বন্ধ দরজা পর্ব ১১

#বন্ধ_দরজা
বন্ধ দরজা পর্ব ১১
.
সুহায়লা রুমে এসে দেখে তানভীর তখনও ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত অবস্থায় খুব সুন্দর দেখা যায় তানভীরকে। কত শান্ত মনে হয় ওকে। ইশশ…. ও যদি সত্যিই এমন শান্ত হতো! তানভীরের পাশে এসে এক হাতের উপর মাথা ভর দিয়ে শুয়ে আছে সুহায়লা। খুব কাছ থেকে দেখছে মানুষটাকে। তানভীরের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গালটা তে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে সুহায়লা। তার স্পর্শে ঘুম ভাঙলো তানভীরের। চোখ মেলে দেখে সুহায়লা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন তানভীর সুহায়লার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-” এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?”
-” তোমাকে দেখি।”
-” কেনো দেখো?”
-” এটা কেমন প্রশ্ন? তোমাকে দেখতে ভালো লাগে তাই দেখি।”
-” ওহ্, দেখো ভালো কথা। কিন্তু গালে গুতাচ্ছো কেনো?”
-” গুতাচ্ছি কোথায়? হালকা করেই তো ধরলাম।”
-” ধরবা না চুপচাপ দেখো। আমার ঘুম এখনো কমপ্লিট হয়নি। তুমি এমন গুতাগুতি করলে আমি ঘুমুতে পারবো না।”
এই কথা বলেই তানভীর চোখ বন্ধ করে ফেললো। সুহায়লা এবার তানভীরকে ধরে ঝাঁকানো শুরু করলো। তীব্র বিরক্তভরা কন্ঠে সুহায়লাকে জিজ্ঞেস করলো,
-” সমস্যা কি?”
-” সাড়ে ছয়টা বাজে। আর কত ঘুমাবা? উঠো। ছাদে নতুন পদ্মফুল ফুটেছে। আমি আর নিশাত আপু একটু আগে দেখে এসেছি। তুমিও চলো। তোমাকেও দেখাবো।”
-” পদ্মফুল দেখার কি আছে?”
-” কত্ত সুন্দর পদ্মফুল আরতুমি বলছো দেখার কি আছে?”
-” আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই দেখার। নিশাতকে আবার নিয়ে যাও। যত খুশি তত দেখে এসো।”
-” ভোরে ছাদে খুব ভালো লাগে। আকাশে হালকা মেঘ আছে।বাতাসও আছে অনেক। চলো না প্লিজ। একসাথে ছাদে কিছুক্ষন গল্প করি।”
-” কি শুরু করেছো তুমি? আমি যাবো না।”
-” এই তানভীর….. প্লিজ চলো না।”
-” সুহায়লা তুমি কিন্তু আমাকে বিরক্ত করছো প্রচন্ড রকমে।”
-” আমি তোমার বউ। তোমাকে বিরক্ত করার অধিকার আছে আমার।”
-” কিসের বউ হ্যাঁ? ভুলে গে…….”
-” থামো, তুমি আমাকে বউ মানো কি মানো না সেটা তোমার ব্যাপার। আমি জানি আমি তোমার ওয়াইফ। আজীবন সেটাই আমি মানবো। এখন তুমি তোমার বউকে বউ হিসেবে সম্মান করবে নাকি পতিতা হিসেবে সম্মান করবে সেটা একান্তই তোমার ইচ্ছা।”
তানভীর কিছুক্ষন চুপ করে থেকে এরপর বললো,
-” ঠিকাছে যাবো। কিন্তু শর্ত আছে। আজ দুপুরের পরই আমরা বাসায় ব্যাক করবো।”
-” কথা তো ছিলো আমরা কাল সকালে যাবো।”
-” হ্যাঁ ছিলো। কিন্তু এখানে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। এখন তুমি ডিসাইড করো আমার সাথে ছাদে কিছুক্ষন টাইম স্পেন্ড করবে নাকি বাপের বাড়ি আরও একরাত থাকবে।”
তানভীরের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছেসুহায়লা। কি করবে সে? থাকবে নাকি চলে যাবে? থাকলে একদিকে খানিকটা রিস্কি হয়ে যায়। তানভীর কখন আবার ঘরভর্তি মেহমানের সামনে উল্টাপাল্টা কথা বলে তাকে সেটার কোনো ঠিক নেই। তাছাড়া এখন তানভীরের মর্জিমতোই ওকে চলতে হবে। ওকে কোনোভাবেই বিগড়ে দেয়া যাবে না। যেভাবেই হোক ওকে মায়ার জালে আটকাতে হবে। ভেবে-চিন্তে সুহায়লা সিদ্ধান্ত নিলো আজই সে চলে যাবে।
-” ঠিকাছে। আজ দুপুরের লাঞ্চ সেড়েই চলে যাবো। তবু তুমি চলো আমার সাথে।”
-” সিউর?”
