#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব: ১৭
ইরিনের হঠাৎ মনে হলো মেয়েলি কন্ঠে কেউ ডাকছে পেছন ফিরতেই বড্ড অবাক হলো সে অনেক কাছে এসে রাজ্যের বিস্ময় চোখে মুখে নিয়ে আলো দাড়িয়ে আছে ।
দুজন যেন হতভম্ব হয়ে থেমে গেছে , এতোটাই অবাক হয়েছে যে কারোর মুখে কথা নেই ।
নিরবতা ভেঙ্গে আলো বলে উঠলো- “ইরিন তুই আমি বিশ্বাস ই করতে পারছি না ” !!
– আলো !
– এতোটা বছর কোথায় ছিলি তুই ??
– অন্য একটা শহরে গাঁ ঢাকা দিয়েছিলাম ।
– একটাবার আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখার কোনো প্রয়োজনবোধ করিস নি কতো খুঁজেছি তোকে জানিস ? কিল ঘুষি দিতে দিতে জড়িয়ে ধরলো ইরিন কে ।
– সরি রে আঘাত পাইতে পাইতে আমি এতোটা শক্ত হয়ে গেছিলাম যে সব কিছু থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম এমন কি আমার পরিবারের সাথে ও যোগাযোগ ছিল না ।
লেকের মধ্যে গোল ঘরের ছাউনিতে দুজন গিয়ে বসে পড়লো ।
– হঠাৎ এই শহরে আবার কিভাবে ? কেন ? কোথায় হারিয়ে গেছিলি বল আমাকে, কেন চলে গেছিলি কাউকে না বলে ?
– বলছি তুই একটু শান্ত হয়ে বস ।
– এতোটা বছর পর দেখেছি তোকে আর বলছিস শান্ত হবো ।
– আলো আমি ভালো আছি রে ।
আলো এবার ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো “তুই কি একা আছিস” ?
ইরিন ম্লান হেসে জবাব দিল আমি তো সারাজীবন ই একা ছিলাম রে হুট করে এসে সেই মানুষটি আমাকে একটা মুল্যবান উপহার দিয়ে গেছে তাকে নিয়েই চলছে আমার জীবন তরী । স্নিগ্ধা, আমার মেয়ের নাম, সাত বছর বয়স । আমি স্নিগ্ধা আর খালা তিনজনের সংসার বেশ ভালোই যাচ্ছে। তোর কথা বল শুনি ?
– আমার এই যে বিয়ে করে বসে আছি ।
– কোথায় সে এসেছে নাকি ?
– হ্যা আছে অন্য দিকে আমাকে খুঁজছে হয়তো আমি তোকে দেখে এদিকে চলে এসেছি ।
– বলিস কি ব্যাচারা হ্যানস্তা হবে তো ।
– রাখ তো পুরো পাগল সে একটা সবসময় পাগলামী করে , আজকেও আসতে চায় নি কিন্তু সে জোর করে নিয়ে এসেছে ।
– বাহ ভালো একটা জামাই পেয়েছিস তবে । আচ্ছা সবার কি খবর রে ? কেমন আছে মিথি , রাতুল ভাই ।
আলো একটু ইতস্তত করে বললো আমি কারোর খোঁজ রাখি না রে , তুই জানিস না এরা কেমন আছে ?
না সবার সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিন্তু দেখ না ভাগ্যের টানে আবার পুরোনো জায়গায় পুরোনো শহরে। আমাদের ভার্সিটিতে চারুকলা ডিপার্টমেন্টের লেকচারার হিসেবে জয়েন দিয়েছি।
মলিন মুখেই একটু হাসি টেনে বললো কনগ্ৰাচুলেশন ।
ওদের কথার মাঝে হঠাৎ কেউ একজন কথা বলে উঠলো ” তুমি এখানে আর আমি সব জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি” ।
– দেখো না আমি কাকে পেয়েছি !
পলাশ ইরিনের দিকে তাকিয়ে খুব সহজে চিনে ফেললো ।
” আরে ম্যাডাম আপনিই তবে সেই ইরিন” !
– আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া কেমন আছেন?
– ওয়ালাইকুমুস সালাম , আপনার নামে তো অনেক বড় বিচার আছে ।
– ইরিন হেসে বললো কি অভিযোগ ভাইয়া বলে ফেলুন ?
