সিঙ্গেল মাদার পর্ব ১৩

#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব: ১৩

সকাল নয়টার দিকে ফোনের আওয়াজে ইরিনের ঘুম ভাঙলো।
– আসসালামুয়ালাইকুম কে বলছেন ?
– অপরিচিতা আমি !
– নিউরোলজিস্ট বাবু, বলুন ।
– এখনো ঘুমোচ্ছেন যে শরীর ঠিক আছে তো ??
– পোড়া কপালীর পোড়া শরীরের কিছুই হবে না টেনশন করিয়েন না অযাথা।
– এভাবে কেন বলছেন অপরিচিতা ! অনেক বেলা হয়েছে উঠুন নাস্তা করে নিন আর দেরি করা ঠিক হবে না।
– হুম উঠে পড়ছি ।
– এইতো দ্যাটস লাইক অ্যা মাই লেডি ।
বলেই জিভে কামড় কাটলো আতিক ।
– কিছু বললেন ?
– না না তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন সেটাই বললাম , এখন তবে রাখছি ।
– আল্লাহ হাফেজ ।

ইরিন ফ্রেশ হয়ে রাহাত কে ফোন দিল – ভাইয়া ওখানে গিয়েছিলে ?
– হ্যা বোন গেছিলাম কাল সন্ধ্যায় কিন্তু দোকান বন্ধ ছিল আজকে আবার যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি ।
– আচ্ছা ভাইয়া তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করিও ।
– আচ্ছা বোন চিন্তা করিস না ।

বেলা এগারোটার দিকে হল সুপার আবার ডেকে পাঠালেন ।
ইরিন গিয়ে বললো-
“আঙ্কেল প্রুফ আনতে আমার ভাইয়া গেছে একটু লেট হচ্ছে” ।
– দেখো ইরিন আজকের মধ্যে যদি প্রমাণ না আনতে পারো তোমাকে হল ছেড়ে চলে যেতে হবে , কথাটা মাথায় রেখো ।
– ইরিন ছোট্ট করে বললো “জ্বি আচ্ছা” ।
বেড়িয়ে আসার পথেই রাহাতের ফোন এলো ।
– ভাইয়া পেয়েছো ?
রাহাত চুপ করে আছে ।
শুনতে পাচ্ছো ভাইয়া ?
– ইরিন প্রমাণ টা জোগাড় করতে পারলাম না বোন ।

ইরিন রাহাতের কথা শুনে যেন নির্বাক হয়ে গেল ।

– কাজী সাহেব দেশের বাইরে গেছেন কাজে । চাবি নিয়ে উনার কর্মচারীকে সাথে নিয়ে আমি সম্পূর্ণ অফিস তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি কাগজটা ।
কাজী সাহেব কেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না ।

– ইরিনের মুখে সব কথা থেমে গেছে আজ কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো ।
ইরিন বিছানায় বসে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো ।
এমন অবস্থা দেখে আশা, আলো, মিথি ছুটে এলো ইরিনের কাছে ।
– ইরিন শান্ত হ বোন এভাবে ভেঙে পড়িস না ।
– আপু হল সুপার আমাকে বেড়িয়ে যেতে বলেছে আমি কি করবো আপু কোথায় যাবো , বাবা-মায়ের সম্মান রক্ষার্থে নিজের বাড়ি গিয়ে উঠতে পারবো না , শ্বশুর বাড়িতে কলঙ্কীনি খেতাব পেলাম আর ভার্সিটিতে নষ্টা মেয়ে ।

আর কতো ধৈর্য্য ধরে থাকবো আমি আপু ?? আমার পায়ের নিচের মাটি তো নেই উপরের মাথা গোঁজার যে ঠাঁই টা ছিল আজ সেটাও গেল ।

ইরিনের কথা শুনে আশা , আলো , মিথি সবার চোখেই জলের খেলা চলছে ।
কান্নার ফোয়ারা নেমেছে ইরিনের ছোট্ট দুটি চোখ জুড়ে ।
আজ কারোর মুখে শান্তনা জানানোর ভাষা নেই ।
সবাই চুপচাপ কান্না করছে হলের কড়া নিয়মে ওরা বাঁধা তার উপর কেউ চাকরি করে না তাই ওদের ও চুপচাপ দেখা আর চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না ।

