গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ৫
গাড়ি ছুটে যাচ্ছে এয়ারের দিকে। এডিনবরা থেকে প্রায় দুই ঘন্টার পথ। গাড়ি চালাচ্ছে ক্রিস, সুজানের বয়ফ্রেন্ড। পাশের সিটে সুজান। পেছনে ক্যাথি আর পিউ। বাকিরা থমাসের গাড়িতে। পিউ জুনায়েদকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এটা মোটেও সমর্থন করতে পারছে না বন্ধুরা। ক্যাথি আর সুজান বাদে বাকিরা মোটামুটি হতবাক। তাদের মতে, যেখানে আর মাত্র একমাস পর ডিভোর্স হয়ে যাবে, সেখানে জুনায়েদের সাথে দেখা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। তাছাড়া জুনায়েদ নিজেও এই ডিভোর্স সমর্থন করছে। নয়তো ইচ্ছে থাকলে গত এগার মাসে অনেকভাবেই যোগাযোগ করতে পারত পিউয়ের সাথে। ফেসবুক থেকে সুজানকে মেসেজ পাঠাতে পারত। একবার পিউয়ের ব্যাপারেই তাকে মেসেজ পাঠিয়েছিল সুজান। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও পাঠিয়েছিল। সে অ্যাকসেপ্ট করেনি, তবে মেসেজের রিপ্লাই দিয়েছিল। অথচ সে ফেসবুকও চালায় না এখন। নিশ্চয়ই নতুন আইডি খুলেছে। যদিও সেই আইডির হদিস পাওয়া যায়নি। তবু নিরুদ্দেশ তো থাকত না। পুলিশ তাকে পিউয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে নিষেধ করেছে। পিউয়ের সাথে যাদের যোগাযোগ আছে, তাদের সাথে যোগাযোগ করতে নিশ্চয়ই মানা নেই কোনো। অনেকভাবে বুঝিয়েও কেউ নিরস্ত করতে পারেনি পিউকে। তারই জের ধরে আজ এয়ারের উদ্দেশ্যে রওনা করেছে তারা। ওখানে যাবার মূল উদ্দেশ্য এটাই, বনফায়ার ক্যাম্পিং নয়। ওটা তো আশপাশে কোথাও করা যেতে পারে। এয়ার যাচ্ছে কারণ সেখানেই আছে জুনায়েদ। তাদের একটা জায়গার দরকার ছিল বনফায়ার উদযাপন করতে আর পিউয়ের দরকার ছিল জুনায়েদের সাথে দেখা করতে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হচ্ছে।
ক্রিসের একজন আংকেল আছেন, যিনি যিনি রিটায়ার্ড আর্মি এবং বর্তমানে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। গ্লাসগো সিটি সেন্টারে একটা ছোট অফিস আছে তার। সুজান তাকে জুনায়েদের একটা ছবি আর যতটা সম্ভব তথ্য দিয়েছিল খোঁজ বের করতে। তিনি তদন্ত শেষ করে জানিয়েছেন, জুনায়েদ এখন এয়ারে থাকে। ওখানে সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত একটা অফিসে চাকরি করে। তারপর পাঁচ ঘন্টা ওভারটাইম করে। রাত আটটায় কাজ শেষ হয় তার। এরপর কখনো বিচে খানিকটা সময় ঘোরাঘুরি করে, কখনোবা সুপার মার্কেটে যায় বাজার-সদাই করতে। আবার কখনো ফেয়ার বা ক্যার্নিভ্যাল থাকলে সেখানে ঢুঁ মারে। সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন সে দুপুর একটা থেকে রাত বারটা পর্যন্ত স্থানীয় একটা টার্কিশ রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে। গাড়িতে বসেই সুজান এক এক করে সবকিছু জানাল। পিউ শুনল চুপচাপ। কোনো মন্তব্য করল না। সবটা জানার পর নির্ভার হলেও মনের অস্থিরতা কমেনি। যতক্ষণ না জুনায়েদকে স্বচক্ষে দেখবে, ততক্ষণ এই অস্থিরতা থাকবেই। তাই নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বাইরের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। গাড়ির ভেতরে হালকা কথোপকথন চলছে। ক্যাথি, সুজান আর ক্রিস তিনজনই অল্পসল্প কথা বলছে। নিচু ভলিউমে স্কটিশ মিউজিক চলছে। কিন্তু সেদিকে মন নেই ওর। শরীরটা গাড়িতে থাকলেও মনটা উড়ে গেছে জুনায়েদের আকাশে। আপনাতেই সময় গুনতে শুরু করে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর ক্রিসের গলা খাকারির শব্দে সম্বিত ফিরল ওর। ক্রিস রেয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে ওর দিকে তাকাল। বলল,
– তুমি ঠিক আছ?
