হেথায় সেথায় সর্বত্রই রিক্ত পর্ব -০৪ ও শেষ

গল্প:- #হেথায়_সেথায়_সর্বত্রই_রিক্ত
পর্ব:-৪ এবং শেষ।
লেখা:- মোঃ শাহরিয়ার ইফতেখায়রুল হক সরকার।

এখনো সঠিক জানিনা। তবে এটা আমি শিওর ভাবে বলছি, আপনার আর ইমতিয়াজের ডিভোর্সই হয়নি। আপনারা আইন অনুযায়ী এখনো স্বামী-স্ত্রী।

চমকে উঠলো অনিন্দিতা। সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এমন কিছু শোনার জন্য একদমই অপ্রস্তুত ছিল সে। বাক্যহীন হয়ে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে এহসানুল সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে অনিন্দিতা।

পাশ থেকে অনিন্দিতার মা ভেঙে যাওয়া গলায় বলে উঠলো,
– এটা কী করে সম্ভব! আমাদের সবার সামনেই সাইন হলো, ডিভোর্স হলো, সব কিছু।

এহসানুল সরকার গলায় গম্ভীরতা এনে বলল,
– ডিভোর্স পেপারটাই যদি আসল না হয়ে সবকিছু আগে থেকে সুন্দর ভাবে পূর্বপরিকল্পনা করা থাকে তাহলে ডিভোর্সটা হয় কী করে?

অনিন্দিতা প্রতুত্তরে বলল,
– প্লিজ সবকিছু বুঝিয়ে বলুন। সত্যি বলছি, আমার মাথায় আর কিছু ঢুকতে চাইছে না। একের পর এক ট্র্যাজেডি মেনে নিতে দুষ্কর হয়ে উঠছে।

এহসানুল সরকার বলল,
– চেয়ারম্যান সহ আরও অনেকেই এর সাথে জড়িত। ডিভোর্সের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, সমস্ত কাগজ, সবকিছু মিথ্যা। পরিকল্পিত সুন্দর একটা প্লানিং ছিল। আর এই প্লানিং স্বয়ং ইমতিয়াজই করেছিল।

অনিন্দিতা আবারও চমকে উঠে বলল,
– কি বলছেন এসব! কিন্তু কেনো? কিসের জন্য এই প্লানিং? এসব করার কারণটা ঠিক কী?

– যেটুকু জেনেছি সেটুকুই আপাতত জানালাম। এর বেশি কিছু না। এখন আমাকে ইমনের ব্যাপারে কিছু কথা বলুন, ইমন আপনাকে কিভাবে ঠকালো? ওর সাথে আপনার রিলেশন কেনো ভাঙলো?

অনিন্দিতা বলল,
– ওর নাম শুনলেও আমার সারা গা ঘিনঘিন করে ওঠে।ইমনকে আমি ঘৃণা করি। অনেক ঘৃণা করি। আমার ভালোবাসা নিয়ে খেলেছে, আমার আবেগ, অনুভূতি সবকিছু নিয়ে খেলা করেছে। আমার সাথে রিলেশন চলাকালীনই ইমনের আরও একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। যাকে ইমন গোপনে বিয়ে করে। তার ওপর মেয়েটা ছিল প্রেগন্যান্ট।মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পরেই ইমন ওকে বিয়ে করেছিল। এটা নিয়ে পরে অনেক ঝামেলাও হয়। এই সূত্র ধরেই ইমনের বাবার সাথে আমার বাবার বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়ে যায়।

এহসানুল সরকার বলল,
– আপনার ভাই-ভাবীও এমনই কিছু বলেছিল। তারপরও আপনার নিজের মুখ থেকে একবার জানতে ইচ্ছা করলো। তাই জিজ্ঞাসা করা।

অনিন্দিতার মা এতোক্ষণ যেন নিরব ভূমিকা পালন করছিলেন। চুপচাপ কপালে হাত দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। নিরব মনোভাব ভেঙে তিনি বলে উঠলেন,
– আমার মেয়ে যা বলেছে সব সত্য। ওই ছেলেটার চরিত্র ভালো ছিল না। অনিন্দিতার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন সময় ওর কুকর্ম ফাঁস হয়।

এহসানুল সরকার কিছু বললেন না। গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। অনিন্দিতার মা খানিকটা সময় চুপ থেকে সঙ্গে সঙ্গে আবার বলে উঠলেন,
– আচ্ছা, অনিন্দিতার বাবার যে অবৈধ ব্যবসা ছিল তা কী আমার ছেলে বা তার বউ জানতো?

