ডার্ক ডায়মন্ড
#আফরিন ইভা
#পর্ব-১০
________________
মীরা সিট বেল্ট বেঁধে বসে আছে।
বসে বসে পেলে আসা আপন মানুষগুলোর কথা ভাবছে, আর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাবা যখন মীরাকে বিদায় জানাচ্ছিল তখন বাবার চোখ ভিজে আসলো, লুকিয়ে লুকিয়ে বাবা যে ঠিক চোখ মুছেছে মীরা ঠিক বুঝতে পেরেছে।
মীরা যখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল শফিক সাহেব মীরার মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে বললো নিজের মনকে শক্ত কর মা, মেয়েদের জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার বাকি কিন্তু তাঁরা সময় সুযোগ করে উঠতে পারেনা বলে সফল হতে পারে না।
কিন্তু আমার মীরার বেলায় এমনটা হবে না কখনো। আমি চাই আমার মীরাও আট দশজন ছেলের মতো করে নিজের মতো বাঁচুক।
– বাবার কথাগুলো মীরাকে অনুপ্রেরণা দিলো ঠিকি কিন্তু বাবার জন্য মনটা ভীষণ খারাপ লাগছিলো। বাবা গুলো এমনই হয় হয়তো।
কখনো আড়ালে গিয়ে ভালোবাসেন নিরবে চোখ মুছেন।
মীরা চোখ বন্ধ করে মায়ের চোখের জলগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলো। মীরা কে যে, মীরার মা বড্ড ভালোবাসে মীরা ছোটবেলা থেকেই ঠিক বুঝতে পারতো।
মায়ের জন্য, ইরার জন্য মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে মীরার।
হঠাৎ কেউ তাঁর শীতল স্পর্শে মীরার চোখের জল মুছে দিলো।
– সাথে সাথে মীরা চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালো।
তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই।
মীরা অবাক হয়ে নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখলো চোখে কোনো জল নেই।
সত্যিই কি এমন কেউ আছে, যে লুকিয়ে লুকিয়ে মীরা কে আড়াল থেকে সবসময়ই চোখে চোখে রাখে। এটা কি সত্যি না-কি কোনো স্বপ্ন, চোখ মেলে তাকালেই সব দুঃস্বপ্ন মীরার কাছে।
মীরার তো সত্যিই মনে হয় তবুও কেনো জানি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে এয়ারহোস্টেস এসে সবাইকে কে কিছু দরকারি কথা বুঝিয়ে গেলো।
প্লেন’টা বিরাট এক ঝাঁকুনি নিয়ে একটু একটু করে উড়তে লাগলো।
প্লেন’টা উপরে উড়বার সময় মীরার বুক টা একদম শূন্য অনুভূত হলো যেনো ভয়ে মীরার বুক টা কেঁপে উঠল।
________________
প্লেন যতো আপন গতিতে চলছে মীরার মন ততো বেশি বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে।
প্লেনে মীরার সিট জানালার পাশেই ছিলো।
মীরা বাহিরের দৃশ্য দেখছে আর অবাক হচ্ছে, প্লেন থেকে নিচে তাকালে উচু উচু দালানকোঠা গুলোকেও পিঁপড়ের মতো দেখাচ্ছে।
যদি মীরার বেলায়ও এমন হতো যে, পেলে আসা মানুষগুলোকেও খুব তারাতাড়ি একটু ভুলে থাকা যেতো হয়তো একটু কষ্ট মীরার কম হতো।
মীরা জানে না কিছুই বুঝে-না ইংল্যান্ডের মতো দেশে কি করে থাকবে একা একা।
বিশাল সাগরের উপর দিয়ে প্লেন’টা যখন যাচ্ছিল মীরার কলিজা টা ভয়ে একদম শুকিয়ে আসছিলো।
মীরা চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কিছুক্ষণের মধ্যে মীরা চোখ খুলে দেখলো প্লেনটি থেমে গেছে।
এক এক করে সবাই প্লেন থেকে নামলো।
প্লেন থেকে নিচে নেমে মীরার কেমন যেনো নার্ভাস নার্ভাস লাগছে।
একটু সামনে এগিয়ে দেখলো কেউ একজন মীরার নামের সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাও একজন মহিলা।