-” একদম সিউর। ”
-” ওয়েট, আমি হাত মুখটা ধুয়ে আসছি।”
দশ মিনিট পর তানভীর ওয়াশ রুম থেকে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এসে বললো,
-” চলো যাই।”
সুহায়লা তানভীরের হাত জড়িয়ে ধরে ছাদে এসেছে। এখনও হাতটা সে ছাড়েনি। ছাদের এপাশ ওপাশ হাঁটছে ওরা দুজনে। সুহায়লা লাগাতার বকবক করেই যাচ্ছে। আর তানভীর শুধু হুম, হ্যাঁ, না এসব বলছে। কিছুক্ষন পর ছাদের রেলিংয়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে দুজন। তানভীরের কাঁধের উপর মাথা রেখে আছে সুহায়লা। সুহায়লার চুল থেকে খুব সুন্দর একটা ঘ্রান পা্চ্ছে তানভীর। গতরাতেও এই ঘ্রানটা সে পেয়েছে। সুহায়লার চুলে নাক ডুবালো সে। ঠিক এমন সময় সাদমান ছাদে আসছিলো তার প্রেমিকাকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। ছাদের দরজার কাছে এসেই দেখলো সুহায়লা আর তানভীর বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে বসে আছে। তাই সেখান থেকে জলদি সরে গেলো সাদমান। সে তাদের কোনো ধরনের বিরক্ত করতে চায়নি। তবে এভাবে ওদের দেখে খানিকটা শান্তি লাগছে সাদমানের। ছেলেটা বোধহয় ভালোই। সম্পর্কটা সম্ভবত খুব মসৃনভাবেই এগোচ্ছে। যদি খারাপ কিছু থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই এভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকতো না। বাবা ঠিকই বলেছিলো। খারাপ চিন্তা করলে অহেতুক মনের অশান্তি বাড়বে। দুই তিন মিনিট সুহায়লার চুলে নাক ডুবিয়ে রাখার পর তানভীর বললো,
-” তোমার শ্যাম্পুর স্মেলটা খুব ভালো।”
– “তোমার পছন্দ হয়েছে?”
-” হুম”
-“যাক। আমার কোনো একটা জিনিস তো অন্তত তোমার পছন্দ হলো তাহলে।”
-” ভালো লেগেছে তাই বলেছি। এখানে এতটাও এক্সাইটেড হওয়ার কিছু নেই।”
-” কি যে বলো না? তুমি আমার প্রশংসা করবে আর আমি এক্সাইটেড হবো না। প্রতিটা ওয়াইফই চায় হাজবেন্ড তার প্রশংসা করুক। আমিও চাই। কিন্তু তুমি তো করতে চাও না।”
-” প্রশংসা করার মতো কিছু থাকলে তো করবো।”
-” কিহ্? আমার মাঝে প্রশংসা করার কিছু নেই?”
-” না।”
-” আমি কি সুন্দর না? আমার রুপের প্রশংসা করতে পারো না তুমি?”
-” একেবারে অসুন্দর তুমি না। কিন্তু আহামরি সুন্দরীও না। মোটামোটি চলে। তোমার চেয়ে আরও বেশি সুন্দরী মেয়ে আমার পিছনে লেগে থাকে।”
-” আসল কথা কি জানো? আমি তো ঐসব মেয়েদের মতো ছোট জামা পড়ে ঢলাঢলি করতে পারি না তাই আমাকে তোমার পছন্দ হয়না।”-”
-” ছোটজামা পড়া মেয়েরা আমার সাথে ঢলাঢলি করে এসব তোমাকে কে বলেছে?”
-” যেইই বলেছে। সেটা তো মূখ্য বিষয় না। মূল কথা হচ্ছে মেয়েরা তোমার সাথে ঢলাঢলি করে। তাও আবার ছোট জামা পড়া মেয়ে।”
দাঁত বের করে হাসছে তানভীর।
-” তুমি কি জেলাস সুহায়লা?”
-” অবশ্যই আমি জেলাস। আমার হাজবেন্ডকে অন্য কেউ তার জালে আটকাতে চাইবে এটা কি আমি সহ্য করবো নাকি? তুমি শুধু আমার। অন্য কেউ তোমার দিকে তাকালে একদম চোখ অন্ধ করে দিবো আমি।”
-” রিল্যাক্স। তানভীরকে জালে আটকানো এতটাও সহজ না যে কেউ এসে একটু ঢঙ করে কথা বললেই আমি ধরা দিবো।”
-” ধরা দাও বা না দাওসেটা পরের কথা। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে কেউ তোমার সাথে ঢঙ করতে পারবে না আমি ছাড়া। বুঝেছো?”
