হৃদমাঝারে পর্ব -১৪

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১৪)

বিয়ে বাড়ি মানেই হরেক রকমের মানুষের আনাগোনা। পুরো বাড়িতে বিভিন্ন ফুল,লাইটিং দিয়ে ডেকোরেশন করা হচ্ছে। এদিক ওদিক মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাশের বাসা থেকেও অনেক মানুষ এসেছে বলে মানুষের সংখ্যা বেশি ঠেকছে। এতো মানুষের মাঝে কাঙ্ক্ষিত মুখ খুঁজে নেওয়া বেশ কষ্টকর,যদি সেটা অচেনা নতুন জায়গা হয় তবে তো কথাই নেই। গ্রামের বাড়িতে বিয়ে হলে এমনিতেই লোক জড়ো হয়ে যায়। কিন্ত শহরের বিয়েতে এতো মানুষ আসে জানা ছিলো না শুভ্রতা। বিয়ের আগের দিন রাতেই আভিয়ানদের সব রিলিটিভ এসে উপস্থিত হয়েছে,অনেকে গ্রাম থেকেও এসেছে। কিছু মুখ চেনা,কিন্ত বেশিরভাগই অচেনা শুভ্রতার কাছে। একটু পরেই হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হবে। অনুষ্ঠানটা ছাদেই হবে। মেঘ ছাদের দিকটা আছে ভেবে শুভ্রতা ছাদের দিকে অগ্রসর হয়।
ছাদের একপাশে আর্টিফিশিয়াল ফুল,মরিচ বাতি দিয়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে। খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। মোটামুটি সব কাজই কমপ্লিট। শুভ্রতা ছাদে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচল। রেগুলার শাড়ি পড়ার অভ্যেস না থাকায় খানিক অসুবিধা হচ্ছে। আপাদত সেসব বাদ দিয়ে পুরো ছাদে চোখ বুলালো। শুভ্রতার ধারণা সত্য করে দিয়ে ছাদেই মেঘের দেখা মেলে। একপাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ফোনে কথা বলছে।
‘আমার কয়টা সতীন আল্লাহ মালুম! একটাকে বাসায় রেখে এসেছি,আবার আরেকটা জুটেছে। ধুর,ধুর ভাল লাগে না!’ নিজের মনে বিড়বিড় করে শুভ্রতা তীক্ষ্ম চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ এখনো খেয়াল করে নি।

‘আরে ভাবি এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে?’ মেয়েলি কন্ঠস্বরে পাশে তাকালো শুভ্রতা। মেয়েটাকে চিনে সে মেঘের খালাতো বোন,আভিয়ানের বোন। শুভ্রতার বিয়েতে গিয়েছিলো। মেয়েটা অনেক মিশুক। শুভ্রতা মিষ্টি হেসে বলে,,’ওই আর কি!’
‘কিসের ওই আর কি? নিশ্চয়ই একা একা বোর হচ্ছিলে? আসলে তোমরা যখন এসেছিলে আমি রুমে সাজছিলাম। মাত্র বের হতে শুনলাম তুমি এসেছো। তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে!’ মাহির কথায় শুভ্রতা খানিক হেসে বলে,,’তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে!’
“তোমাকেও ভাবি। চলো একটু পরেই সবাই উপরে চলে আসবে!’ কথাটা বলে শুভ্রতা আর মাহি স্টেজের দিকে যায়।

একে একে ছাদে মানুষের ভীড় বাড়তে লাগলো। মাহি উঠে অন্যদিকে যায়। শুভ্রতা একা বসে রইল। তার একদম ভালো লাগছে না। যতোটা ভেবেছিলো তার এক পার্সেন্ট ভালো লাগাও কাজ করছে না। মূলত সে নিজেও এইসব ফাংশানে এটেন্ড করাতে আগ্রহী কোনো কালেই ছিলো না। মেঘের মায়ের কথা রাখতে সাথে মেঘের জেদ ভাঙ্গতেই এসেছে। শুভ্রতা উঁকি ঝুঁকি মেরে মেঘকে খোঁজার চেষ্টা করে,আকস্মিক পাশে কেউ বসে পড়লে তাকিয়ে দেখে মেঘ এসে বসেছে। শুভ্রতা মেঘের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। মেঘ নিজের চুলগুলো পেছনের দিকে আলতো’ভাবে ঠেলে বলে,,’এভাবে তাকিয়ে আছো যে? বেশী সুন্দর লাগছে নাকি?’

