সিঙ্গেল মাদার পর্ব ১৬

#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব:১৬

আজ কোয়ার্টারে ফিরে বড্ড অবাক হয় ইরিন দরজা খোলার সাথে সাথে দেখতে পায় চিরচেনা মুখগুলো তার অপেক্ষায় বসে আছে শাহানা বেগম আর ইপ্সিতা ।

ইরিন এতোটাই অবাক হয়েছে যে মুখ দিয়ে আর কোনো কথাই বের হচ্ছে না ইপ্সিতা দৌড়ে এসে জাপটে ধরে আপু কে, ইরিন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না ইপ্সিতা কে জড়িয়ে ধরে সেও কান্না করতে লাগলো কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রহিমা খালা, স্নিগ্ধা, শাহানা বেগম দেখতে লাগলো ।
কান্না মুছে ইরিন মুখ তুলে বললো

– কেমন আছিস ইপু ? কতো বড় হয়ে গেছিস !

– ছয়টা বছর আপু অনেক টা সময় , তোমাকে ছাড়া আমরা কিভাবে ভালো থাকি বলোতো ?
– বাবা কেমন আছে রে ?
– তুমি তো অভিমান করে ছেড়ে আসলে ঐ বাড়ি কতো তুফান গেছে আমাদের উপর দিয়ে একটুও খোঁজ রাখোনি ।

ইরিনের একটু ভয় হলো এবার “বাবা ঠিক আছে তো ইপু” ?

কোনো বাবাই তার সন্তান কে হারিয়ে ভালো থাকতে পারে না আপু ,একরকম ভাবে বেঁচে আছেন ।
যে ভয়টা পেয়েছিল তা হয়নি ভেবে একটু স্বস্তি পেল অভিমানী কন্ঠেই মা কে জিজ্ঞেস করলো
– “কেমন আছো মা” ?

শাহানা বেগম কান্না করে দিল “মা রে কেন ক্ষমা করতে পারিস নি আমাদের ? আমরা কি তোর বাবা-মা না ? একটু বুঝিয়ে বললে কি আমরা তোকে বুঝতাম না বলতো কেন ছেড়ে গিয়ে আমাদের এভাবে শাস্তি দিলি মা ?

ইরিন আর অভিমান করে থাকতে পারলো না মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে হাত ইশারায় স্নিগ্ধাকে দেখিয়ে বললো “ঐ ছোট্ট পুতুলটার জন্য মা , তোমরা সেদিন তোমাদের সন্তানের কথা ভেবেছিলে আর আমি আমার ভেতর বেড়ে ওঠা ছোট্ট পুতুলটার কথা মা , ওকে বাঁচাতে আজ এতো দূর” ।

তাই যদি হবে কেন তবে তিন চার মাস পর ফিরে আসলি না আমরা তো তোকে হন্যি হয়ে খুঁজেছি কোথাও পাইনি , আতিক নামের ছেলেটার কাছে আছিস জেনে সেখানেও গিয়েছিলাম কিন্তু তবুও পায়নি ।

একটা সিঙ্গেল মাদারের জন্য এই পৃথিবীটা বড্ড নরক মা তা আমি গত কয়েকটি বছর ভালোভাবে জেনেছি । অনেক অভিমানে তোমাদের কাছে আর ফিরতে ইচ্ছে হয় নি কিন্তু আজ যে তোমাদের এভাবে দেখবো ভাবতে পারিনি ।

এবার ফিরে চল মা অনেক হয়েছে তো এবার বাড়ি ফিরে চল , তোর বাবা অপেক্ষা করছে তোদের জন্য ।

ইরিন এবার কান্না মুছে বলে আমি এখানের লেকচারার মা, তোমার মেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এখন তো যাওয়া সম্ভব নয় আর বাবাকে নিয়ে এসো তুমি ।

নিজের বাড়িতেও যাবি না মা এখনো অভিমান করে আছিস ? তোর আর কোনো চাকরি করা লাগবে না ।

না মা আর কোনো অভিমান নেই , আর চাকরি আমার জন্য না হলেও আমার মেয়ের জন্য আমাকে করতেই হবে একটা ভালো জীবন দিতে হবে আমার মেয়েকে । কেউ যেন বলতে না পারে বাবা নেই বলে আমার মেয়ে ভালো লাইফ লিড করতে পারে না ।

মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শাহানা বেগম বললেন ইরিন অনেক বড় হয়ে গেছিস , আজ কতো ভারি ভারি কথা বলিস ।

বড় হবো না বলছো‌ মা ? যেই মেয়েকে বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী নিখোঁজ হয় , প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বাড়ি থেকে পালাতে হয় , হল থেকে বের করে দেয় হল সুপার, বন্ধুরা ও পাশ থেকে চলে যায়, নিউরোলজিস্ট বাবুর সাথে কলঙ্কের দাগ লাগে গায়ে সেই মেয়ে কে বড় না হলে আজ হয়তো পৃথিবীর বুকে ইরিন নামের কোনো অস্তিত্বের দেখা পেতে না মা !

