#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১৬)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
এসবে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আরও আমাকে ফাঁদে পাতা জালের মতো আটকে রাখছে আরিয়ান। আমার প্রেমে পড়ে সে এখন পাগল প্রায়। তার প্রথম প্রেম আমি। আর প্রথম প্রেমের ছোট ছোট ভুল গুলো সে একটুও গুনে রাখে না। যখন আমি রান্না ঘরে কাজে ক্লান্ত, সে তখন হুট করে আমার শরীরে জাফরান গুলা পানি ছিটিয়ে দিবে। সবার সামনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে চোখ মারবে। বাড়ি থেকে ডিউটির জন্য বেড়িয়েও কি ভেবে আবার ফিরে আসবে। আমার বাঁধা চুল গুলোর মধ্যে থেকে চুলের কাটা টান মেরে বের করে জানালা দিয়ে ফেলে দিবে। হঠাৎ হঠাৎ আশাতীত অবাঞ্চিত স্পর্শ গুলোর সীমাবদ্ধতা ভুলে যাবে।
.
দিন দিন আরিয়ানের শীতল চাহনিটা, চঞ্চল চাহনিতে রুপান্তরিত হচ্ছে। আর এই চাহনি টা কখনো আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। আমার হৃদয়কে সব সময় খোঁচাতে থাকে। আমার ঠোঁট, গলা, পিঠ, কোমর, পায়েয় নূপুরে ঐ চঞ্চল চাহনি খেলা করতে থাকে।
.
আর আমারও মন আর মস্তিষ্কে যেন আরিয়ান ওর ছোট ছোট ভুল গুলো দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। ওর সব পাগলামীতে আমি কড়া চোখে রাগ দেখায়। কিন্তু মন বলে, চলুক না এই দুষ্টু মিষ্টি খেলাটা। আমার অসুস্থ মন ধীরে ধীরে ওর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পরে। আশে পাশে থাকলে ভালো লাগে। গুরুত্ব দিতে শুরু করেছি ওর সব আবদার গুলোকে। আর এটাই হয়তো তিন কবুলের শক্তি। যার জন্য আরিয়ানের ছবিটা আমার মনে পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে গেঁথে যাচ্ছে। আর ফাহাদের ছবিটা আবছা হতে শুরু করেছে, ধীরে ধীরে হয়তো অদৃশ্যও হয়ে যাবে। আর আমিও সুস্থ হয়ে আর দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো। আজ কাল তকদীরের প্রতি বিশ্বাস করতে মন বলে। হয়তো ফাহাদ আমার ভাগ্যেই ছিলো না। আরিয়ানই ছিলো আমার নিয়তিতে লেখা। নাহলে তিন বছরের সম্পর্ক রেখে, মাত্র কয় দিনের পরিচয়ে আরিয়ানের সাথে আমার বিয়ে হবে কেন,,,,,
.
এসব ভাবনা গুলো এখন আমাকে সারাক্ষণ খুব ব্যাস্ত রাখে। আম্মুর কথাই কি তবে সত্যি হতে যাচ্ছে ? আমার মনে কি আরিয়ান জায়গা করে নিচ্ছে ? কিন্তু এও কি কখনো হওয়ার ছিলো ?
.
দিন টা শুক্রবার। আরিয়ানের আজ হাফ টাইমের ডিউটি। তাই এই বিকাল বেলায় আমার সংসারের সবাই উপস্থিত। বাগানে বসে গল্প করছে মা, বাগানের মালির সাথে। তার গল্পের মূল বক্তব্য, “আমার বৌমা পাখি”। তার কথার ধরনটা টা কিছুটা এরকম,
— বুঝলে মালি, আমার বৌমা লাখে নয়, কোটিতে একটা। যেমন রুপ, তেমন গুন। হাতের রান্না এত্তো মজা কি আর বলবো। (একটু অহংকারী ভাব নিয়ে, কিন্তু দু’চোখে মায়া উপচে পরছে)
— হো মেডাম, আমারে প্রায়ই রাতের খাউন সাথে কইরা বাঁইদা দেয়। আমার বউ আর মাইয়াডা তো সেই তারিফ করে ছোড মেডামের।
— হুমম,,, সব দিকে খেয়াল তার বুঝলে। সবার এতো খেয়াল রাখে কি আর বলবো। আমার তো মাঝে মাঝে নিজেকে আয়াতের বয়সি মনে হয়।( হাসতে হাসতে)
— হো মেডাম, আমি কাম করতে করতে হাঁপাই গেলে, ছোড মেডাম আমারে ঠান্ডা পানির সরপত আইনা দেয়।
— আমি যে আল্লাহর কাছে কত কেঁদেছি আমার ছেলেটার জন্য। আল্লাহ আমার ডাক শুনেছো গো। এমন একটা মেয়ে দিলো আমার ছেলেটার জীবনে, এখন আমি মরেও নিশ্চিন্ত। দেখো দেখো কত হাসি খুশি দেখাচ্ছে।
— আল্লার মেহেরবান।
— আয়াত টাকেও দেখো, কি যে ভালোবাসে মেয়েটা। একদম চোখে হাঁড়ায়। আর ছেলে টাও সারা দিন ওর আঁচল ছারে না।
.