– এখন কোথায় যাবি ইরিন ?
– ইরিন চোখ মুছে বললো “জানিনা মিথি তবে হল ছেড়ে তো বেড়িয়ে যেতে হবে” ।
– আলো বলে উঠলো “আচ্ছা আমরা সবাই মিলে না হয় আর একটা বার শেষ চেষ্টা করে দেখি হল সুপার কি বলেন” ।
– চল আলো তাই দেখি ।
তিনজন মিলে ছুটলো হলসুপারের কাছে কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারলো না ।

– আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না আমি আতিক ভাইয়া কে ফোন দিয়ে বলি বিষয়টা , ভাইয়া নিশ্চয় একটা ব্যাবস্থা নেবে ।

– ইরিন কি মানবে আলো ? ও যেমন মেয়ে নিজের সম্মান খুইয়ে কারোর সাহায্য নেবে বলে মনে হয় না ।

– শোন তোরা , আতিক কে এমন ভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে বলবি আর কাজটা করতে বলবি যেন আতিকের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে ইরিনের ।

আলো ফোন দিয়ে সবটা বুঝিয়ে বললো আতিক কে ।
আতিক আর এক মুহূর্ত ও দেড়ি না করে বেরিয়ে পড়লো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ।

রুমে আসতেই দেখতে পেল ইরিন দুটো লাগেজ আর একটা হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে রেডি ।

আশা জিজ্ঞেস করল “ইরিন বেরিয়ে এখান থেকে কোথায় যাবি বলে মনে করছিস” ??
– আপু কিছুই বুঝতে পারছি না এখন এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে এটাই মেইন উদ্দেশ্য , আমি বের হচ্ছি তোমারা থাকো ।
– ইরিন আমি তোর সাথে আসবো‌ ?
– না রে মিথি মুখে বলেছিস সেটাই হবে বোন অনেক বিরক্ত করেছি আর না ।

আলো ঝটপট ওর লাগেস খুলে হাজার খানেক টাকা এনে ইরিনের হাতে গুঁজে দিল ।
– আলো লাগবে না আমার কেনো দিচ্ছিস ?
– রাখ না ইরিন বন্ধু হিসেবে একটু পাশে থাকতে দে !

ইরিন আলো কে জাপটে ধরে কান্না করতে লাগলো দুজনেই ।
দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি এবার বের হচ্ছি আর পিছুটান দিস না বলেই সবার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হল থেকে ।
সবাই যেন ইরিন কে ভুত দেখার মত করে দেখছে , খবরটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে ।

কিছুদূর এগিয়ে আসতেই এক ছেলে ইরিন কে বললো
– আপা রেট কতো একটু বলতেন আমরাও না হয়… ।

ইরিন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে যেই মেয়ে কিনা নিজের দাপটে চলতো , সবার বিপদে রুখে দাঁড়াতো আজ তার পাশে কেউ নেই ‌।
চোখের জল মুছতে মুছতে এগিয়ে গেল গেটের দিকে ।
মাথায় এখন একটাই চিন্তা কোথায় যাবে সে বাবার বাড়ি নাকি কোনো হোটেলে উঠবে ।

অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল ওর গলার চেইন টা বিক্রি করে একটা মেসে উঠবে দুমাসের খরচ দিয়ে দেবে আর এর মধ্যে একটা চাকরি ম্যানেজ করে নেবে ।

