একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব -৯+১০

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৯
#Saji_Afroz

বাসর ঘরে বসে রয়েছে আজরা। তার চারদিকে ফুলে সাজানো। মজার কথা হলো, এখানের অনেক ফুলের নামই সে জানেনা! একথা ইনতিসার জানলে নিশ্চয় হাসবে। তাই না জানানোই শ্রেয়।
ইনতিসারের রুম দেখে বেশ ভালো লাগলো আজরার। বিশাল রুম তার। আজরাদের তিন রুমের সমান হবে হয়তো এই একটি রুমই। আর এক রুমেই কত ধরনের আসবাবপত্র! এমনটা সিনেমাতে দেখতো আজরা, বড়ো লোকের রুমের অবস্থা এমনই হয়। তার কপালেও যে এমন কিছু লেখা ছিল ভাবেনি সে।
এসব ভাবতে ভাবতে ইনতিসারের দেখা পেল। ভেতরে প্রবেশ করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো সে। তাকে দেখেই বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করলো আজরার। ইনতিসার
ধীরপায়ে আজরার দিকে এগিয়ে এসে তার পাশে বসলো। হালকা কেশে বলল, ফ্রেশ হয়ে আসতে পারেন আপনি ।

এমন কিছু আজরা আশা করেনি। তবে মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। কেননা তার আসলেই এমন ভারী পোশাকে অসহ্য লাগছিল। সে মাথা নেড়ে সাই জানিয়ে উঠে পড়লো। ব্যাগ থেকে একটি শাড়ি বের করে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে।

ইনতিসার তার শেরওয়ানি বদলে নেয়। এরপর বারান্দায় আসে। বাসর রাত নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তার! প্রতিটা মানুষেরই তাই থাকে।
ভেবেছিল প্রিয় মানুষটার হাতে হাত রেখে গল্প করবে, তার কোলে মাথা রেখে করবে ভালোবাসার প্রকাশ। আর এরপরে…
কিন্তু ইনতিসারের বাসর রাত নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই। নেই কোনো আগ্রহ! বরং শরীর অবসাদ হয়ে আসছে। এমনটা হওয়ার কারণ কী নাবীহা?
তার বিয়ে হয়েছে, নাবীহার হবে। তবুও ইনতিসারের মাথায় সে কেন ঘুরপাক খাচ্ছে?
এসব ভেবে মাথাটা ধরে আসছে ইনতিসারের। এক কাপ কফি প্রয়োজন তার। তাই সে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসে। চ্যাঁচিয়ে বুয়াকে ডেকে তার জন্যে কফি নিয়ে আসতে বলে স্টাডি রুমে। এই বলে সে এগিয়ে যায় স্টাডি রুমের দিকে। রুমে এসে এসি অন করে ইজি চেয়ারে বসে পড়লো সে।

এদিকে তার পিছু নিয়েছে ইলারা জামান। বিয়েতে নাবীহা কে দেখার পর থেকেই তিনি চিন্তিত ছিলেন। এখন ইনতিসারের আচরণে এটা স্পষ্ট যে, বিয়েতে নাবীহা কে দেখে তার জীবনে প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাব যাতে দীর্ঘ দিন স্থায়ী না হয়, এই বিষয়ে ইনতিসারের সতর্ক হয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
এই ভেবে তিনি স্টাডি রুমে এলেন। মা কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ইনতিসার। তাকে বসতে বলে নিজেও তার পাশে চেয়ার টেনে বসলেন ইলারা জামান।
কোনো ভনিতা না করেই তিনি বললেন, এমন একটা বিশেষ মুহুর্তে এখানে একা এসে বসে আছিস?
-কফি খেতে ইচ্ছে করছিল।
-সেটা আজরার সাথে বসে একসাথে খাওয়া যেত না?
-সে তো ফ্রেশ হচ্ছে।
-অপেক্ষা করতি!
-আচ্ছা বুয়াকে বলছি দু’কাপ বানাতে কফি।

এই বলে ইনতিসার উঠতে চাইলে তাকে আটকালেন ইলারা জামান। তিনি বললেন, আজ নাবীহা কে দেখেছিলাম বিয়েতে।

