হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ১৫

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১৫)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
আমি আরিয়ানের দিকে তাকালাম, সে আমাকে কোনো সাহায্য করলো না। বরং উল্টা তার ঠোঁট বেকিয়ে, কাঁধ দুটো উঁচু করে ছেরে দিলো। অর্থাৎ তার কিছুই করার নাই।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
— উম,,, মা,,, আমি,,, বলছিলাম,,, যে…….
আবারও আমার কথা কেটে আমার শাশুড়ী মা বলে উঠলো,
— তুমি চুপ থাকো। আরিয়ান, আয়াতকে আমার কাছে দাও।
আমার কেমন জানি মাথা ঘোরাতে লাগলে।
আরিয়ান মা কে বললো,
— না মা, তুমি যাও। আজ আয়াত আমাদের কাছেই ঘুমাবে। ওর পাপায় আর মাম্মাম এর সাথে।
.
বিন্দু বিন্দু সন্মান আরিয়ানের প্রতি আমার বাড়তেই থাকলো। তারপর আমার শাশুড়ী মা রাগে খুস বিস খুস বিস করতে করতে চলে গেল। আরিয়ান আমার কোলে ঘুমন্ত আয়াতকে দিয়ে বললো,
— বিয়ের প্রথম রাতে প্রত্যেক স্বামীই তার স্ত্রীকে কিছু না কিছু উপহার দেয়, কিন্তু আজ আমি তোমার হাতে আমার ছেলেকে তুলে দিচ্ছি। মনে করো আমার কলিজাটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। আমার কলিজার খেয়াল রেখো।
— ও শুধু আপনার একার কলিজা নয়। আমারও।
.
তারপর আরিয়ান মিষ্টি করে হেসে আয়াতকে চুমু দিলো। আর আমি পেলাম ওর শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ।
.
আয়াতকে বিছানায় শোয়াতে যাবো তখনই আরিয়ান আমাকে বললো,
— আয়াতকে একপাশে শোয়াইয়ে, তুমি মাঝখানে শুবে প্লিজ? (তার শীতল চাহনিতে, শীতল কন্ঠে বললো)
— আব…. উম…. হু….
— চিন্তা করো না। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কখনোই কিছু করবো না। শুধু মন ভরে কাছে থেকে তোমাকে দেখবো,,,,, দেবে এই অধিকার টুকু আমাকে ?
— ……. হুম।
— এতোদিন শুধু চুরি করেই তোমার ঘুমন্ত মুখখানি দেখতাম। কিন্তু আজ নিজের অধিকার নিয়ে দেখবো।
— মানে….. এই বাড়িতে ঘুমে থাকা অবস্থায় যতোবার মনে হয়েছে যে আমার মুখের উপর কারোর গরম নিশ্বাস পরছে সেটা আপনার ছিলো ? (বিস্মিত হয়ে)
— জ্বী হ্যা। (আমার মাথায় টোকা মেরে)
— কিন্তু আমি যে রুম লক করে ঘুমাতাম। (মাথা ডলতে ডলতে)
— পাগলি একটা। আমার আয়াতের রুমের চাবি আমার কাছে থাকবেনা এও কি কখনো সম্ভব ? (একটা শয়তানি হাসি)
— ……….. (চোখ দু’টো ছোট করে তাকালাম)
— যাও অজু করে আসো, নামাজ পরবো। (হাসতে হাসতে)
.
তারপর আমরা একসাথে দুই রাকাত নফল নামাজ পরলাম। বিছানাতে শুয়েও পরলাম। আরিয়ানের রুমের বেড টা কিং সাইজ। আমার ডান পাশে আরিয়ান আর বাম পাশে আয়াত। আমি সোজা হয়েই শুয়ে ছিলাম কিন্তু আরিয়ান, আমার দিকে ফিরে ওর বাম হাত নিজের মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে আছে। আমাকে একমনে দেখছে আর টুকটাক কথা বলছে। আমিও কথা বলতে বলতে ঘুমায় গেলাম।
.
.
সামনে সুবিশাল গৌধুলী প্রান্তর। আমি মেঘের রাজ্যে সোনার পালঙ্কে বসে আছি। আমার কাঁধে সাতরঙা বড় একটি প্রজাপতি। আমি ওকে বলছি, “কখনো কাউকে ভালোবেসো না। এই হৃদয় বিদারক অনুভুতি তোমার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ ঘটাবে। তোমাকে এ অনলে পুড়িয়ে ছার ক্ষার করে দিবে। তবুও তুমি বলতে বাধ্য হবে যে, এই কষ্টের আরেক নাম অমৃত। সেই অমৃত কি না শুধুমাত্র প্রেমের সাধকেরাই নিজ বুকে সাগরের ন্যায় প্রসারিত করতে পারে।”
.
হঠাৎ চোখটা খুলে ফেল্লাম। ওহ, তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম। এ আমি কাকে প্রেমের পাঠ পড়াচ্ছিলাম ? প্রজাপতি,,,,! চারিদিকে বেশ মাতাল করা ঘ্রাণ পাচ্ছি। রুম টায় ড্রিম লাইটের আলোতে মোহময় এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জানালার ফাঁক গলে ভোরের আবছা আলো বিনা অনুমতিতে ঢুকে পরছে। কিন্তু এই স্বর্গীয় অনুভূতি আমি অনুভব করতে পারছি না। কারন কেন জানি আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো পাতাল গহ্বরে আছি। আর আমার শরীরের উপর পুরো পৃথিবীর ভার রয়েছে। আমি যেন নিঃশ্বাস টাও নিতে পারছি না।
.