– আপনার গল্প এতো শুনেছি বলার মতো না , বিয়ের আগে যে জমিয়ে প্রেমটা করবো তাও হয়নি ডেটিং এর সময় আপনাকে খুঁজে বেড়িয়েছি বউ এর সাথে বিয়ের আগে প্রেমের সাধ টা আর পূর্ণ হলো না , আর আমার বউ সাহেবা তো সুযোগ পেলে আপনার কথা মনে করে কাঁদতে বসে যায় আমিই মিথ্যে সান্তনা দিয়ে ওকে থামায় ।
– তুমিও না ইরিন কে পেয়ে সব নালিশ করছো আমার বান্ধবী কে কোনো অভিযোগ দেওয়া চলবে না ।
– আমি একান্তভাবে দুঃখিত ভাইয়া , আসলে আমাদের তিনজনের মধ্যে সম্পর্ক টাই এমন ছিল যে কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারতাম না ।
আমিও অনেক মিস করছি ওদের ভিষণ ভাবে ।
– তা বললে তো হবে না ম্যাডাম আমার তো বিচার চাই ।
– কি শাস্তি দেবেন বলেন ভাইয়া অবশ্যই মেনে নেব ।
– আপনাদের বাসায় একদিন দাওয়াত দিলেই হবে ।
– ইরিন মোটেও রাজি হবি না ও দিন দিন ভয়ানক রকমের পেটুক হয়ে যাচ্ছে , লজ্জা বলে তো কিছুই নেই ।
– আমি পেটুক কোথায় বলো তো শুধু একটু বেশি খাই আর কি ।
ইরিন আলো দুজনেই হেসে উঠলো পলাশের কথাতে ।
– আচ্ছা ভাইয়া শাস্তি স্বরূপ তবে তাই মেনে নিতে রাজি আছি , বলুন কবে আমার কোয়ার্টারে আসছেন ?
আলো কপট রাগ দেখিয়ে বললো
– ইরিন তোকে না বলছি রাজি না হতে !
– তুই চুপ কর তো আমার আর ভাইয়ার ব্যাপার তুই একদম কথা বলবি না , ভাইয়া বলুন আপনি ।
– পলাশ ভয়ার্ত মুখে বললো “হোম মিনিস্টার যেভাবে রাগ দেখাচ্ছে বলার সাহস হয়ে উঠছে না ”
সবাই আরো একবার হেসে উঠলো পলাশের কথাতে , পলাশ মজার একটা মানুষ ।
আড্ডা মুখর সময়টা বেশ কাটলো বিদায় নিয়ে সবাই চলে আসলো । ফ্রেশ হয়ে ইরিন বেলকুনি তে বসে আছে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো ।
ফোন হাতে নিয়ে দেখলো শফিক আহমেদের নাম্বার রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করে উঠলো- ম্যাডাম খোঁজ নেওয়ার জন্য কিছু ভেবেছেন ?
– না শফিক ভাই কালকে দেখা যাবে , থানায় যাবো একবার ।
– আচ্ছা ঠিক আছে ম্যাডাম তবে থানায় দেখা হচ্ছে রাখছি ।
ব্যাস্ততার মাঝে আর ভাবা হয় নি কালকেই থানায় যেতে হবে , আচ্ছা আলো কে ফোন দিলেই তো জানা যায় , যেই ভাবা সেই কাজ-
– আলো আমি ইরিন
– বল ইরিন কি হয়েছে ?
– একটা বিষয় জানার ছিল রে !
– বল না কি , এতো ইতস্তত বোধ কেন করছিস।
– আসলে আমি শহর ছাড়ার পর প্রথমদিকে সৌমিকের খোঁজ নিতাম কিন্তু আর কোনো খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিনি সৌমিকের ওর সম্পর্কে কি কোনো খোঁজ পাওয়া গেছিলো ?
– আলো একটু শক্ত হয়ে বলল ইরিন মানুষ চিনতে আমরা খুব ভুল করি রে , “মাঝে মাঝে খুব কাছের আপন মানুষ গুলো আমাদের আদর করতে করতে পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়” ।
– এমন বলছিস কেন ?