ইনতিসার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ওহ!
-মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
-শুনেছি।
-সবই জানিস দেখছি।
-আজরা বলেছে।
– সে কী প্রস্তাবের বিষয়ে জানে?
-তা বলতে পারি না। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল।
-ওহ! এসব নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন নেই।
-হুম।
-দেখ ইনতিসার, এমন প্রস্তাব দেওয়া এটা হয়েই থাকে। ওর পছন্দ আছে বলে তা গ্রহণ করেনি। এখন তো তোকে প্রত্যাখ্যান করার কারণও জেনে গিয়েছিস।
-হুম।
-তবে এসব নিয়ে আর ভাবিস না।

ইলারা জামান কী বলতে চাইছেন ইনতিসার বুঝতে পারে। এটা কী করছে সে! তার আচরণে প্রকাশ করছে সে দ্বিধায় আছে! আজরাও যদি প্রস্তাবের বিষয়ে অবগত হয়ে থাকে, তবে তার মনেও এমন ভাবনাটা আসবে। ইনতিসার কে নিয়ে তখন কী ভাববে সে!
এই ভেবে ইলারা জামানের উদ্দেশ্যে সে বলল, আজরা হয়তো বেরিয়েছে। আমি আসছি।

এই বলে দ্রুত সে স্টাডি রুম থেকে বেরুলো।

গোসল সেরে গোলাপি রঙের শাড়িটি পরে ওয়াশরুম থেকে বেরুলো আজরা। ইনতিসার কে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। গোসল সারতে কী খুব বেশি সময় নিয়ে ফেললো সে?

-হলো আপনার?

পেছনে ফিরে ট্রে হাতে ইনতিসার কে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেল আজরা। ইনতিসার এগিয়ে এসে বলল, কফি আনতে গিয়েছিলাম।

আজরা এক মগ কফি নিয়ে বলল, এটার প্রয়োজন ছিল। ধন্যবাদ।
-এখন থেকে কখন কী প্রয়োজন আমাকে জানাবেন। আর এটা তো আপনারই বাড়ি। নিজের ইচ্ছে মতোই সব করবেন।

এই বলে ট্রে টা টেবিলে রেখে কফি মগটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো ইনতিসার। খেয়াল করলো, আজরার খোলা চুল বেয়ে পড়ছে পানি। ইনতিসার বলল-
চুল বেয়ে পানি পড়ছে আপনার।

আজরা তার কথা শুনে মগ রেখে হাতে তোয়ালে নিলো। এরপর চুল মুছতে শুরু করলো সে। কিন্তু মুছতে গিয়ে ব্লাউজের ফিতের সঙ্গে তার চুল আঁটকে যায়। যা সরানোর চেষ্টায় লেগে পড়লো আজরা। আয়নার সামনে গেলেও সে পেছনের দিকে দেখতে না পারার কারণে চুল ছাড়াতে সক্ষম হয় না। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তা দেখে ইনতিসার এগিয়ে আসে। কিছু না বলে সে আজরার হাতটা সরিয়ে দেয়। এরপর ফিতা থেকে চুল ছাড়াতে চেষ্টা করে। ছাড়ানোর জন্য ব্লাউজের ফিতেটা খুলতে হয় তাকে। এবং খুব তাড়াতাড়ি চুল ছাড়াতে সফলও হয় সে।

