#খোলা_জানালা
#৫ম_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
বাবা -মা এলেন বিকেল বেলায়। তাদের দেখে আমার কী যে কান্না পেলো! শব্দ করে কেঁদে উঠে আমি দৌড়ে গিয়ে বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।বাবা আমার পিঠে তখন আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’তোর চেহারা এমন হয়েছে কেন? চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেমন!’
মা আমার থুতনির নিচে ধরে মুখটা উপরের দিকে তুলে নাক আর কান দেখে আঁতকে উঠা গলায় বললেন,’নাক কান কাটলো কীভাবে তোর? ফুল কোথায় নাক কানের?’
আমি কিছু বলার আগেই নাঈমের মা বলে উঠলো,’তোর মেয়ের যা জেদ!আমি বললাম কী,মা, তুমি নিজের ঘরে স্বামী রেখে অন্য পুরুষের সাথে দেখা করেছো রাতে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোর মেয়ে তখন রাগে নিজের গলার চেন,কানের ফুল,হাতের চুড়ি,নাক ফুল সব টেনে টুনে ছিঁড়ে মেঝেতে ফেলে দিলো!’
এই বানোয়াট কথাগুলো বলে নাঈমের মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,’সব আমার কপাল।কত শখ করে বান্ধবী আর নিজের মাধ্যমিক স্কুলের স্যারের মেয়েকে ঘরের বউ করে আনলাম। কিন্তু সেই বউ—‘
কথাগুলো তিনি মিথ্যে কান্নার জন্য শেষ করতে পারলেন না।একটা মানুষ কীভাবে এতো মিথ্যে কথা আর মিছে কান্নাকাটি এভাবে করতে পারে তা আমি ভাবতেও পারি না।
‘
কিন্তু বাবা মা নাঈমের মায়ের কথায় কান দিলেন না।বাবা আমাকে বুকের উপর জড়িয়ে ধরে রেখেই বললেন,’নাঈম কোথায়?’
নাঈমের মা বললেন,’বাজারে গেছে।আপনারা আসবেন শুনে বাজার করতে গেছে। ছেলেটার মন এমনিতেই খারাপ।আপনারা চলে যান এখন দয়া করে।নাঈম এসে আপনাদের দেখলে তার মন আরো খারাপ হবে।’
বাবা বললেন,’মন খারাপ হবে কেন?সে নিজেই তো আমাদের খবর দিয়ে এনেছে।বলেছে, আমাদের সাথে আপনার কী নাকি বোঝাপড়া আছে।আমরা সেই বোঝাপড়া করতে এসেছি।’
নাঈমের মা বাবার মুখ থেকে এই কথা শুনে মুখ কেমন কালো করে ফেললো।আর কপাল কুঁচকে এখান থেকে ভেতর ঘরের দিকে চলে গেলো।
‘
নাঈম বাজার থেকে এলো সন্ধ্যা বেলায়।তার হাতে বাজার ভর্তি ব্যাগ।সে এসে আমার হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বললো,’তুমি রান্না করো।আমি মা বাবার সাথে কথা বলি।’
আমি তার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলাম।নাঈম ততোক্ষণে মা বাবার সাথে কুশল বিনিময় করে আশে পাশের ক’ বাড়ির লোক আর
আত্মীয় স্বজন যারা গতরাত এসে শুনে গিয়েছিল আমার শাশুড়ির কাছে আমি দোষী তাদের ডেকে আনলো। তারপর সকলকে উঠোনে চেয়ার,পাটিতে বসতে দিলো। এবার বাবা মা আর আমার শাশুড়িকে একপাশে বসিয়ে আমায় ডাকলো।আমি এসে নাঈমের পাশে দাঁড়ালাম।
নাঈম এবার বললো,’আমার মায়ের একটা পুরনো জেদ আছে আমার শশুর শাশুড়ির উপর।ছলে বলে এই পুরনো জেদের শিকারি করেছেন তিনি আমার স্ত্রীকে।এর জন্য গতরাতে তিনি মীরার উপর অত্যাচার করেছেন।তার কান,আর নাক ছিঁড়ে ফেলেছেন।সে যায়হোক। এবার আমার মা আপনাদের সামনে বলবেন কী এমন শক্ত জেদ ছিল আমার শশুর শাশুড়ির উপর যার জন্য তিনি মীরার সাথে এমন অসভ্যতামি করেছেন!আম্মা বলো!’