অনিন্দিতার মায়ের কথার প্রত্যুত্তরে এহসানুল সরকার বলল,
– না। তারা সম্পত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। লোভ বড়ই মারাত্মক একটা জিনিস। তাছাড়া এখন অনিন্দিতার বাবা ও তার ভাইয়ের রুম সার্চ করা অনেক প্রয়োজন। আমাকে তাদের রুম গুলো দেখিয়ে দিন।

অনিন্দিতা বলল,
– আপনি আমার সাথে চলুন। আমি রুম গুলো দেখিয়ে দিচ্ছি।

এহসানুল সরকার অনিন্দিতার পিছু পিছু গেল। সর্ব প্রথম অনিন্দিতার ভাইয়ের রুমটা ভালো করে চেক করলেন। সেখানে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। এরপর অনিন্দিতার বাবার রুমে এলেন। সারা রুমের জিনিসপত্র এদিক-ওদিক করার পর এখানেও তেমন কিছু পেলেন না। শেষমেষ একপ্রকার হতাশ হয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কী মনে করে যেন তিনি একবার অনিন্দিতার বাবার বালিশের কভারের ভেতর চেক করেন। যেখানে কালো রঙের একটা খাম পাওয়া যায়। অযথা সময় নষ্ট না করে দ্রুত খাম খুলে চিঠিটা বের করার পর মনেমনে পড়তে শুরু করলেন।

চিঠিটায় লেখা ছিল:-
কিছু কিছু মানুষকে জানিয়ে আর কিছু মানুষকে না জানতে দিয়ে উপরে জবাবদিহিতার জন্য পাঠাতে আমার ভিষণ ভালো লাগে। আপনার পাপের হিসেব করা হচ্ছে। লিষ্ট করা হচ্ছে। জানিয়ে রাখলাম। যদি আপনি কখনো গুম হয়ে যান বা খু*ন হন তাহলে এর পেছনে এ যাবৎ আপনার করা সমস্ত কুকর্ম গুলোই একমাত্র দায়ী থাকবে।
#সেরু_ভাই

পাশ থেকে অনিন্দিতা বলে উঠলো,
– এটা কি সেই খাম? চিঠিতে কী লেখা আছে?

এহসানুল সরকার প্রত্যুত্তরে বলল,
– হ্যাঁ, এটা সেই খাম। নিচে ছোট করে একটা তারিখও লেখা আছে। খামটা ১’মাস আগের।চিঠিটা পড়ে আমি যা বুঝতে পারলাম, অনেক আগে থেকে আপনার বাবা সেরু ভাইয়ের টার্গেটে ছিল।

– এই জন্যই বোধ হয় ১’মাস আগে বাবাকে অনেক ভয়ভীতিতে এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

পূর্বের ন্যায়ে চিঠিটা বাজ করে কালো রঙের খামের ভেতর রেখে এহসানুল সরকার বলল,
– আজ তাহলে আমি আসি। যেতে হবে আমায়।যেকোনো প্রয়োজনে আমি আবার আসবো। এখনো অনেক কিছুর সমাধান হয়নি। খোঁজাখুঁজি করতে হবে। সবকিছুর জট খুলতে হবে। তন্মধ্যে,
১. আপনার বাবা কাকে খু*ন করে অবৈধ ব্যবসা শুরু করে আর কাকেই বা খু*ন করে সবকিছু শেষ করতে চাইছিলেন।
২. ইমনকে আপনার বাবা কেনো খু*ন করালো।
৩. ইমন কেনো টাকা খাইয়ে ইমতিয়াজের কেসটা বন্ধ করে দিয়েছিল।
৪. সবশেষে ইমতিয়াজের মৃত্যুর আসল রহস্য কী। আর সে কেনোইবা ডিভোর্সের একটা সুন্দর নাটক সাজালো। আরও অনেক কিছু।

