#শেষ_কান্না
#পর্ব_৪
#লেখা_Bobita_Ray
রায়হান সারাদিন অরুর পিছে পিছে ঘুরঘুর করল, অরুর একাজ-সেকাজ হাতে হাতে এগিয়ে দিল শুধুমাত্র একটু কথা বলার আশায়।কিন্তু অরু পাত্তা দিল না! নানান কাজের বাহানায় খুব সাবধানে রায়হানকে এড়িয়ে গেল।দিনটা খুব ছটফট করতে করতেই কাটল রায়হানের।অবশেষে ব্যর্থ হয়ে অরুকে দিনে একান্তে কাছে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিল রায়হান।রায়হান বুঝে গেছে রাত ছাড়া অরুকে একা পাওয়া সম্ভব না।মহারাণীর যে জেদ! সহজে ধরা দিবে বলে মনে হয় না!ভাবতেই ফস করে একটা দম ছাড়ল রায়হান।
অরু একদিনেই সংসারটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।রাতে সবাইকে খেতে দিয়ে সবার শেষে রথী আর অরু খেতে বসল।এ গল্পে ও গল্পে খাওয়া শেষ করল ননদ,ভাবি। রথী বলল,
-“ভাবি তুমি যাও! তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসো। এই ফাঁকে আমি এঁটো থালা-বাসন ধুয়ে ফেলি।
-“আচ্ছা।
অরু হাত ধুঁয়ে ওঠে গেল। রায়হানের ঘরে গিয়ে আলমালি খুলে থ্রী-পিচ,শাড়িগুলো বের করে ব্যাগে একে একে গুছিয়ে রাখছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।হঠাৎ অনুভব করল একজোড়া ঠাণ্ডা হাত পেছন থেকে আলতো করে অরুকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবাল ।অরু ভয়ে এক ঢোক গিলে অস্ফুট স্বরে বলল,
-“কে..?
রায়হান অরুর কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“আমি!
রায়হানের একেকটা গরম নিঃশ্বাস অরুর চুল ভেদ করে কাঁধে উপচে পড়ছে।অরুর সারা শরীরে অজানা শিহরণে মৃদু কাঁপন ধরে গেল।পরম আবেশে দু’চোখ বুজে ফেলল।হার্ট খুব জোরে জোরে ঢিপঢিপ করছে।সুখময় অনুভূতিতে সারা মন ছেয়ে গেছে।ক্ষণিকের জন্য রাগ,জেদ,অভিমান,অপমান,ভুলে রায়হানের শক্ত হাতের কোমল স্পর্শে ভেঁসে গেল সুখের রাজ্যে।রাহয়ানের হাত থেমে নেই অরুর সুতি কাপড় ভেদ করে পায়চারী অরুর মেদহীন পেটে।অরু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-“ছাড়!
রায়হান অরুর পেটে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
-“উঁহু
-“কী করছ কী? ছাড়, কেউ দেখবে তো!
-“এখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ নেই।আসার সময় দরজা আটকে দিয়ে এসেছি।
মুহূর্তেই অরুর ঘোর কেটে গেল।রায়হানের হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,
-“ছাড় বলছি?
-“না ছাড়ব না ‘সোনাবৌ’
অরু ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলল,
-“কী যেন বলেছিলে? আমার মুখ দেখলে তোমার অভিশাপ লাগে!আমার অপয়া মুখ তোমাকে দেখাতে চাই না।প্লিজ ছাড়?
কথাটা রায়হানের বুকে তীরের মতো বিঁধল।নিমিষেই মুখটা শুকিয়ে গেল।হাতের বাঁধন ঢিলে হতে লাগল।অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল,
-“সরি অরু!তুমি তো জানো রেগে গেলে মাথা একদম ঠিক রাখতে পারি না। কী বলতে কী বলেছি!
