হৃদমাঝারে পর্ব -১৬

#হৃদমাঝারে – [১৬]

নার্সিংহোমে নিজের কেবিনে বসে অতিতের কথা ভাবছিলো মুন। চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ছে তার। সে মুখে যতই বলুক না অতীতকে ভুলে গেছে আসলে চাইলেই কি আর অতীত ভুলা যায়। তাছাড়া সেদিন রনি কেন ওর সাথে এমনটা করলো? শুধুই কি ফারহানের দুশমন বলে! নাকি অন্য কোন কারন আছে। কেন যে সেদিন,,,মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে মুন। কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না মুনের। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর ওর মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। মাথা তুলে মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো অর্ণার নাম জ্বলমল করছে। কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে অর্ণা বলে উঠে,

– কিরে আজ কি নার্সিংহোমে রাত কাটানোর ইচ্ছে আছে নাকি? কটা বাজে সে খেয়াল আছে।

অর্ণার কথা শুনে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। ঠোট দিয়ে জিহ্বা ভিজিয়ে বলে,

– উহ্, আমি ভুলেই গিয়েছি। আচ্ছা আমি আসছি।।

কল কেটে নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। একটা নার্সকে ডেকে কয়েকজন পেশেন্টের খেয়াল রাখতে বলে মুন নার্সিংহোম থেকে বেড়িয়ে যায়।

পরেরদিন যথাসময়ে বাড়ি থেকে বের হয় মুন। গন্তব্য তার নার্সিংহোম। রাস্তায় এসে রিক্সার জন্যে দাঁড়াতেই কিছুক্ষণের মধ্যে সে একটা রিক্সা পেয়েও যায়। তারপর সে রিক্সা নিয়ে নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথিমধ্যে আবার দেখা হয় মিষ্টির সাথে। তবে আজ ওর সাথে রনি কিংবা অনন্যা নেই। মিষ্টির সাথে আজ একটা অর্ধবয়স্ক মহিলা আছে। মুন রিক্সা থামিয়ে মিষ্টির কাছে যায়। মুনকে দেখে মিষ্টি ওকে জড়িয়ে ধরে। মুনও মিষ্টির গাল টেনে ওকে আদর করে। এমনি সময় সেই অর্ধবয়স্ক মহিলাটি ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

– এই মিষ্টি চল এবার আমরা বাড়ি ফিরে যাই। তোমার বাবা চিন্তা কিন্তু এবার বকবে।

– পাপা কিছু বলবে না। এই আন্টি তুমি চল না আমাদের বাসায়। পাপা মাম্মা অনেক হ্যাপি হবে।

– না সোনা। আজ হবে না। আমাকে হসপিটালে যেতে হবে। তুমি বরং তোমার পাপা আর মাম্মাকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এসো। আমরা অনেক অনেক গল্প করবো।

– তুমি ডক্টর? অর্ধবয়স্ক মহিলাটি প্রশ্ন করে মুনকে।

– হ্যাঁ।

-কোথায় চেম্বার তোমার?

– এনআর নার্সিংহোম।
এনআর নার্সিংহোম নামটা শুনে মহিলাটি চমকে উঠে যেটা মুনের চোখ এড়ালো না। মুন এবার মহিলাটিকে আপাদমস্তক দেখে নিল। এতক্ষণ মিষ্টির সাথে কথা বলতে গিয়ে তার দিকে খেয়াল করে নি। অর্ধবয়স্ক এই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে মুন। তাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটাই মনে করতে পারছে না সে। তাকে সরাসরি জিগ্যেস ও করতে পারছে না যদি কিছু মনে করে।

– আপনি কে? আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। মিষ্টির কি হোন আপনি?

– আমি মিষ্টির নানির মতো বলতে পারো। ছোট থেকে মিষ্টি আমার কাছেই বড় হয়েছে। আমার নাম আনোয়ারা শিকদার। আনোয়ারা শিকদার নামটা শুনেই চমকে উঠে মুন। এই কি সেই আনোয়ারা, এনআর নার্সিংহোমের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত যে ছিলো। তাকে চেনা চেনা লাগছে। কেন উনি? মাথার মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রশ্নগুলো দমিয়ে রাখতে পারছে না মুন। ইনি যদি আনোয়ারা শিকদার হোন তাহলে তো ওনি সবটা জানেন। মুন প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

– এনআর নার্সিংহোমের চেয়ারম্যান পদে যে আনোয়ারা শিকদার নিযুক্ত ছিলো সেই কি আপনি।

মুনের প্রশ্ন শুনে হচকচিয়ে উঠে মহিলাটি। আমতা আমতা করে বলে,

– আমি মানে, না আমি কেন এনআর নার্সিংহোমের চেয়ারম্যান হবো। আমি তো। আর কিছু বলল না সে। মুনের দিকে একপলক তাকিয়ে মিষ্টিকে জোড় করে চলে গেলো। তার চলে যাওয়া দেখে মনে হলো সে পালিয়ে গেলো। এই নিয়ে মুন বেশী মাথা ঘামালো না। আর কাউকে এই কেইসে ইনভল্ব করবে না মুন। কমিশনড আংকেল যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখন সেই এই কেইসের ফয়সালা করবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নার্সিংহোমের দিকে চলে যায়।

কেবিনে বসে নিজের কাজ করছে মুন।একের পর এক রোগী দেখছে তাদের সাথে কথা বলছে। যাওয়ার সময় তাদের হাতে একটা প্রেশকিপশন ধড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবেই সকাল থেকে দুপুর অব্ধি চলে যাচ্ছে তার। এখন একটা রোগী দেখছে এরপর আর একটা রোগী তাই আজ তার রোগীদেখার কাজ শেষ। বিকালে দুটো ওটি আছে। তারপর আবার যেতে হবে কমিশনড স্যারের বাসায়। এই আকাশটাও না, কি দরকার ছিলো ওকে বাড়িতে ডাকার। এখন আবার যাও ওদের বাসায়।

শেষ পেশেন্ট এসে মুনের সামনে বসে। মুন নিচের দিকে তাকিয়ে একমনে একটা পেশেন্টের এক্সরে রিপোর্ট দেখছিলো। শেষের পেশেন্ট এসে মুনের সামনে বসতে মুন রিপোর্ট-টা রেখে প্রেশকিপশন করার জন্যে কাগজ হাতে নেয়। সামনের দিকে না তাকিয়েই জিগ্যেস করে,

– আপনার নাম?

