তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৫
_______________
আমজাদ হোসেন!অরূণীদের কলেজের ইংলিশ টিচার। অবিবাহিত আমজাদ হোসেন বয়সের তাড়নায় অরূণীদের ক্লাসের নজর কাড়া সুন্দরী সাথির প্রেমে পড়ে যায়। ঘটনা শুধু প্রেমে পড়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকল না।কলেজের বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানের দিন আমজাদ হোসেন সাথি’কে অতি গোপনে কলেজ ক্যাম্পাসের এক কোণে ডেকে নিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। মেয়েদের স্বভাবগত অভ্যাস অনুযায়ী সাথি প্রেম প্রস্তাবের সাথে সাথে হ্যাঁ বলল না।হ্যাঁ বলতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগল।কথায় আছে দেয়ালেরও কান আছে।এই চিরন্তন সত্য বাণী’কে আবারো সত্য প্রমান করে দিয়ে, পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে সাথি আর আমজাদ হোসেনের প্রেমের বিষয় সবার মুখে মুখে।এসব উপেক্ষা করে তাঁদের প্রেম ভালোই চলছিলো। ক্লাসের ফাঁকে শুভদৃষ্টি, ক্যান্টিনে ফুসকা খাওয়া, কলেজের আনাচে-কানাচে ফুসুর-ফাসুর শুরু করে দেয় সুযোগ পেলেই। হঠাৎ একদিন এক ন্যক্কারজনক কথা পুরো কলেজে আলোর বেগে ছড়িয়ে পড়ে। আমজাদ হোসেন আর সাথি নাকি বাথরুমের চিপায় ঢুকে চুমু খেয়েছে। ঘটনা’টা যখন প্রিন্সিপালের কানে গেল তখন ভয়ংকর রূপ নিলো। লোক মুখে শোনা, কলেজ প্রিন্সিপাল নাকি আমজাদ হোসেন’কে চরম অপমান করেছে এমন বিশ্রী কাণ্ডের জন্য। এই ঘটনা ঘটার পর থেকে পনেরো দিন পর্যন্ত কলেজে আসেনি সাথি। আমজাদ হোসেন’কে চাকরির জন্য আসতেই হলো। আমজাদ হোসেনের হাস্যেজ্জ্বল মুখ তখন দেখা যায় নি। অস্বস্তিকরপূর্ণ একটা ভাব মুখে নিয়ে ক্লাসে আসে। আশেপাশে তাকায় না, নিচের দিকে তাকিয়ে ক্লাস নেয়। স্টুডেন্টরা যে যে ভাবে সুযোগ পাচ্ছে সে সে সেভাবে খোঁচা মেরে ইশারা-ইঙ্গিতে হাসা-হাসি করছে আমজাদ হোসেন’কে নিয়ে। লজ্জা কিংবা অস্বস্তি’তে আমজাদ হোসেনের মুখ সব সময় থমথমে থাকত। ঘটনার এক মাস পর সাথির বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে আমজাদ হোসেনের সাথে হয় নি, বিয়ে হয়েছে এক বিসিএস ক্যাডারের সাথে। সাথির প্রাক্তন হিসেবে আমজাদ হোসেন পুরো কলেজে পরিচিত হয়ে যায়। সবাই আড়ালে আবডালে আমজাদ হোসেন’কে নিয়ে হাসাহাসি করে। আমজাদ হোসেন ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে ছাত্র-ছাত্রীরা এমন এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে, আমজাদ হোসেন বুঝতে পারে এই হাসি তাঁকে নিয়ে বিদ্রুপের হাসি। বিরক্ত আর লজ্জার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে যায় আমজাদ হোসেন। আমজাদ হোসেনের বন্ধু সমাজেরও অনেকে এই বিষয় নিয়ে হাসি-তামাশা কিংবা কৌতুকের ছলে মজা লুটে। আমজাদ হোসেন প্রথম প্রথম এসব দাঁত কামড়ে সহ্য করলেও আস্তে আস্তে তিক্ত হয়ে ওঠে।এক পর্যায়ে, সরাসরি কিংবা ইশারা-ইঙ্গিতে কেউ কোন রকম উপহাস করলেই আমজাদ হোসেন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। আর সেখানে তাঁর বাসায় গিয়ে সাথি’কে খোঁজ করা কত’টা দুঃসাহসিক কাজ!না জেনে এই দুঃসাহসিক কাজ’টাই রুদ্র করে ফেলল।
