না চাইলেও তুই আমার পর্ব ৩৯+৪০+শেষ

#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ৩৯
সন্ধ্যার পর মিরা ছাদের দোলনায় মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। অভিমান করেছে সে মিহানের সাথে। কথা বলবে না বলে ঠিক করে রেখেছে। মিহানের পরিবার নিচে হল রুমে বসে আছে। মিরার পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলছে। সতের দিন পর মিহান আর মিরার বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছে। মিহান সবকিছু আগে থেকেই জানতো কিন্তু মিরাকে কিছু বলেনি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো। কারো ছাদে আসার শব্দ পেয়ে মিরা আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো মিহান এসেছে। মিহান এসে মিরার গা ঘেঁষে দোলনায় বসলো। মিরা আবারো আড়চোখে তাকিয়ে পরে চোখ সরিয়ে নেয়। মিহান মিরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

—” অভিমান করেছো জানপাখি?”

মিরা একবার ওদের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার আগের নেয় অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। মিহান মিরার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,

—” কী হলো কথা বলবে না আমার সাথে?”

মিরা এখনো অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে। মিহান মিরার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—” আচ্ছা ঠিক আছে, আমি মমকে বলছি বিয়ের ডেট ক্যানসেল করে দিতে।”

মিরা মিহানের হাত টেনে ধরে বলল,

—” আমি কী তা একবারও বলেছি?”

মিহান মিরার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” তাহলে এতক্ষণ কথা বলছিলে না কেনো?”

মিরা অভিমানী গলায় বলল,

—” আমাকে আগে জানালে কী হতো?”

মিহান মিরার পাশে আবার বসে বলল,

—” সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। তো তাই বলিনি। আচ্ছা, তাও তোমাকে সরি বলছি আর অভিমান করে থেকো না প্লিজ।”

মিরা মিহানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

—” ঠিক আছে, এবারের মত মাফ করে দিলাম। নেক্সট টাইম এমন করলে কিন্তু তোমার খবর আছে!”

মিহান হেসে মিরার কোমর টেনে নিজের কোলে বসিয়ে বলল,

—” যাক অবশেষে তাহলে আমার মহারানীর অভিমান ভেঙেছে।”

মিরা মিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” তুমি তখন বিয়ের ডেট ক্যানসেল করে দেওয়ার কথা বলছিলে কেনো?”

মিহান বাঁকা হেসে বলল,

—” তুমি তো আমার সাথে কথাই বলছিলে না। তাই এই টেকনিক এপ্লাই করেছি। ভালো করছি না বলো?”

মিহানের কথা শুনে মিরা রেগে মিহান কে মারতে মারতে বলল,

—” কুত্তা আজ তোকে আমি মেরেই ফেলবো। তারপর যা হয় দেখা যাবে।”

মিহান‌ মিরার হাতে মারা খেতে খেতে হেসে বলল,

—” উফ… এত জোরে কেউ মারে?”

মিরা মিহান কে মার থামিয়ে মিহানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—” তুমি এমন কেনো?”

মিহান ভ্রু কুঁচকে বলল,

—” কেমন আমি?”

মিরা মিহানের বুকে মাথা রেখে বলল,

—” তোমার মুখের হাসিটা আমাকে পাগল করে দেয়। আমি যখনই রেগে থাকি না কেনো তুমি আমার সামনে এসে হেসে দাও। তুমি এমন কেনো? আমাকে কী একটুও রাগ করে থাকতে দেবেনা।”

মিরার কথা শুনে মিহান কিছু না বলে শুধু মুচকি হেসে আরো শক্ত করে মিরা কে নিজের সাথে জড়িত নেয়।