– কি দরকার বল পুরোনো কিছুর খোঁজ নেওয়ার যা যাওয়ার তা তো চলেই গেছে আল্লাহর কাছে দোয়া কর যেন সবাই ভালো থাকে । তুই ও সুখে আছিস এর চেয়ে বেশি আর কি চাই বল । তবে তুই তোর খুব কাছের এক মানুষ কে হারিয়ে ফেলেছিস যে তোকে সত্যি ভালোবেসেছিল আগলে রেখেছিল দুই হাতে দিয়ে ।
– তুই কি বলতে চাইছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না একটু পরিষ্কার করে বল ।
– ইরিন আমি একটু ব্যাস্ত আছি রে পরে কথা বলবো ।
বলেই আলো ফোনটা কেটে দিলো । ইরিন যেন হতবাক হয়ে গেল আলোর এমন অপ্রত্যাশিত ব্যাবহার ও যেন আশাই করে নি ।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিল ইরিন আকাশী রঙের শাড়ির সাথে সাদা হিজাব টা বাঁধছিল এমন সময় শাহানা বেগম আর ইপ্সিতা রুমে আসলো ।
– কিছু বলবে মা ??
– একসপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে আমরা এসেছি তোর বাবা একা একা আছে এবার আমাদের ফিরতে হবে ।
– এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ?
– হ্যাঁ রে মা ।
– এক কাজ করো না মা তোমরা সবাই চট্টগ্রামে শিফট হয়ে আসো আমি বড় ফ্লার্ট নিবো সবাই এক সাথে থাকবো ।
– ইপ্সিতার সব কিছু ওখানে কিভাবে হবে ? তোর বাবার চাকরি টা আর নেই , ইপ্সিতার টিউশনির টাকা আর তোর বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলে ।
– ইরিনের চোখটা ছলছল করে উঠলো “আমিই মেয়ে হিসেবে যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারি নি মা আমাকে মাফ করে দাও” ।
– না ইরিন আমরাই বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারিনি, তোর দুঃসময়ে শুধু আমাদের পাশে থাকার কথা ছিল তখনই আমরা ছিলাম না তোর পাশে আমাদের তুই মাফ করে দিস ।
– মন খারাপ করো না মা সব ঠিক হয়ে গেছে তো ।
এখন থেকে সব দায়িত্ব আমার আর ইপু তুই শুধু মন দিয়ে পড়ালেখা টা করবি ভালো জায়গায় ভর্তি হতে হবে তো ।
– আচ্ছা আপু , জানিস বাবা খুব করে তোকে দেখতে চাইছে ফোনে বলছিল ।
– এখন তো আমার যাওয়া সম্ভব নয় ছুটি পড়লে একদিন অবশ্যই গিয়ে বাবা কে সারপ্রাইজ দিবো ।
– ইরিন আর একটা কথা বলতে চাই মা
– বলো এভাবে কেন ইতস্তত করছো-
– মা পুরোনো সব কিছু ভুলে যা , সেগুলোকে নতুন করে খোঁজার চেষ্টা করিস না । যা অতীত তা তো অতীত ই বল ওসব আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাস না ।
– কি বলছো মা আমি শেষ বারের মতো একবার আমার সৌমিককে খুঁজে দেখতে চাই , শুধু শেষ বারের মতো তুমি বাঁধা দিও না ।
শাহানা বেগম আর কথা বাড়ালো না কারণ জানে ইরিন কেমন জেদী মেয়ে যার প্রমাণ এই ছয় বছর দূরে থাকা ।
– আচ্ছা তোর যা ভালো মনে হয় করিস আমার মেয়েটা এখন অনেক শক্ত এতো টুকু ভরসা আছে আমার , আমরা তবে আজ চলে যাবো তোর সাথে আর দেখা হবে না ।
– ইরিন ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো এগুলো রাখো মা
– এতো গুলো টাকা কেন দিচ্ছিস ।
– এতো দিন তো কোনো দায়িত্ব পালন করি নি এবার না হয় করতে দাও ।
ইরিন ওদের বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন সময় দেখলো স্নিগ্ধা মন খারাপ করে সোফায় বসে আছে ।
– কি ব্যাপার আমার মাম্মাই টার মন খারাপ কেন ? আজ স্কুলেও যাওয়া হয় নি ব্যাপার কি ??
– আমার মন ভালো না মামনি ।
– আমার মাম্মাইটার কি হয়েছে শুনি কেন মন খারাপ ?
– খালামুনি , নানু আপু আজ চলে যাবে বলেছে ।
– ওহ তবে এই ব্যাপার আচ্ছা তুমি ওদের ভালো করে বলে দাও তো যেন খুব তাড়াতাড়ি ওরা আবার চলে আসে একবারে ।
– ওরা সত্যি একবারে চলে আসবে ? আর যাবে না মামনি ?
