#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১৩)
সূর্যের প্রকোপে চারদিকের সবকিছু জ্বলসে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আজকের রোদ দেখে কেউ বলবে না যে দু’দিন প্রায় টানা বৃষ্টি হয়েছে। ভ্যাপসা গরমে সবার অবস্থা নাজেহাল। এর মাঝে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে শুভ্রতা। মাথার উপর সিলিং ফ্যানটাও যেনো গরম বাতাস দিচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে। পাশে ঠান্ডা পানির বোতল। থেকে থেকে খাচ্ছে। নিজেকে সিদ্ধ ডিমের মতো মনে হচ্ছে! মেঘ সেই সকালে অফিস গেছে,আর খবর নেই। আসতে আসতে সন্ধ্যা। শুভ্রতার কোনো কাজও নেই। শুয়ে,বসে থাকতে থাকতে সে বিরক্ত। কবে রেজাল্ট দিবে, কি রেজাল্ট হবে এইসব নিয়েই টেনশনে যাচ্ছে! তার উপর গরম,যেনো পাগল হয়ে যাবে। নিচে শোয়ার কারণে হাড়ে ব্যাথা পাচ্ছে তাই উঠে বসলো।
‘উফফ আমার জ্বালার শেষ নেই,গরমে নাজেহাল,আবার ফ্লোরে শুলে হাড়ে ব্যাথা পাই। আসলেই আমার পুষ্টির সমস্যা! উনি ঠিকই বলেন। না আর থাকতে পারবো না। এখন আবার গোসল করে একটা ঘুম দিতে হবে!’ নিজে নিজে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায় শুভ্রতা। উদ্দেশ্য গোসল করা। এর মাঝেই খাটের উপরে থাকা ফোন ভাইব্রেট করে উঠে। মেঘ কল দিয়েছে ভেবে হাত নেয় কিন্ত স্ক্রিনে ‘মা’ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। মেঘের মায়ের ফোন। শুভ্রতা হাতে থাকা জামাটা সাইডে রেখে ফোন কানে ধরে সালাম দেয়।
ওপাশ থেকে সালামের উত্তর আসে। শুভ্রতা নম্রভাবে জিজ্ঞাস করে,,’কেমন আছেন মা?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা কেমন আছো?’ মেঘের মায়ের বিপরীতে শুভ্রতাও ‘আলহামদুলিল্লাহ বলে!’ এরপর হাল জিজ্ঞাস করে মেঘের মা বলে,,’তোমাকে যে জন্য কল দিয়েছিলাম!’
‘জ্বি বলুন। কোনো সমস্যা হয়েছে আপনাদের?’
‘না আমাদের কোনো সমস্যা হয় নি। আমরা আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। আসলে আমার বোন তোমার বড় খালা শাশুড়ি তার ছেলে আভিয়ানের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের বৃহস্পতিবার। আমাদের সবাইকে দাওয়াত করেছে। কিন্ত তোমাদের বাবার স্কুলে পরীক্ষা চলছে। উনি যেতে পারবেন না। আর উনাকে একা রেখে আমিও যেতে পারবো না। তাই আমি চাই তুমি আর মেঘ যাও। না গেলে আপা ভীষণ কষ্ট পাবে!’
‘আচ্ছা মা। আমি আর আপনার ছেলেই না হয় যাবো।’ শুভ্রতার কথায় মেঘের মা মুচকি হেসে বলে,,
‘মা তুমি তো বললে যাবে। কিন্ত আমার ঘাড়ত্যাড়া ছেলে রাজি হলে তো যাবে। ও কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে যেতে চায় না। না পারতে জোর করে যায়। এখন ওকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার!’
মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতা মুচকি হেসে বলে,,’আচ্ছা মা। আমি রাজি করাবো। আপনি চিন্তা করবেন না!’ এরপর বউমা,শাশুড়ি মিলে খোশ গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুভ্রতার গোসল করার কথায় বেমালুম ভুলে গেলো। আপাদত শাশুড়ির সাথে গল্প করাটা উত্তম বলে মনে হয়েছে।
_________________________
খাটে হেলান দিয়ে একমনে ল্যাপটপে কাজ করতে ব্যস্ত মেঘ। কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। শুভ্রতা কয়েকবার ঘুরাঘুরি করে গেছে। কিন্ত মেঘের সেদিকে খেয়াল নেই। শুভ্রতা রুমে এসে খাটের একপাশে বসে পড়লো। মেঘের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে খাটে অযথা আঁকিবুঁকি করে আঙ্গুল দিয়ে। মেঘ হঠ্যাৎ করে শুভ্রতার দিকে তাকালে শুভ্রতা ভড়কে যায়। বোকা বোকা হাসি দিয়ে মেঘের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
‘নিজের রেজিস্টার করা বর। আড়চোখে না তাকিয়ে সোজাসুজি তাকাতে পারো। সমস্যা নেই!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা মুখ বাকায়। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। এখন কিছু বললে যদি বিয়েতে যাওয়ার জন্য রাজি না হয়! পরে সুযোগ বুঝে এই কথার উত্তর দিয়ে দিবে। আজ মুড ভালো রাখতে হবে! নিজের মনে কথার ছক সাজিয়ে শুভ্রতা খাটে দু’পা মেলে বসে। তারপর মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,
‘শুনুন,আপনার সাথে একটা কথা ছিলো। আসলে..’ শুভ্রতা আর কিছু বলার আগেই মেঘ শান্তস্বরে বলে,,’আমি বিয়েতে যাবো না!’
মেঘের কথায় শুভ্রতার এতোক্ষণ সাজানো গুছানো সব কথা ফুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। তাও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,,
‘আমি কখন বিয়েতে যেতে বললাম?’