কথাগুলো বলার পর এহসানুল সরকার একমুহূর্তও আর দাঁড়ালো না। সোজাসাপটা অনিন্দিতাদের বাসা থেকে বের হয়ে আসলো। এখনো অনেক রহস্যের সমাধান খোঁজার বাকি।

আজ ২৭’দিন চলে গেল। এখনো এহসানুল সরকার বাকি চারটা রহস্যের কোনো সমাধান খুঁজে পেলেন না। এখানে সেই স্থানে সকল বিষয়েই তিনি শূন্য ছাড়া আর কিছুই পাননি। কেটে গেল আরও বেশ ক’টা দিন। প্রায় পাগল বেশে যেন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। অতঃপর ১মাস ১৭ দিন পর সবকিছুর উত্তর খুঁজে পেলেন। সব রহস্যের সমাধান পেলেন। নির্ঘুমে রাত-বিরেতে এখানে-সেখানে ছুটাছুটি সহ কোনো কিছুই যেন ওনার বৃথা যায়নি। এই মুহূর্তে অনিন্দিতাদের বাসায় সিঙ্গেল একটা সোফায় বসে আছে এহসানুল সরকার। সামনেই তিন সিটের সোফায় সবকিছু জানার অধীর আগ্রহে অনিন্দিতা এবং তার মা বসে আছেন। ৫’মিনিট হলো, উনি এখানে এসেছে।

নিরবতা ভেঙে এহসানুল সরকার বলল,
– অনিন্দিতার বাবা তার অবৈধ ব্যবসা অনন্দিতার মামাকে খু*ন করেই শুরু করেছিলেন। বহু বছরের অবৈধ ব্যবসা। অনিন্দতার বাবার পরনারীর সাথে অ*ন্ত*র*ঙ্গ মূহুর্ত চোখে দেখাসহ অবৈধ কিছু ব্যবসা শুরু করার কথাবার্তাও তিনি জানতেন। সবকিছু ফাঁস ও শেষ হওয়ার ভয়ে অনিন্দিতার মামাকে গুম করার পর খু*ন করানো হয়।

শেষটা অনিন্দিতার মা অর্থাৎ আপনাকে দিয়ে করতে চাইছিলেন। ওনার মৃ*ত্যু*র ৩’দিন আগে উনি মাঝ রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিজের অনেক গোপনীয় কথাবার্তা কারো সাথে ফোনে বলছিলেন।সে মূহুর্তে পেছন থেকে আপনি ওনার কাঁধ স্পর্শ করেন। ঘুম ভাঙার পর ওনাকে দেখতে না পেয়েই তখন ব্যালকনিতে গিয়েছিলেন। সেদিন অনিন্দিতার বাবা সুন্দর ভাবে সবকিছু ম্যানেজ করে নিলেও পরে আপনার অল্পকিছু কার্যকলাপে ওনার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ওনার মনে হচ্ছিল, সেদিন রাতে আপনি সবকিছুই জানতে পেরে গেছেন। সব জেনে আপনি অভিনয় করে যাচ্ছেন। অথচ আপনি কিছুই জানতেন না। এ বয়সে জেলে যেতে চাননি। গেলেও নিশ্চিত ফাঁসি।এই সামন্য সন্দেহ বশে তিনি সেদিন আপনারও খু*নে*র ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

অনিন্দিতা বলল,
– তাহলে ইমনকে বাবা কেনো কন্ট্রাক্ট কিলার দ্বারা খু*ন করালো?

