-“একটু ভালো করে কথা বলেছি বলে আপনি আমায় প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছেন? আপনার থেকে ৪ বছরের বড় আমি। লজ্জা নাই?”
কন্ঠে কাঠিন্য ভাব রেখে নাক ছিটকে বলে উঠলো আরশি। কিন্তু তার এহেন কথায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুগ্ধের কোনো ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। সে আগের মতই শান্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আরশির মুখপানে। আরশি ভীষণ বিরক্ত হলো। হাতের সাহায্যে মুগ্ধের বুকের বামপাশে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে যেতে বললো,
-“আর কখনো যেন আপনাকে আমার সামনে না দেখি মুগ্ধ!”
পিছন থেকে হাত চেপে ধরলো মুগ্ধ। থেমে গেলো আরশির পা।সে পিছনে ফিরে দেখতে পেলো তার হাত মুগ্ধের হাতে আটকে আছে।ভ্রু কুঁচকে আরশি বললো,
-“হাতটা ছাড়ুন মুগ্ধ।”
মুগ্ধ এবার অশান্ত হলো। চোখেমুখে অসহায়ত্ব দেখা গেলো।ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললো,
-“আপনি এমন কেন করছেন আরশি?আমি কি আপনাকে খেয়ে ফেলছি?”
আরশি হাতটা মোচরাতে লাগলো।নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বললো,
-“আমি কিন্তু আপনাকে চড় মারতে বাধ্য হব মুগ্ধ!”
মুগ্ধ হাতটা ছেড়ে দিলো।অসহায় গলায় বললো,
-“আপনাকে আমি ভালোবাসি আরশি।”
আরশি বেশ ক্ষুব্ধ হলো।মুগ্ধর দিকে আঙুল তুলে বললো,
-“আপনাকে যদি আরেকবার আমার পিছনে ঘুরতে দেখেছি তাহলে আমি ভুলে যাব যে আপনি আমাদের ভার্সিটির প্রিন্সিপালের ছেলে।আর আমার হাতের পাঁচটা আঙুলের ছাপ আপনার গালে বসে যাবে।”
বলেই আরশি সেখান থেকে হাঁটা ধরলো উল্টোদিকে।মুগ্ধ আরশির যাওয়ার পথে তাকিয়ে বললো,
-“আপনি আমাকে কেন বুঝতে পারছেন না আরশি!”
আরশি বড় বড় পা ফেলে ক্যান্টিনে এসে বসলো।নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার।তার উচিতই হয়নি এমন ছোটখাটো চিরকুট পেয়ে গাছতলায় চলে যাওয়া।সে না গেলে মুগ্ধ সুযোগই পেত না। আর ছেলেটাই বা কেমন!সবে মাত্র ভার্সিটিতে পা রেখেছে।আরশি এবার মাস্টার্সে। ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় প্রিন্সিপাল স্যার তাকে মুগ্ধকে পড়াশোনায় কিছু হেল্প করতে বলে।তাই আরশি মুগ্ধকে পড়াশোনায় হেল্প করতো।কিন্তু কয়েকমাসেই মুগ্ধ এসব ভেবে বসে আছে।আজ চিরকুটটা পেয়ে সে না গেলে হয়ত জানতেও পারতো না যে মুগ্ধ তাকে নিয়ে এসব ভাবে।হঠাৎ আরশির কাঁধে কেউ হাত রাখায় আরশির ধ্যান ভাঙে।পিছনে ফিরে দেখে ফারিহা আর তারিন দাঁড়িয়ে আছে।আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“ওহ তোরা!”
ফারিহা আরশির সামনে বসতে বসতে বললো,
-“অন্যকাউকে আশা করেছিলি নাকি!”
আরশি বারকয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,
-“নাহ কিছু না।”
তারিন আরশির কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“তুই কি কোনোকিছু নিয়ে আপসেট?”
আরশি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।তারপর নিচু গলায় বললো,
-আসলে প্রিন্সিপাল স্যারের ছেলে মুগ্ধ আছে না?”
-“হ্যা যাকে তুই পড়াতি।সেই মুগ্ধই তো?”
আরশি ঘন ঘন মাথা নাড়ায়।তারিন আগ্রহ নিয়ে বললো,
-“সে আবার কি করলো?”