নিজের পিঠে ইনতিসারের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো আজরা। সামান্য আঙুলের স্পর্শেই তার মনে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করলো।
এদিকে আজরার খোলা পিঠে চোখ পড়তেই তা খুব করে ছুঁয়ে দেখার লোভ হলো ইনতিসারের। আচমকা সে আজরার পিঠে আসা সমস্ত চুল সামনের দিকে সরিয়ে সেখানে হাত বোলাতে শুরু করে।
কেঁপে কেঁপে উঠছে আজরা। তা দেখে ইনতিসার পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আয়নায় চোখ পড়তেই ইনতিসার খেয়াল করলো, নাবীহা পরম আবেশে দু’চোখ বন্ধ করে আছে। লজ্জার আভা ছেয়ে গেছে তার মুখমণ্ডল জুড়ে।
আয়নার দিকে তাকিয়েই নাবীহার ঘাড়ে মুখ ডুবালো ইনতিসার। সেখানে আলতো করে চুমু দিতেই নিঃশ্বাস বড়ো হয়ে এল নাবীহার। নাবীহার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে পাগলপ্রায় অবস্থা ইনতিসারের। অনবরত নাবীহার শরীর কাঁপছে দেখে তাকে কোলে তুলে নিলো ইনতিসার। এরপর নিয়ে এলো বিছানায়। তাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শরীরের ভার তার উপরে দিলো। কিন্তু এ কী! এ তো আজরা! এতক্ষণ সে নাবীহার কল্পনায় বিভোর ছিল ভেবে নিজের উপরে রাগ হলো তার।
আজরা কে ওভাবে রেখেই দ্রুত উঠে পড়লো সে। আজরাও নিজের চোখ জোড়া খুললো। পাশে মাথা নিচু করে বসে থাকা ইনতিসার কে দেখে সেও বসে পড়লো। হঠাৎ তার কী হয়েছে বুঝতে পারলো না সে। শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে ক্ষীণস্বরে বলল, ঠিক আছেন আপনি?

“না আমি ঠিক নেই! এতক্ষণ যা করেছি সবটাই তোমার জায়গায় তোমার বান্ধবী কে কল্পনা করে। এটা শুনে কী তুমিও ঠিক থাকবে?”

কথাটি বলতে চেয়েও বলতে পারলো না ইনতিসার। শুধু বলল-
আসলে আজকে আমাদের একসাথে প্রথমদিন। আর আজই আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ওভাবে…

এই বলে থামলো ইনতিসার। সে কী বলতে চাইছে বুঝে নিলো আজরা। সে মাথা নিচু করে মৃদু হেসে বলল, আমি কিছু মনে করিনি।
-তবুও! আজকের রাতে আমাদের উচিত একে অপর সম্পর্কে জানা, ফিউচার সম্পর্কে আলোচনা করা। তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে কত ধকল গেছে আপনার উপরে। রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।

ইনতিসারের এমন ভাবনায় তার প্রতি সম্মান আরও বেড়ে গেল আজরার। সে তার স্ত্রী। তবুও অনুমতি না নিয়ে স্পর্শ করাতে সংকোচবোধ করছে সে।

আজরা বিষয়টাকে সহজ করতে বলল, আপনাকেও বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
-আসলেই ক্লান্ত অনুভব করছি।
-তবে ঘুমিয়ে পড়ুন?

আজরার দিকে তাকানোর সাহসও ইনতিসারের নেই। নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে এসব মিথ্যে বলে। সে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। আজরা এখনো বসে রয়েছে।

ইনতিসার তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ঘুমোচ্ছেন না?
-ঘুমোবো।

এই বলে আজরাও শুয়ে পড়লো। ইনতিসার ওপাশ ফিরেই শুয়ে আছে। আজরা বলল, একটা কথা বলি?
-জি বলুন?
-আমাকে তুমি করে বলবেন প্লিজ।

কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হলো না ইনতিসারের। তাই শুধুমাত্র “হুম” বলেই থেমে গেল সে।

শোয়ার সথে সাথেই আজরার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসলেও ইনতিসার এক করতে পারলো না তার দু-চোখ।
বুঝতেই পারছে, একটি নির্ঘুম রাত পার করতে চলেছে সে।
.
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠতে আজ দেরী হয়ে গেল মানতাশার। উঠেই সে ঘড়ির দিকে তাকালো। নাহ, এতটাও দেরী হয়নি। সবেমাত্র দিনের বারোটা বাজতে চলতে চলেছে। এই কয়েক দিন যা ধকল গেছে, একটানা রাত বারোটা অবধি ঘুমোলেও তার ঘুমের শেষ হবে না। কিন্তু এতক্ষণ সে ঘুমোতে পারবে না। সন্ধ্যায় আবারও ধকল যাবে। আজ আজরার শশুরবাড়িতে দাওয়াত আছে।
এই ভেবে আবারও শুয়ে পড়লো সে।
মরিয়ম বেগমের ডাকে তাকে শোয়া থেকে উঠে বসতে হলো। বিরক্তভরা কণ্ঠ নিয়ে সে বলল, ডাকছ কেন?
-ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আয়। কথা আছে।
-কথা শোনার জন্যে ফ্রেশ হতে হবে?
-হুম হবে। তাড়াতাড়ি আয়।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়লো মানতাশা। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো সে। কিন্তু সোফার উপরে এমন একজন কে বসে থাকতে দেখে বিস্ময় এর শেষ পর্যায়ে চলে গেল সে।
এজাজ এখানে কী করছে!
মানতাশা দ্রুত তার কাছে আসলো। ধমকের সুরে বলল তাকে, তুমি এইখানে কী করছ?

