বন্ধ দরজা পর্ব ১৯

#বন্ধ_দরজা
পর্ব ১৯
লেখা-মিম
সকাল সাতটায় বিছানা ছেড়ে উঠে আসতে যাচ্ছিলো সুহায়লা। তানভীর ওকে পিছন থেকে আটকালো। তানভীরের চোখ এখনও বন্ধ। চোখ বন্ধ করেই সে বলছে,
-” কোথায় যাচ্ছো?”
-” শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। তাই বের হচ্ছি।”
-” বের হতে হবে না। এখানে শুয়ে থাকো।”
-” আমার ঘুম আসছে না। আর শুয়ে থেকে কি করবো?”
-” আমার ঘুম এখনো কাটেনি। আমি শুয়ে আছি তাই তুমিও এখন শুয়ে থাকবে। আমি উঠলে তুমিও উঠবে। আসো, শুয়ে পড়ো।”
সুহায়লা প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে তানভীরের উপর। ওর মোটেও সহ্য হচ্ছে না এসট নাটক। এতদিন এত কষ্ট দেয়ার পর এখন এই ডিভোর্সের সময় এসে এই সমস্ত নাটকের কোনো মানে হয়না। সুহালা থম মেরে বসেই আছে। চেহারায় প্রচন্ড বিরক্তপ্রকাশ পাচ্ছে ওর। সুহায়লার নড়াচড়া টের না পেয়ে চোখ মেলে তাকালো তানভীর। সুহায়লার বিরক্তিটা ও ভালোই টের পাচ্ছে। কিন্তু ওর এসবে কিছুই আসে যায় না। সুহায়লার মনে ঢুকতে হলে এসব বিরক্তি, রাগ উপেক্ষা করে ঢুকতে হবে।
-” এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? দেখে মনে হচ্ছে আমাকে খেয়ে ফেলবে এক্ষুনি??”
-” ………….”
-” মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার উপর খুব?”
-“…………….”
-” এতো রাগ ভালো না বউ। আসো শুয়ে পড়ো। চোখ বন্ধ করে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করো।”
-” এসব নাটক কেনো করছো তুমি?”
-” ধুর, গতরাত থেকে একই প্রশ্ন করেই যাচ্ছো। বারবার উত্তর দিতে মজা লাগে না। শোও তো এখানে।”
সুহায়লাকে টেনে নিজের পাশে শোয়ালো তানভীর।
-” শোনো, আমি যতক্ষন না ঘুম থেকে উঠবো ততক্ষন পর্যন্ত তুমিও বিছানা ছাড়তে পারবে না। আর তুমি না আমাকে জড়িয়ে ধরতে ঘুমের মধ্যে? আমি দিতে চাইতাম না তবু জোর করে ধরে রাখতে। এখন আর আমাকে জড়িয়ে ধরো না কেনো?”
সুহায়লার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তানভীরকে দু চার কথা শুনিয়ে দিতে। এখন এসব নিয়ে কথা বলতে গেলেই চেঁচামেচি শুরু হয়ে যেতে পারে। তানভীর যা শুরু করেছে ওকে এন একদম বিশ্বাস হচ্ছে না সুহায়লার। তাই এই বাসায় আপাতত কোনো ঝামেলা করতে চাচ্ছে না ও। শ্বশুড়বাড়িতে ফেরত যাক। এরপর ওর কথার উত্তর দিয়ে দিবে মুখের উপর। এখন যা ইচ্ছা করুক। যত লাফাতে ইচ্ছা হয় লাফালাফি করতে থাকুক। সাদমানের বিয়েটা ভালোয় ভালোয় শেষ হোক। এরপর তানভীরকে দেখে নিবে সে। আর যাই হোক এমন লোকের সংসার করা অসম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা তানভীরের উপর থেকে রুচি উঠে গেছে সুহায়লার। যে মনে একটা সময় তার জন্য ভালোবাসা ছিলো সেখানে আজ ঘৃনা জায়গা করে নিয়েছে। আজকাল তানভীরের স্পর্শে সত্যিই গা ঘিনঘিন করে সুহায়লার। এতদিন এমন ঘিনঘিন করতো না। তানভীরের আচরনে নিজেকে পতিতা সমতুল্য মনে হওয়া সত্ত্বেও কখনো এমন ঘৃনার অনুভুতি মনে জন্মায়নি । বরাবরই ভেবেছে তানভীর তার স্বামী। পূর্ন অধিকার আছে তানভীরের ওর উপর। কিন্তু সেদিন রাতে রাহাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা হয়েছিলো এরপর থেকেই এই ঘৃনার উদ্রেক হয়েছে সুহায়লার মনে।
-” এই তোমাকে কি জিজ্ঞেস করছি? উত্তর দিচ্ছো না কেনো? জড়িয়ে ধরো না কেনো আমাকে?”