-“আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে।”
আরশির ধীর কন্ঠে বলা কথায় অবাক হলো ফারিহা আর তারিন।ফারিহা তো বলেই ফেলে,
-“কিহ,এই পিচ্চি ছেলে কিনা তোকে প্রেমের প্রস্তাব? ”
-“হ..হ্যা!”(কাঁপা গলায়)
তারিন ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“তো কি ভাবলি?”
আরশি রেগে তাকায় তারিনের দিকে।ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,
-“কি ভাবলি মানে? আমি এসবে নেই। প্রিন্সিপালের ছেলে ও। তাছাড়া সমাজ এসব মানে নাকি? ছিহ এসব আমি ভাবিও না ওকে নিয়ে।”
বলেই সে উঠে দাঁড়ায়। ফারিহা আর তারিন একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।তাদের তো আর এখানে কিছু বলার নেই।এটা আরশির ব্যক্তিগত বিষয়।তারা শুধু মাথা নাড়ায়।আর সেখান থেকে ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ায়।
_______
অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে থাকার পর রিক্সা পেলো আরশি।বিকাল হয়ে এসেছে। আর না ভেবে আরশি রিক্সায় উঠে পড়লো।রিক্সাচালককে যেতে বলবে এমন সময় কোত্থেকে মুগ্ধ এসে তার পাশে বসতে বসতে বললো,
-“চলুন মামা।”
রিক্সাওয়ালা একবার পিছনে তাকালেন।মুগ্ধ ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“কি হলো চলুন!”
রিক্সা চলতে আরম্ভ করলো। আরশি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে মুগ্ধের দিকে। কি হলো এতক্ষণ সে বুঝতেই পারেনি।মুগ্ধ মিষ্টি হেসে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে।রিক্সা চলতে আরম্ভ করতেই আরশির যেন হুশ এলো।সে চেঁচিয়ে বললো,
-“আপনি এখানে!”
মুগ্ধ নিজের চুলের ভিতর আঙুল ডুবিয়ে বললো,
-“আমিই তো থাকবো।”
আরশি ক্ষুব্ধ নয়নে তাকিয়ে বললো,
-“নামুন বলছি। এই মামা রিক্সা থামান।”
-“একদম না। মামা রিক্সা চালান তো।”
-“কি হচ্ছে টা কি মুগ্ধ? আপনাকে আমি আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছি। আপনি কেন শুনছেন না আমার কথা?”
মুগ্ধ বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়িয়ে বলো,
-“শুনছি তো।”
-“কই শুনছেন আপনি? আপনি হুটহাট এভাবে আমার আশেপাশে চলে আসেন কেন?”
-“ভালো লাগে তাই।”
আরশি কিছুক্ষণ মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।মুগ্ধ গালে হাত দিয়ে আরশির দিকে তাকিয়ে রইলো।আরশির বাসার সামনে আসতেই আরশি রিক্সা থেকে নেমে গেলো।মুগ্ধও নেমে এলো।আরশি রিক্সাওয়ালার দিকে টাকা বাড়ানোর আগেই মুগ্ধ টাকা দিয়ে দিলো।আরশির রাগ যেন সপ্তম আকাশ স্পর্শ করলো। সে চেঁচিয়ে বললো,
-“আপনাকে আমি বলেছি ভাড়া দিতে?”
মুগ্ধ কানে হাত চেপে বললো,
-“উফফ আস্তে। আপনি এখনই আমাকে বয়রা বানিয়ে দিচ্ছেন আরশি।বিয়ের পর তো লোকে বয়রার বউ বলবে।”
আরশি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। তার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। এই ছেলে কতকি ভাবছে। আশেপাশে তাকায় আরশি। পাশে প্রতিবেশী, লোকজন। তাই সে এবার নিম্ন স্বরে আঙুল তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-” আই ওয়ার্নিং টু ইউ ফর দা লাস্ট টাইম…”
আরশির কথা শেষ হওয়ার আগেই মুগ্ধ বলে উঠলো,
-“আই লাভ ইউ।”
-“আপনাকে আসলে আর কিছু বলার নাই। নির্লজ্জ একটা।”
বলেই আরশি চলেই যাচ্ছিলো।কি ভেবে পিছনে ফিরে দেখলো মুগ্ধ তার দিকেই একরাশ আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আরশি দু পা এগিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
-“বাসায় যান। বাহিরে যেন না আসা হয়।”
-“যাব না।”
-“কেন?”