__________________

দুপুর একটার বেশি বাজে। মিহান এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। ভোররাতে মিহান বাড়ি ফিরেছে হসপিটাল থেকে। কাল রাতে মিহানের নাইট ডিউটি পরেছিলো। কিছুক্ষণ পর পর অনু এসে দেখে যাচ্ছে মিহান ঘুম থেকে উঠছো কী না? অনু উপর দায়িত্ব পড়েছে, মিহানের ঘুম থেকে ওঠার খবর তাদের কাজিনদের জানাতে হবে। মিরা মিহানের বিয়ে উপলক্ষে মিহানের কাজিনরা বিয়ের এক সপ্তাহ আগেই এসে হাজির হয়েছে চৌধুরী বাড়িতে।

মিহানের মম এসে মিহানকে ঘুম থেকে তুলে লাঞ্চ করতে ডাকে। মিহান মমের কথা মতো ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়। মিহান গিয়ে দেখে টেবিলে ওর কাজিনরা আগে থেকেই বসে আছে। মিহান চেয়ারে বসতে খাবার খেতে শুরু করে বলল,

—” কী হলো বসে আছিস কেনো? খাওয়া শুরু।”

নিশান মিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ভাইয়া আমাদের তোমার সাথে একটা জরুরী কথা আছে।”

মিহান কপাল ভাঁজ করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” কী কথা?”

আশিক সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,

—” ভাইয়া আমরা সবাই আজ বিকেলে ভাবীর সাথে দেখা করতে চাই।”

মিহান খাবার খেতে খেতে বলল,

—” তো যা না কে বারণ করেছে?”

ইরা মিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” তুমিও যাবে আমাদের সাথে ভাবীর সাথে দেখা করতে।”

মিহান পানি খেয়ে চোখ ছোট ছোট করে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ফেসবুক আইডি থেকে শুরু করে বাড়ির এড্রেস পর্যন্ত তোরা জানিস। তাহলে আমার যাবার কী প্রয়োজন?”

অনু মিহান কে খোঁচা দিয়ে বলল,

—” ভাব দেখে বাঁচি না বাবা। আমরা বলছি দেখে দাম বেড়ে গেছে। অথচ দিনে দুই-তিনবার ভাবির সাথে দেখা করে।”

অনু কথা শুনে সবাই মুখ টিপে হাসে, মিহান শুকনো গলায় কাশি দিয়ে বলল,

—” কখন যাবি তোরা?”

নিশান বলল,

—” বিকালে বললাম তো।”

মিহান খাবার শেষ করে উঠতে উঠতে বলল,

—” বাড়িতে দেখা করবি নাকি অন্য কোথায়ও?”

মিথি তাড়াতাড়ি করে বলল,

—” ভাইয়া কোনো রেস্টুরেন্টে আসতে বলো ভাবী কে তাহলে ভালো হবে।”

মিহান নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিয়ে বলল,

—” ঠিক আছে, তোরা সবাই রেডি থাকিস বিকালে। চারটার পর বেরোবো সবাই।”

মিহান ওখান থেকে চলে গেলে সবাই একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠে, পরে মিহানের মম এসে সবাইকে বকা দিয়ে থামায়।

মিরা মিহান পাশাপাশি বসে আছে রেস্টুরেন্টে। সামনের টেবিলে মিরা আর মিহানের কাজিনরা সবাই মিরানকে নিয়ে মজা করতে। মিরানের কথা শুনে যেনো ওদের হাসি থামে না। মিহান মিরার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,

—” আর মাত্র পাঁচ দিন জানপাখি।”

মিরা অবাক কন্ঠে বলল,

—” আর পাঁচ দিন পর কী?”