এহসানুল সরকার অনিন্দিতার প্রশ্নের জবাবে বলল,
– ইমনকে খু*ন করার একটাই কারণ ছিল, ইমন জানতো আপনার বাবা ফার্মেসির নামে অবৈধ সব কারসাজি করে।এমনকি এটা নিয়ে আপনার বাবাকে ইমন ব্লাকমেল পর্যন্ত করছিল। সবশেষে ওই দিন’ই অনিন্দিতার বাবার সবকিছুর ইতি টানার কথা ছিল কিন্তু সাথে ওনার ইতিও যে হবে, সেটা উনি বোধ হয় কল্পনাও করেননি।

অনিন্দিতার মা বলল,
– অনিন্দিতার বাবার সম্পর্কে আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাইনা। ঘৃণা জন্মে গেছে। তুমি ইমতিয়াজের ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করে বলো।

এহসানুল সরকার বলল,
– ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে ইমতিয়াজের কেসটা টাকা খাইয়ে ইমন জোরপূর্বক কোনো ভাবে বন্ধ করিয়ে ছিল। অবশ্য ইমনকে দিয়ে এটা একপ্রকার করানোই হয়।

ইমতিয়াজ, যে অফিসে চাকরি করতো, সেই অফিসের বস একজন মেয়ে। তবে বিধবা। ৩বছর আগে ওনার স্বামী মা*রা যায়। পরে আর বিয়ে করেনি। শুরু থেকেই ইমতিয়াজের উপর ওনার নজর ভালো ছিলনা। সুদর্শন পুরুষ হওয়ায় ইমতিয়াজের প্রতি উনি প্রথমেই একটু আকৃষ্ট হয়েছিলেন।এরপর ধীরে ধীরে আরও আকৃষ্ট হতে থাকেন। একসময় ইমতিয়াজকে ভালোবেসে ফেলে। যদিও এটাকে ভালোবাসা বলা যায় কি-না জানি না। ইমতিয়াজ বিবাহিত। ইমতিয়াজের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। কিছুদিন পর বাচ্চা হবে। সবকিছু জানা সত্যেও ইমতিয়াজকে বেশ কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাবসহ অনেক কুপ্রস্তাবও দিয়েছিল।

তবে ইমতিয়াজ মানুষ ভালো ছিল। কিছুটা সরল মনের। নিজ স্ত্রীর প্রতি ছিল তার অফুরন্ত ভালোবাসা। রাবেয়া চৌধুরীর কোনো প্রস্তাবেই সে রাজি হয়নি। একদিন অফিস ছুটি হওয়ার পরেও, বিভিন্ন কাজের অজুহাত দিয়ে ইমতিয়াজকে আটকে রাখা হয়। সেদিন-ই মনে মনে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো- সে। কিন্তু আর হলো না।

সেদিন ছল করে ইমতিয়াজকে নেশা জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়। যারপর নিজের সাথে অ*ন্ত*র*ঙ্গ ভিডিও ও কিছু ছবি ফোনে ধারণ করে পরবর্তীতে ইমতিয়াজকে ব্ল্যাকমেল করা হয়। তাই মন চাইলেও আর চাকরিটা ছাড়তে পারলো না ইমতিয়াজ। কিন্তু তারপরেও রাবেয়া চৌধুরীর সম্পূর্ণ হাতের মুঠোয় যেন কিছুতেই আসছিল না ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজকে নিজের করে পাওয়ার প্রবল লালসায় শেষমেষ শীর্ষ এক কন্ট্রাক্ট কিলার দ্বারা অনিন্দিতা এবং তার সন্তান উভয়কেই খু*ন করার ভয় ও হুমকি-ধমকিটা রাবেয়া চৌধুরীর অনেক কাজে লেগে যায়। ধীরে ধীরে ইমতিয়াজ সবদিক থেকে অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়ে যায়। রাবেয়া চৌধুরীর সম্পূর্ণ হাতের মুঠোয় চলে আসে। রাবেয়া চৌধুরীর কথা অনুযায়ী, সেদিন অফিস থেকে হুট করে ফিরে ইমতিয়াজ তোমাকে ডিভোর্সের কথা জানালো। তাছাড়া ইমতিয়াজের হাতে তখন কোনো অপশন ছিল না। পরিস্থিতি বুঝে চাইলেও পুলিশ বা কারো সাহায্য নিতে পারেনি। কাউকে বলতেও পারেনি। সবদিক থেকে ইমতিয়াজ নিরুপায় ছিল। ডিভোর্সটা না হওয়া পর্যন্ত দৃষ্টিবন্দী ছিল। কিন্তু তাই বলে ইমতিয়াজ এতো সহজেও হার স্বীকার করে নেয়নি।তাইতো সেও অনেক ভেবেচিন্তে ডিভোর্স নিয়ে একটা পরিকল্পনা করলো। প্রতিটি ধাপে ধাপে একাই প্লানিং সাজালো। সবকিছু ঠিক ছিল।