অরু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
-“তুমি রেগে গেলে কী কী বলো আমার সব মুখস্ত!আগে আর যাই বলতে না কেন অন্তত এসব খারাপ কথা কক্ষনো বলতে না।আজকে তোমরা মা ছেলে মিলে আমার সাথে যে ব্যবহার করেছ আমি কোনো দিনও এসব কথা ভুলব না।দিন আসবে, দিন যাবে, কিন্তু কথাগুলো মিত্যুর আগ পর্যন্ত আমার হৃদয়ে গাঁথা থাকবে।আমি বিপদে না পড়লে কখনোই বুঝতাম না একটা অসহায় মেয়েকে তোমরা কতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে করতে পার।তোমার সরল মুখের পিছনে এত ভয়ংকর একটা রুপ লুকিয়ে আছে আগে জানলে তোমার মতো একটা অমানুষকে ভালোইবাসতাম রায়হান। আসলে কথাটা যুগযুগ ধরে প্রচলিত হলেও প্রতিনিয়ত আমরা ভুলে যাই সত্যিকারের ভালোবাসা ভুল মানুষের সাথেই হয়।আমার ভালোবাসা খাঁটি ছিল রায়হান কিন্তু তুমি মানুষটা ভুল ছিলে!বাবা সবসময় বলত গ্রামের মানুষেরা সহজ সরল হয় কথাটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম কিন্তু তোমার মায়ের দূর-ব্যবহার আর কটু কথা শুনে আমার বোঝা হয়ে গেছে আসলে তোমরা কতটা নিচু প্রকৃতির মানুষ।তোমাদের লোভ বেশি, মন ছোট।
-“অরু….
-” একদম ধমকাবে না । এত অপবাদ,এত লাঞ্ছনা, সহ্য করে কেন তোমাদের বাড়ি পড়ে আছি জানো শুধু মাত্র আমার পেটে বেড়ে ওঠা একটা ছোট প্রাণের জন্য।হয়তো ভবিষ্যতেও মাটি কামড়ে তোমাদের শত লাঞ্ছনা সহ্য করেও আজীবন এ বাড়িতে পড়ে থাকব। কারণ আমি চাই না আমার অনাগত সন্তান বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হোক।গোটা গ্রামের মানুষ,তোমার আম্মা আমাকে এত অপমান করল তোমার কী উচিৎ ছিল না প্রতিবাদ করা!প্রতিবাদ না করলে আমার হয়ে অন্তত দু’টো কথা তো বলতে পারতে। কিন্তু পুরোটা সময় তুমি নির্বাক ছিলে।মাঝে মাঝে আমার না, ভাবলেই খুব অবাক লাগে রায়হান! আমি তোমাকে কেন ভালোবাসতে গেলাম?
রায়হান চোখ মুখ বুজে শক্ত গলায় বলল,
-“অরু প্লিজ স্টপ!কী বলতে চাইছ তুমি?তোমার জন্য আমার আম্মার মুখে মুখে তর্ক করব?তুমি জান,আমাদের ছোট ছোট রেখে আব্বা মারা যাওয়ার পর কতো কষ্ট করে আমাদের তিন ভাইবোনকে মানুষ করেছে আম্মা।মাটি কেটেছে,সারাদিন অন্যের বাড়ি কাজ করে দিনশেষে আমাদের মুখে ভাত তুলে দিয়েছে।মানুষটা অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে আমাদের আঁকড়ে ধরেছে।আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বার বিয়ের কথাও ভাবেনি।আমরা কেউ আম্মার মুখের উপরে কোনো কথা বলি না। আর আম্মার কথাও অমান্য করি না।প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি।আজ যদি আমার আম্মা তোমাকে ডিভোর্স দিতে বলে আমি হাসি মুখে ডিভোর্স দিব। কোনো কথা বলব না,কোনো প্রতিবাদ করব না।