– হ্যাঁ।
– মন খারাপ নাকি? এত চুপচাপ কেন?
– এমনিই। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
ক্যাথি বলল,
– কাম অন, পিউ! ডোন্ট বি সিলি! তোমার হাজব্যান্ডের খোঁজ পাওয়া গেছে। আর কিছুক্ষণ বাদে ওখানে পৌঁছে যাবে তুমি। তাকে নিজের চোখে দেখতে পাবে। এরপরেও এমন মনমরা হয়ে থাকার কোনো কারণ আছে? কেন এমন করছ?
– আ-আসলে ক্যাথি, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না একদম। শরীরটা খারাপ লাগছে। আমি সুজানকে বলেছিলাম, আমার জ্বর…
সুজান জিজ্ঞেস করল,
– এখনো জ্বর কমেনি? প্যারাসিটামলে তো কাজ হবার কথা!
– কমেছে। আগের তুলনায় কম। তবে জ্বর তো আছেই। পুরোপুরি ঘাম দেয়নি।
ক্যাথি বলল,
– পিউয়ের একটু ঘুমুনোর দরকার ছিল। প্যারাসিটামল খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো করত।
সুজান বলল,
– এখন ঘুমিয়ে পড়ো। এয়ারে পৌঁছুতে আরো ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট লাগবে। ততক্ষণ ঘুমাও তুমি। পৌঁছুলে ডেকে দেব তোমাকে।
– নাহ, অ্যাম ওকে।
ক্রিস বলল,
– তোমাকে কিছু বলার ছিল, পিউ।
– বলো।
– সুজান তো জুনায়েদের ব্যাপারে বলল তোমাকে। আরো একটা ইনফরমেশন আছে, যেটা এখনো বলা হয়নি। আমি সুজানকে বলিনি। ভেবেছিলাম, সরাসরি তোমাকে বললেই ভালো হবে।
– কী ইনফরমেশন?
– জুনায়েদ একটা বান্ধবী জুটিয়েছে। সোম থেকে শুক্র অফিসের পর সে ঘুরাঘুরি করে, তখন তার সাথে ওই মেয়েটাও থাকে।
– মেয়ে?
– মেয়ে না বলে মহিলা বললেই ভালো হবে মনে হয়। বয়স সম্ভবত থার্টি আপ। যেখানে যায়, দুজন একসাথে যায়। সুপার মার্কেটে গিয়ে একসাথে শপিং করে। একসাথে বাসায় ফেরে।
– একই বাসায় থাকে?
– সম্ভবত। ওরকমটাই জানিয়েছে আংকেল। আমি জানি না ওদের মধ্যে কী রিলেশন। আংকেলের কাছ থেকে শুনে আমার মনে হয়েছে, মহিলা জুনায়েদের গার্লফ্রেন্ড।
সুজান আর ক্যাথি দুজনই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল ক্রিসের দিকে। প্রায় চিৎকার করে বলল,
– গার্লফ্রেন্ড? কী বলছ এসব?
