না চাইলেও তুই আমার পর্ব ৩৬+৩৭

#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ৩৬
মিরা আর মিহান অনেকক্ষণ ধরে দুজন দুই প্রান্তে থেকে জ্যোৎস্নাবিলাস করছে। মিহানের কথা যেনো ফুরায়না সারাদিন কী কী করেছে সব বর্ণনা দিচ্ছে। মিরাও মিহানের সব কথা মন দিয়ে শুনছে। চোখ বন্ধ করে দোলনায় মাথা ঠেকিয়ে মিহানের সাথে কথা বলছে। মিহান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” জানপাখি রাত সাড়ে দশটা বাজতে চলল, এখন ফোন রাখি কেমন? কাল আবার সকাল সকাল আমাকে বের হবে হবে। তুমি কিন্তু বেশি রাত জাগবে না তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো কেমন।”

মিরা মৃদু কন্ঠে বলল,

—” আচ্ছা, তুমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো পরে কথা হবে।”

মিহান ঠোঁটের হাসি এনে বলল,

—” গুড নাইট জানপাখি।”

মিরা হালকা হেসে বলল,

—” গুড নাইট ভীতুরাম।”

মিরা ফোন রেখে খোলা আকাশের দিকে তাকায়ে ভাবতে থাকে মিহানের সাথে কথা বললে সময় কোন দিক দিয়ে চলে যাই নিজেই টের পায় না। অদ্ভুত বিষয় তাই না? কই আগে তো কখনো এমন হয়নি ওর সাথে। তাহলে? হ্যা, ভালোবেসে ফেলেছে মিহান কে। মিরার প্রতিটা স্নায়ু জানান দিচ্ছে মিহান কে ভালোবাসার কথা। এসব ভেবে আনমনে হেসে ফেলে মিরা।

________________

মিরার বড় মামা আর মামী বাড়িতে এলে সবাই একসাথে তাদের চমকে দিয়ে উইশ করে। তাদের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল তারা বেশ চমকিয়েছে এ ঘটনায়। তারপর কেক কেটে সেলিব্রেট করে তাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।

রাতের খাবার খেতে সবাই একসাথে বসে। খাবার মাঝে মিরার বড় মামী বলল,

—” মিরা মিরান কোথায়? এসেছি পর থেকে ওকে তো দেখলাম না।”

মিরা খাবার খেতে খেতে বলল,

—” দেখবে কী করে? তোমরা বাড়িতে আসার আধা ঘণ্টা আগে ও ঘুমিয়ে পড়েছে।”

ছোটমামী সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলল,

—” ঘুমাবে না তো কী করবে? সারাদিনে তো আর কম লাফালাফি করেনি।”

নানু ছোট মামীর কথায় হেসে দিয়ে বলল,

—” ও বাড়িতে আসার পর থেকে বাড়ি পরিবেশটাই বদলে গেছে।”

মিরা বড় মামা তার মায়ের কথায় ও সুরে সুর মিলিয়ে বলল,

—” তা যা বলেছো মা।”

এরকম নানান কথার মধ্যে দিয়ে খাবার পর্ব শেষ করে সবাই।

________________

নীলাকে কিছুক্ষণ আগে মিরার মামার বাড়ির লোকেরা এসে আন্টি পরিয়ে গেছে। শুভ, নিশু আর‌ মিশু থেকে গেছে এ বাড়িতে। নীলার রুমে বসে সবাই অভ্র আর নীলার লাভ স্টোরি শুনছে। মিরার তাতে মন নেই। থাকবেই কেমন করে? কাল যে তার মনের মানুষটা আসছে তার কাছে। মিরা কে অন্য মনস্ক দেখে মিশু বলল,

—” কী হলো আপু তোমাকে আজ এতো অন্য মনস্ক দেখাচ্ছে কেনো? কিছু নিয়ে কী চিন্তা করছো?”

প্রিয়া মিরা কে খোঁচা দিয়ে বলল,

—” আরে না মিশু তেমন কিছু না। আমাদের মিরা জিজুর বিরহের মন খারাপ করে বসে আছে।”

প্রিয়ার কথা শুনে সবাই কিটকিটিয়ে করে হেসে দিলো। মিরা ওদের কথার কোনো প্রতি উত্তর না করে শুধু হাসলো। মিরা নীলার রুমের জানলা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকায়, মনে পড়ে যায় মিহানের সাথে ফোনে জ্যোৎস্নাবিলাল করার কথা। কতটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছিলো মিরার জন্য। তা শুধু ওই জানে। মিরা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে নিশু ওর হাত ধরে ঝাঁকানোতে। মিরা তাকিয়ে দেখে নিশু কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মিরা ভ্রু নাচিয়ে বলল,

—” কিছু বলবি?”