মেঘের কথায় শুভ্রতা চোখ গরম করে বলে,,’কই ছিলেন আপনি? অনুষ্ঠানে এসে কি ভুলে গিয়েছেন যে আপনার একটা বউ আছে,আপনি তাকে সাথে নিয়েই বিয়ে বাড়িতে এসেছেন! আমি এখানে নতুন,কাউকেই ঠিক মতো চিনি না। খালা কাজ করবেন না আমাকে সঙ্গ দিবেন। আপনি এসে যে হাওয়া হয়েছে আর কোনো খোঁজ নিয়েছেন? যদি কেউ আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়েও যায় না আপনার খবর থাকবে না!’
মেঘ শুভ্রতার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,,
‘কিডন্যাপারদের সুখে থাকতে ভূতে কিলায় তো,তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে। কিডন্যাপ করলেও আবার এসে দিয়ে যাবে। তাও তোমাকে রাখবে না!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা নাক ফুলিয়ে মেঘের দিকে তাকায়। মেঘ তা দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কাজিন মহল এসে তাদের সামনে হাজির হয়। মেঘ বলতে নিয়েও থেমে যায়, শুভ্রতা মেঘকে ভেংচি কেটে মাহিদের দিকে তাকায়।
‘আরে ভাই। এখন তো ভাবীকে ছাড়বা! এতোদিন তো তোমার সাথেই ছিলো। বাসা থেকে আসার আগে সব সেড়ে আসবে না? আমার বিয়েতে এসে তোমারও কি আবার বিয়ের সাধ জাগলো নাকি?’ আভিয়ান কথাটা বলে মেঘকে চোখ মারে। উপস্থিত কাজিনরা সব হেসে উঠে। শুভ্রতা খানিক লজ্জা পায়।

‘আমার বউ,আমার কাজ,আমার বিয়ের শখ। তোর কি রে?’ মেঘ আভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে। কাজিনরা সব ‘ওই হই’ বলে উঠে।
‘আহারে মেঘ,ভাই আমার। তোর তো দেখি এখনও বিয়ের গন্ধই যায় নি গা থেকে!’ হৃদি বলে উঠে। হৃদি ওদের বড়,বিয়ে হয়েছে। তাও আজ এতোদিন পর কাজিনদের পেয়ে মজা নেওয়ার লোভ সামলাতে পারছে না।
ওদের কথায় শুভ্রতা আর বসে রইলো না। ‘একটু আসছি!’ বলে উঠে চলে যায়। ওদের কথায় শুভ্রতার কাণ গরম হয়ে গেছে লজ্জায়।

“এইরকম কথা ওরা বিয়ের সময়ও বলেছিলো, কিন্ত তখন বিরক্তি ছাড়া আর কিছুই কাজ করে নি। কোনো অনুভূতিও হয় নি। কিন্ত আজ আমার লজ্জা লাগছে। মেঘের আমার বউ সম্বোধনে ভীষণ ভালো লাগছে। হয়তো আমি মেঘকে মন থেকে মেনে নিয়েছি বলে!’ শুভ্রতা নিজে নিজে কথাগুলো ভাবে।

