#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১১
#Saji_Afroz
আজরার সাথে স্টেজে বসে রয়েছে নাবীহা। ইনতিসার কিছুক্ষণ ছিল। কিন্তু এখন নেই। কয়েকটা ছবি তুলেই সে স্টেজ থেকে নিচে নেমে যায়। মেহমানদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত সে।
আজরা বলল, এই মানতাশা টা গেল কোথায়?
-আছে হয়তো কোথাও!
নাবীহা ও আজরা কথা বলছে। ইনতিসারের দৃষ্টি না চাইতেও বারবার সেদিকে যাচ্ছে। তবে আজরার জন্য নয়। নাবীহার জন্য।
নিজের এরূপ কাণ্ডে নিজের উপরেই বিরক্ত ইনতিসার। সে ছাদ থেকেই নেমে যাচ্ছে। এখানে থাকলে নাবীহা কে দেখে আরও অস্থির হয়ে উঠবে তার মনটা।
তাড়াহুড়োয় সিঁড়ি বেয়ে নামার পথে মানতাশার সাথে ধাক্কা লাগে তার।
ইনতিসার ব্যস্ত হয়ে বলল, দুঃখিত।
তাকে দেখে বান্ধবীদের দেওয়া বাজির কথা মনে পড়ে মানতাশার। নিজের চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলল সে, আপনি ঠিক আছেন তো?
-জি।
আর কোনো কথা না বলে ইনতিসার স্টাডি রুমে চলে যায়। তার পথের দিকে চেয়ে রয়েছে মানতাশা।
এই লোকটি কে তার বশে আনতে হবে। কিন্তু বিবাহিত একজনের সাথে এসব করতে কেমন যেন লাগছে তার। আবার না করলেও বাজিতে হেরে যাবে। একদিকে এজাজ কে কীভাবে সরাবে সেই চিন্তা। আবার এদিকে যুক্ত হলো নতুন চিন্তা। তা হলো ইনতিসার কে কীভাবে বশে আনবে!
উফফ! চিন্তায় চিন্তায় মাথাটাই হয়তো ফেটে যাবে তার।
এই ভেবে ছাদে উঠতে লাগলো মানতাশা। উঠে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল সে। তাকে দেখে আজরা কাছে ডাকলো। মানতাশা এসে পাশে বসতে বসতে বলল, ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা!
-হ্যাঁ রে আজরা, তোর বাড়িটা এত সুন্দর! রুমটাও দারুণ। সব রুমই কী এত সুন্দর?
আজরা হেসে বলল, আমি নিজেও এখনো পুরো বাড়ি ঘুরে দেখিনি।
-কী বলছিস?
-হু। দেখব আরকি। আমারই তো বাড়ি। এখনো নতুন বউ। ওভাবে ছুটাছুটি করলে কেমন দেখায় না?
-উনারা তোকে দেখতে বলেনি?
-ব্যস্ত ছিল বউ ভাতের আয়োজনে।
একটু থেমে মানতাশা দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বলল, গতকাল কী করলি? বল বল?
-কী করলাম মানে?
নাবীহার দিকে তাকিয়ে মানতাশা বলল, শোনো মেয়ের কথা? কী করলো মানে বুঝছে না!
মানতাশার কথা শুনে নাবীহাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল। সে বলল, থাক না ওসব কথা এখন।
-কেন থাকবে? এই আজরা বল না কী হলো? বাসর রাতে কী কী হলো?
আফসোরের সুরে আজরা বলল, হতে হতেও হয়নি রে।
-মানে?
-মানে শুরু তো করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি।
-কী বলছিস?
-হু।
-থেমে গেল কেন?
-বললেন মাত্রই বিয়ে হয়েছে। আগে দু’জন দু’জন কে সময় দিই। ওভাবে হুট করে শুরু করা তার উচিত হয়নি।
-তুই কিছু বললি না?
-কী বলব?
-আরে তুই যে সেটাই কিছু মনে করিস নি?
-বলেছি। তবে যে আমার ভালো লাগছিল ওসব বলতে পারিনি। কেমন দেখায় না!