.
মানুষ টা কেন আমাকে এতো ভালোবাসে আমি বুঝি না। যদিও আমি নিজে থেকেই সব সময় এ বাড়ির সবার খুব খেয়াল রাখি, আর রান্নাটা নিজেই করার চেষ্টা করি। তবুও যদি বেখেয়ালি বশত কোনো ভুল হয়ে যায়, তাহলে দৌড়তে দৌড়াতে এসে আমার হাত পা পরখ করে দেখবে যে কোথাও কেটে বা পুড়ে গেছে কিনা। আমার শরীরে যদি একটু আঁচর ও লাগে তবে উনার চোখের কোনা পানিতে উপচে পরে।
.
আয়াত, আরিয়ান আর বাবা ক্রিকেট খেলছে বাগানের ফাঁকা জায়গা টায়। আমি সবার জন্য সরবত নিয়ে গেলাম। আরিয়ান হালকা ঘেমে গিয়েছে। বিকালের সোনা রোদে ওর কপালের দুই পাশে হাল্কা ঘামে চিকচিক করছে। যেন প্রেম রাজ্যের, প্রেমোদ্ধীশ্বরের মুকুট পরানো হয়েছে।
.
বাগানের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলার জন্য কাঠের সোফা বসানো আছে ফুল গাছ গুলোর পাশেই, যা এমন কারুকাজ করে তৈরী করা যেন মনে হচ্ছে, চা গাছের মোটা শেকড় দিয়ে তৈরী। সত্যিই মা আর বাবা খুব সৌখিন দম্পতি, এটা তাদের ঘর সাজানো দেখেই বোঝা যায়। আমি সরবত নিয়ে ওখানেই গেলাম। মা-ও ওখানেই বসে আছে।
.
সবাই কে ডাক দিলাম সরবত খাওয়ার জন্য। সবাই একসাথে বসে পরলো শুধু আয়াত ছাড়া। সে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সবার হাতে গ্লাস দিলাম। আয়াতকেও দিলাম। কিন্তু সে অর্ধেকটা পান করে বাকি টা টগর ফুল গাছের গোড়ায় ঢেলে দিলো। আমি রাগি কন্ঠে আয়াতকে জিজ্ঞাসা করলাম,
— আয়াত তুমি সরবত টা ফেলে দিলা কেন ? জানো না খাবার নষ্ট করতে হয় না। আল্লাহ গুন্নাহ্ দেন।
— উমম্ তোমলা তো প্রতিদিন শুদু গাছ গুলোতে পানি দাও। কিন্তু ওদেলও তো মাঝে মাঝে সলবত খেতে মন বলে না কি ? (গ্লাসের শেষ বিন্দু সরবত টুকু ঢালতে ঢালতে)
.
ওর কথা শুনে আমার মাথাটা পঁয় করে ঘুরে গেল। আমি ভাষা হাড়িয়ে ফেলেছি, ওকে বোঝানো আমার দ্বায়। সবার তো হাসতে হাসতে বেষম উঠে যাওয়ার জোগার।
সবাই মেতে উঠলাম গল্প আড্ডাই। এর মাঝে মা আয়াতকে ওর কানে কানে কি জানো বললো। আর আয়াতও ওর মনটা খারাপ করে ধপ করে বসে পরলো। বিষয় টা যদিও কেউ খেয়াল করিনি। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ করে ওর কি হলো….
.
উঠে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। আঁচল দিয়ে ওর মুখ মুছে জিজ্ঞাসা করলাম,
— আমার আয়ু সোনার কি মন খারাপ ? (আমার কথাই সবাই আমাদের দিকে তাকালো)
— দাদুন ভাই তো ওল্ড ম্যান। (মুখটা ভার করে)
— আয়াত, এটা কোন ধরনের অভদ্রতা ? (রাগি কন্ঠে)
— দাদুন ভাই আমাল সাথে দৌলে দৌলে খেলতে পালে না। আল,,, (চোখে পানি টলমল করছে)
— কি হয়েছে আয়াত, এমন কথা বলছো কেন ? (আমার বুকটা মোচর দিয়ে উঠছে, ও কাঁদছে কেন?)
— আল পাপায় তো বালিতেই থাকে না। আমি কাল সাথে খেলবো বলো মাম্মাম ?
— ওহ্ এই বিষয়। পাগল ছেলে আমার। আমি আছি তো জান। আমি খেলবো তোমার সাথে।
— নাহ্,,, তুমি তো ওলওয়েজ কাজে বিজি থাকো।
— ইসস্ মন খারাপ করে না বাবা আমার।
— মাম্মাম পাপায় আমাল,,,,,,, (এটুকু বলেই কাঁদতে শুরু করলো)
.