মহিলাটি দেখতে একদম ধবধবে সাদা, ছোট পোশাক পরিহিত দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি এই দেশের।
মীরা উনার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো, “হ্যালো ম্যাম মা’ই নেইম ইজ মীরা।”
মহিলাটা অবাক হয়ে মীরার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো।
মহিলাটি ইংরেজিতে বললো, ভার্সিটি থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে তোমাকে রিসিভ করবার জন্য।
মীরা মুখে হাসি ফুটিয়ে মহিলাটির সাথে হ্যান্ডস্যাক করলো এবং মহিলাটা নিজের নাম সান্ড্রা হিলসা বললো।
সান্ড্রা মীরা কে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
নিজে ড্রাইভ করে বাসায় নিয়ে গেলো।
” মীরা বাসায় ঢুকে অবাক, বাসা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার, পুরো বাসা একদম খাঁ খাঁ করছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোথাও কেউ নেই।”
” সান্ড্রা মীরার কাঁধে হাত রাখলো মীরা সাথে সাথে চমকে উঠলো।
সান্ড্রা মীরার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বললো, ” মীরা ডোন্ট ওয়ারী। ”
সান্ড্রা মীরাকে ইংলিশে বললো এটা আমার বাড়ি, এখানে একাই থাকি আমি।
আমার সাথে থাকবার একজন কে প্রয়োজন ছিলো তাই আমি ভার্সিটিতে যোগাযোগ করে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসি।
” মীরার একটু হলেও ভয় কাটলো, মীরার কেমন কেমন যেনো লাগছে।
নির্জন এই বাসায় সান্ড্রা কিভাবে একা একজন থাকছে কে জানে।
সান্ড্রা কে দেখে মীরার কাছে খুব ভালোই মনে হলো আবার কেমন কেমন অদ্ভুতও লাগতে শুরু করলো।”
সান্ড্রা মীরা কে একটা রুমে নিয়ে গেলো, রুমটা বেশ অন্ধকার মনে হচ্ছে। রুমটায় প্রবেশ করবার সাথে সাথে মীরার শরীরে হালকা এক শিহরণ বয়ে গেলো।
মীরার শরীরে অদ্ভুত এক অনুভূতির ছোঁয়া লাগলো।
“সান্ড্রা রুমে লাইটগুলো সব জ্বালিয়ে দিলো।”
মীরা ব্যাগটা রেখে চারদিকে অবাক হয়ে তাকালো।
রুমটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে মীরার কাছে। মনে হচ্ছে এ রুমে আরো আগে কখনো এসেছিলো মীরা। মীরা হাত দিয়ে পুরো রুমের দেয়াল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
মীরা যতো স্পর্শ করছে মীরার শিহরণ ততো যেনো বেড়ে যাচ্ছে।
– সান্ড্রা হঠাৎ মীরার হাত খাপ করে ধরে ইংলিশে বললো, মীরা অনেক দূর থেকে এসেছ, ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো কিছু খেয়ে নিবে।
” সান্ড্রার কথা শুনে মীরার পেট এবার সত্যি জানান দিচ্ছে খুব ক্ষুধা লেগেছে মীরার।”
“সান্ড্রা চলে গেলে মীরা ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো।
মীরা আয়নায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে আর ভাবছে প্রিন্সিপাল স্যার তো মীরার থাকবার কথা কিছুই বলেননি, তাহলে সান্ড্রা উনি কে যে মীরা কে এগোবার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়ে নিয়ে আসলো।
মীরা আস্তে করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখলো সান্ড্রা মীরার জন্য অনেক খাবার তৈরী করে রেখেছে, যেনো এক বিশাল আয়োজন।
মীরা এতো খাবার দেখে খুবি অবাক হলো।
– সান্ড্রা মীরা কে দেখে হাসি ফুটিয়ে বললো, মীরা প্লিজ সিট ডাউন।
” মীরাও সান্ড্রার কথায় মুখে হাসি ফুটিয়ে খেতে বসলো।
মীরা বার্গারে কামড় বসিয়ে খেতে খেতে সান্ড্রা কে বললো, আপনি খাবেন না?”