একটু উঠতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। হাত পা নড়াতে চাইলাম, কিন্তু তাও পারলাম না। মাথাটা হাল্কা উঁচু করে দেখলাম, ছেরে দে মা কান্দে বাঁচি অবস্থা। আয়াত ওর হাত দিয়ে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে, আর পা আমার পেটের একটু উপরে। তাও বিষয়টা মেনে নেওয়া যেত কারন ওর ভার আমি সহ্য করতে পারি। বিষয়টা মানতে পারছি না আরিয়ানের জন্য। সে আমার বুকের উপর দিয়ে তার হাত দ্বারা আয়াতকে ধরে রেখেছে। এবং পা তুলে দিয়েছে আমার তলপেটের উপর মানে আয়াতের পা রাখা যেখানে শেষ, আরিয়ানের সেখানে শুরু। এখানেই শেষ না। আরিয়ান ওর মাথাটা রেখেছে আমার কাঁধের উপর। আমাকে চিড়েচ্যাপ্টা করে আরামে দুই বাপ-বেটা ভুশভুশ করে ঘুমাচ্ছে।
.
উফফ্ এসব কি সহ্য করা যায় ? আমার বায়ান্ন কেজি ওয়েটের শরীর কি এসব মেনে নিতে পারে।
— আআআআআআআআ
দিলাম এক জোরে করে চিল্লানি। সাথে সাথে বাপ-বেটা লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে পরলো। আরিয়ান হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আয়াত তো রীতিমতো ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আমি কোনে মতে আমার অসার শরীর টাকে নিয়ে উঠে বসলাম। রাগে গজরাতে গজরাতে ওদেরকে চিল্লায়ে বললাম,
— এভাবে কেউ একটা মেয়ের উপর হাত পা উঠায়ে ঘুমায় , আপনারা কি মানুষ ? আমার জান একেবারে যায় যায় অবস্থা।
— মানে ? (মাথা চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞাসা করলো আরিয়ান)
— আবার মানে জিজ্ঞাসা করছেন ! (আমি আরও বেশি জোরে চিল্লায়ে বললাম)
.
আমার কথা শুনে আরিয়ান দু’চার সেকেন্ড চুপ করে থাকলো। আর আয়াত তো ভ্যাবাচ্ছেই। তারপর হঠাৎ করে আরিয়ান হু হা করে জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে শুরু করে দিলো। আয়াত আরিয়ানের হাসি দেখে কান্না থামিয়ে দিলো। এ হাসির অর্থ বুঝলো কি না কে জানে, কিন্তু সেও হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে ওদের দুজনার বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এসব আমি আর সহ্য না করতে পেরে ওদের বালিশ দিয়ে মারা শুরু করে দিলাম। এতে যেন ওরা আরও মজা পেয়ে গেল। আমাকেও বালিশ দিয়ে মারা শুরু করে দিলো। হাসছে আর মারা মারি করছে। রাগে গজগজ করতে করতে আমি ওয়াশরুমে ঢুকে পরলাম। যত্তসব পাগলা গারদের বাসিন্দা।
.
.
সকালে একসাথে নাস্তা করতে বসলাম সবাই। আমিই আজ নাস্তা তৈরী করেছি। এতে মা যেন একেবারে খুশিতে পঞ্চমুখ। আর বাকি সবার তো বাড়িতে পায়েশ রান্না করলে কোনো কথায় নায়। সকালটা আমার নিজের কাছেও খুব মুগ্ধময় লাগছে। কেন জানি এই অহংকারী সকালকে আমার জানিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে যে, এটা আমার সংসার। আমার সুখের সংসার।
.
চোখের এক একটা পলক পরার মতো, এক একটা দিনও কেটে যেতে থাকলো। এই বাড়ি, বাড়ির মানুষ জন, তাদের ভালোবাস, আমার প্রতি এতো খেয়াল আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখালো। বাবা মায়ের আদর, তাদের পাগলামি আমাকে তাদের অভিভাবক হিসাবে দাঁড় করালো, যেন তারা চাইছে আমি ওনাদের শাসনে রাখি। আমার কলিজা তো আছেই। আমাকে প্রতি মূহুর্তে মাতৃত্বের স্বাধ জাগাতে। ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে আমাকে জরিয়ে ধরে আদর করে। সারা বাড়িতে বুক ফুলিয়ে দুষ্টমি করে, আরিয়ানের আদরের শাসন থেকে বাঁচতে আমার বুকে লুকিয়ে পরে। আমার বুক থেকে আরিয়ান ওকে টেনে বের, বকা দেওয়ার অভিনয় করতে করতে শব্দ করে হেসে ফেলে।
.
এসবে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আরও আমাকে ফাঁদে পাতা জালের মতো আটকে রাখছে আরিয়ান। আমার প্রেমে পড়ে সে এখন পাগল প্রায়। তার প্রথম প্রেম আমি। আর প্রথম প্রেমের ছোট ছোট ভুল গুলো সে একটুও গুনে রাখে না। যখন আমি রান্না ঘরে কাজে ক্লান্ত, সে তখন হুট করে আমার শরীরে জাফরান গুলা পানি ছিটিয়ে দিবে। সবার সামনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে চোখ মারবে। বাড়ি থেকে ডিউটির জন্য বেড়িয়েও কি ভেবে আবার ফিরে আসবে। আমার বাঁধা চুল গুলোর মধ্যে থেকে চুলের কাটা টান মেরে বের করে জানালা দিয়ে ফেলে দিবে। হঠাৎ হঠাৎ আশাতীত অবাঞ্চিত স্পর্শ গুলোর সীমাবদ্ধতা ভুলে যাবে……
·
·
·
চলবে………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here