সডিভোর্সের ১৭দিন পর রাত সোয়া ৪’টার সময় আমার প্রাক্তন স্বামী ফোন করেছিল। তখন আমি ওরই ছবি বুকে জড়িয়ে ৭মাসের সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কাঁদছিলাম। এতো রাতে হঠাৎ তার ফোন কল পেয়ে আমি চমকে উঠলাম। ফোনে তখনও সেই প্রিয় নামটাতেই তার নাম্বার সেভ করা ছিল।মন না চাইলেও ইতস্ততঃ করে কেনো যেন কল রিসিভ করলাম।সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে সে আর্ত কাতর স্বরে বলল,
– আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাইনি অনিন্দিতা। গোপন ফন্দি ও মমতাশূন্য পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। আমার সন্তান ও তোমাকে নিয়ে খুব সুন্দর ভাবে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। শেষ শ্বাস অবধি যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিধাতা হয়তো এমনটা চায়নি।
ভাঙা গলায় বললাম,
এতো রাতে ফোন করে এসব তুমি কী বলছো ইমতিয়াজ? তোমার কোনো কথাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তুমি আমাকে কেনো ফোন করেছো? কী বলতে চাইছো? আর কখনো আমাকে ফোন করবে না। তোমার সাথে সব সম্পর্কই আমার শেষ হয়ে গেছে।
– আমি জানি, তুমি এখনো আমাদের ডিভোর্সটা মেনে পারছো না। এমনকি এতো রাতে আমারই ছবি বুকে জড়িয়ে তুমি কাঁদছো। কিছু সত্য তোমাকে মেনে নিতে হবে আর কিছু সত্য তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। আজ তোমাকে অনেক কিছুই বলার ছিল আমার। কিন্তু সে পর্যন্ত আয়ুষ্কাল আমার হাতে নেই। অলরেডি আমার শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে অনিন্দিতা। আমার ভেতরটা ঝ*ল*সে যাচ্ছে। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয়ো। তোমাকে দেওয়া কোনো কথা, প্রতিশ্রুতিই আমি রাখতে পারলাম না। যদি কাল শীতের সকালে তুমি শুনতে পাও, আমার লা*শ খাটিয়ায় উঠেছে। দয়াকরে তুমি কাফন জড়ানো লা*শটা দেখতে এখানে, কখনো এসো না। শেষ বেলা তোমাকে একটু না দেখার মানসিক আর্তি আমার রয়ে গেল।
তারপর ওপাশ থেকে আর কোনো আওয়াজ আসেনি। কলও কাটেনি। এভাবে আধাঘন্টা গেল। পরে আমিই ফোনটা কেটে দিই। সেদিন রাতে আমি আর চোখের পাতা বন্ধ করিনি। বাকি রাতটাও অশ্রুতে নয়ন ভিজিয়ে পার হয়েছিল আমার। পরেরদিন সকালে বাড়িতে পুলিশ আসে। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, ইমতিয়াজ মা*রা গেছে। সকালে নিজের রুমেই নাকি ওর লা*শ পাওয়া গেছে। যা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। চোখ থেকে পানি বের হয়ে গেল। মুখ চেপে কোনোরূপ কান্না আটকে রেখেছিলাম।
অতঃপর নিজেকে যথাসম্ভব নৈসর্গিক করে বললাম,
– সে কী করে মা*রা গেছে?