এজাজ দাঁড়িয়ে বলল, ঘুম থেকে উঠার পর তো দারুণ লাগে দেখতে তোমাকে।

রাগে গিজগিজ করতে করতে মানতাশা বলল, এখুনি বেরিয়ে যাও। কেউ দেখার আগে যাও বলছি!
-এভাবে যাওয়ার জন্য তো আসিনি।
-তবে কেন এসেছ?
-ডেকেছে তাই এসেছি!
-ডেকেছে! কে ডেকেছে?

“আমি ডেকেছি”

মা এর কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকায় মানতাশা। চোখ জোড়া বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো সে মরিয়ম বেগমের দিকে। তিনি এজাজ কে ডেকেছে মানে! তবে কী এজাজের সম্পর্কে সব জেনে গেলেন তিনি! যেই সম্পর্ক টা সে শেষ করতে যাচ্ছিলো, তা কী সবার সামনে চলে এসেছে?
এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠে মানতাশার মন।
.
.
.
নাবীহার ছোটো ভাই একটি কালো রঙের শার্ট নিয়ে এসে তাকে দেখিয়ে বলল, আপু আপু? আজ আজরা আপুর বাসায় এটা পরে যাই?

নাবীহা তাকে দেখে হেসে বলল, এটা তোকে খুব মানিয়েছে। কিন্তু আজ আমরা যে ওখানে যাব না ভাই!

জহির মন খারাপ করে বলল, কেন আপু? আজরা আপু আমাকেও যেতে বলেছে তো। বলেছে আমি গেলে মনে হবে তার ছোটো ভাই গেছে।

আজরার কোনো ভাই-বোন নেই বলে সে যে জহির কে কত ভালোবাসে জানে নাবীহা। কিন্তু আজ আজরার বাড়িতে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না নাবীহার।
আবারও ইনতিসারের মুখোমুখি তাকে হতে হবে। তাছাড়া ও বাড়িতে যাওয়াটা কী পছন্দ করবে ইনতিসারের পরিবার?
এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো নাবীহা।
.
চলবে#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১০
#Saji_Afroz

মা এর কথা শুনে গলাটা শুকিয়ে গেছে মানতাশার। সে আমতাআমতা করে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি ডেকেছ মানে?
-হু, আমি ডেকেছি ওকে।
-কিন্তু কেন?
-তোমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে।
-বাবার সাথে!
-হু।

চিন্তার ভাজ পড়লো মানতাশার কপালে। কী হতে যাচ্ছে ভাবতেই মাথাটা ঘুরে আসছে তার।

মরিয়ম বেগম বললেন, নিজেকে অনেক চালাক মনে করো? গোপণে প্রেম করে বেড়াবে আর আমরা টের পাব না! এমনটা ভেবেছ?

এইবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এজাজের দিকে তাকালো মানতাশা। সে কী সব বলে দিয়েছে মরিয়ম বেগম কে!

তিনি আরও বললেন, ওর দিকেও ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আজরার বিয়েতে আমি তোদের কথোপকথন শুনেছিলাম। তখনি বুঝেছি তোদের সম্পর্ক আছে। পরে অবশ্য শিওর হওয়ার জন্যে এজাজের সাথে কথা বলি। ও সবটা স্বীকার করে নেয়। আর একথা তোর বাবা কে জানাই। তোর বাবা এজাজের সাথে দেখা করতে চেয়েছে। তাই ডেকেছি ওকে।

এই বলে এজাজের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বসো তুমি। তোমার আঙ্কেল কে ডেকে নিয়ে আসি।

এই বলে তিনি ভেতরের দিকে যান।
মানতাশা রাগে কটমট করতে করতে বলল, শান্তি হলো তো? বলেছিলাম মা আছে ওভাবে ঘুরঘুর করো না।
-আরে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আমি তো ভয় পাচ্ছি না।
-বাবা যখন শুনবে তুমি বেকার তখন না করে দেবে। এরপর?