– অ্যাম নট শিউর।
পিউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ভেতরে তুমুল ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। কেউ যেন ওর বুকে ছুরিকাঘাত করেছে৷ রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তবু সে নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করল। অথবা আচমকা অপ্রত্যাশিত একটা খবর পেয়ে মনটা হয়তো ধাতস্থ হয়নি তখনো। বুঝে উঠতে পারেনি, কতটা ভয়ঙ্কর খবর শুনিয়েছে ক্রিস। ধীরে ধীরে তোলপাড় মাত্রা ছাড়াতে শুরু করেছে। চোখটা ভিজে আসতেই সে আগের মতো মুখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। মনকে প্রবোধ দিল, কথাটা মিথ্যে। জুনায়েদের কখনো কোনো গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে না। জুনায়েদ কেবলমাত্র ওকেই ভালোবাসে। কিন্তু মস্তিষ্ক তাতে সায় দিল না। মনের ভেতর থেকে একটা সত্ত্বা বলল, আমি জুনায়েদের মুখোমুখি হব। ওর মুখ থেকেই শুনব সত্যিটা। তবু মনের তোলপাড় থামল না। কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। মন বারবার বলছে, মেয়েটা জুনায়েদের গার্লফ্রেন্ড না হলেও প্রতিদিন একসাথে ঘুরছে-ফিরছে। উইকেন্ডে একসাথে কাজ করছে। তার মানে সময় কাটানোর মানুষ পেয়ে গেছে জুনায়েদ। নতুন জীবনে বেশ ভালো আছে সে। এজন্যই ওর কথা জানার তাগিদ নেই তার। হয়তো ভুলেই গেছে পিউ নামে কেউ একজন ছিল তার জীবনে। অথবা ভুলে থাকার চেষ্টা করছে।
পিউকে কিছুক্ষণ ধাতস্থ হবার সময় দিল ক্রিস। তারপর বলল,
– যদি কিছু মনে না করো, আমরা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?
– কী ব্যাপারে?
– তোমার আর জুনায়েদের ব্যাপারে। আই ফিল কিউরিয়াস, সো…
– বলো।
– আজ দেখা করতে যাচ্ছ কী মনে করে? তুমি কি ডিভোর্স ক্যানসেল করার কোনো প্ল্যান করেছ?
পিউ থেমে থেমে বলল,
– আপাতত ডিভোর্স টার্মটা আমার মাথায় নেই। আমি শুধু একবার দেখা করতে চাই ওর সাথে। কথা বলতে চাই কিছুক্ষণ। তারপর কী হবে আমি জানি না।
– আমি তোমাকে একটা সাজেশন দিতে চাই।
– বলো।
– আজকে দেখা করো, ঠিক আছে। কিন্তু ডিভোর্স ক্যানসেল করো না। ডিভোর্সটা হোক তোমাদের। এরপর তার সাথে নরমালি যোগাযোগ রাখ। মাঝেমধ্যে তাকে ফোন করো। হাই-হ্যালো টাইপ কিছু ক্যাজুয়াল কথাবার্তা বলো। উইকেন্ডে দেখা করতে পার। ইভনিং ডেট করতে পার।
– এক্স হাজবেন্ডের সাথে ডিনার ডেট?
– সাউন্ডস অকার্ড বাট দিস উইল ওয়ার্ক। তুমি তো জান আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়েছি। একটা সাইক্রিয়াট্রিক সেন্টারে ইন্টার্ন হিসেবে কাজও করেছি। এখন যেখানে জব করি, সেটাও মোটামুটি সাইকোলজিক্যাল ধরনের। সুজান আমাকে তোমার আর জুনায়েদের ব্যাপারে ডিটেইলস বলেছে, যতটুকু সে জানে। শুনে আমার মনে হয়েছে, এটাই তোমাদের জন্য পারফেক্ট সলিউশন। ট্রাস্ট মি, পিউ! ইট উইল ডেফো ওয়ার্ক।
– ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন মোর?
– ওয়েল, সবার আগে জুনায়েদকে ছাড়তে হবে। মানে তাকে মুক্ত করে দিতে হবে যেন কোনোরকম পিছুটান না থাকে। কেন জান? কারণ, সে নিজেকে বন্দি ভাবে।
সুজান প্রায় চেঁচিয়ে বলল,
– বন্দি! ক্রিস, তুমি পাগল হয়ে গেছ? আমি তোমাকে বলিনি, সে কীভাবে পিউকে টর্চার করে? বলিনি, সে কীভাবে পিউকে বন্দি করে রেখেছে?