আরিয়ান সাথে সাথে উঠে এসে ওর পাশে এসে বসে পরলো। আমাদের দুজনের মাঝে আয়াত। দুজনায় ঝুঁকে পড়ে ওর কান্না থামাতে চেষ্টা করছি। আরিয়ান বলতে লাগলো,
— চলো তো আমার ব্রেভ বয়, আমরা অনেক গুলো চকলেট আর আইসক্রিম কিনে আনি। আর তোমার ফেবারিট রোবো-ডায়নোসর।
— না পাপায়। আমাল তো বেবি আপুনি আর বেবি ভাইয়া চাই। আমি ওদেল সাথে খেলবো। মাম্মাম চলো না কিনে নিয়ে আসি। (ভোরের সুর্য ওঠা হাসি মুখে কথাটা বললো)
.
আমি আর আরিয়ান ওর কথা শুনে একদম স্পিচলেস হয়ে গিয়েছি। তবে হঠাৎ করে আরিয়ান সেই প্রথম দিনের মতো শীতল চাহনিতে আমার চোখের শিরা গুনতে চাইছে। আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। কিন্তু তার ভাবখানা এমন যেন, এই বিকাল বেলাও আকাশে তারা জেগেছে আর সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঐ তারা গুলো গুনছে। বাবাও কেমন জানি পাগলদের মতো করে বলতে লাগলো,
— হ্যা দাদুন ভাই একদম ঠিক বলেছো। আমারও চাই অনেক গুলো ভাইয়ু আর আপুনি। আরিয়ান, পাখি তোমরা কালই আমাদের জন্য অনেক গুলো বেবি কিনে আনবে বুঝেছো। (কথাটা বলেই বাবা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে ওকে চোখ মারলো, আর আরিয়ানও লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকে দুই আঙ্গুল দিয়ে স্যালুট করলো)
.
আচ্ছা এরা সত্যি বাবা ছেলে তো? এদের পরিবারটা এমন অদ্ভুত কেন ? লজ্জায় আমার মাটির চোদ্দ হাত নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে। মাথা নিচু করে মায়ের দিকে আড়চোখে তাকালাম, সে আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানি মার্কা হাসি দিচ্ছেন। উফফ্,,,,
.
আজ রাতে কেমন জানি আবহাওয়া টা গুমোট ভাব হয়ে আছে। এসি চলছে বিধায় তেমন সমস্যা হচ্ছে না। আমার আর আরিয়ানের মাঝ খানে আয়াত ঘুমাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। রাত প্রায় ১ টা। বাইরে মনে হয় ঝড় হচ্ছে। আমি শব্দ শুনতে পারছি। হঠাৎ মনে হলো আরিয়ান উঠে এসে আমার পাশে বসলো। ঝড়ের গতি বাড়ছে। সাথে আমার হৃদয়ের স্পন্দনেরও। আরিয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার পুরো মুখমন্ডলে অনুভব করলাম। হঠাৎ খুব জোরে কোথাও বজ্রপাত হলো। আমি আমার বুকের আঁচল শক্ত করে মুঠ পাকিয়ে ধরলাম।কিন্তু চোখ খুললাম না। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, ঠিক সেরকম কিছুই হলো না। শুধু আরিয়ানের ঠোঁটের স্পর্শ আমার কপালে অনুভব করলাম।
.
ধীরে ধীরে হয়তো ও উঠে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। অনুমান করার কারন আমি দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর আমার চোখটা খুললাম। আমার চোখের কোনায় নোনতা বিষ। আমার পুরো শরীর অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে। ভাবছি এতটা নিয়ন্ত্রণ সে নিজের উপর কিভাবে রাখে। সে কি মানুষ নয় ? আমি কি গুন্নাহ্ করছি তাকে স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ?
.
আধঘন্টা পর বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। আরিয়ান এখনো ঘরে ফেরেনি। কোথায় গেল ও ? ধীরে ধীরে আমি উঠে বারান্দায় গেলাম। বিদ্যুৎ এর ঝলকানিতে দেখতে পেলাম আরিয়ান বাগানে কাঠের ঐ সোফায় বসে আছে। হাঁটুতে তার দু’হাতের কনুই রেখে মাথাটা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে উন্মাদ প্রেমিক। কিছুক্ষণ পর ও বারান্দায় তাকালো। যেন ও জানতো আমি বারান্দায় আসবো। উঠে দাড়িয়ে পরলো। ওখানে দাড়িয়ে থেকেই আমাকে দেখতে লাগলো। বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে গেছে।
.
আমি ঘরে চলে আসলাম। ভাবছি এই উন্মাদ প্রেমিকের উন্মাদনা কিভাবে থামাবো ? ওকে থামানোর দ্বায়িত্ব কি আমার ? আমার হলেও আমি ওকে থামাবো না। বিছানায় শুতে গিয়েও, ঘর থেকে বের হয়ে নিচে গেলাম। একটা ছাতা হাতে করে আমার পা দু’টোকে নির্দেশ দিলাম, তোমার প্রেমে উন্মাদ সেই পাগলের কাছে যাও,,,,,,,
·
·
·
চলবে…………………..