অরু রায়হানের শার্টের কলার চেপে ধরে অতিরিক্ত রাগে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“এতই সহজ ডিভোর্স দেওয়া?কান খুলে শুনে রাখ। এ বাড়িতে তোর হাত ধরে এক কাপড়ে ঢুকেছি না। যেতে হলে আমার মরা লাশ যাবে।এ দেহে প্রাণ থাকতে আমি যাব না।আর আমি তোর মতো স্বার্থপর না। আমারও ভাই আছে। আমার মাও একদিন শাশুড়ি হবে!আমি খারাপ হলেও এতটাও খারাপ না যে তোদের মা ছেলের সম্পর্ক খারাপ করব। সংসারে অশান্তি করব।আসলে তুই মায়ের সাথে বউয়ের ভালোবাসা গুলিয়ে ফেলেছিস।মায়ের জায়গা মাকে আর বউয়ের যায়গা বউকে রাখতে হয় এই সাধারণ কমনসেন্স তোর নেই।শুধু বলেছিলাম প্রতিবাদ না করলি তোর মাকে একটু বুঝিয়েও তো বলতে পারতি। কিন্তু তুই কী করলি আমাকে ভুল বুঝে কতগুলো বাড়তি কথা শুনিয়ে দিলি।আজ থেকে আমার ভালো মন্দের কথা তোকে কখনো বলব না।তবুও তুই, তোর মা,তোর অপদার্থ ভাইকে নিয়ে ভালো থাক।আর এতই যখন মায়ের বাধ্য ছেলে তাহলে আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করে আমাকে ধোঁকা দিলি কেন?এটাও কী তোর মা শিখিয়ে দিয়েছিল?কথাগুলো বলেই অরু কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।আর রায়হান মূর্তির মতো এক জায়গা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।মিনিট দুই পরে হুঁশ ফিরতেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে তাতে আয়েশ করে টানতে লাগল একেক পর এক।
রথী বলল,
-“ভাবি তুমি সবসময় এত কান্না করো কেন?এতটা দূর্বল হলে চলে?
-“কী করব রথী! ও কথায় কথায় আমাকে ভুল বুঝে।আমি কী এতই খারাপ?ওদের মা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট করব?ও কেন মা’কে মায়ের জায়গা আর বউকে বউয়ের জায়গা রেখে ভালোবাসতে পারে না।দুজনকেই একসাথে গুলিয়ে ফেলে?
-“বড় ভাইকে বুঝিয়ে বলো তাহলেই বুঝবে?
-“ও আমাকে একদম বুঝতে চায় না। হয়তো কোনোদিনও বুঝবে না।
-“চোখের জল মুছে ঘুমিয়ে পড় ভাবি আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
-“না লাগবে না। তোমার কাল স্কুল আছে শুয়ে পড়।
-“ধুর,কাল স্কুলে যাব না। আমার স্কুলে যেতে ভালো লাগে না।তাছাড়া এখন আবার আরেক ঝামেলা শুরু হয়েছে।সবাই ডেকে ডেকে কৌতুহল নিয়ে তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।সবচে বিরক্ত লাগে এই ব্যাপারটা।মানুষের খাইয়া-দাইয়া কাজ নাই অন্যের হাঁড়ির খবর শুনে এরা কী যে আনন্দ পায় আল্লাহ্ ভালো জানে।
অরু কথা বলল না।শূণ্য দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল।রথী একমনে কথা বলছে হঠাৎ একটু থেমে আবারও অরুর হাত চেপে ধরে বলল,
-“ভাবি..?
-“বলো শুনছি।
রথী ফিসফিস করে বলল,
-“এখান থেকে চলে যাও ভাবি।আর কখনো এসো না।এ গ্রাম তোমার জন্য না।এখানে থাকলে সারাটা জীবন মাথা নিচু করে বাঁচতে হবে।কেউ মূল্য দেবে না তোমাকে, কেউ না।
অরু ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল,
-“আমি চলে গেলে তুমি খুশি হবে?