১৭ তারিখ,
আজ থেকে ৩’বছর আগে পরপুরুষে আকৃষ্ট হয়ে নিজের স্বামীকে খু*ন করা সহ রাবেয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরও অনেক প্রমাণই, ইমতিয়াজের হাতে আসলো। তার প্লানিং অনুযায়ী পরের দিন ১৮ তারিখ রাবেয়া চৌধুরীর সবকিছু ফাঁস করার কথা ছিল কিন্তু কিছু অসাবধানতা ও ভুলের জন্য ইমতিয়াজের সমস্ত প্লানিং সম্পর্কে রাবেয়া চৌধুরী জেনে গিয়েছিল। যা ইমতিয়াজ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

এহসানুল সরকার এইবার একটু থেমে অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে উঠলো,
– ১৭ তারিখ অর্থাৎ সেদিনই কাজের মেয়েটার সাহায্যে ইমতিয়াজের ঠান্ডা শরবতে সেই বিষটা মেশানো হয়।যার ১৩ঘন্টা পর ইমতিয়াজের মৃ*ত্যু হয়। মৃ*ত্যু*র পূর্বে আপনার সাথে কথা বলার আগে রাবেয়া চৌধুরীর সঙ্গে ইমতিয়াজের কথা হয়েছিল। অবশ্য রাবেয়া চৌধুরীর ফোন কলেই অতো রাতে ইমতিয়াজের ঘুম ভেঙে ছিল। তার সাথে কথা বলার দু’মিনিট পরেই বিষের প্রতিক্রিয়াটা তৎক্ষণাৎ শুরু হয়।

রুমের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করা ছিল। অন্যদিকে ইমতিয়াজের মা ছিল গভীর নিদ্রায়। কাজের মেয়েটা আড়ালে পানির সাথে ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। ইমতিয়াজের মায়ের, ইমতিয়াজ ছাড়া পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউই ছিল না। সেদিন ছেলের হাজারো চিৎকার চেঁচামেচি ও যন্ত্রনার আর্তনাদেও ওনার ঘুম ভাঙলো না। সল্প সময়ের মধ্যেই দুর্দন্ত পরিকল্পনা করেছিল রাবেয়া চৌধুরী। তবে ইমতিয়াজকে খু*ন করার বিষয়ে বারংবার ভেবেছিলেন, তিনি।

অনিন্দিতা নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়ে বলল,
– তাহলে ইমনের এখানে কী ভূমিকা ছিল?

