#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২
রাত দশটায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ইউসুফ চৌধুরী ফিরলেন। রুমু ড্রয়িংরুমে বসে তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আজকে সারাদিন সে একবারও নিজের ঘরে যায় নি। অনিক কি করছে না করছে তার কোন খোঁজ খবর নেয় নি। এমনকি ও বাড়িতে আছে নাকি নেই তাও জানে না। জানার প্রয়োজনও মনে করে নি। কি দরকার ঐ মাতালটার খবর নেওয়ার। হয়ত বসে বসে মদ গিলছে। তাছাড়া সে যখন এখানে থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে তখন আর এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন মানে হয় না।
ইউসুফ চৌধুরী চেইঞ্জ করে রুমুকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো রুমু। কথাটা কীভাবে জানাবে বুঝতে পারছিলো না। পরোক্ষনেই মনে হলো এরা যদি তার সাথে এতবড় প্রতারণা করতে পারে তবে সে কেন স্পষ্ট ভাবে নিজের মতামত জানাতে পারবে না? কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো। ইউসুফ সাহেব এখনো খান নি। রহমানকে তার খাবার নিয়ে আসার কথা বলছিলেন। রুমু লজ্জিত কন্ঠে বললো,’আপনি খেয়ে নিন বাবা। আমি পরে কথা বলবো।’
বাসায় ফিরে রুমুকে সোফায় বসে থাকতে দেখেই ইউসুফ চৌধুরী বুঝতে পেরেছেন রুমু এখন হলে এখনই বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তাই যাবতীয় কথাবার্তা যত দ্রুত সম্ভব সেরে ফেলতে চাইলেন। বললেন,’বসো। খাবার আসতে আসতে কথা সেরে ফেলি।’
রুমু চেয়ারে বসলো। ইউসুফ সাহেব কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে খাটের ওপর বসলেন। বললেন,’তুমি কি বলবে তা আমি জানি মা। কিন্তু আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই। তুমি হয়ত ভাবছো আমি জেনে শুনে কি করে তোমার এতবড় সর্বনাশ করলাম। ভাবছো আমার মত, ঠক, বাটপার, প্রতারক আর নেই। কি ভাবছো না?’
রুমু লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো। ইউসুফ সাহেব হাসলেন। বললেন,’ভাবাটাই স্বাভাবিক। না ভাবলে অস্বাভাবিক হতো। আসলে তোমাকে আমার এত পছন্দ হয়েছিলো যে আমি ভুলেই গেছিলাম এমন লক্ষ্মীকে ঘরে রাখার মতন কপাল আমার নেই।’
গলা ধরে এলো ইউসুফ সাহেবের। রুমু অবাক হলো। উনি কি কাঁদছেন? রুমুর হতবিহ্বল চেহারা দেখে নিজেকে সামলে নিলেন ইউসুফ চৌধুরী।বললেন,’যাইহোক। তুমি যখন থাকবে না সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো আমি তোমাকে আটকাবো না। কাল সকালেই রহমান তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আর তোমার বাবাকে বলো তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন।’
রুমু কিছুই বুঝলো না। সে ভেবেছিলো ইউসুফ চৌধুরী আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু সাফাই দিবেন। কিন্তু তিনি তো কিছুই বললেন না? কি জরুরী কথা বলবেন বলেছিলেন তাও বললেন না। কেবল মাফ চাইলেন! মনে মনে কৌতুহল বোধ করলো সে। নিরবে মাথা নিচু করে বসে রইল। ইউসুফ সাহেব পুনরায় মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’তোমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মা। লজ্জা তো আমার পাওয়া উচিৎ। আমি নিজের স্বার্থে তোমার জীবনটা বরবাদ করে দিলাম। রহমানের মুখে আমি সব শুনেছি। বদমাইশটা গতকাল রাতেও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ছিলো। জেনেশুনে এমন ছেলের সাথে তুমিই বা সংসার করতে যাবে কেন? ততুমি সময় থাকতে সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমি তোমার মতামতকে সম্মান করি। তাই তোমাকে আমি জোর করবো না!’
খাবার এসে গেছে। ইউসুফ চৌধুরী খেতে বসলেন। রুমু বেরিয়ে আসতে চাইলো। বেরিয়ে আসার সময় ইউসুফ সাহেব রুমুর পানে চেয়ে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার খাওয়া দাওয়া হয়েছে তো মা?’