মিহান মৃদু হেসে মিরার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

—” আর পাঁচ দিন পর তোমাকে আমার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দেবো।”

মিরা মিহানের কথা শুনে লজ্জায় অন্য দিকে তাকায়। তা দেখে মিহান বাঁকা হেসে মিরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নেয়।
#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ শেষ পর্ব
গায়ে হলুদের জন্য সেজেগুজে স্টেজে বসে আছে মিরা, সাথে নীলা, প্রিয়া, নিশু, মিশু আর অন্যান্য কাজিনরা বসে আছে। প্রেম আর প্রিয়াদের পুরো পরিবার মিরার বিয়ের তিনদিন আগেই চলে এসেছে বাংলাদেশ। প্রেম মিরানকে কোলে নিয়ে আশপাশ টা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ ফটোশুট করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে মিরার মা-বাবা মিরার গায়ে হলুদ ছোঁয়ায়। এরপর একে একে সবাই মিরার গায়ে হলুদ ছোঁয়া দিয়ে শুরু করে। মিরার বাবা-মা স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছে। মিরার মাম্মা মিরার পাপার দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে বলল,

—” সত্যিই! সময় কোনো দিক দিয়ে যে চলে যায় বোঝা যায়। দেখতে দেখতে মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে তাই না?”

মিরার পাপা উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টিতে মিরার দিকে তাকিয়ে থাকে। মিরার মাম্মা মিরার পাপার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনা। মিরার পাপা মিরার সামনে বেশীক্ষন থাকতে না পেরে চলে যাও ওখান থেকে। মিরার মাম্মা মিরার পাপার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

মিরা ফ্রেশ হয়ে এসে সবে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে। আজ সারাদিনে কম তো আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয়নি মিরা কে। সবকিছুর মিলিয়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মিরা। তার ওপরে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের সবাই জোর করে মিষ্টি খাইয়েছে এখন হাঁটারও শক্তি পাচ্ছি না মিরা। ডিনার না করেই চলে এসেছে রুমে। চোখটা সবে লেগে এগিয়ে এসেছিলো তখন ফোনের শব্দে তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে মিরা। হাত বাড়িয়ে ফোন খোঁজার চেষ্টা করে। হাতের নাগালে ফোন পেয়ে রিসিভ করে ঘুমধুম কন্ঠে বলল,

—” হ্যালো।”

ওপাশ থেকে কেউ মৃদু স্বরে বলল,

—” ঘুমিয়ে পড়েছো জানপাখি?”

মিরা ফোনটা কান থেকে সরিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখেন ভীতুরাম ফোন করেছে। আবার ফোনটা কানের কাছে গিয়ে বলল,

—” হ্যা, তুমি কিছু বলবে?”

মিহান একটু থেমে বলল,

—” মিরান কোথায়? তোমার কাছে আছে?”

মিরা ধীর গলায় বলল,

—” মিরান আমার কাছে নেই। মিরান আজ অভ্র ভাইয়া আর নীলা আপুর ঘরে শুয়েছে।”

মিহান মোলায়েম গলায় বলল,

—” আচ্ছা, তুমি এখন ঘুমাও তোমার কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে তুমি বেশ ক্লান্ত। কাল সকালে কথা হবে। Bye & I Love You Janpakhi.

মিরা মুচকি হেসে দিয়ে বলল,

—” I know.”

মিরার কথা শুনে মিহানের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে তোলে।

রাত কয়টা বাজে তা ঠিক মিরার জানা নেই। ঘুম ঘুম চোখে হেলেদুলে চলছে কিচেনের দিকে। প্রচন্ড খিদের কারণে ঘুম ভেঙে গেছে মিরার। কিচেন থেকে দুই প্যাকেট চিপস আর একটা কোল ড্রিংস নিয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো মিরা হঠাৎ করে চোখ যায় মিরার বাবা-মার রুমের দিকে। রুমে এখনও আলো জ্বলছে। মিরা ওর বাবা-মার রুমের দিকে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,

—” মাম্মা পাপা কী এখনও ঘুমায়নি না কী? এত রাত পর্যন্ত জেগে কী করছে তারা? একবার গিয়ে দেখে আসি।”

মিরা ওর মাম্মা পাপার রুমে নক করার আগে দেখে দরজা খোলা। মিরা দরজায় দাঁড়িয়ে রুমে চোখ বুলায়। মিরার মাম্মা পাপা সোফায় বসে কিছু দেখছে তারা। মিরা রুমে না ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ওর বাবা-মার হালচাল দেখার জন্য। কিছুক্ষণ সময় কেটে গেলে মিরার মাম্মা হেসে বলল,