নিশু চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—” সেই কখন থেকেই তো বলে যাচ্ছি, তুমি তো শুনছো না।”

মিরা কপাল ভাঁজ করে বলল,

—” আমি শুনছি না? আচ্ছা, যাই হোক বল কী বলবি?”

নিশু আরাম করে বসে বলল,

—” তুমি তো আগে থেকেই জানতে তাই না অভ্র ভাইয়া আর নীলা আপুর লাভ স্টোরির কথা?”

মিরা কপালের ভাঁজ সরিয়ে বলল,

—” না তো, আগে থেকে জানতাম না কিছুদিন আগে জেনেছি।”

নিশু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,

—” তাহলে ঐদিন কেনো তোমার গান শুনে ভাইয়া কাশি উঠে গেছিলো?”

মিরা অবাক হয়ে বলল,

—” কোন দিন?”

নিশু একটু গম্ভীর হয়ে বলল,

—” যে দিন অভ্র ভাইয়ার সাথে তোমার প্রথম দেখা হয়েছিলো আর তোমার গাওয়া ‘নীলাঞ্জনা’ গানটা শুনে অভ্র ভাইয়ার কাশি উঠে গেছিলো।”

শুভ উত্তেজিত হয়ে বলল,

—” রাইট! রাইট! নীলাঞ্জনা গানটার কিছু লাইন গাইছিলো। উমম…. মনে পড়েছে। ‘যখন খোলা চুলে হয়তো মনের ভুলে। তাকাতো সে অবহেলে দু’চোখ মেলে। হাজার কবিতা বেকার সবই তা। হাজার কবিতা বেকার সবই তা। তার কথা কেউ বলে না। সে। প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা! সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা!’ এটাই তো গাইছিলে তাই না?”

শুভর কথা শুনে সবাই চোখ বড় বড় করে মিরার দিকে তাকায়। মিরা ওদের এই অবস্থা দেখে হেসে বলল,

—” ও ঐ ঘটনার! আমি তো তার আগে থেকেই জানতাম ওদের লাভ স্টোরির কথা।”

মিরার কথা সবাই হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। মাঝখান দিয়ে প্রেম জোরে হেসে দিয়ে বলল,

—” এই না হলে আমাদের মিরা!”

প্রেমের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে দেয়। মিরা ওদের হাসতে দেখে ভেংচি কেটে ওখান থেকে চলে যায়।

________________

রাতের খাবার খেয়ে মিরা ছাদে এসে দাঁড়ায়। রাত এগারোটার বেশি বাজে। ছাদটা অন্ধকার করে রাখা। মিরা ভাবে হয়তো ছাদের লাইট নষ্ট হয়ে গেছে তাই ছাদটা অন্ধকার। কিন্তু রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোতে আবছা আবছা সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আর কিছু না ভেবে মিরা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। বারবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে। মিহান সিলেটি যাবার পর থেকে প্রতিদিন রাত নটায় ফোন করে মিরা কে। কিন্তু আজ এত রাত হয়ে যাবার পরও মিহান ফোন করছে না মিরা কে। অবশ্য মিরা কয়েকবার ফোন করেছে মিহান কে কিন্তু প্রতিবারই রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে মিহানের ফোন। ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরা। আচ্ছা, মিহানের কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো? ভাবলেই মিরার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাতে থাকা ফোনটা রেলিংয়ের পাশে থাকা চেয়ারে রেখে, বুকে হাত গুজে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মৃদু বাতাসে চারিদিক শীতল ময় পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। মিরার খোলা অবাধ্য চুলগুলো একটু একটু করে উঠছে। হঠাৎ করে মনে পড়ে মিরান রুমে একা ঘুমিয়ে আছে। মিরা চোখ খুলে ফোন হাতে নিয়ে দেখি এগারোটার পঞ্চাশ বাজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরা পা বাড়ায় রুমে যাবার জন্য। দুই পা এগুলে মিরা চমকে ওঠে। অন্ধকারের মধ্যে কেউ মিরার থেকে চার পা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে যে ছেলে তা রাস্তার সোডিয়াম লাইট জানান দিচ্ছে। মিরা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটিয়ে তুলে বলল,

—” কে ওখানে?”