মাথায় হাত দিয়ে মানতাশা বলল, তুইও না! আর ইনতিসার ওমন আচরণ করলো কেন! বাসর রাতে বুঝি সবাই গল্পই করে শুধু? বাসর করে না? আমার তো মনে হচ্ছে অন্য কারণ।
-কী?
-হয়তো তার মন অন্য ভাবনায় চলে গিয়েছিল তখন।
এই বলে সে আড়চোখে তাকালো নাবীহার দিকে। মানতাশা কী বোঝাতে চাচ্ছে তা বুঝতে পেরে নাবীহা বলল, কী যে বলিস না তুই! প্রথম দিনেই সব হতে হবে কেন? সারাজীবন পড়ে আছে এসব করার জন্যে।
-শুরু তো করেছিল। মাঝপথে থামলো কেন এটাই ভাবার বিষয়।
-কী ভাবার আছে এতে!
-ওই সময় তার এমন কী ভাবনা এলো যে ওমন একটা বিশেষ মুহুর্তে নিজেকে কন্ট্রোল করে ফেললো?
এইবার চিন্তার ভাজ পড়ে আজরার কপালে।
সেই মুহুর্তটার কথা ভাবলে গা শিউরে উঠে তার। মনে হয়েছিল যেন সুখের বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলো সে। অন্য কিছুই তার মাথায় ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিলো আরও গভীরে হারিয়ে যেতে চায় সে। মিশে যেতে চায় ইনতিসারের সাথে। ইনতিসারেরও কী এমনটা মনে হয়নি? হলে নিজেকে সামলে নিলো সে কীভাবে!
আজরা কে নিশ্চুপ দেখে নাবীহা বলল, দেখ আজরা! তোদের পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হয়েছে। উনি হয়তো দ্বিধা নিয়ে শুরু করলেও কন্টিনিউ করতে পারেনি তুই কী ভাবছিস মনে করে।
নাবীহার কথা শুনে নিজের মন কে শান্তনা দিয়ে আজরা বলল, আমিও এটাই ভেবেছি।
-এটাই হবে। এসব কথা ছাড় তো।
এরমধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা এসে বলল, বান্ধবীদের সময় দিলেই হবে! আমাদেরও নতুন বউ এর মুখ দেখার সুযোগ দিতে হবে তো!
এই বলে তিনি আজরার দিকে এগিয়ে আসলেন। তাকে দেখে বললেন, সে কী! নতুন বউ এর নাকে নাক ফুল নেই কেন?
আজরা আমতাআমতা করে বলল, আসলে আমার পরার অভ্যেস নেই তো। ভুলে গিয়েছিলাম।
-মানুষ জন কী ভাববে! পরে নাও পরে নাও।
নাবীহা বলল, কোথায় রেখেছিস? আমি নিয়ে আসি।
-ড্রেসিং টেবিলের প্রথম ড্রয়ারেই একটা ছোট বাক্সে পাবি। কাউকে জিজ্ঞাসা করলে দেখিয়ে দেবে আমার রুম।
-আচ্ছা।
এই বলে নাবীহা নেমে যায়। হাসনা রাও চলে এসেছে। নাবীহা তাদের দেখে দাঁড়ালো। তারা আজরার বাড়ি সম্পর্কে বলতে শুরু করে। নাক ফুল আনতে যাচ্ছে শুনে একজন বলল, সেই সুযোগে আজরার রুমটাও দেখে আয়। অনেক সুন্দর!
কথাটা কেমন যেন লাগলো নাবীহার কাছে। সে বলল, ওর রুমে যেতে আমার সুযোগের অপেক্ষা কেন করতে হবে? যখন খুশিই যেতে পারি।
-না আমি কথার কথা বললাম।
এই বলে কথা ঘুরিয়ে মেয়েটি অন্য কথা বলতে শুরু করে।
.
.
.