______________________
কিরণ আগে আগে রকেটের গতিতে দৌড়াচ্ছে। রুদ্র দৌড় বন্ধ করে হাঁপাচ্ছে আর হাঁটছে। কিরণ’কে দূর থেকে ডাকে।হাঁপানো স্বরের ডাক বেশিদূর পর্যন্ত যায় না। রুদ্রের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে রাগের ফুলকি ছড়াচ্ছে যেন। কিরণ আমজাদ হোসেনের বাসা থেকে অনেক দূর গিয়ে থামে। রুদ্র ক্ষীপ্তবস্থায় হেঁটে কিরণের কাছে যায়। রুদ্রের অগ্নিবর্ণ চোখের কঠিন দৃষ্টি কিরণের দিকে। ক্রোধান্বিত গলায় চেঁচিয়ে বলল, “দৌড় দিলি কেন?আমরা কি চুরি করতে গেছি?ওই সাথির ভাই শালায় অমন তালবাহানা করল কেন?”
দৌড় শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে কিরণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। নিচের দিকে ঝুঁকে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। মাথা তুলে রুদ্রর দিকে তাকাতেই দেখে রুদ্র ওঁর দিকে তীব্র রোষপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে। কিরণ অসহায় গলায় বলল, “দোস্ত তুই তো জানিস আমি মারধর কত ভয় পাই। উফ্ দোস্ত! মার খাইলে এত ব্যথা লাগে! ওই শালায় পাগলা কুত্তার মত তাকিয়ে ছিলো। যেন এক্ষুনি আমাদের পা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবে।”
রুদ্র নিদারূণ বিরক্তি নিয়ে বলল, “অহেতুক ভয় পেলি কেন তুই? আর রুদ্র আকন কি মানুষ’কে ভয় পায়?সাথির ভাই আমাদের শালার পুত বলল কেন? আমাদের গালি দিলো আর আমরা প্রতিবাদ না করে দৌড় দিয়েছি।”
আমজাদ হোসেনের ওপর তীব্র রাগে রুদ্র প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে অস্থির ভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে রুদ্র। কিরণ বলল, “আমি না হয় মারধর ভয় পাই। তুই তো পাস না ভয়। তাহলে তুই দৌড় কেন দিয়েছিস?”
– “আমি তো তোর দৌড় দেখে দৌড় দিয়েছি। ভয় পেয়ে দৌড় দিই নি।”
রুদ্র এইটুকু বলে থেমে বদমেজাজ নিয়ে বলল, “ওই ইঁচড়ে পাকা মেয়ে’টা কে আর একবার সামনে পেলে গুনে গুনে চার’টা চড় দিবো। সবে মাত্র স্কুলে পড়ে অথচ কি ফিচলেমী’টা করল।”
– “দোস্ত তুই ওই টাকার আশা ছেড়ে দে।আমি আর এসবে নেই।”
– “টাকার আশা ছাড়ব মানে? আমি আবার যাবো ওই বাসায়। কিন্তু একটা কথা বল ওই লোক আমাদের গালি দিলো কেন?”
কিরণ ক্রূর বিদ্রূপ করে বলল, “বাসায় গিয়ে যুবতী বোন’কে খুঁজলে গালি দিবে না তো কি?”