—” নিলয় তোমার মনে আছে এই ছবিটার কথা? মিরার তখন বোধহয় আঠারো মাস বয়স, সেদিন আমি ভুল করে আমার লিপিস্টিক টা বিছানায় রেখে নিচে গেছিলাম। এসে দেখি মিরা লিপস্টিক টা পুরো মুখে মেখে ভূত হয়ে আছে।”

মিরার ঠোঁটে হাসি এনে বলল,

—” খুব মনে আছে।”

মিরা একটু উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ওরা কিসের ছবি নিয়ে কথা বলছে। মিরার পাপার হাতে থাকা জিনিসটা রেখে উঠে দাঁড়ালে মিরা দেখতে পায় জিনিসটাকে। মিরার ছোটবেলার ছবির অ্যালবাম। মিরা মাম্মা মিরার পাপার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” কী হলো উঠে দাঁড়ালে কেনো?”

মিরা পাপা চোখে পানি নিয়ে মিরার মাম্মার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” কী করে থাকবো নিতু আমাদের রাজকুমারীকে ছাড়া? কাল চলে যাবে আমাদের ছেড়ে অন্য পরিবেশে, এক অন্য পরিবারে। আমি পারবো না নিতু আমার রাজকুমারীকে ছাড়া থাকতে।”

মিরা মাম্মা কেঁদে দিয়ে মিরার পাপা কে জড়িয়ে ধরে বলল,

—” আমারও তো কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে, নিজের কলিজার টুকরো কে দূরে পাঠাতে। কিন্তু কি করবো বলো মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে, নিজের ঘর ছেড়ে পরের ঘরে তো যেতেই হবে।”

মিরা পাপা নিজের চোখ মুছে মিরার মাম্মার চোখ মুছে দিয়ে বলল,

—” আমাদের মেয়ের বিয়েতে আমাদের কান্নাকাটি মানায় না নিতু। আমাদের কান্নাকাটি দেখলে দেখা যাবে মিরা বিয়ে টা ক্যানসেল করে দিবে।”

মিরার পাপা কথা শুনে মিরা মাম্মা হেসে দিয়ে বলল,

—” হা হা হা। একদম তোমার মত হয়েছে মেয়েটা কারো দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে না।”

মিরার পাপা ভাব নিয়ে বলল,

—” আমার মেয়ে আমার মতো হবে না তো কার মতো হবে?”

মিরার মাম্মা মিরার পাপার কথা শুনে হেসে ফেলে। মিরার মাম্মা জানে তাকে হাসানোর জন্য তিনি এমন কথা বলছে, অথচ ভিতর ভিতর কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। মিরার মাম্মা আর মিরার পাপা কে কিছু না বলে তার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

মিরা নিঃশব্দে ওখান থেকে নিজের রুমে চলে আসে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে চারটা দশ বেজে। ফোন হাতে নিয়ে মিহানের নাম্বার ডায়াল করে মিরা। দুইবার রিং হয় ফোন কেটে যায়, তিনবারের বার মিহান ফোন রিসিভ করে উত্তেজিত হয়ে বলল,

—” হ্যালো, জানপাখি তুমি ঠিক আছো তো? এত রাতে ফোন দিলে যে?”

মিরা নিঃশব্দে কেঁদে বলল,

—” ভীতুরাম আমি কোনো ভুল করছি না তো এই বিয়েটা করে?

মিহান বেশ অবাক হয়ে মিরার এমন দাঁড়ার কথায়, তাও নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

—” কী হয়েছে তোমার হঠাৎ এমন কথা বলছো যে? আজ রাত পোহালেই তো আমাদের বিয়ে। তাহলে হঠাৎ এমন করছো কেনো?”