– না মাম্মাই বলেই আদর করে দিয়ে দিল
স্নিগ্ধা এবার অনেক খুশি হয়ে গেছে ।
ইরিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো থানায় যেতে হবে ওকে সৌমিকের খোঁজ টা জানতে হবে । ওর মাথায় একটা কথা শুধু বার বার পাক খেতে লাগলো “আলো আর মা খুব অদ্ভুত একটা আচরণ করলো ওরা কি কিছু জানে ! জানলে আমাকে কেন আড়াল করলো” ।
এসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যাচ্ছিল এর ই মাঝে আবার শফিক আহমেদ এর ফোন এলো ।
– ম্যাডাম কতোদূর আমি তো থানায় এসে দাড়িয়ে আছি ।
– আর পাঁচ মিনিট শফিক ভাই ।
থানায় পোঁছে দুজনেই পুরোনো কেসের কথা বললো পুরোনো ফাইল তদন্ত সব কিছুর কথা বললো কিন্তু থানা থেকে খুব অবাক করা একটা কথা বললো যে সৌমিক কে খুঁজে পাওয়া গেছিলো ফাইল, রিপোর্ট অনুযায়ী ।
ইরিন এতোটা আশ্চর্য আর খুশি হলো শফিকের হাত ধরে বললো ” সৌমিক বেঁচে আছে শফিক ভাই ” ।
শফিক আহমেদ ও অবাক হয়ে দেখলো ইরিন কে , ইরিন এতোটাই খুশি যে খেয়াল পর্যন্ত করে নাই আমার হাত ধরে ফেলেছে খুশিতে ।
ইরিনের কোনো দিকে খেয়াল নেই কখন হাত ধরেছে ছেড়ে দিয়েছে কিছুই টের পায় নি ।
“এবার মানুষ টা কেও তবে খুঁজে পাবো ম্যাডাম ট্রিটের কথা কিন্তু মনে রাখবেন” ।
– শফিক ভাই মানুষ টা কে একবার খুঁজে পায় তারপর আপনি যা চাইবেন তাই দেব কথা দিচ্ছি ।
– ম্যাডাম কথা দিয়ে কথা রাখবেন তো ?
– ইরিন জামান কথা দিয়ে কথা ভেঙ্গে ফেলার মেয়ে নয়
– দেখা যাক তবে ।
ইরিনের সারাটা দিন কাটলো একটা ব্যাপক উৎকণ্ঠাতে ক্লাসের লেকচারে মনোযোগ দিতে পারে নি ।
বাড়ি ফিরে আবার আলো কে ফোন দিল ।
– আলো একটা গুড নিউজ আছে ।
– তাই নাকি বল কি নিউজ ।
– গেস কর
– না বাবা তুই বলে দে আমার ধৈর্য্য নেই দ্রুত বল কি নিউজ ।
– সৌমিক বেঁচে আছে ।
– ইরিন পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কি বল তো বোন ?
– এভাবে কেন বলছিস তুই খুশি নস ? আচ্ছা থাক তোকে আর সৌমিকের কথা বলবো না ।
– আচ্ছা তবে আমি কিছু বলি সৌমিক ভাইয়ার ব্যাপারে ।
– কি বলবি ?
– যদি বলি সে তোকে ছাড়া অনেক সুখে আছে ।
– কি বলছিস আলো তোর কোনো ধারণা আছে ?
– না হয়তো পুরোটা ঠিক না বললেও অনেক টাই সত্যি বললাম । মানুষ একটা সময় পর নিজের ভুল বুঝতে পারে কিন্তু সময় টা চলে যায় মানুষগুলো ও বদলে যায় তখন ভুল বুঝতে পারা আর না পারা সমান কথা ।
– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তোর কথা, সৌমিক কোথায় আছে বলতে পারবি ?
– হয়তো নিজের বাড়িতে , কখোনো যাস না ওখানে অমানুষ গুলো কে সহ্য করতে পারবি না ।
ইরিনের আলোর কথা গুলো একদম মাথায় ঢুকছিল না ও ফোনটা কেটে দিয়ে বসে পড়লো হতভম্ব হয়ে ।
চলবে ….
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আর যারা পড়বেন প্লিজ জানাবেন কেমন হয়েছে আপনাদের কথার মাঝেই লেখার শক্তি পাওয়া যায় ।)