– “জানতেও চাইবে না কেন খুঁজছি? আমাদের শালার পুত বলল! ভাবতে পারিস ব্যাপার’টা?”
কিরণ দাঁত কেলিয়ে বলল, “ভাবা-ভাবির কি আছে? আবার কখনো ওই লোকের সাথে দেখা হলে আমরা মামা ডাকব।”
কিরণের অহেতুক দাঁত কেলানিতে রুদ্রর শরীর রাগে চড়চড় করছে।রাগ শেষ পর্যন্ত ঘুরেফিরে অরূণীর ওপর গিয়ে ঠেকছে। রুদ্রের হাত ইশপিশ করছে। এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, “কিরণ তুই বাসায় যা।”
কিরণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুই কোথায় যাবি?”
কিরণ একটু থেমে রুদ্র’কে সাবধান করে দিয়ে বলল, “ওই বাসায় আর যাস না। মার দিয়ে বসলে তখন আর কি করার? টাকার থেকে মান-সম্মান বড়। বাসায় গিয়ে টাকার জন্য জোরাজুরি করলে মিথ্যে মামলা ঠুকে দিবে। নারী নির্যাতনের মামলা বুঝলি? যেমন ইঁচড়ে পাকা বোন, তেমন ভাই। ভয়ঙ্কর মানুষ এঁরা।”
রুদ্র কি যেন ভেবে বলল, “তুই বুঝলি কীভাবে ওটা ওই মেয়ের ভাই?”
– “তো কি হাইস্কুলে পড়া মেয়ের হাজবেন্ড? সে যুগ এখন আর আছে?”
রুদ্র উত্তর দিলো না। কিরণ আবার তীব্র আক্ষেপ করে বলল, “যুগ পাল্টায়। যুগে যুগে অনেক কিছু পাল্টায়। কিন্তু আইনের ধারা পাল্টাচ্ছে না। নারী নির্যাতন মামলা আছে, পুরুষ নির্যাতন মামলা নেই কেন?ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে দেখ কত পুরুষ নির্যাতিত হচ্ছে। গার্লফ্রেন্ডের হাতে কিংবা বউয়ের হাতে। আমাদের সাথে যা হয়েছে সেটা কি এক প্রকার নির্যাতন না?”
রুদ্র প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট’টা বের করে সিগারেট ধরালো। সিগারেট’টা দুই আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে দুই’টা টান দিয়ে নাক দিয়ে ধোঁয়া উড়ালো। শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এটা নির্যাতন নয় প্রতারণা। প্রতারণা মামলা দেওয়া যেতে পারে।”
রুদ্র সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তেই কিরণ নিজের নাক টিপে ধরল। সিগারেটের গন্ধে কিরণের মাথা ব্যথা হয়। রুদ্র কিরণের দিকে তাকিয়ে বলল, “যে পুরুষ সিগারেট খায় না, সে কোন পুরুষ না।”
– “তো কি আমি পুরুষ না? সিগারেট খেয়ে প্রমান করতে হবে যে আমি পুরুষ?”
– “তুই সিগারেট কেনার টাকা পাবি কোথায়? গার্লফ্রেন্ড’কে লিপস্টিক,স্নো কিনে দিতে দিতেই তো পকেট খালি।”
কিরণ যেন যুক্তিতে পরাস্ত হলো। গার্লফ্রেন্ড’কে নিয়ে এসব প্রসঙ্গ আসলেই কিরণ চতুরতার সহিত এড়িয়ে যাবে। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, “তুই কি সত্যিই প্রতারণা মামলা দিবি?”
রুদ্র হালকা গলায় বলল, “আরে ধুর! এই কয়টা টাকার জন্য মামলা দিবো?”