– হ্যাঁ বলেছ। সেটা তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ। তুমি পিউয়ের ফ্রেন্ড। তুমি পিউয়ের দিকটাই আগে দেখবে। তোমার চিন্তাধারা অতি অবশ্যই পিউয়ের পক্ষ নেবে। কিন্তু তার দিক থেকে ভাবতে গেলে ব্যাপারটা অন্যরকম। আমি তোমার ফ্রেন্ডকে চিনি না খুব একটা। তার হাজব্যান্ডকেও চিনি না। সো, এখানে আমি থার্ড পারসন। আর একজন থার্ড পারসন হিসেবে আমার এটাই মনে হয়েছে। আমার ধারণা, সে কোনোভাবে পিউয়ের কাছে বন্দি, দায়বদ্ধ। এবং এই দায়বদ্ধতার ভেতর থাকতে থাকতে তার মন বিষিয়ে গেছে। সে এখন এসব থেকে মুক্তি চাচ্ছে। পিউয়ের কাছ থেকে দূরে সরতে চাচ্ছে। কোনোরকম পিছুটান রাখতে চাচ্ছে না। পিউ যেহেতু তার বিবাহিতা স্ত্রী, গার্লফ্রেন্ড নয়, সেহেতু তার হাত-পা বাঁধা। চাইলেই সে বিবাহিতা স্ত্রীকে ফেলে কোথাও চলে যেতে পারে না। দিনশেষে তাকে ফিরতে হয় পিউয়ের কাছেই। তাই, এবারে যখন একটা সুযোগ চলেই আসলো, সেও হাতছাড়া করেনি। সুযোগটা লুফে নিয়ে এয়ারে এসে সেটলড হয়েছে। কারণ, পুলিশ তাকে শহর ছাড়তে কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। নিষেধাজ্ঞা ছিল কেবলমাত্র তোমার ত্রিসীমানায় পা না দেবার। চাইলে এডিনবরার অন্য প্রান্তে গিয়ে সে ইজিলি সেটলড হতে পারত। তার আগের যে চাকরি ছিল, সেটার অন্য ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার নিতে পারত। কিন্তু সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। নতুন জায়গায় গিয়ে, নতুনভাবে লাইফ শুরু করেছে।
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– ইউ আর রাইট, ক্রিস।অ্যাবসল্যুটলি রাইট। ঠিক এটাই হয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি এতদিন। এখন কী উপায়? ডিভোর্স হয়ে যাবে আমাদের?
– আমার সাজেশন, ডিভোর্সটা হতে দাও। ডিভোর্সের পর সে ফিল করবে তার কোনো পিছুটান নেই। তুমি যোগাযোগ রাখলেও তখন তোমার প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না। এতে করে তোমাদের মধ্যে যে দেয়াল তৈরী হয়েছে, সেটা ধসে পড়বে। তবে ধসে পড়াটা সময়ের ব্যাপার। ইন দ্য মিন টাইম, তুমি নরমালি কনভারসেশন চালিয়ে যাবে অ্যাজ অ্যা ওয়েল-উইশার বা ফ্রেন্ড। যেহেতু অনেকটা সময় তোমরা একসাথে ছিলে, সেহেতু অনেক ব্যাপারেই তোমাদের আলোচনার দরকার হবে। সেই আলোচনাটাই চালিয়ে যাবে ফ্রেন্ডলি। ইটস লাইক অ্যা নিউ ফ্রেন্ডশিপ, নিউ রিলেশন। বুঝাতে পারলাম? মানে অ্যা নিউ স্টার্ট…
– আর যদি সে ইন্টারেস্টেড না হয়? যদি সে অন্য কাউকে নিয়ে জীবন শুরু করে আবার? তুমিই তো বললে, একটা মেয়ের সাথে সবসময় ঘুরাঘুরি করে সে। মেয়েটা যদি সত্যিই তার গার্লফ্রেন্ড হয়?
– ওয়েল, ইন দ্যাট কেস তোমাকে তার আশা ছাড়তে হবে। তাকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে হবে। জাস্ট একটা কথা মনে রেখ, যে তোমার সে কিন্তু তোমার কাছেই ফিরবে। না ফিরলে বুঝে নিতে হবে, সে কখনোই তোমার ছিল না। (চলবে)