– ফারহান সাদিক। সরি শিকদার ফারহান সাদিক।

নাম এবং কন্ঠশ্বর দুটোই বেশ চেনা মুনের। সামনে তাকিয়ে চমকে উঠে। এতো ফারহান। ভ্রু কুঁচকে উঠে মুনের।

– আপনি? আপনি এখানে কেন এসেছেন?

– মানুষ ডক্টরের কাছে কেন আসে!

– মানে। কি বলতে চাইছেন আপনি?

– তোমার সাথে আমার কথা আছে মেহরিমা। উঠে দাঁড়ায় ফারহান। মুনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, উঠ আর চল আমার সাথে।

– মানে কি? আর কোথায় যাব? আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। আপনি এখন আসতে পারেন। কথাটা বলেই আর এক্সরে রিপোর্ট হাতে নেয় মুন। ফারহান রিপোর্টের দিকে একপলক তাকিয়ে মুনের হাত ধরে ওকে দাঁড়া করিয়ে বলে, তুমি কখনোই ভালো কথা শুনার মানুষ নও। চল আমার সাথে। মুন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফারহান মুনের অধোরে নিজের আঙ্গুল চেপে ধরে আর বলে, স্টপ। মুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে টেনে নার্সিংহোমের বাহিরে নিয়ে আসে।
পার্কিং লটে নিজের গাড়ির কাছে এসে মুনকে গাড়িতে বাসিয়ে দেয়। মুন চলে যেতে চাইলে ফারহান ওকে ধমক দিয়ে গাড়ির দরজা লক করে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

গাড়ি চলছে তার নিজ গতিতে। গাড়ির ভিতরে দুজনেই চুপচাপ। একজন বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি এই রং বদলের খেলা দেখতে ব্যাস্ত আর অপরজন সামনে দিতে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। ফারহান গাড়ি থেকে নেমে মুনকেও বাহিরে বের করে ওর হাত ধরে টেনে রেস্টুরেন্টের ভিতরে নিয়ে গেলো।

দুজনেই মুখোমুখি বসে আছে। একজন মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে আর অপর তাকিয়ে আছে মুনের এই শান্ত মুখের দিকে। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু মনে চলছে মুনকে কাছে পাবার চির বাসনা। মাথা ও মনের সাথপ লড়াই চলছে ফারহানের। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না মুনকে আগে কি প্রশ্ন করা উচিৎ। কিছুক্ষণ নিজের মাথা ও মনের ধন্ধ কাটিয়ে বলল,

– এনআর নার্সিংহোমের মালিক তোমার বাবা?

ফারহানের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে সামনে তাকায় মুন। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়।

– তাহলে তুমি নিশ্চয় জানো কি কি হয় এই নার্সিংহোমে। প্লিজ মেহরিমা আমার থেকে কিছু লুকাবে না। আমরা সবটা জানা প্রয়োজন।

– কেন? এতদিন পর আবার এসব কেন? শেষের কথাগুলো বিরবির করে বলল মুন।

– তুমি কি চাওনা তোমার বাবা শাস্তি পাক। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ফারহান। মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, উহ্ সরি। তুমি কেন চাইবে ডক্টর ইমরান খান শাস্তুি পাক। সে তো তোমার বাবা।

– আপনি ভুল ভাবছেন ক্যাপ্টেন ফারহান সাদিক। আমি চাই অপরাধী তার শাস্তুি পাক। আর সে যেই হোক না কেন? কিন্তু আপনি কেন এসব কথা আমাকে জিগ্যেস করছেন।

– দুটো কারনে।

– কি কারন?

– এক. আমি ও আমার টিম এই কেইসের দায়িত্ব নিয়েছি আর দুই. আজ থেকে চার বছর সাত মাস আগে এই কেইসের তদন্ত করতে গিয়ে আমার চাচা মারা যায়। সরি মারা যায় না সে খুন হয়। ফারহানের কথ শুনে আতঙ্কিত কন্ঠে ওর দিকে তাকায় মুন। অস্ফুটভাবে বলে,

-তা-তার মানে, সি-সিনিয়র পুলিশ ক-কমিশনার ফুয়াদ শিকদার আপনার চাচা।

– তুমি চেনো তাকে? প্রশ্ন করে ফারহান।

– হ্যাঁ। আমার কথা শুনে কমিশনড আংকেল তার বন্ধু সিনিয়র পুলিশ কমিশনার ফুয়াদ শিকদারের সাথে এনআর নার্সিংহোমের ব্যাপারে কথা বলে। আর সে এখানে শিফট করে। তারপর এনআর নার্সিংহোমের উপর তদন্ত শুরু করে। অনেক প্রমানও পেয়ে যায় সে আর তারপরেই তাকে খুন করা হয়। কথাগুলো বলেই মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো মুন।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here