মিহান কথা শুনে মিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। তা শুনে মিহান উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

—” কী হয়েছে জানপাখি তুমি কান্না করছ কেনো? কেউ কিছু বলছে তোমায়? আমাকে বলো কী হয়েছে তোমার?”

মিরা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—” আমি ঠিক আছে ভীতুরাম আমাকে কেউ কিছু বলেনি।”

মিহান কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটিয়ে তুলে বলল,

—” ঠিক আছে মানে? তাহলে কান্না করছো কেনো? সত্যি করে বলো কী হয়েছে তোমার না হলে কিন্তু আমি এখন তোমাদের বাড়ি চলে আসবো।”

মিরা নিজের কান্না থামিয়ে বলল,

—” না! না তোমাকে এখন আর আসতে হবে না। আমি ঠিক আছি।”

মিহান শান্ত গলায় বলল,

—” কী হয়েছে জানপাখি বলো না আমায় কেনো তুমি বিয়ে করতে চাইছো না?”

মিরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,

—” জানো ভীতুরাম মাম্মা পাপা না খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি তাদের ছেড়ে চলে যাবে বলে তারা দুজনে কান্না করছে। আমি পারবো না ভীতুরাম তাদের কষ্ট দিতে।”

মিহান এতক্ষণে মিরার কথা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—” ধুর পাগলী এসব বিষয় নিয়ে কেউ কান্নাকাটি করে? শোনো প্রতিটা মেয়ের বিয়ের পর তার স্বামীর ঘরে যেতে হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তোমাকে আমাকে মাম্মা কে দেখো আমার মম কে দেখো তারা তো তাদের বাবার ঘর ছেড়ে এসেছিলো তাই না! আর তুমি এত চিন্তা করছো কেনো তোমার যখন খুশি তখন যাবে তুমি তোমার বাবা-মার সাথে দেখা করতে। তোমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব কত? মাত্র আধা ঘন্টার দূরত্ব তাই না। তাহলে এত চিন্তা করছো কেনো?”

মিহানের কথা শুনে মিরা নিজেকে কিছুটা শান্ত করে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

—” হুম।”

মিহান মোলায়েম গলায় বলল,

—” এবার একটু হাসো! হেসে আমাকে পাগল করে দাও।”

মিহানের কথা শুনে মিরা মুচকি হেসে দেয়। মিহান হাসিটা অনুভব করে বলল,

—” এইতো হেসেছে আমার জানপাখি। শোনো পাঁচটা বাজতে চললো এখন একটু ঘুমিয়ে নাও না হলে আর সারাদিনে ঘুমাতে পারবে না। এখন রাখি জানপাখি পরে কথা হবে। Bye & I Love You Janpakhi.

মিরা উত্তরে কিছু বলে না মিহান ফোন রাখলে মিরা ফোনের স্ক্রিনে মুচকি হেসে দেয়।

______________________

‘পার্লারের কোনো লোক দরকার নেই’ জোর গলায় বলে দিয়েছে নীলা আর প্রিয়া। তারা দুজনে মিরা কে সাজাবে। মিরাও কোনো আপত্তি না থাকে নীলা আর প্রিয়ার মিলে মিরাকে সাজায়। মিরার মাম্মা কিছুক্ষণ পর পর রুমে এসে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে তার রাজকুমারীকে। মিরার পাপা সে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। মিরার সাজানো কমপ্লিট হলে, মিরার কথা মতন নীলা চলে যায় মিরার বাবা-মাকে ডেকে আনতে। নীলার সাথে মিরার বাবা-মা দুজনে একসাথে রুমে এসে থমকে যায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তাদের রাজকুমারীর উপর থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না। মিরার বাবা-মা দুজন দুজনের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মিরার দিকে। মিরার চোখ গড়িয়ে পানি পড়লে মিরার পাপা এসে মিরার গালে দুহাত দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,