এইবার চিন্তায় ভ্রু কুচকে আসে এজাজের। মানতাশা আপনমনে বলল, এটাই যেন হয়! তার বাবা দিদার আলম যেন এজাজ কে কয়েকটা শক্ত কথা শুনিয়ে দেন। এতে করে মানতাশারও এজাজের সাথে সম্পর্কটা ছিন্ন করতে সহজ হবে!
.
.
.
অনেকক্ষণ রুমে একা একা বসে রয়েছে আজরা।
সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে সে। নামাজ সেরে আবারও শুয়েছিল। কিন্তু চোখে আর ঘুম আসেনি।
বাসার জন্য বড্ড মন খারাপ তার। যদিও এই নিয়ে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলা হয়েছে। সন্ধ্যায় তাদের দেখা পাবে আজরা।
তাই সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কখন যে সন্ধ্যে হবে!
-কিছু খাবেন ম্যাডাম?

বুয়ার ডাকে ঘড়ির দিক থেকে দৃষ্টি সরালো আজরা। জবাবে বলল, নাহ।
-কিছু লাগবে আপনার?
-বাড়ির সবাই কোথায় বলতে পারেন?
-আজকে রাতের আয়োজনে সবাই ব্যস্ত।
-ইনতিসারও?
-জি।

এই বলে সে চলে যায়।
বেশ ক্লান্ত লাগছে আজরার। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেউ এসে নতুন বউ এভাবে শুয়ে আছে দেখলে কিছু মনে করবে না তো?
এসব ভেবে আর শোয়া হলো না আজরার।

স্টাডি রুমে পায়চারি করছে ইনতিসার। গতকালের ঘটনাটা কোনোমতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না সে। এমন একটা জঘন্য কাজ সে কীভাবে করতে পারলো! এটা শুধু পাপ নয়, অন্যায়! আজরার সাথে করা অন্যায় এর জন্যে মনটা অস্থির হয়ে আছে তার।
কেন নাবীহা কে দেখার পর সবকিছু উলোটপালোট লাগছে তার কাছে! কী আছে ওর মাঝে? যার কারণে কালকের মতো বিশেষ রাতেও নিজের স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণবোধ করলো না ইনতিসার!
.
.
.
দিদার আলম এসে বসলেন এজাজের সামনে। পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো মানতাশা ও মরিয়ম বেগম।
এজাজ তাকে সালাম জানাতেই তিনি বললেন, মরিয়মের মুখে সবটা শুনেছি। এখন নাকি কিছু করো না তুমি? তা ফিউচার প্লান কী তোমার?
-কিছু করি না বলেই আপনাদের সামনে আসতে পারিনি আঙ্কেল। তবে আমার রেজাল্ট সব ভালো। আশাকরি ভালো একটা জব পেয়ে যাব। এরপরেই পরিবার নিয়ে আপনাদের সাথে দেখা করব। এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম।
-বাসায় জানে ওর কথা?
-জানে।
-তবে একদিন আসতে বলো তাদের।

মানতাশা ও এজাজ দু’জনেই অবাক চোখে তাকালো দিদার আলমের দিকে। তিনি বললেন, একমাত্র মেয়ে আমার। ওর খুশিতেই আমার খুশি। তুমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর বিয়ে সাদি করতে চাও সেটা অন্যকথা। এর আগে অন্তত আমরা দুই পরিবার দেখা সাক্ষাত করে নিই? আমারও দেখতে হবে, যে ঘরে মেয়েটা যাবে পরিবারের সদস্যরা কেমন!