কিছুক্ষণ পর রুদ্র আবার ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “সিনিয়র-জুনিয়র সবাই আমার সাথে মেপে কথা বলে। আর ওই হাই স্কুলে পড়া মেয়ে আমায় হাতের তালুতে নিয়ে নাচাচ্ছে।”
কিরণ হাসলো। স্বস্তিপূর্ণ গলায় বলল, “আর যাই বলিস। ওখানে বসে আর কথা বাড়ালে নিশ্চিত আমাদের মার দিতো। আমরাও না হয় মারতে পারতাম কিন্তু মান-সম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো?”
রুদ্র খ্যাক করে ওঠে বলল, “রাখ তোর জ্ঞান। ওই শালারে আমি মার না দিয়ে ছাড়বো?”
কিরণের ফোন বেজে ওঠে এর ভিতর। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিরণ যেন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। ব্যস্ত গলায় বলল, “দোস্ত,আমার ডেটিং-এ অলরেডি আধা ঘন্টা লেইট। আমি যাচ্ছি।”
– “যা। আমারও কম্পিউটারের দোকানে কাজ আছে।”
রুদ্র কয়েক মুহূর্ত পর আবার বলল, “তোর যে কাল নাগিনী গার্লফ্রেন্ড,আজ তোকে যেন ঠোকর দিয়ে মেরে না ফেলে।”
কিরণ একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেল। সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ’টা হাত থেকে ফেলে দিয়ে রুদ্রও হাঁটতে লাগলো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে। টাকা ধার দিয়ে কি একটা উটকো ঝামেলায় পড়ল! এই কথা ভাবতেই রুদ্রর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রুদ্রর কান ধরে ওঠ-সব করতে ইচ্ছে করছে নিজের এরূপ ভ্রমের জন্য। চারদিকে থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। রুদ্র নামাজ পড়ে কম্পিউটারের দোকানের দিকে হাঁটতে লাগলো।
__________________________
সন্ধ্যার পর অরূণী জানালার কাছে হেলান দিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যার পর পৃথিবী’টা কেমন যেন মোহনীয় মনে হয়। অরূণী তাকিয়ে তাকিয়ে ব্যস্ত শহর দেখে, দেখে ব্যস্ততম মানুষ গুলো। মানুষের কর্মব্যস্ততা কিংবা ঘরে ফেরার তাড়া। কিছুক্ষণ পর পর তীব্র জোরে হর্ন বাজিয়ে বড় বড় ট্রাক যাচ্ছে শোঁ শোঁ করে। চারদিকে নানা রঙের লাইটের আলোতে শহর’টা রঙ-বেরঙের রূপ ধারণ করেছে।দূরে ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো’টা তেল ফুরিয়ে আসা লণ্ঠনের মত জ্বলছে।তার আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা ৫-৭ বছর বয়সী এক বাচ্চার দিকে তাকিয়ে অরূণীর চোখ আটকে যায়। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় বাচ্চাটার চেহেরায় মনোরম সৌন্দর্যের হলুদ আভা ফুটে ওঠেছে। পৃথিবীর নানা রকম সৌন্দর্য মানুষ’কে নানা রকম অনুভুতি দান করে।যেমন নদী দেখলে মানুষ অকারণেই উদাস হয়ে যায়।