-মনের ভেতরে থাকা সমস্ত ভাবনা একপাশে রেখে এখন শুধু এটা ভাব যে, তোর স্ত্রী রয়েছে। ওর সাথে সময় কাটা। সুন্দর কিছু মুহুর্ত তৈরী কর। দেখবি আর কোনো ভাবনা আসছে না তোর মনে। এভাবে নাবীহা কে ভাবতে থাকলে তো আজরার প্রতি কোনো টান তুই অনুভব করবি না! মেয়েটার কথা ভাব একবার! সে কিন্তু তোকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে। তোরও উচিত নিজেকে ও তাকে একটা সুযোগ দেওয়া।
বন্ধু আসমলের কথা শুনে যেন সাহস পেল ইনতিসার। একমাত্র তাকে মনের সব কথা বলে শান্তি পায় সে। আর সেও তাকে সবসময় ভালো পরামর্শ দেয়।
আসমলের কথা শুনে সে বলল, আমি চেষ্টা করব।
-এখন থেকেই কর?
-মানে?
-মানে উপরে যা। বউ এর সাথে সময় কাটা। একগাল হেসে ইনতিসার ছুটে যায় ছাদের দিকে।
.
.
বান্ধবী দের সাথে কথা শেষে নিচে নেমে আসে নাবীহা। একজন কর্মচারীর কাছে আজরার রুম কোন দিকে তা জানতে চায় সে। সে রুম দেখিয়ে দিলে নাবীহা সেখানে প্রবেশ করে। যদিও এর আগে কাউকে না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করতে হয়েছিল তাকে।
আজরার বিশাল রুম দেখে তাকেও এক নজর চোখ বুলাতে হলো। পরিপাটি রুমটাতে বিছানার পেছনের দেয়ালে ইনতিসারের একটি বড়ো ছবি টাঙানো রয়েছে। ক’দিন বাদে হয়তো এই ছবিটি সরিয়ে আজরার সাথে তোলা কোনো ছবি টাঙানো হবে।
এই ভেবে সে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। আজরার কথা মতো ড্রেসিংটেবিল এর প্রথম ড্রয়ারে নাক ফুল খুঁজতে শুরু করলো সে। এবং খুব তাড়াতাড়ি পেয়েও যায়।
নাবীহার ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। এসেছে যখন আজরার ওয়াশরুম ব্যবহার করা যাক। এই ভেবে সে প্রবেশ করে ওয়াশরুমে।
.
.
.
ছাদের দরজা অবধি এসে থেমে যায় ইনতিসার। স্টেজে আজরা কে দেখে না। পাশেই তার একজন বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে। ইনতিসার তার কাছে আজরা কোথায় জানতে চায়।
জবাবে সে বলল, স্টেজ থেকে তো নিচে নামবে বলে নেমেছিল। হয়তো রুমে গেছে!
একথা শুনে ইনতিসার আবারো নিচে থামতে থাকে।
রুমে এসে আজরা কে পায় না সে। তবে ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ শুনে বুঝলো, আজরা ভেতরে আছে।
কালকের বিষয়টির জন্য অনুতপ্ত ইনতিসার। আজ থেকে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে আজরাতেই আঁটকে থাকতে চায়। নাবীহার উপস্থিতির মাধ্যমেই শুরুটা হোক। কেন তার উপস্থিতি ইনতিসারের মন কে অশান্ত করবে! তার মন শান্ত হয়ে থাকতে চায় আজরার ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যমে। সবাই উপরে আছে। এই সুযোগে আজরা কে নিজের বাহুডোরে নিয়ে সবকিছু ভুলে নতুন এক শুরুর পথে চলতে চায় ইনতিসার।
এই ভেবে রুমের লাইট বন্ধ করে দেয় সে। ওয়াশরুমের পাশে এসে অপেক্ষা করতে থাকে আজরার জন্য।
এদিকে নাবীহা ফ্রেশ হয়ে নিজের জামা-কাপড় ও চুল ঠিক করে ওয়াশরুমের দরজাটা খুললো। সে কী! রুম এত অন্ধকার কেন? এটা ভেবে ওয়াশরুমের বাইরে এক পা রাখতেই নিজের হাতে টান অনুভব করে নাবীহা। কিছু বুঝে উঠার আগেই কারও বুকের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। নাবীহার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হওয়ার আগে ইনতিসার তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ভয় পেওনা! আমি…
ইনতিসারের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো নাবীহা। সে কী ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে নাকি তাকে আজরা ভেবেছে?