একথা শুনে একগাল হেসে এজাজ বলল, অবশ্যই। আমি মা কে নিয়ে আসব।

এসব শুনে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো মানতাশার মেজাজ। সম্পর্ক শেষ করার মুহুর্তে দুই পরিবার একত্রিত হতে চলেছে। এখন কীভাবে এসব থেকে নিজেকে সরাবে সে! সে তো এজাজ কে চায় না। চায় ইনতিসারের মতো কাউকে তার জীবনে। সেই স্বপ্ন কী স্বপ্নই থেকে যাবে!
.
.
.
-তুই আসবি না মানে? অবশ্যই আসবি। জহির কে নিয়ে চলে আসবি। আমি আর কোনো কথাই শুনতে চাই না।

আজরার কথা শুনে নাবীহা বলল, বিশ্বাস কর কাজ পড়ে গেছে।
-রাতে কীসের কাজ রে? আমি কোনো বাহানা শুনতে চাইনা।
-বোঝার চেষ্টা কর…
-কী বুঝব? কেন আসবি না তুই? ওহ আচ্ছা! ভাবছিস ইনতিসার আমাকে ফেলে তোর পেছনে ঘুরবে? এমন ছেলে ও নয়।
-কীসব বলছিস!
-তবে তুই কেন আসতে চাইছিস না বল আমায়?
না আসলে তো আমি এটাই ভাববো। আমার বর কে তুই অন্যসব পুরুষের সাথে গোলাতে পারিস না নাবীহা।

আজরার কথা শুনে নাবীহা বলল, এমন কিছু নয়। আর আজরার মতো বউ থাকতে উনি অন্যদিকে চোখ কীভাবে দিতে পারে! এই ভাবনা আমার মনেও আসেনি।
-তবে চলে আসিস। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আসা যাওয়া লেগে থাকতে হবে। আজ থেকেই শুরু হোক!

ফোন রেখে ওয়ারড্রব খুলে জামা বের করলো নাবীহা। আজরার জন্যে ও বাড়ি সে যাবে। তবে ইনতিসার তার দিকে নজর দেবে এমন কিছু সে ভাবেনি আর ভাবেওনা। শুধুমাত্র তার যাওয়াটা ইনতিসারের পরিবার কীভাবে দেখবে এটা নিয়েই ভাবছে সে!
এদিকে ইচ্ছে করে নাবীহা কে এসব শুনিয়েছে আজরা। নাহলে যে সে আসতো না ভালো করেই জানতো। একবার আসলে সংকোচ দূর হয়ে যাবে। বান্ধবীর বাসায় বান্ধবী আসবে না তা কী করে হয়! অতীত নিয়ে পড়ে থেকে বর্তমান সময় টাকে নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। আগেও তাদের মাঝে সম্পর্ক যেমন ছিল, এখনো তেমনই থাকবে এবং আজীবন তাই থাকবে। এই প্রত্যাশা করে আজরা।
এই ভেবে সন্ধ্যের জন্য তৈরী হতে শুরু করলো সে।
.
.
তৈরী হওয়া শেষে নিজেকে আয়নায় দেখতে ব্যস্ত আজরা। ইনতিসারের আগমনে পেছনে ঘুরে তাকায় সে। হালকা গোলাপি রঙের ভারী কাতান শাড়িটাতে বেশ মানিয়েছে আজরা কে। ইনতিসার তার দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে বলল, ভালো লাগছে তোমাকে।

মিষ্টি করে হেসে আজরা বলল, ধন্যবাদ। আপনি তৈরী হবেন না?
-হতে এলাম।

এই বলে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যায় ইনতিসার। সে বেরিয়ে আসলে তাকে দেখে আজরাও বলল, আপনাকেও মানিয়েছে সাদা রঙটা।
-ধন্যবাদ।

এই বলে ঘড়ি হাতে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইনতিসার। আজরা বলল, সারাদিন কী খুব বেশি ব্যস্ত ছিলেন? না মানে সকালের পর থেকে আর দেখাই পেলাম না আপনার।

মন মেজাজ যে খারাপ ছিল তা গোপন করে ইনতিসার বলল, হ্যাঁ একটু। কিছু খেয়েছ?
-জি।
-ওকে থাকো তবে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে ফোন দিও।