—” দেখ মা একদম কাঁদবি না আজকের দিনে। তোর কান্না আমি বা তোর মাম্মা সহ্য করতে পারিনা।”

মিরার মাম্মা ওদের আড়ালে চোখ মুছে নিয়ে বলল,

—” দেখি সরো তো তুমি। আমার মেয়েটাকে আজ একদম পরীর মত লাগছে।একটু পরেই আমার মেয়ের স্বপ্নের রাজপুত্র চলে আসবে তাকে নিতে।”

মিরার মাম্মার কথা শুনে মিরা হেসে দেয়। পাশ থেকে নিঝুম বলল,

—” এ আবার যে সে রাজপুত্র না। একদম পাগলা রাজপুত্র।”

নিঝুমের কথা শুনে সবাই হেসে দেয়।

মিহান বর সেজে আসনে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে মিহানরা এসে পৌঁছেছে এখানে। মিহান ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো তখন ওর এক বন্ধু মিহানকে ধাক্কা দিয়ে সামনে তাকাতে বলল। মিহান ওদের থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালে স্তব্ধ হয়ে যায়। মিরা মিরানের হাত ধরে হেঁটে আসছে মিহানের দিকে। তাদের পিছনে মিরার কিছু কাজিনও আসছে। মিরা কে বউ সাজে যে এত সুন্দর লাগবে তা কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি মিহান। মিহানের ভাবনার মাঝে মিরা কখন মিহানের সামনে চলে এসেছে তা খেয়াল করেনি। মিরা কে নিজের সামনে দেখে মিষ্টি হেসে মিরার হাত ধরে আসনে বসায় মিহান। মিরাও মিহানেকে দেখে মিষ্টি হেসে দেয়। অনু এসে মিরানকে নিয়ে যায় নিজের সাথে। বেশ কিছুক্ষণ পর বড়দের কথায় মিরা মিহানের বিয়ে পড়ানো শুরু করে কাজী। কাজী মিহানকে ‘কবুল’ বলতে বললে মিহান নির্দ্বিধায় ‘কবুল’ বলে দেয়। কাজী মিরা কে ‘কবুল’ বলতে বললে, সময় চলে যায় কিন্তু মিরা ‘কবুল’ বলে না। মিহান উৎসুক হয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে আছে। এরমধ্যে মিরার মাম্মা পাপা মিরার কাছে এসে ওর হাত ধরে চোখের ইশারায় ‘কবুল’ বলতে বলল। মিরা ছল ছল চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আস্তে করে বলল,

—” কবুল।”

ভালোবাসার মানুষ সাথে থাকলে কোনদিক দিয়ে সময় চলে যায় টেরই পাওয়া যায় না। কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। মিরা মিহান আজ দ্বিতীয় বার বাবা-মা হওয়ার স্বাদ গ্রহণ করেছে। তাদের ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে মেয়ে জন্ম নিয়েছে। তা নিয়ে চৌধুরী বাড়ি আর খান বাড়িতে খুশির সীমানা নেই। চৌধুরী বাড়িকে নব বধু সাজে সাজিয়ে তুলে সবাই অপেক্ষা করছে কখন মিহান মিরাকে আর তাদের বাড়ির নতুন সদস্যকে নিয়ে আসবে। মিরার মামা মামীরা ও এসেছে। নীলাও এসেছে তার কোলে ছয় মাসের মেয়েকে নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে অনেক কিছু কিন্তু বদলাইনি তাদের ভালোবাসা। প্রেম আর প্রিয়া মিরা কে দেখতে আসতে পারেনি বাংলাদেশ তাদের ছেলের জন্য। হঠাৎ করে ওদের ছেলে ঠান্ডা জ্বর লেগে যাওয়ার কারণে ওদের দেশে আসা ক্যানসেল হয়ে যায়। মিরার ছোট মামার ছেলে শুভর বিয়ে হয়েছে মিহানের চাচাতো বোন মিথির সাথে। মিরার বিয়ের সময় ওদের দুজন দুজনকে ভালো লাগে যায় তখন থেকে শুরু হয়ে ওদের পথ চলা। বিয়ে হয়ে গেছে নিশুও। প্রিয়ার ভাই আয়ান নীলার বিয়েতে নিশুকে দেখে পছন্দ করে বসে। তারপর দেখেশুনে ওদের বিয়েটা হয় যায়। মিশুর জন্য বর্তমানে পাত্র দেখা চলছে পছন্দ হলেই বিয়ে দিয়ে দেবে। অনুর বিয়ে অনেক আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে ওদের পাপা তার বিজনেস পার্টনার এর ছেলের সাথে। অনুর ফাইনাল এক্সাম আর তিন মাস বাকি তাই তিন মাস পরে ওদের বিয়ে হবে বলে ঠিক করে রেখেছে সবাই। নিঝুম সবাইকে স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছে সে আগে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর অন্য সব চিন্তাভাবনা।