এহসানুল সরকার বলল,
– ইমনের ভূমিকাও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্টেপে আছে। কারণ বেকার ইমনকে অফিসের সবচেয়ে বড় পজিশনে চাকরি দেওয়ার প্রবল স্পৃহা দেখিয়েই আপনার বাবার ফার্মেসি থেকে প্রথমে ওই বিষটা আনিয়ে ছিল। তারপর ইমতিয়াজদের বাসার কাজের মেয়েটাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে কাজটা করানো সহ সবকিছুই ইমনকে দিয়ে করিয়েছে। শুরুতে ইমন নাকচ করে দিলেও পরমূহুর্তে ঠিকই রাজি হয়ে গিয়েছিল। শেষে রাবেয়া চৌধুরীর কথাতেই তার কাছ থেকে মোটা অংকের যথেষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ইমতিয়াজের কেসটা কোনো একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে বন্ধ করালো। বলতে গেলে ইমন প্রায়ই সবকিছুই জানতো। তাছাড়া ইমতিয়াজের করা ডিভোর্সের ওই প্লানিংয়ের সাথে যারা যারা জড়িত ছিল, তাদের প্রত্যেককে অনেক আগেই টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সাথে রাবেয়া চৌধুরীর বিরূদ্ধে ইমতিয়াজের জমা করা সমস্ত প্রমাণও কত আগেই ভেনিস হয়ে যায়।

সবকিছু শোনার পর অনিন্দিতা কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। অনিন্দিতার মা-তো অনেক আগে থেকেই ভাষা হারিয়ে চুপ করে আছেন। এভাবেই কিছুক্ষণ পিনপিনে নিরবতা চললো। হঠাৎ অনিন্দিতা বলল,
– ইমতিয়াজের বাসার কাজের মেয়েটা এখন কোথায়? সবকিছুর জন্য যে মহিলা দায়ী, সেও এখন কোথায়? তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তো?

এহসানুল সরকার গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো,
– কাজের মেয়েটাকে গ্রাফতার করা হয়েছে। একটুর জন্য তার প্রাণটা বাঁচলো বলে। কিন্তু রাবেয়া চৌধুরীকে গ্রেফতার করতে পারিনি। সে মা*রা গেছে। আমি পৌঁছানোর আগেই সেরু ভাই সেখানে পৌঁছে গেছিল।

– ভালোই হয়েছে। ওর মতো নিকৃষ্ট মহিলার মরাই উচিত। আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে এহসানুল সরকার বলল,
– আর একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ইমনের সারা ডায়েরি জুড়ে,
অনিন্দিতা ঠক, অনিন্দিতা প্রতারক। অনিন্দিতা আমাকে ঠকাইছে। অনিন্দিতা আমার সাথে প্রতারণা করছে।
এই লিখাগুলোর বিষয়ে। এই কথা গুলো রাবেয়া চৌধুরীর কথাতেই ইমন তার সারা ডায়েরিতে লিখেছিল। জানি না কেনো।

অনিন্দিতার মা চোখের জল মুছে এবার বলে উঠলো,
– তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার মেয়েকে তুমি সাহায্য না করলে এতোকিছু কখনোই জানতে পারতাম না। সেই সাথে এতো সত্যও কখনো সামনে আসতো না। কখনোই বোধ হয় প্রকাশ হতো না।

চোখে টলমল করতে থাকা জল মুছে অনিন্দিতা বলল,
– আপনাকে কিছু বলার ভাষা আমার নেই। সবশেষে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

অতঃপর আরও কিছুক্ষণ তাদের সাথে ভালো মন্দ অনেক কথা বলার পর এহসানুল সরকার অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– তাহলে আমি আসি। ইমতিয়াজের মা’কেও সবকিছু জানাতে হবে। তারপর আমাকে আমার বাড়িতে ফিরতে হবে। ভালো থাকবেন আপনারা।

★★★★
৮ দিন পর।
সকাল ১০টায় রেস্টুরেন্টের ডান দিকের একটা সিটে বসে লাচ্ছি খাচ্ছিল এহসানুল সরকার। লাচ্ছি তার ভিষণ পছন্দের।সেই মুহূর্তে তার ফোন বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার। ফোন রিসিভ করে বললেন,
– কে?

ওপাশ থেকে কেউ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
– আমি।

– সেরু ভাই!

– চিনে গেছেন?