ওদের কথাবার্তা দূর থেকে দেখছে স্নিগ্ধা । এবার দৌড়ে এলো ইরিনের কাছে । ইরিন বুকের মধ্যে টেনে নিলো । স্নিগ্ধা মুখ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল
– মামনি এটা সেই ছবির নানুটা ??
– হুম মাম্মাই এটা সেই নানুটা , তুমি কথা বলো নি নানু আপুর সাথে ?
– না মামনি তুমি ছিলে না তো তাই কথা বলি নি ।
– আচ্ছা তবে এখন কথা বলো নানু আপুর সাথে ।
– আসসালামুয়ালাইকুম নানু আপু ।
শাহানা বেগম স্নিগ্ধাকে একদম বুকের মধ্যে নিয়ে আদর করতে লাগলো ।
– আমাকে ক্ষমা করে দিও স্নিগ্ধা নানুভাই ।
– ক্ষমা তো বড়রা করে নানু আপু আমি কি বড় ?
– হুম বড় তো তুমি আমার একমাত্র নানুভাই ।
– আর ঐ টা কে মামনি ??
– ওটা তোমার ইপু খালামনি মাম্মাই ।

তুমি তো অন্য ছবি দেখিয়েছিলে ইপু খালামনির এটা তো খালামনি না ।
– মাম্মাই তোমার খালামনি টা ও না তোমার মতো বড়ো হয়ে গেছে।
– ও আচ্ছা এই ব্যাপার তবে !
– হুম স্নিগ্ধা মামনি আমিই তোমার খালামনি ।
– তোমাকে তো খালামনি খালামনি লাগে না মামনির মতো আপু আপু লাগে ।
সবাই স্নিগ্ধার কথাতে হেসে ফেললো ।

তোমরা বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি খুব ক্লান্ত লাগছে । খালা তুমি রান্না চাপিয়েছো ?

– হুম মা আমি চাপিয়ে দিয়েছি তোমার আম্মুদের আসতে দেখেই।
আচ্ছা তবে আমি গেলাম । সবাই স্নিগ্ধার সাথে হাসি আনন্দে মেতে উঠলো । আজ যেন ইরিনদের ঈদ লেগেছে এমন অবস্থা দীর্ঘ ছয় বছর পর মা মেয়ের সাক্ষাৎ হয়েছে ।

“পৃথিবীতে কিছু ঘটনা খুব আকস্মিক ঘটে যায় যার কোনো কূল কিনারা থাকেনা । ”
ইরিন ভাবতেই পারে নি আবার দেখা হবে ওর পরিবারের সাথে কারণ ইরিন বড্ড অভিমানী কখোনো নিজে থেকে দেখা করতে যেত না ।
আর ইরিনের পরিবার কে খবর দিয়েছে এক বুড়ো কর্মকর্তা পিওন ।

একটা সপ্তাহ কেটে গেল এতো আনন্দের মাঝে যে ইরিন অনিকের কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল । হঠাৎ করেই মনে পড়ায় ইরিন বেশ গম্ভীর হয়ে গেল ।
কিছু হয়েছে রে মা ?
– না মা তেমন কিছু হয় নি ।
– তবে চুপচাপ কেন ?
– মা ভাবছি শেষ বারের মতো সৌমিকের একটা খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবো ।
শাহানা বেগম যেন একটু চমকে উঠলেন সাথে অবাক ও হলেন সব ভাবমূর্তি চাপা রেখে ইরিন কে জিজ্ঞেস করলো
– তুই ওর আর কোনো খোঁজ রাখিস নি ??
– না মা আর ইচ্ছে হয় নি , ভেবেছিলাম যে নিজে থেকে আমাকে ছেড়ে গেছে আর কি খোঁজ নিব তার , বাসায় ফেরে নি শুনেছিলাম শেষ বারের মতো আর পরে খোঁজ নেই নি অভিমানে ।
– তবে খোঁজ নেওয়ার আর কি দরকার যা যাওয়ার তা তো চলেই গেছে এখন সে যেখানে থাকে ভালো থাকুক এটাই একমাত্র চাওয়া ।
– না মা আমি আর একবার খোঁজ নিব শেষ বারের মতো মনটা কিছুতেই থামছে না ।