আভিয়ানের হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। বড়রা সবাই হলুদ ছুঁইয়ে নিজেদের কাজে চলে গেছে। আনন্দ যা করার সব ছোটরাই করবে। তাই এবার ছোটরা সবাই মিলে হলুদ লাগায়, আভিয়ানকে ভূত বানিয়ে এবার একে অন্যকে মাখানোতে লেগে যায়। শুভ্রতা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে। মূলত নিজেকে আড়াল করে রেখেছে,সে চায় না কেউ তাকে হলুদ লাগাক। তার চেয়েও বড় কথা,তার আজ নিজের বিয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। সবাই মজা করেছিলো কিন্ত সে ব্যতীত। যে বিয়েটাকে সে মন থেকে মেনে নিতে পারে নি,সে বিয়েতে আনন্দ কি করে করবে। কিন্ত আজ কেনো জানি ভীষণ আফসোস হচ্ছে শুভ্রতার। নিজের ভাবনায় মত্ত অবস্থায় শরীর ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে কেঁপে উঠে শুভ্রতা। হালকা ভয় ফেলেও চেনা গন্ধ অনুভব করতেই নিজেকে শান্ত করে নেয়। মেঘের হাত শুভ্রতার গাল ছুঁইয়ে শাড়ি ভেদ করা অংশে ঠেকেছে। শুভ্রতা চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। বেশ খানিকক্ষণ পরে চোখ মেলে মেঘের দিকে তাকায়। শুভ্রতা ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলো যাতে আলো কম আসে। আবছা আলোয় মেঘের মুখ স্পষ্ট শুভ্রতার কাছে। আজ যেনো মেঘকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে শুভ্রতার কাছে। মোহিত দৃষ্টিতে সে মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়।
মেঘ শুভ্রতার নাকের আগায় এক আঙ্গুল দিয়ে হলুদ লাগাতে শুভ্রতা নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। পেট থেকে মেঘের হাত সরিয়ে বলে,,
‘কি করছেন কি? মাহিরা,আভিয়ান ভাইরা দেখলে কি ভাববে? ছাড়ুন তো!’ কথাটা বলে শুভ্রতা নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর মেঘের দিকে তাকায়।
‘আমায় হলুদ লাগাবে না?’

এই আজ আপনার কি হয়েছে বলুন তো? আপনার ব্যবহারে তো আমি বেকুব বনে যাচ্ছি! এই রুপ তো আগে দেখি নি? আপনি তো গিরগিটির মতো রঙ পাল্টান!’ শুভ্রতা কোমড়ে হাত দিয়ে মেঘের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে।

‘তুমি তো বললা তোমায় সময় দি না। সারাদিন তোমার সতীন নিয়ে থাকি। তাই তোমাকে সময় দিচ্ছি। আমি নাকি বেরসিক,করলা। এখন রসিক হলেও তোমার সহ্য হচ্ছে না! তোমার আচরণে তো আমিই বেকুব বনে যাচ্ছি!’

মেঘের কথায় মেঘ,শুভ্রতা দু’জনেই ফিক করে হেসে দেয়। শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকায়। ‘লোকটা কখনো মুখ খুলে হাসে না। আজ প্রথম এইভাবে হাসলো। দারুণ মানিয়েছে কিন্ত। অবশ্য মুচকি হাসিতেও ভালো লাগে,কিন্ত এভাবে যেনো একটু বেশীই ভালো লাগে!’ নিজের মনে কথাগুলো বলে শুভ্রতা। মেঘ শুভ্রতার একেবারে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা পা উঁচু করে দু’হাতে মেঘের মুখ ধরে নিচে নামায়,অতঃপর নিজের গালের সাথে মেঘের গাল ছুঁইয়ে দেয়। ফলস্বরুপ শুভ্রতার গালে থাকা হলুদ মেঘের গালে লেগে যায়। মেঘ শুভ্রতা দু’জনের ঠোঁটেই আলতো হাসি ফুটে উঠে। শুভ্রতা সরে আসতে নিলে মেঘ শুভ্রতাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। আজ নাই’বা হলো তাদের হলুদ সন্ধ্যা। নিজেদের মতো উপভোগ করতে তো ক্ষতি নেই। সুন্দর এই মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে রইলো আকাশের চাঁদ আর মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলো!

চলবে..?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন লাগলো প্লিজ দু’লাইনের মন্তব্য করবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here