সামনে থাকা ব্যক্তি এক কদম এগিয়ে এসে নেশা ভরা কন্ঠে বলল,

—” জানপাখি।”

মিরা ‘জানপাখি’ শব্দটা শুনে যেনো থমকে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর গলায় বলল,

—” ভীতুরাম!”

মিহান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে এগিয়ে যায় মিরার দিকে।
#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ৩৭
একদিন আগেও ভালোবাসার মানুষ দুটি দুই প্রান্তে ছিলো। আর এখন একেক জন একেক জনের বাহুডোরে আবদ্ধ। মিরা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না মিহান তার সামনে দাঁড়িয়ে তার বুকে মিরা কে জড়িয়ে ধরে আছে। মিরা আস্তে করে মিহানকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

—” ভীতুরাম তুমি এখানে? তোমার না কাল সিলেট থেকে আসার কথা ছিলো?”

মিহান বাঁকা হেসে মিরা কে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,

—” ছিলো তো, কিন্তু আমি আমার জানপাখির জন্য একদিন আগেই চলে এসেছি।”

মিরা অবাক হয়ে মিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। মিরা চুপ থাকা দেখে মিহান মিরার মুখের সামনে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,

—” কনফিউজ হচ্ছো তাই তো? ওকে আমি ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। আমি আজ সকালে সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছি। সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। রাত আটটার পর এখানে এসেছি, এমন কী তোমাদের বাড়ির কেউ জানে না আমি এখানে এসেছি। তোমাদের বাড়ির পিছনের পাঁচিল টপকে অনেক কষ্টে ছাদে উঠেছি।”

মিরা মিহানের কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়। বড় বড় চোখ করে মিহানের দিকে তাকায়। কিঞ্চিৎ কপাল ভাঁজ করে বলল,

—” এখন প্রায় বারোটা বাজতে চলল, তুমি রাত আটটা থেকে এখানে ছাদে দাঁড়িয়ে আছো? আর তুমি যে সকালে ঢাকায় এসেছো আমাকে একবার ফোন করে বললে কী হতো?”

মিহান মিরা কে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

—” তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তাই বলেনি কিছু।”

মিরা রেগে উঁচু গলায় বলল,

—” এই তোকে কেউ আমাকে সারপ্রাইজ দিতে বলেছে? বেশী বুঝিস কেনো? সারাদিন আমাকে টেনশন এর মধ্যে রেখে এসেছে সারপ্রাইজ দিতে। তুই যা তো এখন থেকে, আমার সাথে কথা বলতে আসবি না একদম।”

মিহান মিরার রেগে যাওয়া দেখে শুকনো গলায় ডাক দিলে বলল,

—” জানপাখি তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো?”

মিরা মিহানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—” আমি রেগে যাচ্ছি কেনো তুই জানিস না? ইচ্ছে করছে তোকে এখন খুন করে ফেলি।”

মিহান জিব্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

—” রাগ করো না। আগে শোনো তো আমার কথাটা তারপরে যা খুশি বলো।”

মিরা নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলল,

—” ঠিক আছে, বলো কী বলবে?”

মিহান মিরার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর চোখে কাপড় বেঁধে দেয়। মিরা অবাক কন্ঠে বলল,

—” কী হলো চোখ বাঁধছো কেনো?”

মিহান তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,

—” ইশ! একটু সময় চুপ থাকো না। একটু পরে সব বুঝতে পারবে। কতক্ষণ চুপ করে থাকো।”

মিরা কিছু না বলে চুপ হয়ে যায়। তিন চার মিনিটের মাথায় এসে মিহান মিরার চোখের বাধন খুলে দেয়। মিরা চোখ ঘষতে ঘষতে মিহানের দিকে তাকায়। মিহান মিরার সামনে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। মিরা হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মিরা কিছু বুঝে উঠার আগে মিহান আবেগি গলায় বলল,

