#হয়ত
পর্ব:- ২৫
.
আজ ভোরের দিকে ব্যস্ত ঢাকা নগরীর উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। অতি বৃষ্টি নয়। হঠাৎ আচমকা এসে কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপ্তিতে নগরীকে সতেজ নির্মল রূপ দিয়ে যেতে পারে এমন ধরণের বৃষ্টি। এখন আকাশ একদম পরিষ্কার। বর্ষণ হাটতে বের হচ্ছিল। প্রতিদিন সকালে রমনায় কয়েকটা রাউন্ড দিয়ে আসা ওর অভ্যাস। তিনদিন হলো তনয়া বেগম এসেছেন। অথৈকে নিজের বাড়ি তিনিও যেতে দেননি। ফ্ল্যাটে তো থাকার জায়গার অভাব পড়েনি। তাছাড়াও দিশার সেই দুঃসম্পর্কের চাচাদের আসতে দেরি হবে। তনয়া বেগম ধীরে সুস্থে আসতে বলেছেন উনাদের। সেই সাথে বর্ষণকে কিছু টাকা পাঠাতেও বলেছেন।
তাপৌষি কেবলই ঘুম থেকে উঠেছে। গতকাল রাতেও ওর ভালো ঘুম হয়নি। দারোয়ান ঘটিত সেই ঘটনা মনের মধ্যে এক কালো দাগ কেটে দিয়ে গেছে। দিশা আর অথৈ গভীর ঘুমে মগ্ন এখন। তাপৌষি কখনোই ওদের সকাল সকাল উঠতে দেখেনি। তবে ক্লাসের কারণে দিশা দুইদিন সকালে উঠেছিল।
-‘ তাপৌষি হাতমুখ ধুয়ে আসো। রুটি খাবে নাকি খিচুড়ি?’
সকালে খালি পেটে খিচুড়ি এখন কোন মতেই হজম হবে না। রুটি খাওয়া যায়।
-‘ রুটি খাবো খালামনি।’
-‘ আচ্ছা। আর বর্ষণ তুই?’
-‘ আমি হাটতে বের হবো মা। হেটে এসে খাবো।’
এতক্ষণে তাপৌষির নজর বর্ষণৈর উপর পড়ে। দরজার পাশে থাকা সু-ক্যাবিনেটের উপর বসে ট্রাক সু বাধছে। পড়নে ট্রাকিং স্যুট, হাতে একটা সাধারণ ঘড়ি। একটা পানির বোতল আর রুমাল রাখা আছে পাশে। হয়ত বের হওয়ার সময় এগুলো নিয়ে বের হবে।
-‘ আপনি কোথায় হাটতে যাচ্ছেন? ‘
-‘ রমনায় যাব। কেন?’
-‘ আসলে আমি বের হতে চাচ্ছিলাম। ঘরের গুমোট পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু মনে না করলে আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি?’
বর্ষণ হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকালো। অলরেডি ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। তাপৌষিকে নিতে গেলে আরও সময় চলে যাবে। না বলতে যেয়েও তাপৌষির মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বলল। তাপৌষি সম্মতি পেয়ে দ্রুত রেডি হতে চলে গেল।
.
বরাবরের মতো আজও তাপৌষি চটজলদি রেডি হয়েছে। বর্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল তাপৌষি সর্বোচ্চ পনেরো মিনিট নিয়েছে। মেয়েটাকে দেখলে বর্ষণ অবাক হয় বারবার। মেয়েটার পোশাকে সব সময় শালীনতা স্পষ্ট। এই যে হাটতে বের হচ্ছে তবুও জগিং স্যুট পড়ে নি। পড়েছে হালকা নীল রঙের লং জামা, চুরিদার পায়জামা আর একটা সুতির ওড়না। ভালো লাগে একে দেখলে।
.
রমনার বটতলার নিচে দাঁড়িয়ে আছে তাপৌষি। একবার রাউন্ড দিয়েই ও হাঁপিয়ে উঠেছে। বর্ষণ ঘাসের উপর বসে আছে।
-‘ তাপৌষি তুমি চাইলে এখানে বসতে পারো। কর্তৃপক্ষ বসার জন্য জরিমানা করেনা।’
তাপৌষি বর্ষণের কথায় বেশ লজ্জা পেল। ও আসলে বসতে চাচ্ছিল। তবে বর্ষণ ওর আগে বসেছে। ও যদি হুট করে পাশে বসে যায় তাহলে তো বর্ষণ খারাপ ভাবতে পারে।
-‘ না আমি ঠিক আছি।’
-‘ আরে বসো বসো। একটু বিশ্রাম নাও। এরপর আরেকটা রাউন্ড দিব। তুমি তো এক রাউন্ড দিতেই অস্থির হয়ে পড়েছ। আমি এখানে কমপক্ষে পাঁচ রাউন্ড তো দেই।’
বর্ষণ কী তাপৌষিকে কটুক্তি করলো? করতেই পারে। করাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে তাপৌষির কী দোষ? ও তো কখনো এমন ভাবে হাটতে বের হয়নি। একটু দম নিয়ে তাপৌষি বর্ষণের পাশে বসলো।
.
“হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে
দারুচিনি- দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে
সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটরের
বনলতা সেন।”
-‘ জি?’
-‘ কবিতা। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন।’
-‘ ওহ।’
এরপর দুজনের কথার সমাপ্তি ঘটে। তাপৌষি মাথা তুলে অন্তরীক্ষ পানে চায়। আকাশে আবার একদল দাপুটে কালো মেঘ নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে চলে এসেছে। মন বলছে আবার বৃষ্টি নামবে। এই অসময়ের বৃষ্টি তাপৌষির খারাপ লাগেনা। বরং ভালোই লাগে। রোদে পোড়া রাস্তা থেকে পোড়া গন্ধ ছড়ায়। সেই গন্ধ তাপৌষি প্রাণ ভরে গ্রহণ করে।
-‘ প্রেম করেছ কখনো জীবনে?’
-‘ জি?’
-‘ ভালোবেসেছ কখনো কাউকে?’
বর্ষণের এই অকস্মাৎ প্রশ্নে তাপৌষি কিছুক্ষণ নিরব থাকে। প্রেম, ভালোবাসা এই শব্দগুলো ওর কাছে এখন খুব পরিচিত। ও চাইলেই বর্ষণের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে পারে। তবে দিবেনা। অন্য কেউ এই প্রশ্ন করলে তাপৌষি সানন্দে এর উত্তর দিতো। কারণ প্রশ্নটা ওর খুব প্রিয়। এই যে এখন প্রশ্নকর্তা মানুষটিও খুব প্রিয়।
তাপৌষি বর্ষণের প্রশ্নের উত্তর দিল না। শুধু মিষ্টি করে হেসে আবার আন্তরীক্ষ পানে চাইলো।
বর্ষণের হৃদয় খচখচ করছে। গতকাল রাতে ও তাপৌষিকে একটা ছেলের সাথে ভিডিও চ্যাট করতে দেখেছে। কথা বার্তায় যত টুকু বোঝা গেছে, তুই তুকারি সম্পর্ক। হয়ত বন্ধু হবে। কিন্তু সহজ সরল তাপৌষির যে ছেলে বন্ধু থাকতে পারে সেই বিষয়টাই বর্ষণ হজম করতে পারছে না।
-‘ উত্তর দিলে না যে..’
-‘ উত্তর না আবার হ্যাঁ।’
-‘ বুঝলাম না।’
-‘ প্রেম করিনি তবে ভালোবেসেছি।’
-‘ কে সে?’
তাপৌষির কেন যেন বলতে ইচ্ছা করছে “আপনি সে”। তবে কথাটা গলা অবধি এসে আটকে গেল। তবে এরপর ও সরাসরি বর্ষণের সুন্দর চোখের দিকে চেয়ে উত্তর দিল,
-‘ আছে কেউ একজন। খুবই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তার পারসোনালিটি, চাল-চলন, কথা-বার্তা যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। ভালোবাসার সঙ্গা তো তার কাছে থেকেই শিখেছি। তবে আমিই তাকে ভালোবাসি। তার দিক থেকে কোন সাড়া নেই। একতরফা ভালোবাসা বলতে পারেন।’
বর্ষণকে আজ হয়ত কেউ সম্মোহন করেছে। নইলে ও এতক্ষণ তাপৌষির চোখের দিকে চেয়ে থাকতো না। তাপৌষির চোখে ও সত্য দেখতে পাচ্ছে। ভালোবাসার সত্য। আপন হৃদয়ের কথাগুলো বলার সময় তাপৌষির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। মেয়েটা সত্যি প্রেমে পড়েছে। ভয়ানক প্রেম যাকে বলে। বর্ষণের মন বলছে এটা তাপৌষির জীবনের প্রথম প্রেম। বালিকার প্রথম প্রেম যে সর্বনাশা। তাপৌষির চোখে এই সত্য ভালোবাসার পাশাপাশি বর্ষণ অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে। নিজের প্রতিচ্ছবি তাপৌষির চোখের মণি তে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাপৌষি প্রেমে পড়েছে তবে যার প্রেমে পড়েছে সে মানুষটি আর কেউ নয় বর্ষণ নিজেই।
মাথার স্নায়ু কাজ করছে না মনে হচ্ছে। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ব্ল্যাংক হয়ে পড়েছে। বর্ষণ তাপৌষির চোখ থেকে চোখে সরিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। ফিরার সময় হয়ে গেছে। আজ আর হাটা হবে না।
-‘ চলো উঠি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘
তাপৌষি গা ঝারা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর কেন জানি মনে হচ্ছে আজ বর্ষণ ওর চোখের সাথে সাথে হৃদয় ডায়রিও পড়েছে। সেখানের প্রতিটি পৃষ্ঠায় নিজের নামের কাব্য দেখেছে।
.