পুলিশ অফিসার প্লাবন সাথে সাথে জবাব দিলো,
– দেখে তো মনে হলো বিষ খেয়েছে। পোস্ট মর্টেমের জন্য লা*শ পাঠানো হয়েছে। পোস্ট মর্টেম হওয়ার পর রিপোর্ট বের হলেই সব খুঁটিনাটি জানা যাবে। শেষ আপনার সাথেই ইমতিয়াজ ইসলামের কথা হয়। যদিওবা অত রাতে। তা ডিভোর্সের ১৭ দিন পর আপনাদের মাঝে ঠিক কী নিয়ে কথা হয়েছিল? তাছাড়া আরও বিভিন্ন বিষয় জানার জন্যই আমাদের এখানে আসা।
প্রত্যুত্তরে সব কিছু বললাম। এরপরও তারা আমায় বিভিন্ন ভাবে জেরা করে। নিঃশঙ্ক ভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিলাম। তারপর ওনার চলে যায়। সাথে সাথে আমি আমার রুমে চলে এসে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বো*বা* কা*ন্না*য় ভেঙে পড়ি। এরপর প্রায়ই একসপ্তাহ পর জানতে পারলাম, পোস্ট মর্টেমের পর ইমতিয়াজের লা*শ আজ তার বাড়িতে আনা হয়েছে।
দুপুর ১২’টার সময় বাবাকে বললাম, জোহরের নামাজের পর ইমতিয়াজকে কবর দেওয়া হবে। আমি ওকে শেষবারের জন্য একবার দেখতে চাই। বাবা এতে নারাজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিত গলায় বলে উঠলো,
– তুই ওখানে কিছুতেই যাবি না অনিন্দিতা। ওর সাথে তোর আর কোনো সম্পর্ক নেই। যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। কোন অধিকারে যাবি তুই?
কিছু না বলে চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসি। আলমারি থেকে কালো রঙের একটা বোরকা বের করলাম। অজান্তেই কয়েক ফোটা চোখ থেকে পানি বের গেল। বিবাহবার্ষিকীতে ইমতিয়াজের দেওয়া উপহার ছিল এটা। খুব পছন্দের বোরকা। অতঃপর কাজের মেয়েটাকে ডেকে বললাম, আমি বের হচ্ছি। আমার ছেলে (অমিত) এখন ঘুমাচ্ছে। আমি না ফেরা পর্যন্ত ওকে দেখে রেখো আর ঘুম ভেঙে গেলে সামলে নিয়ো। বিলম্ব করবো না। অতি শীঘ্র চলে আসবো।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় যাচ্ছি। কিছু বলিনি। চুপচাপ বেরিয়ে আসছিলাম। কিছু আঁচ করতে পেরে বাবা আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। রাস্তায় কোনো যানজট না থাকলে সর্বোচ্চ ৩০’মিনিট সময় লাগবে ইমতিয়াজদের বাড়ি যেতে। ঠিক ৩০’মিনিটই সময় লাগলো। একতলা বিশিষ্ট বাড়ি। ঢেরদিন পর এ বাড়িতে পা রাখলাম। শহরা অঞ্চলে এ বাড়িটা করার জন্য ইমতিয়াজকে কতযে কাঠগড় পোড়াতে হয়েছিল। ওর জীবন সংগ্রামের কোনো কথাই আমার অজানা নয়। কতশত মানুষের ভিড়। থাকবেই তো। লা*শে*র ক্ষানিকটা দূরেই ছেলে হারানো মায়ের আর্তনাদ। যা আমার বুকের ভেতরের পীড়া, যাতনাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি বেশিক্ষণ সেখানে থাকিনি। থাকতেও পারিনি। শেষবার ওর ফ্যাকাসে যাওয়া মুখটা দেখেই চলে এসেছিলাম।
বাড়িতে আসা মাত্রই সবার ক্রোধ, আক্রোশের সম্মুখে পড়তে হয়।সবার মুখে একই প্রশ্ন, কাউকে কিছু না বলে আমি কোথায় গিয়েছিলাম। ভাবী-তো বলেই ফেলে, বেহায়া মেয়ে। লাজ শরমহীন। নিশ্চয় বোরকা পরে ও প্রাক্তন স্বামীর লা*শ দেখতে গেছিল।
