#হৃদমাঝারে – [২১]
রওনাক অর্ণাকে কল করলে সে অর্ণা বলল ওদের কেনাকাটা শেষ। ফোনের ওপাশ থেকে রওনাক যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল, এরা শপিং করতে আসে নাকি জিনিসপাতির সত্যতা যাচাই করতে আসে। এমন ভাবে সব জিনিস খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে মনে হয় যেন এরা এগুলো পর্যবেক্ষণ করে পরে রিভিউ দিবে। কি এত ভাবছো রওনাক? অর্ণার কথায় রওনাকে ঘোর কাটে। না কিছু ভাবছি না। বলছি কখন বের হবে? প্রশ্ন করে রওনাক। আমরা এখুনি বের হচ্ছি। কোথায় আছো তোমরা দুজনে। বাহিরে আসো দেখতে পাবে। বলেই কল কেটে দেয় রওনাক।
অর্ণা আর মুনকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে একেবারে ডিনার শেষ করে বাড়ি ফিরে রওনাক আর ফারহান। ফেরার সময় মুনের সাথে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে ফারহান কিন্তু মুন ওকে সব সময় এড়িয়ে চলেছে। ফারহান যখন মুনের সাথে কথা বলতে যায় তখনি মুনের মনে পরে ফারহানের দেওয়া শর্তের কথা। কখনো আমার সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করবে না। সুযোগ পেলেও না। অভিমানে দূরে সরে যায় মুন। ফারহানকে এত কাছ থেকে দেখেও ওর থেকে দূরে থাকতে হচ্চে ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। আড় চোখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুন যে ভালো নেই। আর পারছে না নিজেকে সামলাতে।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে মুন। ঘুম কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না দু চোখের পাতায়। মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। বাবাকে হাড়িয়ে মা একেবারে ভেঙে পরেছে। সত্যিটা মানতে পারছে না। মা আর মিঠু দুজনেই এখন নানার বাড়িতে থাকে। মিঠু এখন সবটা সামলাচ্ছে। ওই ঘটনার পর নার্সিংহোম, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সবই সরকারের আওতায় চলে গেছে। বাড়িটাও নিলামে উঠেছে। শুধুমাত্র একটা ফ্ল্যাট ছাড়া। মায়ের কথা মনে পড়তেই মুন বিছানা ছেড়েন
উঠে। মোবাইলে একবার ঘড়ির টাইমটা দেখে নেয়। রাত এখন বারোটা ছুঁইছুই। কাবার্ড থেকে একটা উড়না বের করে মাথায় পেঁচিয়ে চলে আসে ছাদে। রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের ওই রুটির গোলাকার দেখতে চাদটার দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদমামা যেন আজ নিজের সবটা জুড়ে আলোকিত করেছে শহরটাকে। মুন মৃদু হাসলো। তাহলে কেন মনে হয় আমার জিবনে কোন আলো নেই। আর না আছে কোন রং। এমন বেরঙিন কেন হলো আমার জিবনটা। জিব কাটে মুন। ইশ্ কি হচ্ছে। আমি এসব কেন ভাবছি। আচ্ছা আমি কি কোন ভাবে ফারহানকে নিয়ে কিছু ভাবছি। না- না এটা হতে পারেনা। আমি আর ওকে নিয়ে ভাবতে চাইনা। যে আমাকে বিশ্বাস করে না। কথায় কথায় অপমান করে তাকে নিয়ে আমি ভাবতে চাইনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুন।
-ভাবতে চাইনা বলে কি তুই ফারহানকে নিয়ে ভাববি না আর মুন। ফারহান যতই তোকে অপমান করুক তুই তো ওকে ভালোবাসিস। তাহলে কেন অস্বীকার করছিস। কথাগুলো শুনে চমকে উঠে সামনে তাকায় মুন। সামনে তাকাতেই দেখতে পায় ওর মতোই দেখতে একটা মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে মুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঠোঁটের কোনে তার অদ্ভুত হাসি। মাথার চুলগুলো হাওয়ায় ভাসছে। মুন অবাক সুরে জিগ্যেস করলো,
– কে তুমি?