রথী অরুর বুকে মুখ গুঁজে দু’হাতে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“তুমি চলে গেলে সবচে বেশি কষ্ট আমি পাব। তবুও চাই তুমি চলে যাও,মাথা উঁচু করে বাঁচো।ভালো থাকো!সুখে থাকো।
-“কোথায় যাব আমি?
-“তোমার বাবার বাসায়।
-“সম্ভব না?
রথী অবাক হয়ে বলল,
-”কেন?
অরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার সময় বাবা দু’টো অপশন দিয়েছিল। আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছি।
-“কী অপশন ভাবি?
অরু চোখ বুজল।অরুর চোখের পাতা হালকা কেঁপে উঠল।
অরুর বাবাকে সেদিন রায়হানের কথা বলায় তিনি দু’টো অপশন দিয়েছিল অরুকে,
১.বাচ্চাটাকে এবোর্ট করে নতুন করে সব শুরু করতে,পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে।২.রায়হানের সাথে বিয়ে হলে এ বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ।এবং এক কাপড়ে বেড়িয়ে যেতে হবে,কোনো যোগাযোগ রাখা চলবে না,তাছাড়া একটা পয়সাও যৌতুক হিসাবে দিবে না।
অতীতের কথাগুলো ভাবতেই নিজের অজান্তেই দু’ফোটা নোনা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অরুর।রথী সব শুনে বলল,
-“আল্লাহ্ এসব কী বলো?
হাসল অরু।বলল,
-“আবেগের বশে ভুল করেছি বাস্তবতা দিয়ে উপলব্ধি করছি।
-“মন খারাপ করো না ভাবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
-“হয়তোবা।
***
রাত গভীর!টিনের চাল বেয়ে ঝাঁপুর-ঝুঁপুর বৃষ্টি পড়ছে।পাশাপাশি ঘরে শুয়ে আছে অরু,রায়হান।দু’জনের মনের ভিতরেই চলছে উথাল-পাতাল ঝড়।অরু নিঃশব্দে বাঁলিশ ভিজাতে ব্যস্ত।আর রায়হান একটার পর একটা সিগারেট টানায় ব্যস্ত।এই মুহূর্তে রায়হানের মনে অনেক গুলো প্রশ্ন হানা দিয়েছে।সে ভাবছে,
-“আমি কী আঁধোও অরুকে ভালোবাসি?অবশ্যই ভালোবাসি!ভালো না বাসলে আমার ঘুম আসছে না কেন?ওর অশ্রুসিক্ত মায়াবী মুখটা আমার চোখের সামনে ভাঁসছে কেন?ওর জাদুমাখা কথাগুলো আমার হৃদয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে কেন?আমি ওর কাছে সংকোচে যেতে পারছি না কেন?আমার ভালোবাসাই বা আগের মতো প্রকাশ করতে পারছি না কেন?
অরু ভাবছে,
-“রায়হান কী আর আমায় ভালোবাসে না?
অবশ্যই ভালোবাসে না। আমি তো ওর ক্ষণিকের মোহ ছিলাম।যা সময়ের সাথে সাথে কেটে গেছে!সবই ওর নাটক ছিল।আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে ভোগ করাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিল।এখন আমি ওর রাগের কারণ,বিরক্তের কারণ। হাইরে, এক সময় যে আমাকে ভালোবাসি,ভালোবাসি বলে পাগল করে দিত এখন সে আমাকে দু’চোখের বিষ মনে করে। আমাকে সহ্যই করতে পারে না। ভালোবাসার দোহায় দিয়ে এভাবে না ঠকালেও পারতে রায়হান!
দুজনেই মনেই কত কত প্রশ্ন,কত ব্যাথা,
কত কষ্ট,কত হাহাকার। অথচ কেউ কাউকে ভুলেও বলতে চায় না।ভুলেও নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। একজন চোখের জলে বাঁলিশ ভিজাতে ব্যস্ত আরেক জন চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেটের ধোঁয়াকে সঙ্গী করে নির্ঘুম রাত কাটাতে ব্যস্ত!
চলবে