অরূণী জানালার কাছ থেকে উঠে আসে। রাত দশ’টার দিকে হঠাৎ রুদ্রর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো অরূণীর। রুদ্র’কে যে সিমের নম্বর দিয়েছিল সেই সিম অন করে। রুদ্রের কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে অরূণীর। তীব্র রকমের ইচ্ছা, পিপাসা। নিজের এই বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসার ভবিষ্যৎ নিয়ে মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে অরূণী। মাঝে মাঝে এসব ভেবে হাঁ হয়ে থাকে। একটা ছেলেকে সত্যি এতটা ভালোবেসে ফেলেছে? রুদ্রের কাছে ফোন দিলে রুদ্রের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সে ভেবে উত্তেজিত হয়ে পড়ে অরূণী। ধমক দিবে হয়ত! ফোনের ভিতর তো আর চড় দিতে পারবে না। অরূণী ফোন দিলো। রুদ্র তখন ঘড়ি দামাদামি করছিল। দোকানির সাথে কথা বলার মাঝে ফোন বাজায় ফোনের স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই ফোন’টা কেটে দেয়। রুদ্র ফোন কেটে দেওয়ায় অরূণী অবাক হয়ে যায়। অরূণী ভেবেছিল ফোন দেওয়ার সাথে সাথে রুদ্র ফোন রিসিভ করে আকাশ-পাতাশ ফাটিয়ে ধমক দিবে ও’কে। রুদ্র শপিং মল থেকে বের হয়ে পকেট থেকে ফোন’টা বের। ফোনের দিকে তাকিয়ে রুদ্রর চোখ কপালে উঠে গেল অরূণীর ফোন নম্বর দেখে। এর ভিতর অরূণী আবার ফোন দিলো। রুদ্র সাথে সাথে ফোন তুলে গর্জে ওঠে বলল, “ইঁচড়ে পাকা মেয়ে তোমায় সামনে পেলেই চার’টা চড় দিবো।”
রুদ্রর এমন আচরণও অরূণীর কাছে ভয়ঙ্কর রকমের মিষ্টি লাগছে। অরূণী নিজেকে নিজে ধমক দেয়। এমন আচরণ মিষ্টি লাগা মোটেও কাম্য নয়। অরূণী রুদ্রের গলার স্বরে বিবশ হয়ে থাকে।কৌতুক করে বলল, “চার’টা কেন? চৌষট্টি’টা চড় দিবেন। আপনার ছোঁয়া পাবো।”
কথা’টা বলে অরূণী জিহ্বায় কামড় দিলো। ছিঃ কি বললো এটা?অরূণীর এমন জবাবে রুদ্র হতবাক। মজা লুটছে মেয়ে’টা? রুদ্র চোয়াল শক্ত করে বলল, “এই মেয়ে চিনো তুমি আমায়?টাকার জন্য তোমার বাসা পর্যন্ত গিয়েছি। সামনে পেলেই গাল লাল করে দিবো।”
বাসা পর্যন্ত গিয়েছে মানে? আমজাদ স্যারের বাসায় গিয়েছিল? কি হয়েছে সেখানে গিয়ে?অরূণীর মাথায় প্রশ্ন গুলো ডাঙায় তুলে রাখা মাছের মত তাড়পাতে থাকে। অরূণী’কে নিরুত্তর দেখে রুদ্র ফের বলল, “তোমার ভাই যে ব্যবহার করেছে এর মাশুল গুনতে হবে। ভদ্রতা নেই কোনো? মানুষ বাসায় গেলে কিছু জিজ্ঞেস না করে গালি দিবে?তাড়া করবে?”