– নিজেকেই চিনতে পারছো না তুমি। আমি তোমার ভিতরের মানুষটা, যাবে তুমি কাঠিন্য আবরণে মোড়ক পড়িয়ে রেখেছো। কেন অস্বীকার করতে চাইছো ফারহানকে। কেন এত কষ্ট দিচ্ছো নিজেকে। তুমি তো জানো, আজও তুমি ফারহানকেই ভালোবাসো। দূরত্ব তোমার মন থেকে ফারহানকে দূরে সড়াতে পারে নি। বরং #হৃদমাঝারে সুপ্ত হয়ে গেঁথে গেছে ফারহান। সম্পর্কে দূরত্ব থাকবেই তাই বলে ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যায় না।
– ফারহান তো আমাকে ভালোবাসে না। ও আমাকে ঘৃনা করে। কথায় কথায় অপমান করে। বিশ্বাস করে না আমাকে।
– সেটা তো পরিস্থিতি ছিলো মুন। তুমি একবার নিজেকে প্রশ্ন করো, তুমি যদি ওই অবস্থায় ফারহানকে অন্য কোন মেয়ের সাথে দেখতে তাহলে তুমি কি করতে? ফারহান তো তোমাকেই ভালোবাসতো। তোমাকে হাড়িয়ে ও কষ্ট পায় নয় কি? কেন শুধু নিজের কথা ভাবছো তুমি।
– চুপ করো তুমি। ফারহান আমাকে ভালোবাসে না। ও আমাকে শর্ত দিয়েছে যাতে আমি সংস্পর্শে কখনো না আসি।
– সে তো তুমিও ওকে এড়িয়ে চলছো। ভুল তুমি করছো না কি? ফারহান তোমাকে কয়েকবার কথা শুনিয়ে দিলো আর তুমি দেশ ছেড়ে চলে গেলে?
– তখন আমার পরিস্থিতি অন্যরকম ছিলো। সব দিক থেকে ভেঙে পরেছিলাম আমি। একটা আশ্রয়ের দরকার ছিলো আমার। আর সেই সময়ই ফারহান আমাকে ভুল বুঝে দূরে সড়িয়ে দিলো। আমি কখনো ফিরে যাব না ওর কাছে।
– সে তুমি যা ভালো বুঝো সেটাই করো। নিজেকে কষ্ট দিয়ে যদি শান্তি পাও তাহলে যেওনা ফারহানের কাছে।
– হুম যাব না। যাব না ফিরে বুঝেছো তুমি। প্লিজ চলে যাও এখান থেকে। চলে যাও বলছি। দু-হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলল মুন।
এখানে তো কেউ নেই মেহরিমা, তুমি কাকে চলে যেতে বলছো? মুনের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে, মুনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলল ফারহান। হঠাৎ করেই ফারহানের গলার আওয়াজ পেয়ে আতকে উঠে মুন। দু-হাতে চোখ বন্ধকরে নেয়। বিড়বিড় বলে, না মুন, ফারহান এখানে আসেনি তুই ওকে নিয়ে বেশী ভাবছিস, ফারহার তোর ভাবনায় এসেছে মাত্র,,,,,
– আমি তোমার ভাবনাতেও বিরাজ করি। ফারহানের কথা শুনে চট করে চোখ খুলে মুন। সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো ফারহান একদম ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে অধোর চেপে হাসছে। মুনের ভ্রু কুঁচকে যায়। নিজের নিজের হাতের উপর চিমটি কাটে। উহ্ এটা স্বপ্ন নয় তাহলে। কিন্তু ফারহান এত রাতে এখানে আসবে কি করে।
– আ্ আপনি এখানে?