গাড়ির শব্দ সবাই উৎসুক হয়ে দরজার দিকে তাকায়। মিহান মিরাকে ধরে আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতরের নিয়ে আসছে। মিহানের মম এগিয়ে গিয়ে তিনিও একপাশ দিয়ে মিরাকে ধরে। মিরার কোলে ঘুমিয়ে আছে বাচ্চাটা। হলরুমের মাঝ বরাবর আসতে না আসতেই ওপর থেকে কারো চিৎকার শোনা যায়।

—” মাম্মা! মাম্মা!”

সবাই কৌতুহলী হয়ে উপরের দিকে তাকায়। মিরান আসছে দৌড়ে মিরার দিকে। মিরানকে জোরে দৌড়াতে দেখে মিরা তাড়াতাড়ি করে বলল,

—” মিরান বাবা আস্তে পড়ে যাবে তো।”

মিরান দৌড়ে মিরার সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মিরার কোলে থাকা বাচ্চাটাকে চুমু দিয়ে বলল,

—” Welcome sister to our house.”

মিরা হেসে মিরানের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। মিরান হেসে ওর মাম্মার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” মাম্মা আমি একটু আমার বোনকে কোলে নেবো।”

মিরা মিরানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে বলল,

—” আচ্ছা, বাবা তুমি সোফার গিয়ে বসো তারপর আমি ওকে তোমার কোলে দিচ্ছি কেমন?”

মিরান সোফায় বসতে বসতে বলল,

—” ওকে মাম্মা।”

মিরান সোফায় বসলে মিরা মিরানের কোলে বাচ্চাটাকে দেয়। মিরান বাচ্চাটার মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে মিরাকে বলল,

—” মাম্মা দেখো আমার ডান পকেটে একটা বক্স আছে ওটা একটু বের করো।”

মিরা মিরানের পাশে বসে ওর কথা মত বক্সটা বের করে। মিরা বক্স টা বের করে দেখে স্বর্ণের চেইনের বক্স। মিরা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মিরানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” সোনা তুমি এটা কোথায় পেয়েছো?”

ওদের কথার মাঝে মিহানের পাপা বলল,

—” এটা আমার দাদু ভাই তার বোনের জন্য নিজে পছন্দ করে কিনেছে।”

মিহান ওর পাপার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” কিন্তু পাপা ও টাকা কোথায় পেয়েছে?”