এই বলে তাড়া দেখিয়ে আবারও বেরিয়ে যায় ইনতিসার।
সারাদিন একা রুমের মাঝে থাকতে থাকতে বিরক্ত আজরা। শাশুড়ী বেশ কয়েকবার আসলেও সময় দিতে পারেননি। আজ বাড়িতে কাজ আছে কিনা! খুব করে একটা ননদের অভাববোধ করছে আজরা। যদিও ইনতিসারের কাজিনরা রয়েছে। তবে আপন বোন নয় বলে হয়তো সবাই যে যার মতো থাকতে পছন্দ করছে। নাকি বড়ো ঘরের নিয়মই এমন!
এই ভেবে আবারও ঘড়ির দিকে তাকালো সে। বাড়ির মানুষজন, মানতাশা ও নাবীহা যে কখন আসবে!
.
.
.
সন্ধ্যায় আজরার বাড়ির সবাই তাদের আত্মীয় স্বজনের সাথে তার শ্বশুর বাড়িতে আসলো।
মানতাশা ও নাবীহাও এসেছে তাদের সঙ্গে।
ইনতিসারের পরিবার ছাদে স্টেজ সাজিয়েছে। যেখানে বসানো হয়েছে ইনতিসার ও আজরা কে।
এদিকে সবাই ছাদে চলে গেলেও মানতাশা গেল না। এই বাড়িতে প্রবেশ করেই চমকে উঠলো সে। এত বড়ো বাড়ি শুধু টিভি তেই দেখেছে সে সবসময়। আজ সরাসরি দেখে তার মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। পুরো বাড়ি সে ঘুরে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়। জিনিসপত্রও ঘেটেঘুটে দেখতে শুরু করে দিয়েছে সে।

হঠাৎ কারও ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় মানতাশা। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা নিজেকে ইনতিসারের খালাতো বোন হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলল, তুমি কে?
-আমি আজরার বান্ধবী।
-ওহ! সবাই উপরে গেছে। তুমি যাওনি যে?
-ওয়াশরুম! ওয়াশরুম খুঁজছিলাম।

তিনি ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলেন মানতাশা কে। ওয়াশরুমে এসে আরও চমকে যায় মানতাশা।
এই এক ওয়াশরুমই তো তার রুমের চেয়েও বড়ো!
এসব দেখে আজরার রুম দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠে সে। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই একজন বুয়াকে দেখতে পায় সে। এখানের সব কর্মীরাই একই রকম পোশাক পরিধান করেছে। এই পোশাকের কথা বলেই ইলারা জামান বলেছিলেন, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তাদের বলতে।

মানতাশা বলল, আজরার রুমটা কোনদিকে?
-আপনি কে?

মানতাশা গম্ভীরমুখে বলল, আমি ওর বান্ধবী। যেন তেন বান্ধবী নয়! ক্লোজ ফ্রেন্ড।
বুঝো ক্লোজ ফ্রেন্ড মানে?
-ঘনিষ্ট বান্ধবী।

বাপ্রে! শিক্ষিত বুয়া! মনে মনে তা আওড়িয়ে আবারও রুম দেখাতে বলল সে। বুয়া রুম দেখিয়ে দিতেই সেখানে গেল মানতাশা।

আজরার রুম দেখে কিছুক্ষণ নীরব ভাবে তাকিয়ে রইলো মানতাশা। এরপর সারারুমে পায়চারি করে সে প্রতিটা জিনিস দেখতে লাগলো আর আপনমনে ভাবলো, কপাল নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে। নাহলে এই বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্যতা তার আছে! কী এমন করে সে? চেহারাও আহামরি না। কিন্তু ঠিকই কপালটা আহামরি হয়ে গেল। এসব ভেবে হিংসায় সারা শরীর জ্বলে উঠে মানতাশার।

-তুই এখানে?

পেছনে ফিরে এক ঝাক বান্ধবীর দল কে দেখে মানতাশা আমতাআমতা করে বলল, ওয়াশরুম ইউজ করতে এসেছি।

তারানা বলল, ওদিকে যে আজরা তোকে খুঁজছে? দেখা করে আসবি না? তোকে খুঁজতে আসলাম আমরা।
-ওয়াশরুম তো বলে কয়ে আসেনা! সেরে যাব ভেবেছিলাম।

সকলে রুমে প্রবেশ করে। সবাই অবাক হয়ে চারপাশ দেখতে থাকে। আজরার কপাল নিয়ে একেকজন একেক কথা বলছে।