—” জানপাখি জানিস তুই যখন ক্লাস সিক্সে পড়িস তখন থেকে আমি তোকে ভালোবাসি। মনে পড়ে তোর সাথে সেই প্রথম দেখা? তুই যখন তাড়াহুড়ো করে ড্রয়িং ক্লাস থেকে বের হচ্ছি, তখন তোর সাথে আমার হঠাৎ করে ধাক্কা লাগার কারণে তোর হাতে সমস্ত রং আমার সাদা শার্টে লেগে যায়। আমি তখন আমার শার্টের অবস্থা দেখে কেঁদে দিয়েছিলাম। তুই আমাকে সরিও বলিস কিন্তু আমার কান্না থামছিল না। তখন তুই রেগে আমাকে থাপ্পড় লাগিয়ে দিস। আমি গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। মনে আছে তোর? তুই আমার শার্টটা খুলে নিয়ে বলিস, শার্ট টা পরিষ্কার করে দিবি বলে। আমি সেদিন তোর জন্য স্কুল থেকে গেঞ্জি পড়ে বাড়ি ফিরছি। পরেরদিন তুই এলি আমার কাছে একটা নতুন শার্ট নিয়ে, নতুন সেটটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলি, রং শার্টে শুকিয়ে যাওয়ায় শার্ট থেকে রং তুলতে পারিস নি। সেই থেকে আমাদের কথা বলা শুরু। আমার খুব বেশি বন্ধু ছিলো না কখনো, তাদের সাথেও এতোটা কথা বলতাম না যতটা তোর সাথে বলতাম। একটু একটু করে তোকে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি তা আমি নিজেই জানি না। তোর আমাকে রাগ দেখানো, শাসন করা সবকিছুকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। মুখ ফুটে প্রকাশ করার আগেই একদিন তুই এসে বললি, তোর পাপার বিজনেসের জন্য তোরা বিদেশে চলে যাবি। খুব কষ্ট হয়েছিলো সে দিন। কিন্তু মুখ ফুটে তা প্রকাশ করিনি। তুই চলে গেলি আমাকে একা ফেলে কিন্তু যাওয়ার আগে বলে গেলি, তুই ফিরে আসবি আমার কাছে। এসেছিলি তুই আমার কাছে ফিরে, সেদিন আমার খুশির সীমা ছিলো না। তোকে হারানোর ভয়ে পাপা মমকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসি। কিন্তু তুই আমাকে বিয়ে করতে রাজি না বলে দিস, তোর পাপার কথায় তুই আমাকে তিন মাস সময় দিয়েছিস। আমি চেয়েছিলাম তিন মাস পর আমার মনে কথা বলতে কিন্তু পারলাম না তার আগেই বলে দিলাম। কারন #না_চাইলেও_তুই_আমার তাই। আমি জানি না তুই আমাকে ভালোবাসিস কী না জানপাখি! কিন্তু আমার মন বলে তুইও আমাকে ভালোবাসি। ‘হৃদয় খুলে সপে দিলাম তোর ই চরণে। ইচ্ছা হলে আগলে রাখিস হৃদয় গহীনে।’ ভালোবাসি জানপাখি! খুব বেশি ভালোবাসি। একবার ভালোবাসবি আমায়? কথা দিলাম কখনো কষ্ট পেতে দিবো না তোকে। বল না ভালোবাসবি আমায়?”

মিরা হতবাক হয়ে গেছে মিহানের কাজে। মিরা ভাবনায় মাঝে ছিলো না মিহানের এমন কাজ। চোখ দুটো ছল ছল করছে। ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে মিরা। কিন্তু সে চেষ্টায় ব্যর্থ। চোখ থেকে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ে। কিছু বলতে গিয়েও গলা কেঁপে উঠছে বারংবার মিরার। মিরা কাঁপা কাঁপা হাতে মিহানের হাতে থাকা ফুলটা ধরে ভাঙ্গা গলায় বলল,

—” ভা….ভা….ভালোবাসি!”