নাঈম তার মাকে খুলে বলতে বললো বাবার প্রতি তার কী জেদ। কিন্তু নাঈমের মা এখন কথা বলতে পারছেন না। কেমন আমতা আমতা করছেন।
নাঈম এবার জোর গলায় বললো,’বলো না কেন?নাকি আমি বলবো।’
নাঈমের মা এবার কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’নাঈম,তুই বাড়াবাড়ি করছিস। মানুষের সামনে নিজের মাকে অপমান করছিস। তোর বউ তোকে জাদু করেছে এর জন্য তুই এমন করছিস!’
নাঈম তখন হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,’আমাকে কেউ জাদু করেনি। আমি সত্যিটা বলছি সবাই শুনুন।আর বাবা মা আপনারা আরো মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
আমার মায়ের মাধ্যমিক স্কুলের স্যার ছিলেন আমার শশুর আর আমার শাশুড়ি ছিলেন আমার মায়ের বান্ধবী।স্যারের সাথে নাকি আমার মায়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল।দিন তারিখ পর্যন্ত ধার্য্য করা ছিল। কিন্তু সেই বিয়ে না করে আমার শশুর আমার শাশুড়ি অর্থাৎ আম্মার বান্ধবীকে নিয়ে পালিয়ে যান।’
তারপর নাঈম খানিক সময় চুপ করে রইলো।চুপ করে থাকার পর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,’আম্মা যা বললো তা কী সত্যি?’
বাবা বেশ অবাক হলেন।আর নিজের চশমাটা খুলে দুটো চোখের জমা জল মুছলেন পাঞ্জাবির কোনো দিয়ে। তারপর ভেজা গলায় বললেন,’কী বলবো বলো বাবা? তোমার মা আমার স্টুডেন্ট ছিল। আমার স্ত্রীর বান্ধবী ছিল। তাকে আমি নিজের বোনের মতো দেখেছি সব সময়। ওদের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল আমার।ওর বাবা অর্থাৎ তোমার নানা আমায় খুব আদর সোহাগ করতেন।এতোটুকুই।এর বেশি কিছু আমি জানি না।’
বাবার পর মা মুখ খুললেন। তিনি বললেন,’মিনা, তোকে আমি নিজের বোনের মতো দেখতাম। বোনের মতো দেখতাম বলেই তোর ঘরে আমার মেয়েটা তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই যে এতো নীচ তা আমি জানতাম না। আচ্ছা কেন তুই এইসব মিথ্যে অভিযোগ তুলে আমার মেয়েটার উপর এমন টর্চার করলি?তার চরিত্রে কালিমা লেপলি?’
নাঈমের মা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো।
নাঈম এবার তার মার কাছে গিয়ে বললো,’আম্মা, কাকে বিশ্বাস করবো?
তোমাকে না উনাদের দুজনকে?
না মানে তুমি তো আমার চোখের সামনেই বারবার মিথ্যে বলেছো। গতকাল থেকে মীরার উপরই শুধু একশো একটা মিথ্যা অভিযোগ তুলেছো!’
নাঈমের মা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন,’সবাই শুনুন।আমিই অপরাধী।আমি মীরার উপর মিথ্যা অভিযোগ তুলেছি। মিথ্যা অভিযোগ তুলেছি এই জন্য যে আমি তার বাবার কাছ থেকে ভালোবাসা পাইনি।আমি তার বাবাকে মনে মনে পছন্দ করতাম।বলতেও চেয়েছিলাম সেই কথা তার বাবার কাছে। কিন্তু বলার আগেই দেখি মীরার মায়ের সাথে তার সম্পর্ক হয়ে গেছে। তখন মনে মনে খুব আঘাত পাই আমি। তারপরও আশায় ছিলাম যদি উনার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যায়! কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো না। বিয়ের আলাপ দেয়ার আগেই মীরার মায়ের সাথে তিনি পালালেন!’
