজ এতটাই কম ছিলো যে গানের ভাষা বুঝতে পারছে না ফারহান। আচ্ছা গান গাইছে কে? কয়েক পা এগিয়ে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় ফারহান। দরজাটা হালকা ভেড়ানো ছিলো হাত দিতেই সেটা খুলে যায়। সামনে এগিয়ে আসে ফারহান। তার চোখ আটকে যায় ড্রেসিংটেবিলের সামনে থাকা একটা রমণীর দিকে। হোয়াইট ব্লাউজের সাথে নীল শাড়ি। একটা আশ্চর্য হলো ফারহান। কিন্তু তার চোখ শুধু দেখেই চলেছে আয়নাতে প্রতিবিম্ব এই রমণীটিকে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও থমকে যায় ফারহান। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। মুন ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খোপায় বেশী ফুলের মালা লাগানোর চেষ্টা করছে। কিছুতেই ঠিকমতো পেরে উঠছে না। এদিকে ফারহান কখন যে মুনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পরেছে সে খেয়ালই নেই। মুনের হাত থেকে মালাটা নিয়ে নেয়। মুন নিজের সাথে ফারহানের স্পর্শ পেয়ে কেপে উঠে। শরীর জুড়ে এক হীম শীতল শ্রোত বয়ে যায় তার। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। শরীরের রক্ত চলাচল মনে হয় বন্ধ হয়ে গেছে। হাত শক্ত মুঠি করে ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে সে। ফারহান একমনে মুনের মাথায় বেলী ফুলের মালা পড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর খোপায় মালা লাগানো শেষ হলে ফারহান মুনকে সামনের দিকে ঘুড়িয়ে নেয়। তারপর সে তাকিয়ে থাকে মুনের চোখের দিকে। মুন ফারহানের চোখে হাড়িয়ে যেতে চাইলেও পারলো না। সে মাথা নিচু করে নিলো। তারপর ওর থেকে কয়েকপা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ফারহান ভ্রু কুচকে ফেললো।অতঃপর বলল,

– হোয়াট হ্যাপেন্ড?

– আমি কিন্তু আপনার সংস্পর্শে যাইনি, আপনি এসেছেন। মাথা নিচু করে বলল মুন।

মুনের কথা শুনে ফারহানের কপালে কয়েকটা ভাজ পড়লো। পরক্ষনেই মনে হলো, সে এখন কোথায়? এখানে আসলো কি করে? ফারহানের এতক্ষণের দৃষ্টি আচরণ নিমিষেই বিলিন হয়ে চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠে। তারপর মুনের কাছে গিয়ে ওর হাত শক্তকরে চেপে ধরে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here