‘শোন শুভ্র আমি তোমাকে ভালোভাবে চিনি। তুমি হা করলেই আমি বুঝি তুমি কি বলবা। আর মা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে সবকিছু!’
‘ওহ তাহলে তো আর কোনো প্যারাই নেই। আমরা আভিয়ান ভাইয়ের বিয়েতে যাচ্ছি। বিয়ে যেহেতু বৃহস্পতিবার,শুক্রবার আপনার প্যারা নেই। একদিনের ছুটি নিলেই হবে।’
‘আমি পারবো না ছুটি নিতে। তার চেয়েও বড় কথা আমি বিয়েতে যাবো না। চো তোমারও যাওয়া হবে না!” মেঘের কথায় শুভ্রতা ধুম করে খাট থেকে নেমে যায়। মেঘের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে,,’যেতে হবে না আপনাকে। থাকুন আপনি সতীন নিয়া। কি কপাল আমার বিয়ে করে সতীনের ঘর করছি! আমার জন্য টাইমই নেই!’
শুভ্রতার এমন কথায় আহাম্মক বনে যায় মেঘ। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে,,’কে সতীন? কার সতীন? আমি সজ্ঞানে, স্ব-ইচ্ছেয় তো একজনকেই বিয়ে করলাম!”
‘কেনো এইটা আপনার ল্যাপটপ আমার সতীন। সারাদিন অফিস তারপর এইটা নিয়েই তো থাকেন আপনি। বললাম শুধু আভিয়ান ভাইয়ের বিয়েতে যাবো সেটাতেও আপনি রাজি না। থাকুন আপনি!’ কথাটা বলে শুভ্রতা আর দাঁড়াল না। পা চালিয়ে বেলকনিতে চলে এলো। উঁকি মেরে মেঘের প্রতিক্রিয়া দেখে।
মেঘ ল্যাপটপের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। হয়তো শুভ্রতার কথাগুলো মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছে। তারপর হালকা হেসে ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে,,’শুভ্রর সতীন ল্যাপটপ!’
মেঘকে উঠে আসতে দেখে শুভ্রতা বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘ নিঃশব্দে শুভ্রতার পেছনে দাঁড়ায়। শুভ্রতা বুঝেও কোনো প্রতিক্রিয়া করে না। আপাদত সে উদাস!
‘আচ্ছা আভিয়ানের বিয়েতে কি উপহার দেওয়া যায়?’ মেঘের কথায় শুভ্রতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। রাজি হয়েছে মেঘ। শুভ্রতা একগাল হেসে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,’আমরা যাবো?’
‘হ্যাঁ।’ শুভ্রতা উল্লাসিত হয়ে মেঘের হাত চেপে ধরে বলে,,’সত্যি?’
মেঘ শুভ্রতার মাথায় টোকা মেরে বলে,,’সত্যি!’ মেঘ শুভ্রতাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।
_______________
‘আর কতোক্ষণ লাগবে? তাড়াতাড়ি করুন না!’ শুভ্রতা মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে। মেঘ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শুভ্রতার শাড়ির কুঁচি গুলো ঠিক করে। তারপর দাঁড়িয়ে বলে ‘হয়ে গেছে!’ শুভ্রতা ঠোঁট এলিয়ে হাসে। এরপর কি হবে তার জানা আছে। তাই চুপ’চাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার ধারণাকে সত্যি করে দিয়ে মেঘ কাজল,আর বেলী ফুলের মালা পড়িয়ে দেয়। শুভ্রতা যেদিন শাড়ি পড়বে সেদিন এই কাজ গুলো করে মেঘ।কেনো করে বা কি আনন্দ পায় জানা নেই শুভ্রতার। কিন্ত মেঘের ছোট ছোট এই কাজ গুলো মেঘের প্রতি মুগ্ধতা বাড়িয়ে তোলে। দিন দিনে মেঘের মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে শুভ্রতা। মেঘের সাজানো শেষে দুজনে আয়নায় নিজেদের দেখে নেয়। তারপর রওনা দেয় আভিয়ানদের বাসার উদ্দেশ্য!
বিয়ে বাড়ি মানেই মানুষে ভরপুর। শুভ্রতা এতোদিন ভাবতো শুধু গ্রামের বিয়েতেই মানুষের ভীড় হয়,কিন্ত শহরের বিয়েতেও অনেক মানুষের সমাগম হয়। কিন্ত আপাদত আভিয়ানের বিয়ে রেখে সবাই শুভ্রতাকে দেখতে ব্যস্ত। অনেকগুলো মহিলার মাঝে ভদ্রভাবে চুপচাপ বসে আছে শুভ্রতা। আভিয়ানের মা সবার সাথে শুভ্রতার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রতার রীতিমত বিরক্ত লাগছে। কিন্ত কিছুই করার নেই। ভদ্রতার খাতিরে বসে আছে। মেঘ সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে,কিন্ত ফেঁসে গেছে শুভ্রতা। না পারছে উঠতে না পারছে বসতে। শুভ্রতা নিজের মনে মনে বলে,,’ফাইসা গেছি,আমি ফাইসা গেছি,মাইনকার চিপায়!’
দীর্ঘ এক পরিচয় পর্ব শেষে সবাই নিজেদের কাজে যায়। শুভ্রতা ফোস করে শ্বাস ছাড়ে। “এতোক্ষণে বাঁচলাম। এবার খুঁজতে হবে আমার ওয়ান এন্ড ওনলি বেয়াক্কল বরকে!’ নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠে দাঁড়ায় শুভ্রতা। সে নাকি বিয়েতেই আসবে না। আর এখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে বউ ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুতেই মানবে না সে!
#চলবে?
(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কাল গল্প না দেওয়ার জন্য দুঃখিত। ধন্যবাদ)