আমজাদ স্যারের বাসায় গিয়েছে তাহলে! অরূণীর পরিকল্পনা সফল হওয়ায় পেট ফেটে যাচ্ছে হাসির বেগে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপিয়ে রাখলো। শেষে ব্যর্থ হয় ফোন হোল্ড করে রেখে রুম কাঁপিয়ে হাসছে। হাসতে হাসতে অরূণীর চাপা ব্যথা হয়ে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসছে। পাঁচ মিনিট পর হাসি নিয়ন্ত্রণ করে ফোন হাতে নেয়। মুহুর্তেই গলার স্বর পরিবর্তন করে ব্যথিত গলায় বলল, “জানেন ভাইয়া কি হয়েছে?প্রেম করে বাসায় ধরা খেয়েছি। হাই স্কুলে বসেই প্রেম-প্রীত করে ধরা খাওয়ার ফলস্বরূপ আমায় রুমে বন্ধি করে রেখেছে।আমি বয়সের তুলনায় বেশি পেকেছি। নয়ত কি কেউ হাই স্কুলে বসে প্রেম করে বলুন? আর আমার ভাই ভেবেছে আপনি সেই ছেলে তাই অমন ব্যবহার করেছে। আপনার কাছে স্যরি বলতে ফোন দিয়েছি। আর শুনুন আপনার টাকা কালই দিয়ে দিবো।”
রুদ্র কিছু বলার আগে অরূণী আবার বলল, “সেদিন আপনার সাথে ফাজলামি করে উল্টাপাল্টা বলে ফোন অফ করে রেখেছিলাম। আমি ভেবেছি আবার বিকেলে ফোন দিয়ে বলব যে, “ভাইয়া স্যরি, ফাজলামি করেছি।আপনার টাকা এখনই দিয়ে দিবো।” কিন্তু দুপুরেই ধরা খেয়েছি আর সুযোগ হয়নি ফোন দেওয়ার।আমি একটু বেশি ফাজলামি করি। দেখেন না এই বন্দি দশায় থেকেও কি চটপট কথা বলি? এটা আমার স্বভাব ভাইয়া। কিন্তু আমি খুব কষ্টে আছি। প্লীজ আমায় বকা দিবেন না। আমি পরিস্থিতির স্বীকার।”
সবকিছু শুনে রুদ্রের মেজাজ একটু হালকা হলো। অরূণীর এমন সরল স্বীকারোক্তি কেমন অদ্ভুত লাগলো রুদ্রর। বিরক্ত ভরা গলায় বলল, “টাকা কখন দিবে?”
ওপাশ থেকে অরূণী অসহায় গলায় বলল, “প্লীজ ভাইয়া কিছু মনে করেন না। আমায় তো বাসা থেকে বের হতে দেয় না। আপনার একটু কষ্ট করে বাসায় আসতে হবে। এবার আর আমার ভাই ওরকম আচরণ করবে না। আমি আমার মা’কে বুঝিয়ে বলেছি। মা ভাইয়া’কে বলেছে। ভাইয়া আপনার টাকা দিয়ে দিবে। আপনি আমার উপকার করেছেন ,আমার উচিত হেঁটে গিয়ে আপনার বাসায় টাকা দিয়ে আসা। দুই-একশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে আসা উচিত। কিন্তু কি করব বলুন? আমি খারাপ অবস্থায় আছি খুব।”
– “দুই-একশ টাকা বেশি দিতে হবে না। যা নিয়েছো তাই দিলেই হবে।”
অরূণী প্রবল চেষ্টা করে হাসি চাপিয়ে বলল, “কালকে আবার আসবেন কিন্তু ভাইয়া। এসে আমার ভাইয়ের কাছে টাকা চাইলেই দিয়ে দিবে।”
যা হয়েছে তাতে অরূণীর তেমন দোষ নেই। প্রেম ধরা খেয়ে বন্ধী হয়ে আছে। এসব ভেবে অরূণীর ওপর রাগ’টা এখন তেমন নেই । কিন্তু ঝামেলা লাগছে রুদ্রর কাছে।টাকা ধার দিয়ে ভীষণ ঠেকা ঠেকেছে। রুদ্র রাগে বিড়বিড় করতে থাকে।থমথমে গলায় বলল, “আচ্ছা রাখো।”
অরূণী বলে ওঠল, “রাখবেন? একটু হাসেন না ভাইয়া। আপনার হাসি’টা সুন্দর।”
রুদ্র খিটখিটে মেজাজে বলল, “এই রকম ইঁচড়ে পাকাগিরি করো বলেই তো এই বয়সে ধরা খেয়েছো। ফাজিল কোথাকার! ফোন রাখো।”
দুই-চার’টা ধমক দিয়ে রুদ্র ফোন রেখে দিলো।রুদ্রের ধমক গুলোও রোমাঞ্চকর লাগছে অরূণীর কাছে। রুদ্র ফোন রাখার পর আবার হাসছে অরূণী। হাসতে হাসতে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। আবার রুদ্র কাল আমজাদ স্যারের বাসায় যাবে। গিয়ে টাকা চাইবে। অরূণী হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
_________________________
রুদ্র বাসায় ফিরে দেখে কিরণ ভাত খাচ্ছে। রুদ্র শার্টের বোটাম খুলতে খুলতে বলল, “কিরণ ঘটনা তো আরেকটা ঘটেছে।”
কিরণ ভাতের লোকমা মুখে তুলতে তুলতে বলল, “কিসের ঘটনা?তোর সেই সাথিকে নিয়ে ঘটনা?”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার সাথি মানে?”