মিহানের পাপা উচ্চ স্বরে বলল,

—” তোরা ওকে যে টাকাগুলো দিতি খাবার জন্য ও সে টাকাগুলো না খেয়ে জমিয়েছে। আর সেই টাকা দিয়েই নিজের বোনের জন্য এই সোনার চেইন টা কিনে এনেছে আমাকে সাথে নিয়ে।”

মিহানের পাপার সবার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মিরা ছল ছল চোখে মিরানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” নিজের জমানো টাকাগুলো এভাবে নষ্ট করে দিলে আমাদের বললে তো আমরাই কিনি দিতে পারতাম।”

মিরান ওর বোনের গালে চুমু দিয়ে বলল,

—” দিতে পারতে মাম্মা। কিন্তু আমি নিজে আমার বোনকে কিছু দিতে চেয়েছিলাম।”

মিরা মিরানের কপালে চুমু দিয়ে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।

মিহান মৃদু স্বরে বলল,

—” নাও পরিয়ে দাও বেবি চেইন না।”

মিহানের মম মিহানকে বকা দিয়ে বলল,

—” কী বেবি বেবি করছিস? ওর জন্য ভালো দেখে একটা নাম রাখ।”

মিরান মিহানের মমের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” দাদু আমি একটা নাম রেখেছি বোনের।”

মিহানের মম আগ্রহী হয়ে বলল,

—” কী নাম দাদুভাই?”

মিরান ওর মাম্মা দিকে তাকিয়ে বলল,

—” মাম্মা চেইনের লকেটের নামটা লেখা আছে তুমি দেখো।”

মিরা মিরানের কথা মত বক্স টা খুলে লকেট টা হাতে নিয়ে বলল,

—” মিরু!”

মিরান একগাল হেসে বলল,

—” হ্যা, মিরানের বোন মিরু।”

অনু ওদের কথার মাঝে বলল,

—” না! না! হবে না আমি ওর নাম আমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখবো। ওর নাম হবে অনন্যা চৌধুরী।”

মিরান ভাব নিয়ে বলল,

—” রাখো কেউ মানা করেনি। মিরুর ভালো নাম অনন্যা চৌধুরী হতেই পারে। কিন্তু আমি ওকে মিরু বলেই ডাকবো। আর কে কী নাম রাখলো না রাখলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। I don’t care.”

মিরানের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে সবাই হেসে দেয়। মিরা মিরান আর মিরুকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।

মিহান বেলকনির দোলনায় শুয়ে শুয়ে হসপিটালের কিছু ফাইল দেখছে আর তার বুকের উপর শুয়ে আছে মিরা। মিরান আর মিরুকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে রুমের লাইট অফ করে বেলকনির আলো জ্বালিয়ে ফাইল দেখছিলো মিহান। ফাইল দেখা শেষ করে মিরাকে জড়িয়ে ধরে মিহান। মিরা মাথাটা উঁচু করে মিহানের দিকে তাকিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

—” সময়ের সাথে সাথে কত কিছু বদলে যায় ভীতুরাম কিন্তু বদলাইনি তোমার ভালোবাসা। কেনো এত ভালোবাসো আমায় ভীতুরাম?”

মিহান মিরার কপালে চুমু দিয়ে বলল,

—” আমি আমার আত্মাকে ভালোবাসবো না তো কাকে ভালোবাসবো?”

মিরা মিহানের কথা শুনে হেসে মিহানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

—” ভালোবাসি আত্মাপাখি।”

মিহান মিরার মাথায় চুমু দিয়ে বলল,

—” খুব বেশি ভালোবাসি আত্মাপাখি!”

মিহানের মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শুনে মিরা আর শক্ত করে মিহানকে জড়িয়ে ধরে মিহানের বুকে মুখ গুজে দেয়।

সমাপ্ত —

[ অবশেষে শেষ হলো গল্পটা। অনেকেই চেয়েছিলেন’ গল্পটা আরো বড় করি কিন্তু আমি গল্পটা এখানেই শেষ করলাম। গল্পটা থেকে আপনাদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি তার জন্য আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশাকরি গল্পটা আপনাদের মনে একটু হলেও দাগ কাটতে পেরেছে। গল্পটি যদি আপনাদের মনে একটু হলেও দাগ কেটে থাকে তাহলে অবশ্যই জানাবেন প্লিজ। সকলে ভালো থাকবেন এবং সকলকে ভালো রাখবেন। ধন্যবাদ। ]
#

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here