এদিকে আজরাও রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্টেজ থেকে নেমেছিল। ভেবেছে নাবীহার যদি রুম খুঁজতে অসুবিধে হয়?
কিন্তু নিচে নামার পর ইনতিসারের এক আত্মীয়া তাকে একপাশে নিয়ে যায় ছবি তোলার জন্য। যার কারণে ইনতিসার এসে তাকে স্টেজে পায়নি।
ছবি তোলা শেষে মানতাশা কে সাথে নিয়ে নিচে নামতে থাকে আজরা। এতক্ষণেও নাবীহা আসেনি মানে রুম খুঁজতে হয়তো অসুবিধে হচ্ছে তার। এই ভেবে আজরা দ্রুত হাঁটতে বলল মানতাশা কে। মানতাশা ভাবছে অন্য কথা। রুম খুঁজে না পেলে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতো বা মানতাশা তাকে ফোন দিয়েছিল তা রিসিভ করতো। গেল কোথায় এই মেয়ে? তার মতো ওয়াশরুমে যায়নি তো? যেতেই পারে। এই আজরা অহেতুক এত দুশ্চিন্তা করে।
এই ভারী পোশাক নিয়ে নিচে নামতে হচ্ছে বলে আজরার প্রতি বিরক্ত মানতাশা।
.
চলবে#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১২
#Saji_Afroz
আজরা কাঁপছে। তা বুঝতে পেরে ইনতিসার বলল,
তুমি কী খুব বেশি ভয় পেলে আজরা?
এইবার ইনতিসারের কাছ থেকে এক ঝাটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নাবীহা। তার এমন কাণ্ডে ইনতিসার অবাক হয়। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই নাবীহা বলল, লাইট কোনদিকে? প্লিজ জ্বালিয়ে দিন। আমি আজরা নই।
তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় ইনতিসার। কিন্তু সময় নষ্ট না করে রুমের লাইট অন করে সে। নাবীহা কে দেখে চমকে উঠে ইনতিসার। সে বলল, আপনি এখানে?
নাবীবা বলল, আজরা পাঠিয়েছিল নাক ফুল নিতে।
এই বলে মাথা নিচু করে ফেললো নাবীহা। ইনতিসার নিজের করা কর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে বলল, আসলে আমি ভেবেছি আপনি আজরা! ওর এক বান্ধবী বলেছিল ও নিচে এসেছে। আমি খুবই দুঃখিত।
-ইটস ওকে।
এই বলে আর সময় নিলো না নাবীহা। ড্রেসিংটেবিল এর উপর থেকে নাক ফুল টা নিয়ে একপ্রকার ছুটেই রুম থেকে বেরুলো সে। পথিমধ্যে তার দেখা হয় আজরা ও মানতাশার সাথে। মানতাশা কটমট করতে করতে বলল, ফোন কেন ধরছিলি না?
-সাইলেন্ট ছিল!
আজরা বলল, আমি আরও টেনশন করছিলাম।
মানতাশা বলল, এতবড়ো বাড়িতে হারিয়ে যাবি বলে টেনশন করছিল ও।
কথাটা যে তাকে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে ভালোই বুঝতে পেরেছে নাবীহা। সে আজরার দিকে নাক ফুলের বাক্সটা এগিয়ে দেয়। আজরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তা পরিয়ে দিতে বলল।
নাবীহা তার নাকে ফুলটা পরিয়ে দিতে থাকে। আজরা খেয়াল করলো, নাবীহার হাত কাঁপছে। সে বলল, ঠিক আছিস তুই? হাত কাঁপছে কেন?
-কই না তো! আমি ঠিক আছি। কী হবে আমার?
ওদিকে ইনতিসার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো বিছানার উপরে। যতবার সে মনকে বুঝিয়ে আজরার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে যায়, ততবারই নাবীহার চিন্তা তার মাথায় আসবে। আজ তো নাবীহা সরাসরিই চলে এসেছে। তাও তার বাহুডোরে! এতবড়ো ভুল সে কীভাবে করলো?
নাবীহা কী বিষয়টা সহজ ভাবে নিয়েছে নাকি ভুল বুঝছে তাকে? আর যদি আজরাকে এসব বলে! সেও বা কী ভাববে?
এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠে ইনতিসার। ঠিক তখনি ইলারা জামানের ফোন আসলো। তিনি বললেন, জামাই বউ কোথায় চলে গেলি? সবাই তোদের খুঁজছে।
-আসছি মা।
এই বলে ইনতিসার বেরিয়ে আসে। একটু আসতেই সে আজরা, মানতাশা ও নাবীহার দেখা পায়। তাকে দেখেই নাবীহা ছাদের দিকে হাঁটা শুরু করে। তার পিছু নেয় মানতাশা।
আজরার হাসি মুখ দেখে ইনতিসার বুঝলো, তাকে নাবীহা কিছু জানায়নি। পাশে এসে তার সাথে কথা বলে বিষয়টা আরও ভালোভাবে বুঝলো সে। শান্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে নাবীহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো সে আপনমনে।
.
.
-শুনেছি ইনতিসার নাবীহা কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল?
-তাই! তবে হয়নি কেন বিয়ে?
-নাবীহার পরিবার চায়নি। সাজিরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার।
-এতবড়ো ভুল করলো তারা? নাবীহা এখানে এসে এসব দেখে নিশ্চয় পস্তাবে।
-ওর নসীবেই ছিল না আসলে এসব।
তারা এসব কথা বলতে এতই ব্যস্ত যে, কখন নাবীহা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি।
বান্ধবীদের এসব কথা শুনে নাবীহা বলল, মোটে পস্তানোর মতো কিছু হয়নি। আজরা যে ভালো আছে এটা দেখেই আমি অনেক খুশি। আর এসব কথা তোদের কে বলেছে?
তারা সবাই মানতাশার দিকে তাকাতেই নাবীহা বুঝলো এটা তার কাজ। মানতাশা আমতাআমতা করে বলল, আমি তো জাস্ট তোর সুনাম করতেই বলেছিলাম। এই যে তুই সাজিরের জন্য এতসব কিছু ছাড়লি…
তাকে থামিয়ে নাবীহা বলল, এসব নিয়ে আর কখনো যেন তোকে কিছু বলতে না শুনি।
এই বলে নাবীহা অন্যদিকে চলে যায়। অন্যান্য বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে মানতাশা বলল, আফসোস সে ঠিকই করছে। কিন্তু প্রকাশ করছে না। দেখবি খুব দ্রুত সেটাও করবে।
.
.
অনুষ্ঠান শেষে যে যার বাড়িতে চলে আসে।
বাড়ি পৌঁছে মানতাশা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই তার ফোনের রিং বেজে উঠে। এজাজের ফোন দেখে বিরক্ত হলেও রিসিভ করলো সে। নাহলে যে প্রতিনিয়ত ফোন আসতে থাকবে জানা আছে তার। সে রিসিভ করতেই এজাজ বলল, এসেছ বাসায়?
-হু।
-কবে এলে?
-মাত্রই।
-আজরা ভালো আছে?
-অনেক ভালো আছে! এত বিশাল বাড়িতে কে খারাপ থাকতে পারে বলো তো?
-বিশাল বাড়ি?
-হু। আজরার কপালের মতোই বিশাল। ওর কপালটা একটু বড়ো বলে অনেকেই মজা নিতো। অথচ মুরুব্বি দের কথাই ঠিক হলো।
-কী কথা?
-এই যে, যাদের কপাল বড়ো হয় তারা ভাগ্যবতী হয়।
-তোমার কপাল তো বড়ো না। তবুও তুমি ভাগ্যবতী।
-কীভাবে?
-আমাকে পেতে চলেছ বলে।
ব্যঙ্গসুরে মানতাশা বলল, তোমার কী ইনতিসারের মতো বিশাল বাড়ি আছে? না আছে অনেক গুলো গাড়ি?
-যতটুক আছে আলহামদুলিল্লাহ। এতেই সারাজীবন ভালোভাবে কেটে যাবে আমাদের। তাছাড়া আমার সুন্দর একটা মন আছে না? যেই মনটা পুরাটাই তুমি তুমি করে।
এসব কথা শুনতে বিরক্ত লাগছে মানতাশার। তাই সে কথা শেষ করার জন্য বলল, ঘুম পাচ্ছে।
-স্বাভাবিক। ক্লান্ত তো। আচ্ছা ঘুমাও।
এজাজ কে বিদায় জানিয়ে ফোন রাখলো মানতাশা। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজরার শশুরবাড়ির প্রতিচ্ছবি। মানতাশার কপালেও কী এমন শশুরবাড়ি জুটবে?