মিরার ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলতে দেরি কিন্তু মিহান নিজের বাহুডোরে মিরাকে বন্দী করতে দেরি হলো না। মিরা অশ্রু ভেজা চোখে মিহান কে জড়িয়ে ধরে, মিহানের পিঠের শার্ট খামচে ধরে। বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে কাটিয়ে দিয়ে মিহান আবারো হাঁটু গেড়ে বসে একটা আংটি বাড়িয়ে দেয় মিরার দিকে। মিরা হালকা হেসে নিজের হাতটা এগিয়ে দেয় মিহানের দিকে। মিহান একবার মিরার হাতের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার মিরার তাকাচ্ছে। মিরার অনামিকা আঙ্গুলে মিহানের মমের পরিয়ে দেওয়া আংটি টা আছে। মিহান এখন কী করবে নিজেই বুঝতে পারছে না। মিরা মিহানের অবস্থা বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে দিয়ে ঐ আংটি টার সাথে মিহানের দেওয়া আংটি টাও পরে নেয়। মিহান হেসে মিরার হাতে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মিরা এতক্ষণ আশপাশটা ভালো করে খেয়াল করেনি। ছাদটা বেলুন আর ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। এতক্ষণ ছাদটা অন্ধকার থাকায় এসব কিছু বোঝা যায়নি। মিরার চোখ যায় মিহানের দিকে। কেমন মাতাল চোখে তাকিয়ে আছে মিরার দিকে। মিহান ধীর পায়ে হেটে এসে মিরা কে জড়িয়ে ধরে। মিরা মিহানের বুকে মাথা রেখে বলল,

—” এসব সাজালে কখন?”

মিহান নিচু গলায় বলল,

—” রাত আটটার পর এখানে এসে এসব করেছি। সাথে আমার বন্ধুরাও ছিলো। তুমি ছাদে আসার আগেই ওরা চলে গেছে।”

মিরা মাথা উঁচু করে মিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” এতক্ষন তুই করে বললে এখন আবার তুমি?”

মিহান হেসে বলল,

—” কেনো….

মিহান কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই পিছন থেকে হাসির শব্দ আসে। মিরা মিহানকে ছাড়িয়ে পিছন তাকিয়ে দেখে, ওর প্রান প্রিয় ভাই ও বোনেরা ওখানে উপস্থিত সাথে আবার অনুও আছে। ওদের দেখে মিরা মিহানের থেকে একটু দূরে সরে যায়। তা দেখে মিশু কিটকিটে হেসে বলল,

—” বাহ! বাহ! কী ভালোবাসা। দূরে গেলে কেনো আপু জিজুর কাছে যাও।”

মিরা চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকায়। মিহান অনুর দিকে তাকিয়ে বলল,

—” তুই এখানে কী করছিস?”

অনু ভাব নিয়ে বলল,

—” তুই যে আজ ভাবীকে প্রপোজ করবি তা আমি জানতাম। ভাবলাম এই ঐতিহাসিক দিনটার কোনো ভাবে সাক্ষী থাকা যায় কী না? তাই চলে এলাম এখানে।”

মিহান‌ অবাক কন্ঠে বলল,

—” তুই একথা জানলি কী করে?”

অনু নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলল,

—” তুই যখন তোর বন্ধুদের বলছিলি ফুল আর বেলুন কিনে রাখার জন্য তখন আমি তো রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি। ব্যাস আমিও দুয়ে দুয়ে চার করে ফেলি।”

শুভ বলল,

—” তবে যাই বলো ভাইয়া তোমার প্রপোজ টা কিন্তু দারুন হয়েছে।”

মিহান মিরার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,

—” তাই নাকি শালাবাবু?”

মাঝে প্রিয়া মিরা কে খোঁচা দিয়ে বলল,

—” তা নয়তো কী? দেখছেন না আমাদের মিরার গাল লজ্জায় কেমন লাল হয়ে গেছে।”

মিরা ওদের কথার উত্তর না দিয়ে লজ্জায় মিহানের বুকে মুখ লুকায়। মিরার অবস্থা দেখে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে দেয়।

_____________________

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবার খাবার মাঝে মিরার ফুপা মিরার পাপার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ভাইয়া নীলার হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন তো পনের দিনের মধ্যে বিয়েটা সেরে ফেলতে চাচ্ছে। এই পনের দিনের মধ্যে যদি বিয়ে না তাহলে নাকি দুই মাস পর হবে বিয়েটা।”

মিরা পাপা মিরার ফুপার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” হ্যা, কাল তো তাই বলল সবাই। অভ্রর বাবা মানে ভাইয়া নাকি অফিসের কাজ বিদেশ যেতে হবে এক মাসের জন্য। তাই ভাইয়া দেশে থাকতে থাকতে ওদের বিয়েটা দিতে চাচ্ছে।”

মিরা দাদা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” আমার মনের পনের দিনের মধ্যে বিয়েটা দিয়ে দেওয়াই ভালো হবে। কারণ শুভ কাজে দেরি করতে নেই।”

মিরা ফুপা মিরার দাদার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” বাবা আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই করুন। আমার আপনজন বলতে শুধু আপনার এই আছে এই পৃথিবীতে। তাই আপনার যে সিদ্ধান্ত নিবেন তাই হবে।”

মিরার পাপা মিরার দাদার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” বাবা তাহলে পনের দিন পরে বিয়ে সেই অনুযায়ী অ্যারেঞ্জমেন্ট শুরু করে দেই?”