-” আই থিংক তোমার ঘুমের নেশা কেটে গেছে। এবার আমি উঠতে পারি।”
-” উহুম। শুয়ে থাকো।”
-” সাতটা পনেরো বাজে। ফ্রেশ হবো, নাস্তা করবো। এরপর বাসায় যেতে হবে। গোসল সেড়ে, রেডি হয়ে তোমাকে অফিস যেতে হবে।”
-” হুমম, সেটাও কথা।আচ্ছা যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো।”
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে বাবা ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে। সাদমান নাস্তা খাচ্ছে। আর মা রান্নাঘরে কাজ করছে। সাদমানের কাছে জানতে পারলো সাবা পাঁচ মিনিট আগেই কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। বাবার পাশে বসতে বসতে সুহায়লা বললো,
-” আম্মা, চুলায় পানি বসাও তো। তানভীরের জন্য কফি বানাবো।”
মেয়েকে যথেষ্ট স্বাভাবিক দেখতে পাচ্ছেন মিতা। কিছুটা অবাক হচ্ছেন। কারন উনি উনার মেয়েকে চিনেন। এই মূহূর্তে এতটাও স্বাভাবিক থাকার তো কথা না। আবার তানভীরের জন্য কফিও বানাচ্ছে! উনি গতরাতে মোটামোটি ধারনা করে নিয়েছিলেন যেভাবে তানভীর মাঝরাতে এসেছে ওকে নিতে, এই ছেলে ওকে না নিয়ে যাবে না। উনি এটাও ধারনা করেছিলেন উনার মেয়ের সাথে তানভীরের বাক বিতন্ডা হবে। এতসহজে সুহায়লাকে রাজি করানো যাবে না। এজন্য তানভীরকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে। কিন্তু ঘটনা তো তেমন কিছুই না।সুহায়লার হাবভাবে তো মনে হচ্ছে ও আজই ফিরে যাবে। কোনো ঝগড়ঝাটিও তো এখন পর্যন্ত শুনতে পাননি। কি এমন কথা বলেছে তানভীর যে সুহায়লা ওর সাথে স্বাভাবিক আচরন করছে? সুহায়লাকে জিজ্ঞেস করতে হবে এ ব্যাপারে।
-” কি রে, তানভীর নাকি এসেছে গতরাতে তোকে নিতে?”
-” হ্যাঁ আব্বা।”
-” তুই নাকি ঝগড়া করে এসেছিস?”
-” কে বললো?”
-” সাদি।”
-” হুম করেছিলাম।”
-” ঝগড়া করেছিসভালো কথা। তাই বলে কি নিজের ঘর ছেড়ে চলে আসবি। তানভীর তোকে নিয়ে কতটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো দেখ । চিটাগাং থেকে কাজ ফেলে চলে এসেছে তোর রাগ ভাঙাতে। ও পুরুষ মানুষ। ব্যস্ততা তো থাকবেই। তাই বলে এমন সামান্য ব্যাপারে ঝগড়া করবি?”
-” মানুষটা তোকে খুব ভালোবাসে। তুই জানিস গতরাতে গেইট খুলে উনার মুখটা যখনদেখলাম তখন বুঝতে পারছিলাম উনার মনে কতবড় তুফান চলছে। উনি যেই কাজ পাগল মানুষ! তোর রাগ ভাঙাতে কাজ ফেলে রা ত সাড়ে বারোটায় হাজির হয়ে গেছে। এমন মানুষের সাথে রাগ করিস কিভাবে তুই?”