– তুমি আমার আশা-পাশে থাকলেও আমি বুঝতে পারি। অনুভব করতে পারি।

– প্রথমেই বলছি, ট্র্যাকিং করার কোনো চেষ্টা করবেন না। কোনো লাভ হবে না।

– তুমিকি এতোটাই বো*কা এমন কোনো কাজ করবে কী? সেটা আমি জানি। কেনো ফোন করেছো, এটা বলো?

– আপনি একটা ভুল ধারণা মনের মধ্যে পোষণ করে আছেন। যেটা ভাঙার জন্যই ফোন করা।

– কিসের ভুল ধারণা?

– আপনি মনে করেন, আপনি যেসব কেসের সাথে জড়ান। আমিও সেসবেই জড়িয়ে পড়ি। কথাটা ভুল। আমি কখন, কোথায় কিভাবে কার সাথে জড়াবো সেটা কেউ জানে না। কেউ জানবেও না। মাঝেমধ্যে অনেক কিছু কাকতালীয় হয়ে যায়। তবে আপনার সাথে চোর পুলিশের খেলা খেলতে আমার একটু বেশিই ভালো লাগে। অন্যরকম লাগে। জানি না সেটা কেনো।

এহসানুল সরকার মৃদু স্বরে বলল,
– মাঝে মাঝে তোমার জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়। তোমার নিদারুণ ভাগ্যকে খুব দোষ দিতে ইচ্ছে হয়। জন্মানোর পর যদি তুমি বাচ্চা চুরির চক্রে না পড়তে, তাহলে নিশ্চিত আজ তুমি আমার পাশে থাকতে। আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হতে পারতে। আজ থেকে প্রায়ই দু’বছর আগে যদি তোমার ফাঁসি হয়ে যেতো, তাহলে আমি বোধ হয় কখনো জানতেও পারতাম না। সেই তুমি কি-না আমার আপন রক্তের ভাই! এ কথা আমি বা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না। জানবেও না কখনো। কাউকে জানতেও দিবো না। ভেবোনা নরম করে কথা বলেছি দেখে, আমি তোমাকে ছাড় দিবো। কখনোই না। দু’বার রক্ষা পেয়েছো। দু’বছর আগে তোমার ফাঁসির মহা চক্রান্তের পিছনে যারা জড়িত ছিল, তারা সবাই সেদিন ধরা পড়েনি। আসল দু’জন কালপ্রিট গ্রেফতার হয়নি। তারাই আবার তোমাকে ২য়’বার জেল থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল। ভেবোনা বারবার তুমি এভাবে পালাতে পারবে। বারবার তোমার বিষয়টা ধামাচাপায় পড়ে যাবে। এখনো জানিনা সেই কালপ্রিট দু’জন কে? জানতেও বোধ হয় বেশি সময় লাগবে না। নিজের কোনো শেষ ইচ্ছে থাকলে সেটা পূরণ করে নিতে পারো। কারণ এইবার গ্রেফতার হলে তুমি আর পালাতে পারবে না। খুব শীগ্রই তুমি হোঁচট খেয়ে পড়তে চলেছো। যা তোমার অন্ত নিশ্চিত করবে। তোমার সেই পড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। যারপর আমি নিজ ইচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিবো। মা’কে নিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাবো।

ফোনের ওপাশ থেকে প্রত্যুত্তরে সেরু ভাই কর্কশ গলায় বলল,
– লাভ নেই। আপনি আমাকে কখনো ধরতে পারবেন না। আপনার চাকরি চলে যাবে। ততদিনে বুড়ো হয়ে যাবেন।আপনি অবসরে চলে যাবেন। আপনার সবকিছু থেমে যাবে। কিন্তু আমি বুড়ো হলেও আমার কোনো অবসর নেই। আমার কোনো কাজকর্ম থামবে না। কখনোই না। আপনার গল্পে হয়তো আমি চোর আপনি পুলিশ কিন্তু আমার সব গল্পে আমি ছাড়া বাকি সবাই চোর। সেরু ভাইয়ের গল্প, সেরু ভাইয়ের কাহিনি, কখনো শেষ হওয়ার নয়।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here