-“আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকব। অপেক্ষা করবো।”
-“আমার থেকে দূরে থাকুন মুগ্ধ। এতেই আপনার মঙ্গল।”
-“আমি চাই না আমার মঙ্গল হোক।খারাপ হলে হোক। তবুও আমার আপনাকে চাই আরশি।”
আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“আপনি কেন বুঝতে পারছেন না মুগ্ধ? আপনি তো বাচ্চা নন।”
-“বাচ্চা নই বলেই তো ভালোটা বুঝতে পারছি।”
(মুচকি হেসে)
-“আপনার থেকে ৪ বছরের বড় আমি।এটা কি যেমন-তেমন কথা মনে করছেন?বিষয়টা যতটা সহজ ভাবছেন এটা এতটাও সহজ নয়।”
-“চাইলে সবটাই সহজ।”
সোজা জবাব মুগ্ধের।আরশি আর কিছু বললো না। বাসার দিকে পা বাড়ালো।মুগ্ধ পিছন থেকেই আরশিকে দেখতে লাগলো।আর আস্তে করে বলতে লাগলো,
-“আপনি যতক্ষন না আমাকে ভালোবাসি বলবেন ততক্ষণ আমি আপনার পিছু ছাড়বো না আরশি।আপনায় মায়ায় পড়ে গেছি আমি। নিজেকে আপনার থেকে দূরে সরানো যে বড্ড দায়।”
বলেই সে হাসলো।এদিকে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে আরশি ভাবলো,
-“ছেলেটার বয়স হচ্ছে ঠিকই।কিন্তু বুদ্ধির দিক থেকে এখনো বাচ্চাদের মত করছে।ও তো ইচ্ছে করে অবুঝ হচ্ছে। এটা কি ওকে মানায়? সমাজ কি কখনো এটা মানবে?”
আরশির ১০ বছরের পিচ্চি বোন দিবা আরশিকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললো,
-“আপু তুমি চলে এসেছো?”
আফসোস!প্রতিদিনের মত আজকে আরশি হাসিমুখে জবাব দিলো না। যেন কথাটা কানেই গেলো না।নিজের মত ভাবতে ভাবতে রুমের দিকে এগুতে লাগলো।
মুগ্ধের মনে রয়েছে আরশির জন্য আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা।আরশি বিষয়টা জানতো না। আজই জানতে পারলো। আরশিদের বাসা থেকে ১০ মিনিট হাঁটলেই মুগ্ধদের ইয়া বড় বাড়িটা।আরশি মাঝে মাঝে সেখানে যেত প্রিন্সিপালের কথায়।মুগ্ধর ছোট বোন মায়াকে পড়াতে যেতো।আর মুগ্ধকেও সাহায্য করে দিতো। তবে আজ থেকে কেন যেন আরশির যাওয়ার মুড উবে গেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মুগ্ধদের বাসায় যাওয়া মানে আরশি আর মুগ্ধের দুজনেরই বিপদ।কারণ মুগ্ধ আরশির জন্যে যে অনুভূতি জমিয়েছে সেই অনুভূতির মূল্য হয়ত কেউ দেবে না।দোষটা হয়ত পড়বে আরশিরই কাঁধে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরশি নিজের ঘরে ঢুকলো।ব্যাগটা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় চলে গেলো।টাওয়াল টা হাতে নিতেই দেখতে পেলো মুগ্ধ তার দিকে তাকিয়ে রাস্তার আরেকপাশে দাঁড়িয়ে। আরশির ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে ইশারায় বললো,
-“মুগ্ধ! যান বাসায়!”
মুগ্ধ হেসে তাকিয়ে রইলো। আরশি কি বলবে বুঝতে পারছে না। কেন এত অবুঝ হচ্ছে মুগ্ধ! সে তো বাচ্চা নয়।আরশি কিছুতেই মুগ্ধকে দমাতে পারছে না। এর পরিণতি কি হতে পারে?
#হৃদয়ে শুধু আপনি❤️
#লেখীনিতেঃঅনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#সূচনা পর্ব
চলবে কি?
(