-” হুম তানভীর অত্যাধিক ভালো মানুষ। এত ভালো মানুষকে হাজবেন্ড হিসেবে পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে।”
-” এভাবে খোঁচা মেরে বলছিস কেনো? উনি যদি তোকে ভালো নাই বাসতো তাহলে কি তোর জন্য এতরাতে এখানে আসতো?”
-” সেসব বলে লাভ নেই সাদমান। তোমার বোনকে এত ভালোবাসি আর ও আমার ভালোবাসা বুঝতেই চায় না।”
-” আরে বাবা, এসো এসো। বসো এখানে।’
-” ভালো আছেন আংকেল?”
-” এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?”
-” আপনার মেেয় খুব জ্বালায়। ওর অত্যাচারে র যন্ত্রনায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই দেখেন, না বলেই রাগ করে চলে এসেছে। ফোনটাও অফ রেখেছে সারাদিন। চিন্তায় অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে আমার । আপনাদের কারো নম্বরও আমার কাছে সেইভ করা নেই। ”
-” কি বলো? আমাদের কারো নম্বর তোমার কাছে নেই?”
-” না ইয়ে… মানে…. আগের ফোনটা চুরি হয়েছে তিনদিন আগে। নতুন ফোন নিয়েছি তো।এই ফোনে আপনাদের নম্বর নেই।”
-” ওহ আচ্ছা আচ্ছা। কই মিতা…. পানি গরম হলো? তানভীরকে কফি দাও।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই কফি হাতে তানভীরের সামনে দাঁড়ালেন মিতা। তানভীরকে কফিটা দিয়ে বললেন,
-” তোমরা গল্প করো। সুহা আমার সঙ্গে একটু আয় তো ।”
মায়ের পিছন পিছন সুহায়লা রুমে গেলো। উনি খুব আস্তে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন
-” তুই কি তানভীরের সাথে যাবি নাকি?”
-” যাবো না। যেতে হবে।”
-“যেতে হবে মানে? কিছু বলেছে নাকি ও তোকে?”
-” হুম থ্রেট দিচ্ছে আমি না গেলে সাদির বিয়ে ভেঙে দিবে।”
-” সাদির বিয়ে ভাঙবে কেনো?”
-” জানিনা আমি। আমার এখন ওর সাথে যেতে হবে এটাই জানি। বিয়েটা শেষ হোক এরপর ওর একটা ব্যবস্থা করবো।”
-” কি করবি?”
-” ডিভোর্স দিবো। তখন তো ও আর কোনো থ্রেট আমাকে দিতে পারবে না।”
-” মা তোকে কিছু কথা বলি। মন দিয়ে শোন। ছেলেটা অতীতে যা করেছে খুব খারাপ করেছে। এখন ওকে দেখলেই বুঝা যায় ও তোকে ভালোবাসে। এভাবে সম্পর্কটা শেষ করে দিস না।”
-” ওর ভালোবাসায় আমার কিছুই আসে যায় না। ও যা করেছে এরপর ওকে মন থেকে আমি জীবনেও মানতে পারবো না।”
-” ছেলেটা নিজেকে শুধরাতে চাচ্ছে। ওকে একটা সুযোগ দে।”
-” বিনা দোষে শাস্তি দিয়েছে ও আমাকে আম্মা। দেড়টা বছর প্রতিনিয়ত জ্বলেছি আমি। ওকে ক্ষমা করা অসম্ভব।”
-” তুই আমার কথাটা শোন।”
-” শোনো আম্মা, তুমি কি চাও আমি আর তোমার ঘরে না আসি?”
-” চাইবো না কেনো? অবশ্যই চাই।”
-” যদি চাও আমি এই বাড়িতে আসি তাহলে তানভীরের সাফাই গাইতে আসবে না আমার সামনে। যদি গাও তাহলে চিরতরে এ বাড়ির রাস্তা মন থেকে মুছে ফেলবো। ডিভোর্সের পর সোজা অন্য কোথাও চলে যাবো। তোমাদের কাছে আসবো না।”
-” এত ঘৃনা জন্মেছে তোর মনে তানভীরের জন্য?”