-” তোমার ছাদে ঘুরা হয়েছে? হয়ে থাকলে চলো নিচে যাই। ”
-” তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?”
-” হ্যাঁ হচ্ছি। রোদের টেম্পারেচার বাড়ছে। এতক্ষন মেঘ ছিলো। সেটা সরে গেছে। রোদে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার খুব বেশি অপছন্দের।”
-” ওহ্। আচ্ছা চলো চলে যাই।”
দোতলায় নেমে এসে দেখে বারান্দায় বসে ফাহিম আর নিশাত চা খাচ্ছে আর গল্প করছে।
-” কি রে ছাদে গিয়েছিলি?”
-” হুম”।
-” আয়, বস এখানে। গল্প করি।”
-” তানভীর তুমি বসো। আমি নিচে যেয়ে চা পাঠাচ্ছি তোমার জন্য।”
-” এই দাঁড়াও। চা পাঠাবে মানে? আমি কি চা খাই? আমি যে কফি খাই জানো না? নয়ন তোমাকে বলেনি?”
-” হ্যাঁ জানি তো।”
-” তাহলে চা পাঠাবে কেনো?”
-” আমাদের বাসায় তো কেউ কফি খায় না। সবাই চা খায়। কফি তো আমাদের বাসায় নেই।”
-” বড়লোক ছেলে দেখলে তো হুঁশ থাকে না তোমাদের মিডেল ক্লাসদের। কখন সেই ছেলের গলায়ঝুলবে তার ছক কষতে শুরু করে দাও। ছক কষার সময় এটা মাথায় থাকে না যে বড়লোক জামাইদের তাদের মতো করেই আপ্যায়ন করতে হয়? যাও তোমার ভাইকে যেয়ে বলো কফি পাউডার কিনে আনতে।”
-” কিশুরু করেছিস? একদিন চা খেলে কি তুই মরে যাবি ?”
-” উহুম…… এমন তো না যে ওর ফ্যামিলিকে নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হবে আমাকে আপ্যায়ন করার জন্য। প্রতি মাসেই তো সুহায়লা বাপের বাড়িতে টাকা পাঠাবেই। আমার টাকা দিয়ে যদি আমাকে আপ্যায়ন করতে কৃপনতা করে তাহলে কিভাবে হবে?”
-” তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করছিস।”
-” মোটেই না। এই তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেনো? নিচে যাও। সাদমানকে যেয়ে বলো কফি আনতে।”
সুহায়লা একটা টু শব্দও করলো না। তানভীরের কথাগুলো কানে পৌঁছানোর পর বহু কষ্টে সে অন্যকান দিয়ে কথাগুলো বের করেছে। কোনোভাবেই এগুলো মনে পুষে রাখা যাবে না। এসব মনে পুষে রাখলে কখনোই তানভীরের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী করা যাবে না। নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে এগোতেই দেখতে পেলো সাবা দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে পানি ছলছল করছে। তারমানে সব শুনেছে ও। ওর চোখে হাজারো প্রশ্ন দেখতে পাচ্ছে সুহায়লা। কি বলবে ওকে? ওর যা মেজাজ। এখন যদি তানভীরের সাথে ঝগড়া বাজিয়ে দেয়? সুহায়লা তৎক্ষনাৎ সাবার হাত ধরে নিচে নামিয়ে আনলো। নিচে এসেই হাত ঝেড়ে ছাড়িয়ে নিলো সাবা।
-” তুই এসব লুকাচ্ছিস কেনো সুহা? লোকটা তো ভালো না।”
-” সাবা, আমার কথাটা একটু শোন। ঘরভর্তি মানুষ। এত মানুষের ভীড়ে এসব বলা সম্ভব না। আমি আজ বাসায় যেয়ে তোকে ফোনে সব বলবো। প্লিজততক্ষন তুই তোর মুখটা খুলিস না। প্লিজ……”-” কেনো বলবো না?”
-” প্লিজ সাবা।বুঝার চেষ্টা কর। এখন কোনো উত্তর আমি দিতে পারবো না।”
-” বাসায় যেয়ে বলবি তো?”
-” সব বলবো। প্লিজ আপাতত তুই চুপ থাক।”
-” ঠিকাছে।”
সুহায়লা চলে গেলো সাদমানের রুমে। ওকে কফি কিনে আনতে বলেছে সুহায়লা। কিছুক্ষন পর ডাক এলো সুহায়লার মা ওকে ডাকছে। একান্তে কিছু কথা বলতে চান তিনি তার মেয়ের সাথে।
(চলবে)

.
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here