সবাই খানিক সময়ের জন্য থেমে গিয়েছিল নাঈমের মার মুখ থেকে কথাটি শুনে।নাঈম এবার তার মাকে বললো,’ছিঃ মা ছিঃ! তুমি এতো নীচ! এখানে তো আমি মীরা কিংবা তার বাবা মা কারোর দোষ খুঁজে পাইনি।সব দোষ তো তোমার। তুমি সাহস করে বলতে পারোনি। এই দোষ তো আর মীরার বাবার না। এই দোষ তোমার।এই একটা সামান্য বিষয় মনে রেখে তুমি মীরার উপর প্রতিশোধ নিয়েছো। ছিঃ মা ছিঃ!’
নাঈমের মা তখন কাঁদতে কাঁদতে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,’সবাই শুনুন।আমি অপরাধী।বড় অপরাধ করে ফেলেছি আমি।তাই আমি লজ্জিত।আপনারা কেউ এমন নিকৃষ্ট কাজ করবেন না।’
তারপর তিনি বাবা মার কাছে এসেও মাফ চাইলেন।আমার হাত ধরে বললেন,’মারে, বড়ো অপরাধ করে ফেলেছি আমি।তোমার সাথে যে ব্যাবহার করেছি আমি তার জানি কোন মাফ নাই। তবুও তোমার কাছে মাফ চাইছি আমি।’
কথাগুলো বলে জড়জড় করে কেঁদে উঠলেন তিনি।আমি ভাবলাম, এখন তাকে মাফ করে দেয়া যায়।যে ভুল করে সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাকে বাঁধা দিতে নেই। কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নাঈম বললো ,’যাও মীরা ঘরে যাও।ব্যাগ গোছাও।আমরা আজ রাতেই ঢাকা চলে যাবো।’
নাঈম আবার সকল সমবেত লোকেদের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে আপনারা দেখুন।কারোর প্রতি মিথ্যা অবিচার আর শত্রুতা পোষণ করে শেষ পর্যন্ত সফল হওয়া যায় না। বরং পরাজিতই হতে হয়!’
সবাই এক কন্ঠ হয়ে তখন বললো,’ঠিক বলেছো। তুমি ঠিকই বলেছো।’
””””””
নাঈমের সাথে ঢাকায় যেতে আমি নারাজ ছিলাম। আমার শাশুড়ির জন্য আমার খুব মন খারাপ লাগছিলো।আমি নাঈমকে বলেছিলাম,’শুনুন,আমরা বাড়িতেই থাকি।আম্মা তো তার ভুল বুঝতে পেরেছেনই!’
নাঈম তখন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আমায় টেনে নিয়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে বললো,’কারোর কাছে আসার জন্য মাঝেমধ্যে এমন কিছু করতে হয়।বাহানা করে হলেও একবার দূরে যেতে হয়। দূরে যাওয়া মানেই শুধু ছেড়ে যাওয়া নয়। দূরে যাওয়া মানে আবার ফিরে আসবো এমন একটি কথা উহ্য ভাবে বলে যাওয়া।’
নাঈমের মুখ থেকে এমন একটি কথা শোনার পর আমার মনে হলো জীবনটা এতোটাও খারাপ নয়। মানুষের সুখ দুঃখ নিয়েই তো জীবন।নাঈম আমার সুখ।যেই শোক সেদিন আমার খোলা জানালা দিয়ে ঘরে এসেছিল সেই শোক আবার খোলা জানালা দিয়েই টুপ করে মিলিয়ে গেল। তারপর এলো ঘর ভর্তি সুখ।এটাই জীবন। মানুষের জীবন। জীবনের একটি অংশের গল্প।
‘
—সমাপ্ত—