– হ্যাঁ জন্মেছে। এসব তানভীরের কারনেই হয়েছে। এসবের জন্য শুধুমাত্র ও নিজেই দায়ী।”
-” কি নিয়ে কথা বলছো তোমরা? কে দায়ী?”
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে সাদমান এসেছে রুমে।
-” অন্য ব্যাপারে কথা বলছি।”
-” ওহ্। আচ্ছা ঘটনা কি বলতো? তুই তো এতো সামান্য বিষয়ে ঝগড়া করে সংসার ছাড়ার মেয়ে না। বড় কিছু অবশ্যই হয়েছে। কি হয়েছে?”
-” এটাই সমস্যা। সবসময় এত দূরত্ব ভালো লাগে না সাদি।সারাদিন ঘরে একা পড়ে থাকি । ও সকালে যায় রাতে আসে। নিজে সারাদিনে একটা ফোনও করে না। আমি ফোন করলেও ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে ফোন রিসিভ করে না। এভাবে আর কতদিন তুই ই বল? রাগ তো আমি একদিনে হইনি। পুরো দেড়বছর ওর এসব তামাশা সহ্য করেছি। আর ভালো লাগছে না সেসব।”
-” ঠিকাছে বুঝতে পারছি তোর কথা। কিন্তু উনি তো আর এমনি এমনি দূরে থাকে না। বেচারা কাজের প্রেশারে থাকে। তো এখন কি করবে বল? এভাবে আর রাগ করে থাকিস না। বেচারা কষ্ট পাচ্ছে। নিতে এসেছে। বাড়ি ফিরে যা। সপ্তাহখানেক থেকে আবার চলে আসিস। একেবারে বিয়ে খেয়ে এরপর যাস।”
-” বলেছিলাম এখন যাবো, এক সপ্তাহ পর আবার আসবো। সে মানবে না। বলছে বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আসতে।”
-” বুঝিয়ে বল যে বিয়ের শপিং করতে হবে। তোকে এখানে প্রয়োজন।”
-” বলেছি। তবু মানে না। বলে যে ওর বাসা থেকে শপিংয়ে যেতে আবার শপিং শেষে সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে।”
-” শোন মূল কথা হচ্ছে তোকে ছাড়া থাকতে উনার কষ্ট হয়। এজন্য তোকে আসতে দিতে চায় না। উনি সত্যিই তোকে ভালোবাসে সুহা। তুই অহেতুক উনার সাথে ঝগড়া করিস।”
-” হ্যাঁ যা…. আমি অহেতুকই ঝগড়া করি।”
-” উনি যেভাবে বলে সেভাবেই কর। বিয়ের এক সপ্তাহ আগেই আয়। আর প্লিজ সামনে আমার বিয়ে। উনার সাথে ঝগড়া করিস না। আমি চাইনা আমার বিয়ের সময় তোদের কারো মুখ গোমড়া থাকুক।”
-” আমিও সাদির সাথে একমত। এই খুশির সময় ঝগড়াঝাটি করিস না। ওকে তুই মাফ করে দে। রাগ ক্ষোভ মন থেকে ঝেড়ে ফেল।”
-” ঝগড়া করবো না। হয়েছে? খুশি?”
-” তোরা দুই বোন সুখে থাকলেই আমি খুশি। আম্মা আমি অফিসে গেলাম। তুমি তানভীর ভাইকে নাস্তা দাও।”
সাড়ে নয়টার দিকে নাস্তা সেড়ে তানভীর সুহায়লা বনশ্রীর বাসায় এসেছে। দরজা খুলেই নয়ন সুহায়লাকে দেখে সে কি খুশি। মনে হচ্ছিলো ওর আত্মায় পানি ফিরে এসেছে। বাকি দুই কাজের মেয়েকে নিয়ে এক এক করে তিনটা লাগেজ সুহায়লার রুমে রেখে এসেছে। গোসল সেড়ে রেডি হয়ে তানভীর অফিসে চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে দুপুরে তার জন্য পুইশাক ভাজি, চিংড়ি ভুনা আর ছোট মাছের চচ্চরি রেঁধে অফিসে নিয়ে যেতে। দুজনে একসাথে বসে অফিসে লাঞ্চ করবে।
(চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here