শাহানা বেগম আর কিছু বললেন না কিন্তু একটা চাপা ভয় কাজ করতে লাগলো ।

ক্লাস নেওয়া শেষ করে ইরিন সৌমিকের ডিপার্টমেন্টে চলে গেল , সেখানে সবাই এখন নতুন পুরোনো কেউ নেই । তবুও ডিপার্টমেন্ট হেডের কাছে জানতে গিয়ে কিছুই জানতে পারলো না তার নাকি জানা নেই এই বিষয়ে ।
ইরিন বেরিয়ে আসতে যাবে এমন সময় শফিক আহমেদ ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের লেকচারার ইরিন কে ডাক দিয়ে বললো
– ম্যাডাম কিছু খুঁজছেন নাকি ?
– জ্বি একজনের খোঁজ জানার ছিল কিন্তু নতুন স্যার কিছুই বলতে পারলো না , কি করবো এখন বুঝতে পারছি না ।
– ওহ আচ্ছা ।
– আসছি ।
ইরিন আর দাঁড়ালো না চলে আসতে আসতে ভাবলো আর একটাবার থানায় গিয়ে দেখবে ।
হঠাৎ পেছন থেকে শফিক আহমেদ আবার ডাকতে লাগলো । ইরিনের এবার বড্ড বিরক্ত লাগলো এই মানুষ টা এতো বিরক্ত কেন করে , প্রচুর কৌতুহল এর আগেও দেখেছে মানুষটাকে ।
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বললো “কিছু বলবেন শফিক ভাই” ?
– কাকে খুঁজছেন জানতে পারি ম্যাডাম , সাহায্য করতে পারতাম আর কি !
– আমার একজন পরিচিত , খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তার শেষ পরিণতি টা কি হয়েছিল তাই তাকে খুজতে চাওয়া ।
– আপনি কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি ।
– লাগবে না তো শফিক ভাই কেন‌ অযাথা এসবে জড়াচ্ছেন ।

– আমার কৌতুহল টা বেশি ম্যাডাম আর যদি আপনার পরিচিত কে খুঁজে দিতে পারি তবে আমাকে ট্রিট দিতে হবে ।

হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার কথায় ইরিনের অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করলো ও রাজি হয়ে গেল।

সেদিনের মতো বাসায় ফিরলো ইরিন , বাড়িতে সময় গুলো অনেক ভালো কাটছে বিকেলে সবাই মিলে ফয়েজ লেক ঘুরতে যাওয়ার প্লান করলো কিন্তু ইরিনের কোনো কিছুই আর ভালো লাগছে না পুরোনো কথা গুলো বড্ড মনে পড়ছে ।
ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো । একটু চোখ লেগে এসেছিল ।
– মামনি , ও মামনি ওঠো !
স্নিগ্ধার ডাকে ইরিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
-কি হয়েছে মাম্মাই ডাকছো কেন ?
-আমরা ঘুরতে যাবো তো তুমি রেডি হবে কখন ?
– মাম্মাই আমার যেতে ভালো লাগছে না তুমি নানু আপুদের সাথে যাও কেমন ।
– না মামনি তুমি না গেলে আমিও যাবো না ।
স্নিগ্ধা মাম্মাই আমার তো ভালো লাগছে না বোঝো না কেন !
– আচ্ছা মামনি সমস্যা নেই আমি যাবো না ।
বলেই মন খারাপ করে চলে গেল রুম থেকে ,
ইরিন আর কোনো উপায় না দেখে উঠে পড়লো স্নিগ্ধার মন খারাপ ও সহ্য করতে পারে না সব ছোট থেকে ছোট আবদার গুলো ও পূরণ করে ।
উঠে নাস্তা করে সবাই বেরিয়ে গেল ফয়েজলেকের উদ্দেশ্যে ।

ঘুরতে ঘুরতে সবাই লেকের পাড়ে এসেছে এসে ছবি তুলছে । ইপ্সিতা আর স্নিগ্ধা বোটে ওঠার জন্য খুব করে বায়না ধরেছে শাহানা বেগম কিছুতেই উঠতে দেবে না ।
– মা ওরা যখন চাইছে যেতে দাও না ।
– না ইরিন আমি পানি তে ভয় পাই ।
– মা তুমি তো যাচ্ছো না যাবে তো ওরা অযাথা কেন ভয় পাচ্ছো ?
– না বাপু আমি ওসব বুঝিনা কাউকে বোটে উঠতে হবে না ।
– আচ্ছা তবে এক কাজ করো তুমি রহিমা খালা আর ইপ্সিতা মিলে গিয়ে ওখানে রাইডে উঠো তাইলেই ও আর বোটে উঠতে চাইবে না ।
আচ্ছা আর তুই যাবি না ?
– না আমি এখানে খোলা প্রকৃতিতে একটু দাড়িয়ে থাকি ।
– আচ্ছা তবে গেলাম আমরা ।
ওরা রাইডের কাছে চলে গেল ইরিন একা দাঁড়িয়ে আছে চারিপাশের পরিবেশ টা দেখছে । কোথাও চলছে খুনশুটির হাট কোথাও চলছে প্রেমালাপ কোথাও আবার ফ্যামিলি নিয়ে ব্যাস্ত ‌। আর এরই মাঝে প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য এক পাশে মাথা উঁচু করে পাহাড় দাড়িয়ে আছে আর একপাশে সবুজ পানির মনোরম লেক ।
এসবের মাঝে মগ্ন হয়ে ছিল ইরিন হঠাৎ মনে হলো কোনো মেয়েলি কন্ঠে কেউ ডাকছে ।

চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here