.
.
.
আজ মা বাবার সাথে নিজের বাড়িতে এসেছে আজরা। তিনদিন এখানেই থাকবে সে।
চিরচেনা এই বাড়িটা তার কত আপন! অথচ আজ এখানে এসেও মন শান্ত নয়। ইনতিসারের কথা যে খুব করে মনে পড়ছে। তিন দিন তার দেখা পাবে না ভাবতেই কষ্ট লাগছে। এটাই বুঝি স্বামীর প্রতি ভালোবাসা?
ইনতিসার রুমে এসে বিছানার দিকে চোখ পড়তেই আজরার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। কাল গুটিসুটি মেরে মেয়েটা শান্তির ঘুম দিয়েছিল এখানে। আজ সে নেই। যদিও তিন দিন পরেই সে চলে আসবে।
এই ভেবে ফ্রেশ হয়ে আসে ইনতিসার। নাবীহার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠে সে।
নাবীহা কে এতটা কাছে পেয়ে তার কী খুশি হওয়া উচিত ছিল? কিন্তু সে তো খুশি হতে পারেনি। বরং এরূপ কাণ্ডের জন্যে লজ্জিত সে৷ না জানে এসব নিয়ে নাবীহাই বা কী ভাবছে!
.
.
সকালে কারও চিৎকারে ঘুম ভাঙে নাবীহার। দ্রুত ড্রয়িংরুমে ছুটে এসে দেখলো তার মা নায়লা খাতুন কাঁদছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছে বড়ো বোন নাফিসা। তার চোখেও পানি। কী হয়েছে জানতে চাইলে নাফিসা ভাঙা গলায় বলল, তালাক দিয়েছে আমাকে।
একথা শুনে বিস্ময় এর শেষ পর্যায়ে চলে যায় নাবীহা। সে বলল, কেন?
-তাদের অনেক লোভ। বাবার কাছ থেকে বারবার টাকা চাইতে বলতো ব্যবসার জন্য। কিন্তু আমি তো জানি বাবা টাকা দিতে পারবে না। তাই বলিওনি। এসব নিয়ে ঝগড়া হত। আর আজ আমাকে তালাকই দিয়ে দিলো!
বিকট শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় সকলে। তারা দেখলো, মোহাম্মদ জাকির মেঝেতে পড়ে রয়েছেন। নাবীহা চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলো-
বাবা!
.
.
একা একা ভালো লাগছে না আজরার। ইনতিসার কে ফোন দেবে দেবে করেও দিতে পারছে না। অপেক্ষা করছে ইনতিসারের ফোনের। কারণ সে ব্যস্ত মানুষ। অফিসেও থাকতে পারে এই সময়ে।
সময় কাটানোর জন্য মানতাশা কে ফোন করে বাসায় আসতে বলল আজরা। এরপরই নাবীহা কে ফোন দেয় সে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করলো নাবীহা। আজরা তাকে কোথায় জিজ্ঞাসা করলে ওপাশ থেকে সাজিরের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে। আজরা বলল, নাবীহা কোথায়?
নরমস্বরে সাজির বলল, আছে। একটা অঘটন ঘটেছে।
চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনে আজরা জানতে চাইলো, কী হয়েছে? এত শব্দ কেন?
-নাবীহার বাবা আর এই পৃথিবী তে নেই।
কথাটি শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো আজরা। কী বলবে বুঝতে পারছে না সে। সাজির বলল, এখন আমরা হাসপাতালে।
-আমি এখুনি আসছি।
-এখানে এসো না। বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ওখানেই এসো।
এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় সাজির। আজরা নাবীহার কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলো। প্রাণ প্রিয় বাবাকে হারিয়ে নিশ্চয় পাগলপ্রায় হয়ে গেছে মেয়েটা!
.
চলবে
.