একটা অটো ডেকে উঠতে যাবে ঠিক ঐ মুহুর্তে কোথা থেকে আতিক এসে হাজির ।
– অপরিচিতা কোথায় যাচ্ছেন এভাবে লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে ?
– ইরিন সহজ গলায় বললো হল থেকে বের করে দিয়েছে ।
– তো এখন কোথায় যাচ্ছেন ?
– ভাবছি একটা মেসে উঠবো নিউরোলজিস্ট বাবু ।
– মাথা খারাপ নাকি এই অবস্থায় মেসে ?
– উপায় নেই !
– কেন থাকবেনা , আমি আছি তো ।
– সম্ভব না নিউরোলজিস্ট বাবু ।
– আপনি কি আমাকে একটুও ভালো বন্ধু মনে করতে পারেন না অপরিচিতা ?
– এমন কেন বলছেন নিউরোলজিস্ট বাবু সমাজের কড়া জালে আমরা সবাই আবদ্ধ আমার দিকে তোলা নোংড়া আঙ্গুল গুলো আপনার দিকে তোলা হোক তা আমি চাই না ।
– সমাজের তৈরি নিয়ম আমি মানি না অপিরিচিতা সমাজ নিয়ম তৈরি করে নি , আমরা নিয়ম তৈরি করেছি সমাজের জন্য ।
– এভাবে হয় না নিউরোলজিস্ট বাবু বোঝার চেষ্টা করুন ।
– আপনি আর একটা কথা ও বলবেন না , গাড়িতে উঠুন ।
ইরিন কে জোর করেই আতিক নিজের ফ্লাটে নিয়ে এলো , ইরিন আর কিছুই বলতে পারলো না ।
দোতালায় দুই রুমের একটা সাজানো গোছানো সুন্দর ফ্লাট ।
হাত মুখ ধুয়ে ইরিন ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আলো কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো সবটা ।
সৌমিক ডাইনিং টেবিলে ডিম পোচ করে গরম গরম ভাত দিলো ।
– অপরিচিতা অনেক ধকল গেছে চলুন খেয়ে নেবেন আগে ।
– আমার আপনার সাথে কথা আছে নিউরোলজিস্ট বাবু !
– সব হবে সময় হারিয়ে যাচ্ছে না , আগে খাওয়া দাওয়া করে নেবেন তার পর ।
ইরিন খাচ্ছে আর আতিক দায়িত্ব করে ইরিন কে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে ।
ইরিন মনে মনে ভাবলো আজ নিউরোলজিস্ট বাবুর জায়গায় সৌমিক থাকার কথা ছিল ।

দিন‌ গুলো দিব্বি কেটে যাচ্ছে ইরিনকে রান্না বান্না করতে দেয় না আতিক সবটা নিজে হাতে করার চেষ্টা করে কিন্তু আতিক বের হয়ে যাওয়ার পর পরই ইরিন নাক মুখ চেপে রান্না করে , এর জন্য প্রতিদিন বকুনিও খাই ইরিন ।
এভাবেই কেটে গেল আরো একটা মাস ইরিন এখন বেশ মোটা সোটা হয়েছে ।
একা ফ্লার্টে থাকে তাই কোনো লোকচক্ষুর সামনে পড়তে হয় নি ইরিন কে সমস্যার ও সৃষ্টি হয় নি ।
সৌমিক কে খোঁজার কাজে এখন ব্যার্থ হয়ে পুলিশ ও বিরক্ত নিয়ে তাকায় কেস ফাইলে ।

ইরিনও আস্তে আস্তে আশা ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু মাঝে মাঝে বড্ড চিন্তা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আতিকের ঘাড়ে আর কতো দিন এভাবে বসে বসে খাবে সে তো আপন কেউ নয় বন্ধু হিসেবে এতোটা করছে যা ভাবাই যায় না ।
জানালার পাশে বসে ইরিন চিন্তার জগতে বিচরণ করছিল হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো ।
ইরিন আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল দরজার দিকে ,
দরজা খুলে দেখতে পেল এক মধ্য বয়স্কা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে হাতে লাগেজ নিয়ে ।

-‌ আসসালামুয়ালাইকুম কে আপনি ? চিনলাম না ।
– এটা আতিকের বাসা না ??
– জ্বি কিন্তু আপনি কে ?
ইরিন কে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো ” আমি আতিকের মা ” ভদ্র মহিলা ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি কে” ?
ইরিন যেন একটু ভয় পেলো নিজেকে ‌সামলে নিয়ে বললো “সরি আন্টি আমি আতিকের বন্ধু” ।

– ইরিন কে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখে বললো “তোমাকে দেখে তো গর্ভবতী মনে হচ্ছে ঠিক করে বলো তো তুমি কে” ??

-আন্টি আমি শুধুই বন্ধু আতিকের ।
– “বন্ধুই যদি হবে তবে এ বাড়িতে তুমি কি করছো” ??
– ইরিন মুখ নিচু করে বললো “আন্টি আমি এখানেই থাকি” ।
– তুমি জানো আমার ছেলে অবিবাহিত ?
– জ্বি আন্টি ।
– তুমি বিবাহিতা ?
– জ্বি আন্টি ।
– তবে আমার ছেলের কাছে কেন তুমি , তোমার স্বামী কোথায় ?
ইরিন একটু ইতস্তত করে বললো- “আসলে আন্টি ও নিখোঁজ” !

চলবে …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here