সান্ড্রা না বোধক হাসি হেসে বললো, আমি খেয়েই বের হয়েছি।
-মীরা খাবার শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো।
শরীরটা আজ বড্ড বেশি ক্লান্ত মনে হচ্ছে, বোধহয় জ্বর আসবে। বাংলাদেশেও ফোন করার দরকার কিন্তু বাংলাদেশে এখন মধ্যরাত তাই মীরা আর ফোন করেনি।
মীরার কাছে সেই প্রথম থেকেই আয়না টাকে বড্ড বেশি অদ্ভুত লাগছে, মনে হয় যেনো এই আয়নায় আছে অনেক অনেক রহস্য, হঠাৎ মীরার পেছন থেকে রক্ত মাখা একটা হাত বের হয়ে আসলো, মীরা আয়নায় চোখ রেখে চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুলে তাকালো, দেহের কোনো অংশ নেই, নেই মুখের কোনো অংশ তবুও কেউ যেনো বলে যাচ্ছে মীরা প্লিজ হেল্প মি, প্লিজ হেল্প মি।
মীরা তোমার জন্য আমি বহুকাল ধরে অপেক্ষা করে আছি কখন আসবে কখন আমায় বাঁচাবে।
মীরার হার্টবিট বড্ড বেশি দ্রুত চলছে মীরার কলিজা শুকিয়ে আসছে, ডীপ ডীপ বুকে মীরা উঠে বসলো।
এবার মীরা বুঝতে পারলো এটা নিছকই স্বপ্ন মাত্র।
মীরা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত্রি প্রায় ৪টা ছুঁই ছুঁই।
মীরা স্বপ্নের সেই আয়না মানে নিজের আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
আয়নাটায় হাত দিয়ে স্পর্শ করতে যেই গেলে সান্ড্রা এসে মীরার হাত ধরে ফেললো, এবং বললো মীরা কি ব্যাপার ঘুমোচ্ছ না কেনো?
” সান্ড্রার আগমনে মীরা যেনো সব ভুলে গেলো। মীরা আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলো।
হঠাৎ একটা … মীরা কিছু বলতে যাবে এমন সময় সান্ড্রা মীরাকে থামিয়ে বললো ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর খবর দেশে জানিয়েছে?
“মীরা মাথা নেড়ে না বোধক জানালো।”
“সান্ড্রা মীরার হাতে নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো দেশে জানিয়ে দিও।”
“মীরা খুশি মনে সান্ড্রার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিলো।
সান্ড্রা চলে গেলে মোবাইলটা রেখে মীরা আবার শুয়ে পরলো।
রুদ্র ভাই আপনি?
হ্যাঁ আমি!
কেনো তুই কি ভেবেছিস এটা আমার আত্মা? আত্মা হয়েও তোর কাছে আসা ছাড়া আমার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না?
রুদ্র ভাইয়ের কথায় মীরার চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো।
মীরা মনে মনে বলতে লাগলো, আপনি কেনো মারা যাবেন রুদ্র ভাই, আমি তো চাই আমার রুদ্র ভাই হাজার বছর বেঁচে থাকুক।
মীরা কাঁদছে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মীরার, কাঁদতে কাঁদতে মীরার হেঁচকি উঠে গেলো।
মীরা আর সহ্য করতে না পেরে চোখ মেলে তাকালো।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো সকালের আলো ফোটে উঠেছে।
বাহিরে হিম হিম বাতাস বইছে।
মীরা শোয়া থেকে উঠে বসলো।
হাত দিয়ে গালে স্পর্শ করে দেখলো চোখের জলে পুরো গাল ভিজে আছে।
মীরা অজান্তেই মুচকি হাসলো আর মনে মনে বললো রুদ্র ভাই আপনি স্বপ্নেও ইংল্যান্ডে চলে এসেছেন আমাকে জ্বালাতে?
আল্লাহ জানে আর কোথায় কোথায় যেতে পারেন আপনি?
#চলবে—–