আমি কারো কোনোরূপ প্রশ্নের জবাব দেয়নি। সোজাসাপ্টা নিজের রুমে চলে আসি। কাজের মেয়েটার কোলে অমিত কাঁদছিল তখন। অমিতকে কোলে নিয়ে কাজের মেয়েটাকে যেতে বললাম। মায়ের কোলে আসতেই অমিতের কান্না মুহূর্তেই থেমে যায়।
আমার তখনও সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল এখনো আমি গভীর ঘুমেই আছি। একটু পরেই আমার ঘুম ভেঙে যাবে আর আমি চোখ মেলে দেখবো, ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছি। সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।
পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়ে হয়। যদিও শুরুতে ইমতিয়াজের সাথে আমার ঠিক মতো মনোমালিন্য হচ্ছিল না। কিন্তু যবে থেকে আমি ওকে বুঝতে শিখি, উপলব্ধি করতে পারি তখন থেকেই ওর সবকিছুর মায়ায় পড়ে যাই আমি। ওকে আমি ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, প্রত্যয় এবং সংসার সবকিছুই খুব ভালো ভাবে চলছিল। যখন আমার কোল আলো করে আমাদের সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হলো, তার কিছুটা দিন পরই আমি ইমতিয়াজের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করি। ওর আচার-আচরণ সবকিছুই পাল্টে যেতে থাকে। শান্তশিষ্ট স্বভাবের ইমতিয়াজকে আমি দিনের দিন রাগান্বিত, খিটখিটে মেজাজের হতে দেখি।
তারপর হঠাৎই একদিন হুট করে অফিস থেকে এসে, সে আমায় ডিভোর্সের কথা জানালো। ভেবেছিলাম মজা করে বলেছে তাই একদমই অবাক হয়নি কিন্তু আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম তখন, যখন ইমতিয়াজ আমার গায়ে হাত তুলে। এতো বছরের সংসার জীবনে ইমতিয়াজ কখনো আমার গায়ে হাত উঠায়নি। সেদিনই প্রথম ছিল।
ডিভোর্স চলাকালীন আমি আমার বাবার বাড়িতেই ছিলাম। ডিভোর্সটা আটকানোর কতই না চেষ্টা করেছিলাম। সব চেষ্টাই বৃথা যায়। এমনকি ইমতিয়াজের মা-ও ওর বিপক্ষে ছিল। উনিও কখনো চাননি আমাদের ডিভোর্স হোক। ছেলেকে কত বুঝালেন, কত চেষ্টা করলেন তবুও কোনো লাভ হয়নি। আমি এখনো সঠিক কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না ও- আমাকে কেনো ডিভোর্স দিলো। যতবার জিজ্ঞেস করেছি, কেনো ডিভোর্স দিচ্ছো, ততবারই কোনো জবাব পাইনি। অন্য কোনো মেয়ের সাথেও ওর কোনোরূপ সম্পর্ক ছিল না। পরিশেষে, আমার সাথে সে থাকতে চায়না, মানিয়ে নিতে পারছে না এবং আরও বিভিন্ন অজুহাত, অযুক্তিকর কথাবার্তা দাঁড় করিয়ে আমাদের ডিভোর্স হয়।
রেস্টুরেন্টের ডানদিকের জানালার পাশের টেবিলে বসে উপরোক্ত কথা গুলো বলেই এবার থামলো অনিন্দিতা। টেবিলের অপরপ্রান্তে লাচ্ছি খেতে ব্যস্ত এহসানুল সরকার।এতোক্ষণ যাবৎ এতো গুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার পরেও এহসানুল সরকারকে স্বাভাবিক ভাবে লাচ্ছি খেতে দেখে অনিন্দিতা বেশ অবাক হলো। পরক্ষণেই আবার বলে উঠলো,
– আপনি আমার বলা সব কথা শুনেছেন তো?
মৃদু স্বরে এহসানুল সরকার জবাব দিলো,
– হ্যাঁ।
– আপনাকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না আমার, আপনি এতোক্ষণ যাবৎ আমার বলা সব কথাই মনযোগ সহকারে শুনেছেন।
– প্রথমে সবাই এমনই মনে করে। আপনি কী আরও কিছু বলবেন?
– হ্যাঁ।
– বলুন?
– পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে পুলিশ বলেছে, ইমতিয়াজের মৃত্যু বিষক্রিয়ায় হয়েছে। বিষ খেয়েছে তেরো ঘন্টা আগে মৃত্যু হয় শেষ রাতের দিকে। বিষটাই নাকি এমন। আমাদের দেশ সহ পাশের অনেক দেশেও সচরাচর পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মানসিক চাপে ভুগছিল বিধায় ইমতিয়াজ বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল বলে তিনমাস পর কেসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ইমতিয়াজ আর যাইহোক আত্মহত্যা করতে পারে না। তাছাড়া হুট করে ইমতিয়াজের পাল্টে যাওয়া, আমাদের ডিভোর্স, তারপর শেষ রাতে ইমতিয়াজের ফোন করা, এরপর অস্বাভাবিক মৃত্যু। এ সব কিছুর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো বড় কারণ রয়েছে, আমার মনে হয়। আর কী সেই কারণ তা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে।
জানেন, শান্তিতে ঘুমাতেও পারিনা আমি। শেষ ফোন কলে ইমতিয়াজের বলা সেই কথাগুলো শুধু আমার কানে ভাসে। রোজ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার করেও কাঁদতে পারিনা। মুখ চেপে বো*বা*কা*ন্না করতে হয়। আমার দূরের বান্ধবী শান্তা। অর্থাৎ আপনার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী। ওর মাধ্যমেই আপনার সাথে আজ দেখা করার সুযোগ পেলাম। এর আগে আপনার নামই শুধু শুনেছি। আপনাকে কখনো দেখা হয়নি। আমি আশা করছি আমাকে আপনি সাহায্য করবেন।
– ডিভোর্সের পরেও প্রাক্তন স্বামীর প্রতি এতো ভালোবাসা! প্রথম দেখলাম। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। বিষয়টার শেষ পর্যন্ত ঘেঁটে দেখবো। তবে আমার কিছু শর্ত আছে।
– কী শর্ত?
– আপনি আমার সাথে দেখা করেছেন। আমার সাথে কথা বলেছেন।আমি আপনাকে সাহায্য করবো।বিষয়টা ঘেঁটে দেখবো বলেছি।এ সব যেন আর কেউ না জানে। কাউকে জানাবেন না। কোনো কিছু বলবেন না। আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, কাছের কেউ, কাউকে না।
– নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমিও এমন কিছুই বলতে চেয়েছিলাম।
– আপনি এখন যেতে পারেন। আর যাওয়ার সময় যদি এমন মনে হয় কেউ আপনার পিছু নিচ্ছে, পিছুপিছু আসছে বা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে কিছু বলবেন না।পাত্তা দিবেন না।চুপচাপ চলে যাবেন। আজ শনিবার। ঠিক সাত দিন পর শনিবার, একই টাইমে, একই রেস্টুরেন্টে, ডানদিকের এই একই টেবিলের একই সিটে বসে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।
আরকিছু বলল না অনিন্দিতা। উঠে দাঁড়ালো। আসি বলে চলে যেতে লাগলো। এহসানুল সরকার ওয়েটারকে ডেকে আরেকটা লাচ্ছি দিতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে ওয়েটার লাচ্ছি দিয়ে গেল। পূর্বের ন্যায়ে এহসানুল সরকার আবার লাচ্ছি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তবে এবার তার মুখে গম্ভীর একটা ভাব দেখা গেল।
বাড়িতে আসার পরপরই অনিন্দিতা আগে তার ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। কিছু সময় পর অনিন্দিতার রুমে তার মা-বাবা, ভাইয়া-ভাবি সবাই আসলো। সবাইকে একত্রে রুমে দেখে অনিন্দিতা একটু অবাক হলো।
কর্কশ গলায় অনিন্দিতার ভাই বলে উঠলো,
– তুই দিনদিন এতো নিচে কী করে নামছিস অনিন্দিতা? তোর গয়না লাগতো, তোর ভাবীকে বলতি। নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতো। চুরি করার কী দরকার ছিল? টাকার প্রয়োজন হয়েছিল, বাবাকে বা আমাকে বলতি, তোর ভাবীর গয়না বেচার কী দরকার ছিল?
আচমকা নিজের ভাইয়ের মুখ থেকে এমন কথা শোনা মাত্রই আঁতকে উঠলো অনিন্দিতা। অবাক আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে অনিন্দিতা সাথে সাথে জবাব দিলো,
– ছিঃ। এসব তুমি কি বলছো, ভাইয়া? আমি কেনো ভাবীর গয়না চুরি করতে যাবো? নিশ্চয়ই তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
– মাথা খারাপ হয়নি। ঠিকই আছে। আমি কি করে বলবো কেনো তুই গয়না চুরি করতে গেছিস! কেনো এমন করেছিস সেটাই তো জানতে চাইছি।
– কি প্রমাণ আছে? কেনো মিথ্যা বলছো ভাইয়া? কেনো মিথ্যা দোষারোপ দিচ্ছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব হচ্ছেটা কি? আর বাবা-মা তোমরাই বা কিছু বলছো না কেনো?