সেগুনবাগিচা দিয়ে যাওয়ার সময় বর্ষণ তাপৌষকে নিয়ে কাঁচা বাজারে ঢুকে। বাসায় রান্নার মতো তেমন কিছু নেই। ফ্রিজ প্রায় খালি। তনয়া বেগম নারিশ্যা থেকে অনেক কিছুই নিয়ে এসেছিলেন। তবে তার কোন কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। এসময় বাজারে একটু ভিড় হয়। তবে আজ যেন বেশিই ভিড় হয়েছে। আশেপাশে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ। কিছু মহিলাও আছে। তাপৌষি বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। কেউ হয়ত হাটতে লেগে ভুলে ধাক্কা দিয়ে ফেলছে তো কেউ আবার ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। বর্ষণের দুই হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ। তাপৌষি বারবার করে বলেছিল কিছু ব্যাগ ওকে দিতে। বর্ষণ তাপৌষির কথা শোনেনি। ধাক্কাধাক্কিতে তাপৌষির অবস্থা বেহাল। গরম লাগছে খুব। একটু আগে পেট বরারব কেউ হাতের কুনুই দিয়ে আঘাত করেছে ভিড়ের মাঝে। ব্যথা করছে এখন। বর্ষণ একবার তাপৌষির দিকে তাকাল।
-‘ বাড়ি যাবে তাপৌষি?’
-‘ বাজার করা শেষ? ‘
-‘ নাহ, মাছ কেনা হয়নি। থাক পরে এসে কিনে নিব। চলো তুমি।’
-‘ আমি ঠিক আছি। আপনি কিনুন।’
বর্ষণ তাপৌষিকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। ঘামের কারণে পিঠে জামা শেটে গেছে। ওর মাছ না কিনলেও চলবে। গ্রামে পুকুরে চাষ করা কৈ মাছ আছে ফ্রিজে। তনয়া বেগম নিয়ে এসেছেন। তবে রৌদ, দিশা দুজনের একজনও কৈ মাছ মুখে তোলে না। ওদের এই মাছ নেকি গন্ধ লাগে।
তাপৌষির অবস্থা দেখে বর্ষণের খারাপ লাগছে। না খেয়ে মেয়েটা ওর সাথে কাঁচা বাজারে হাটাহাটি করছে। একটা পরিকল্পনা ওর মাথায় এসেছে। তবে বিবেকে বাধছে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে। একটু আগে যে ও তাপৌষির চোখে নিজের জন্য অন্যরকম এক জায়গা দেখতে পেয়েছে। তাই বলে মেয়েটাকে বাজারের উপস্থিত কিছু নোংরা লোকদের নোংরামির শিকার হতে দিতে পারেনা ও। বাধ্য হয়েই তাপৌষিকে সামনে হাটতে বলে বাজারের দুই ব্যাগসহ হাত দুটো দিয়ে তাপৌষির ডানেবামে প্রাচীর তুলল বর্ষণ। তাপৌষির পিছন পিছন ও হাটছে। চমৎকার পুরুষালি পারফিউমের গন্ধ তাপৌষির নাকে এসে লাগছে। এটা বর্ষণের পারফিউমের গন্ধ। ও এখন বর্ষণের দুই হাতের মাঝে বন্দি। ওর পিঠ ঠেকে আছে বর্ষণের বুক বরাবর। সুক্ষ্ম ভালোলাগার এক স্রোত তাপৌষির মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে চলেছে। ভুল মানুষকে সে মন দেয়নি। মানুষটা সচেতন, বিবেকবান, আত্মসংযমী, আত্মপ্রত্যয়ী সেই সাথে দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন একজন পুরুষ।
.
.
চলবে…
(গল্প পড়ে সমালোচনা করলে ও ভুল ধরিয়ে দিলে খুশি হবো।)