মাইমুনা বলল, আসলে আজরার কপালের সাথে সাথে ইনতিসারের কথাও বলতে হয়। সে চাইলেই সুন্দরী কাউকে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু সে খুঁজেছে সুন্দর মন।

তার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মানতাশা বলল, মন কী দেখা যায়? আসলে তার মা চায়নি কোনো সুন্দরী মেয়ে এই বাড়িতে এসে রাজত্ব করুক। শুনিসনি? মা এর পছন্দে বিয়ে করেছে সে।
-উনি এমনটা কেন চায়বে?
-অনেক মা আছে এমন। ছেলের বউ এর রাজত্ব মেনে নিতে পারে না। বিচ্ছিরি মেয়ে এনে দাবিয়ে রাখতে চায়।
-আজরা কী বাজে নাকি?
-উহু! আহামরি সুন্দরীও তো না! এখন কোনো সুন্দরী মেয়ে ইনতিসারের আশেপাশে ঘুরঘুর করুক! আজরা কে ছেড়ে দেবে নিমিষেই।

তাদের মধ্যে এক বান্ধবী ছিল মানতাশার স্বভাবের। যার নাম হাসনা। সে মানতাশার কথা শুনে হেসে বলল, আমারও তাই মনে হয়।

কিন্তু অন্যরা এতে সহমত পোষণ না করলে হাসনা বলল, এখন কী তোদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে? তারপর বিশ্বাস করবি তো?

মাইমুনা বলল, কেমন প্রমাণ?
-এই যে ইনতিসার সুন্দরী মেয়ে পেলে পটে যাবে।
-কীভাবে প্রমাণ করবি?
-আগে বল বাজি হয়ে যাক দুই টিম নিয়ে? মানতাশা ও আমি একদিকে। তোরা আরেকদিকে।

সবাই রাজি হলে হাসনা বলল, আমাদের মানতাশা পটাবে ইনতিসার কে। যদি পটে যায় তবে বাজিতে আমরা জিতব। না পটলে তোরা!

তারানা বলল, কিন্তু এসব আজরা জানলে?
-আজরা বা নাবীহা কেউই জানবে না।

একথা শুনে ভ্রু কুচকে মানতাশা বলল, ও হ্যালো? অন্যের হাসবেন্ড কে আমি কেন পটাবো!

হাসনা হেসে বলল, জাস্ট বাজিতে জেতার জন্য।
-নো ওয়ে! ওকে পটিয়ে সময় নষ্ট করতে চাইনা আমি।
-তাই? নাকি নিজের উপরে ভরসা নেই তোর? তোরা চাইলে কাজটা আমিই করছি। মানতাশার প্রেমে পড়বে না বলে সে আগে থেকেই ভেগে যাচ্ছে।

এই বলে হেসে উঠলো হাসনা। মানতাশা তা শুনে একপ্রকার জেদ থেকেই বলল, মোটেও না! এটা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।
-তবে করে দেখা?

একটু ভেবে মানতাশা বলল, দেখাব। ইনতিসার কে যদি নাকে দঁড়ি দিয়ে না ঘুরাই তবে আমার নামও মানতাশা নয়!

এই বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের দিকে এগুই। মাইমুনার কপালে চিন্তার ভাজ দেখে তারানা বলল, কী ভাবছিস?
-ভাবছি সত্যি যদি ইনতিসার পটে গিয়ে মানতাশার প্রেমে হাবুডুবু খায়? তখন কী হবে?

এদিকে আপনমনে হেসে চলেছে হাসনা। সে তো এটাই চেয়েছিল! এই তিন বান্ধবীর জন্য তার জীবন থেকে সরে গিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটি। সেই থেকে তাদের উপরে ক্ষোভ রয়েছে হাসনার। তাই সে তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায়। আর আজ সে মানতাশার মাথায় এসব ইচ্ছে করেই ঢুকিয়েছে। মানতাশার স্বভাব সে জানে। ইনতিসার যদি একবার তার প্রেমে পড়ে তবে সে যে নিজেকে এই বিলাসবহুল জীবন থেকে সরাতে পারবে না জানে সে। আর তখনি তার ও আজরার মধ্যে হবে ঝামেলা। আগে তো এদের আলাদা করুক। নাবীহা কেও দেখে নেবে সে!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here