– “না, না কিছু না। বল।”
রুদ্র খাটে বসে ফ্যান’টা অন করে আয়েশ করে শুয়ে বলল, “ওই মেয়ে প্রেম করে ধরা খেয়েছে বাসায়। তাই ওই ভদ্রলোক আমাদের দেখে ভেবেছে, সেই প্রেমিক তোর আর আমার ভিতর কেউ।”
রুদ্র সব’টা কিরণ অবাক হলো। হাসতে হাসতে বলল , “খুব জটিল কাহিনি তো।আমরা শুধু শুধু উল্টাপাল্টা ভেবেছি। কালকে যাবি তুই আবার?”
– “না গিয়ে উপায় আছে?”
কিরণ বলল, “আমরা যদি তখন দৌড়ে না আসতাম, বোনের বয়ফ্রেন্ড ভেবে আমাদের ঠিকই মার দিতো।বোনের বয়ফ্রেন্ড বাসা পর্যন্ত গেলে কেউ আস্ত রাখে বল?”
রুদ্র উত্তরে হাসলো।কিছুক্ষণ পর রুদ্র আবার বলল, “মেয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত রে ভাই।”
কিরণ হাসে। রুদ্রও আবার হাসলো।কিরণ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হতাশ গলায় বলল, “এত কাহিনি টাকা ধার নিয়ে।”
রুদ্র আর উত্তর না দিয়ে শুয়ে শুয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছে।ভাত খাওয়া শেষে কিরণের ফোন আসে।কিরণ ফোন নিয়ে বারান্দায় যায়। নিশ্চয়ই কিরণের গার্লফ্রেন্ড ফোন দিয়েছে। কিরণ খুব রোমান্টিক গলায় কথা বলছে। রুম থেকে স্পষ্ট কিরণের গলা শোনা যাচ্ছে। এক পর্যায়ে বলল, “জান পাখি প্লীজ রাগ করে থেকো না। খেয়ে নেও। তুমি খাওনি বলে আমিও খাইনি।”
রুদ্রের কপালে ভাঁজ পড়ল। মাত্রই তো তিন প্লেট ভাত খেয়ে বারান্দায় গেল কিরণ। রুদ্র হাসছে নিঃশব্দে। কিরণ কথা বলা শেষে রুমে আসতেই রুদ্র ফোনের দিক থেকে মুখ তুলে বলল, “কয় বেলা না খেয়ে আছিস কিরণ?”
কিরণ প্রথমে কথা’টা বুঝতে পারলো না ঠিক।পরে বুঝতে পেরে হেসে ওঠে। বলল, “গার্লফ্রেন্ডের মন রক্ষা করতে কত কি যে বলা লাগে। তুই কি বুঝবি?”
রুদ্র একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝিনা বলেই তো গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে চলে গেছে।”
কিছুক্ষণ পর রুদ্র আবার বলল, “কথা একটু আস্তে বলিস। কি সব উম্মাহ টুম্মাহ বলিস সব শোনা যায়।”
রুদ্রর গলায় কৌতুক।উচ্চস্বরে হেসে ওঠে কথা’টা বলে। কিরণ বোধ হয় কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো। রুদ্রের হাসি আরো বেড়ে গেল।
(চলবে)
~টাইপ মিস্টেক থাকতে পারে। ভুল ত্রুটি বুঝে নিয়েন