মিরা দাদা সবার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” তাই ভালো হবে তোমরা সবাই কেনাকাটা শুরু করে দাও।”

নিঝুম নীলার হাতে একটা চিমটি কেটে বলল,

—” আর মাত্র পনের দিন তারপর আপনি মিসেস অভ্র।”

নিঝুমের কথা শুনে নীলার লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

_____________________

দুপুর বারোটায় টার বেশি বাজে। মিরা অনেকক্ষণ ধরে মিহান আর মিরানকে খুঁজে চলেছে। বাড়ির মধ্যে তাদের না পেয়ে চলে আসে বাগান দিকে। একটু এগিয়ে দেখে সুইমিংপুল সাইডে দুজনে ফুটবল নিয়ে খেলছে। মিরা মিষ্টি হেসে ওদের দিকে এগিয়ে যায়। মিরা কে দেখতে পেয়ে মিরান দৌড়ে মিরার দিকে আছে। মিরা হাঁটু গেড়ে বসে মিরানের সামনে, দৌড়াদৌড়ি করে একদম ঘেমে গেছে মিরান। মিরা মিরানকে চোখ রাঙিয়ে বলল,

—” দৌড়াদৌড়ি করেছো কেনো? দেখেছো কেমন ঘেমে গেছো।”

মিরান হাসি মুখে বলল,

—” পাপার থাথে খেলথিলাম তো মাম্মা!”

মিরা ওর গালে হাত দিয়ে বলল,

—” তাই বলে এই দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে?”

মিহান ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

—” এই তুমি আমার ছেলেকে একদম বকবে না বলে দিলাম।”

মিরা দাঁড়িয়ে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—” এরকম রোদের মধ্যে খেললে একশো বার বকবো কী করবে তুমি?”

মিহান মিরার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

—” কী করব তাই না? ওয়েট!”

মিরা কিছু বুঝে উঠার আগেই মিহান ওকে ধাক্কা দিয়ে সুইমিংপুলে ফেলে দেয়। মিরা সুইমিংপুল দাঁড়িয়ে রেগে চিৎকার করে বলল,

—” ভীতুরাম তোকে আমি ছাড়বো না। আজ তোর এক দিন কী আমার একদিন।”

মিরান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,

—” পাপা তুমি আমাল মাম্মা কে পানিতে ফেলে দিলে কেনু?”

মিহান সুইমিং পুলের পাশে দাঁড়িয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

—” বেশ করেছি ফেলে দিয়েছি।

মিরান মিহানের কথা শুনে রেগে গিয়ে ছোট ছোট হাতে মিহান কে ধাক্কা দিয়ে সুইমিংপুলে ফেলে দেয়। মিহান হাবুডুবু খেয়ে কোনো মতে সুইমিংপুলে মধ্যে দাঁড়ায়। আর এদিকে মিরা মিরানের এমন কাজে গগন ফাটিয়ে হাসছে। পেটে হাত দিয়ে কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলল,

—” এই না হলে আমার মিরান বাবা! আসো মাম্মার কাছে আসো সোনা।”

মিরান ছোট ছোট পায়ে এসে সুইমিং পুলের কোনায় দাঁড়ায়। মিরা মিরানকে কোলে নিয়েসুইমিং পুলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে মিহানের কাছে যায়। মিরা মিহানের মুখে পানি ছুড়ে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

—” কী আর কখনো লাগতে আসবে আমাদের মা ছেলের সাথে?”

মিহান করুণ চোখে মিরানের দিকে তাকায়। সে তার মাম্মার গালা জড়িয়ে ধরে আছে পানির মধ্যে। মিরা মিহানের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে আবার জোরে হেসে দেয়।

#চলবে….
#চলবে….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here