– তোর কী মনে হয়, প্রমাণ ছাড়া শুধু শুধু তোকে আমি একটা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিবো? গতকাল থেকে তোর ভাবীর একটা গয়না পাওয়া যাচ্ছিল না। আজ তোর রুমে গয়না বিক্রি করার জুয়েলার্সের একটা কাগজ পাওয়া যায়। কিছুটা সন্দেহ বশে সেই জুয়েলার্সের দোকানে খোঁজ নিয়েই জানতে পারি, তুই তাদের কাছে একটা গয়না বিক্রি করেছিস আর সেই গয়নাটাই হলো তোর ভাবীর। বাবা-মা’ও কিছু বলবে না। কারণ সব প্রমাণই তোর বিপক্ষে।
পাশ থেকে অনিন্দিতার ভাবী বলে উঠলো,
– তোমার বোনকে এটাও জিজ্ঞাসা করো, সেই টাকা দিয়ে কী কী করছে। আর কিছু দিন পরপর বাচ্চাকে কাজের মেয়েটার কাছে রেখে কই যায়। কার সাথে দেখা করতে যায়। যতবার জিজ্ঞাসা করা হয় ততবারই কোনো জবাব দেয়না। চুপ করে থাকে। এড়িয়ে যায়। আজ যেন ও- কোনো কিছু থেকে রেহাই না পায়।
অনিন্দিতা বলল,
– আমি জানিনা। কিচ্ছু জানিনা। আমি গয়না চুরি করিনি। মিথ্যা। সব মিথ্যা।
অনিন্দিতার ভাই প্রত্যুত্তরে বলল,
– দেখো বাবা-মা তোমাদের অদূরে মেয়ে। এখনো অস্বীকার করে যাচ্ছে। কোনো অনুশোচনা নেই। তোমরা আর চুপ থেকো না। তোমরা তো সবই জানো?
নিরব মনোভাব ভেঙে অনিন্দিতার বাবা অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে এবার বলে উঠলো,
– কোলে যদি নানা ভাই না থাকতো, তাহলে এতোক্ষণে তোকে ঠাটিয়ে দু’টো চ*ড় দিতাম। যখন থেকে এ বাড়িতে তুই পা রেখেছিস, তখন থেকেই একটা না একটা অশান্তি লেগেই আছে। সবশেষে তুই যে এতোটাও নিচে নামতে পারিস তা আমি আসা করিনি। কিছু বলবো না। কিছু জিজ্ঞাসা করবো না। কেনো গয়না চুরি করেছিস জানতেও চাইবো না। সেই টাকা দিয়ে কী করেছিস তার কৈফিয়তও চাইবো না। শুধু একটা কথা বলবো, যত দ্রুত সম্ভব এ বাড়ি ছেড়ে তুই যেখানে খুশি সেখানে চলে যা।
কথাগুলো বলেই অনিন্দিতার বাবা রেগে হনহন করে চলে গেল। অনিন্দিতাকে কিছু বলার সুযোগও দিলেন না তিনি। মা’কে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। অনিন্দিতার মা-ও অনিন্দিতার থেকে মুখ ঘুড়িয়ে চলে যায়। শেষে অনিন্দিতার ভাই-ভাবিও আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে অনিন্দিতার দিকে তার ভাবী কেমন যেন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। মাথায় হাত দিয়ে অনিন্দিতা বিছানায় বসে পড়ে। এদিকে অমিতও কান্না জুড়ে দিয়েছে। অমিতকে কোনোমতে সামলে নিলো অনিন্দিতা।
হুট করে কি থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না অনিন্দিতা। অনিন্দিতার জীবনে আজ পর্যন্ত অস্বাভাবিক যা কিছু ঘটেছে সবকিছুই হুট করে। হুট করে কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত অনিন্দিতা মেনে নিতে পারেনি।সে-তো এমন কিছুই করেনি তাহলে কি করে তার রুমে গয়না বিক্রি করার কাগজটা পাওয়া গেল? মাথা ঝিমঝিম করছে অনিন্দিতার। কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে।
পদে পদে একেক জনের একেক রকম কথা শুনে আজ চারদিন কেটে গেল অনিন্দিতার। রাত ২’টার দিকে অনিন্দিতার ফোন বেজে ওঠে। এহসানুল সরকার ফোন করেছে। সাথে সাথে ফোন রিসিভ করে অনিন্দিতা বলল,
– কী ব্যাপার! আপনি এতো রাতে কেনো ফোন করলেন? কিছু কী জানতে পেরেছেন?