ফারহান মুনের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে মুনের দিকে। কিছুক্ষণ পর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। ওষ্ঠযুগলে হাসির রেখে টেনে বলে উঠে,
– হ্যাপি বার্থডে মেহরিমা। ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্ন অফ দ্যা ডে। একগুচ্ছ লাল গোলাপ মুনের সামনে ধরে হাটু গেরে বসে বলে উঠে, শুভ জন্মদিন, মেহু। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তুমি আমার কাছে তোমার দিনটিকে ততটাই বিশেষ করে তুলবে, এবং আমি তোমার বছরটিকে আরও বেশী বিশেষ করে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ! শুভ জন্মদিন মেহু। মুগ্ধ চোখে মুনের দিকে তাকিয়ে থাকে ফারহান। মুন অবাক চোখে ফারহানকে দেখছিলো।এটা যে ওর বার্থ নাইট সেটা ওর মনেই ছিলো না। মুন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ফারহানের দিকে। তারপর অতি সন্তর্পণে ফুলের গুচ্ছ হাতে নিয়ে নিরবে সেখান থেকে প্রস্থান করতে নিলে ফারহান মুনের হাত ধরে। থমকে দাঁড়িয়ে যায় মুন। ওর সারা শরীর জুড়ে হীম শীতল শিহরণ বয়ে যায়। হাত কাপছে। ফারহান এক টানে মুনকে আবার আগের জায়গায় দাঁড় করায়। মুন মাথা নিচু করে রেখেছে দেখে ফারহান মুনের চিবুক ধরে ওর মাথাটা উচু করে নেয়। মুনের চোখে চোখ রেখ নিঃপলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুন ফারহানের হাত সড়িয়ে চলে যেতে নিলে ফারহান আবার ওকে বাধা দিয়ে দু-গালে হাত রাখে। কপালে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলে উঠে,
– আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না মেহু।
মুন ফারহানের থেকে নিজেকে সড়িয়ে নিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। দু-হাত শক্ত মুঠি করে চোখ বন্ধ করে। বড় করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে আরো শক্ত করে নেয়। না, ফারহানের সামনে সে কিছুতেই দূর্বল হবে না। মুখশ্রীতে কাঠিন্য ফুটিয়ে বলে উঠে,
– ক্ষমা, কিসের ক্ষমা চাইছেন আপনি? কি অপরাধ করেছেন! আর আমার কাছেই বা কেন ক্ষমা চাইছেন আপনি?
একনাগাড়ে মুনের এতগুলা প্রশ্ন শুনে ফারহান অসহায় মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলে,
– কেন এমন বিহ্যাভ করছো তুমি মেহু। মেহু, আমি আর পারছি না তোমার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে। প্লিজ আর রাগ করে থেকো না। আর কত শাস্তি দিবে আমায়! ছয় বছর কি কম সময় ছিলো? বিশ্বাস করো মেহু, এই ছয় বছরে একটা বারের জন্যেও তোমাকে ভুলতে পারিনি। তোমার উপর রাগটা কবে যে ভালোবাসায় পরিণিত হয়েছে বুঝতেই পারিনি। #হৃদমাঝারে ছিলে তুমি। এই লং ডিসটেন্স তোমার মন থেকে তোমাকে দূরে সরাতে পারেনি। বরং সময় অনুক্রমে আরো বেশী ভালো বেসেছি তোমায়। মেহু, হয় তুমি আমাকে শাস্তি দাও আর না হয় ক্ষমা করে দাও। এই দূরত্ব আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
মুন কিছু বলছে না শুধু তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। ফারহান উঠে দাঁড়িয়ে মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুন কি জবাব দেয় সেই প্রত্যাশায়। কিন্তু মুন কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। ফারহান কিছু বলবে তখনি ওর কলটা বেজে উঠে, মুনের থেকে চোখ সড়িয়ে জিহ্বা দিয়ে অধোর ভিজিয়ে বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে রওনাক বলে উঠে,
– কিরে ভাই আর কত সময় নিবি এবার তো নিচে আয়। আমরা সকলে অপেক্ষা করছি।
– আসছি। কলটা কেটে মুনের দিকে তাকিয়ে বলে, নিচে সবাই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর সেখন থেকে প্রস্থান করে।
ড্রয়িংরুমে আসতেই অর্ণা মিঠু দুজনে ঝাপিয়ে পরে মুনের উপর। তারপর একে একে বাড়ির সকলে ওকে বার্থডে ওয়িশ করে। মুন সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। ফারহান এক সাইডে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে মুন কে। মুনের হাসি মুখ দেখে বলে উঠলো, এখন কত খুশি। সবার সাথে কত হেসে হেসে কথা বলছে আর আমি থাকলেই ম্যাডামের মন খারাপ হয়।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।