তীক্ষ্ণ গলায় এহসানুল সরকার বলল,
– আপনি আমার কাছে অনেক কিছুই লুকিয়েছেন। যেটা উচিত হয়নি। আপনার যে আগে বয়ফ্রেন্ড ছিল সেটা কেনো জানান নি? এমনকি বিয়ের পরেও আপনি ওর সাথে ৫বার দেখা করেছিলেন।
চমকে ওঠে অনিন্দিতা। আমতাআমতা করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই এহসানুল সরকার আবার বলে উঠলো,
– আপনার সেই বয়ফ্রেন্ড কিছুক্ষণ আগে খু*ন হয়েছে। তার সারা ডায়েরি জুড়ে শুধু চারটা কথাই লেখা ছিল, অনিন্দিতা ঠক, অনিন্দিতা প্রতারক। অনিন্দিতা আমাকে ঠকাইছে। অনিন্দিতা আমার সাথে প্রতারণা করছে। তাছাড়া আপনি আরও একটা অনেক বড় ভুল করেছেন, আমাদের মধ্যকার কথাবার্তা পাঁচকান করে দিয়ে। যেটা আমি ঘুণাক্ষরেও চাইনি। এখন শুধু একের পর এক মৃ*ত্যু, লা*শ, নৃশংসতাই দেখতে পারবেন।
কথাগুলো বলার পর সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দিলো এহসানুল সরকার। সাথে সাথে অনিন্দিতা বেশ কয়েকবার এহসানুল সরকারকে ফোন করেছিল কিন্তু রিসিভ করেনি। অনিন্দিতার কপাল ঘামছে। হাত-পা কাঁপছে। কিছু ভাবতে পারছে না। ভাবতেও চাইছে না। ৫’মিনিট পর এহসানুল সরকার নিজে থেকেই আবার অনিন্দিতাকে কল করে দ্রুত গলায় বলল,
– আপনার বাবা কোথায় এখন? দেখুন তো উনি রুমে আছেন কি-না। ওনার প্রাণ সংশয়ে আছে। ওনাকে এলার্ট করেন। ওনার বেঁচে থাকাটা অনেক জরুরী। ফাস্ট!
উত্তেজিত হয়ে অনিন্দিতা বলল,
– এসব আপনি কী বলছেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
– এখন কিছু বলার বা বোঝানোর সময় নেই। আপনি শীঘ্রই যান।
অনিন্দিতা আর কিছু না বলে দ্রুত বাবার রুমে গেল। ওয়াশরুম, বেলকনি রুমের কোথাও বাবা নেই। মা’কে ডাক দিয়ে জানতে চাইলে, তিনিও কিছু বলতে পারলেন না। ইতিমধ্যে বাসার সবাই জেগে গেছে। বাসার ভেতর কোথা-ও বাবা নেই। বয়স্ক মানুষ। এতো রাতে বাবা কোথায় গেল? সবার মনে এখন একই প্রশ্ন। বাসার মেইন দরজা খোলা। বাইরে একবারও খোঁজা হয়নি। দেখা হয়নি। সবাই দ্রুত গতিতে বাইরে গেল। অনিন্দিতা চিৎকার করে উঠলো। বাসার বাইরের গেটের বাম পাশে বাবা মাটিতে পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে বাবার শরীর স্পর্শ করলো অনিন্দিতা। মুহূর্তেই আঁতকে উঠলো সে। বাবার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে।
গল্প:- #হেথায়_সেথায়_সর্বত্রই_রিক্ত (পর্ব:-১)
লেখা:-
মোঃ শাহরিয়ার ইফতেখায়রুল হক সরকার।
লেখাতে কোনো ভুল থাকলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন, আমি সংশোধন করে নিবো। আশা করছি সবাই পাশে থাকবেন। সাপোর্ট করবেন।