-‘জি।’
আজকে সারাদিনের অভুক্ত ইউসুফ সাহেব। সকাল রুমুর সাথে দেখা হওয়ার পর সারাদিন অনিকের ব্যপারে অনেক ভেবেছেন তিনি। মেয়েটাকে আটকে রেখে শুধুশুধু তার জীবনটা নষ্ট করার কোন মানে হয় না। এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে বিষণ্ণ এতটাই ছিলেন যে খাওয়ার রুচি হলো না।
রুমু বেরিয়েই যাচ্ছিলো হঠাৎ সাথীকে ছুটে ইউসুফ চৌধুরীর ঘরে ঢুকতে দেখে পুনরায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেলো সে।
-‘মামা। ভাইয়া অজ্ঞান হয়ে গেছে। জলদি আসেন।’
ইউসুফ সাহেব শংকিত মুখে আধখাওয়া ভাতের প্লেট রেখে সাথীর পেছন পেছন ছুটে বেরিয়ে গেলেন। ভাইয়া বলতে সাথী অনিকের কথাই বলেছে সেটা বুঝতে রুমুর অসুবিধে হলো না। সবার পেছন পেছন সেও দৌঁড়ে গেলো।
অনিক মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ইউসুফ চৌধুরী এবং রহমান পাঁজকোলা করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তহুরা বানু মরাকান্না জুড়ে দিয়েছেন। সাথীও মায়ের সুরে সুর মিলিয়ে কান্না শুরু করে দিলো। এক কোনায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে সবার কাণ্ডকারখানা দেখছে রুমু। ইউসুফ চৌধুরী ক্রমাগত সাথীকে ধমকে যাচ্ছেন।
-‘আজকে সারাদিন ওর জ্বর আমাকে জানালি না কেন? ‘
-‘ভাইয়ার তো গত দুতিনদিনই জ্বর ছিলো। আপনাকে জানাতে বারণ করেছিলো তাই..!’
-‘আশ্চর্য! ও বারণ করলো আর তুই শুনলি।’
-‘গতদুদিন তো এতবেশি ছিলো না। আজকেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়েছে। বোধহয় কাল সারারাত মেঝেতে শুয়ে বুকে ঠান্ডা লেগে গেছে। ‘
-‘তোরা সব কোথায় ছিলি? বাড়িতে এতগুলো লোক থাকতে ও মেঝেতে ঘুমিয়েছিলো কেন? কারো কোন খবর নেই?”
-‘মামা কাল রাতের পর থেকে আমরা তো আর কেউ ভাইয়ার ঘরে যাই নি। আমি ভার্সিটিতে ছিলাম, মা ঘরের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিলো..”
‘তাই বলে তোরা কেউ ওর খবর নিবি না? ছেলেটা কালরাত থেকে মেঝেতে পড়ে আছে কারো কোন খবর নেই?’, হঠাৎ করেই ইউসুফ সাহেব থমকে গেলেন। ছেলের অবস্থা দেখে এতটাই ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলেন যে সহজ কথাটা তার মাথায় ঢুকে নি। কালকে সারারাত তো অনিকের ঘরে রুমু ছিলো। কথাটা মাথায় আসতেই বিব্রত হলেন তিনি। অনিকের ঠান্ডা একেবারেই সহ্য হয় না। একবার জ্বর হল সেটা একেবারে নিউমোনিয়া পর্যন্ত না গিয়ে ছাড়ে না। সেই সময়টা তে তাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি চলে। রহমান ইতোমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে খবর পাঠিয়েছে। আধঘন্টার মাঝেই অনিককে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয়ে গেলেন ইউসুফ চৌধুরী আর রহমান।
★
সারারাত হাসপাতালে কাটিয়ে ইউসুফ চৌধুরী পরেরদিন বেলা বারোটায় বাসায় ফিরলেন। ড্রয়িংরুমে সাথী, তহুরা বানু এদের সবার সাথে রুমুও সারারাত জেগে বসে ছিলো। বাড়ির একজন সদস্যকে গুরুতর অবস্থায় রাত বারোটার দিকে হস্পিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন অবস্থায় সে নিশ্চই অমানুষের মত পড়ে পড়ে ঘুমাতে পারে না?
ইউসুফ চৌধুরী ফিরতেই তহুরা বানু ছুটে গেলেন। তার পেছন পেছন সাথী। রুমু সোফা থেকে উঠে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ইউসুফ সাহেব কি বলেন তা শোনার জন্য কান পেতে রইলো।
-‘কি অবস্থা এখন?’
-‘ভালো না। লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে।’
বলতে না বলেতেই ইউসুফ চৌধুরী সোফায় এলিয়ে পড়লেন। নিঃশব্দে কাঁদছেন তিনি! খবরটা শোনার পর হার্টবিট মিস হয়ে গেলো রুমুর! সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ইউসুফ সাহেব দুহাতে মুখ ঢেকে আত্মসংবরণ করলেন। এই প্রথম রুমুর ভেতরটা অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটা মানুষ সারারাত মেঝেতে পড়েছিলো সে ফিরেও তাকায় নি। স্ত্রী হিসেবে না হোক মানুষ হিসেবে বিচার করলেও ব্যাপারটা খুবই অমানবিক। ইউসুফ চৌধুরী ওকে বসে থাকতে দেখে বললেন,’ তোমাকে আর আটকে রেখে কি লাভ মা? আমি রহমানকে বলে দিচ্ছি। ও তোমাকে পৌঁছে দিক।’
এইমুহূর্তে বাড়ি ফিরে যাওয়াটা যে সেদিন রাতের চেয়েও বেশি অমানবিক হবে সেটা বুঝতে পেরে রুমু বললো,’থাক বাবা। আপনার ছেলে সুস্থ হলে এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আমি বরং এখন থাকি।’
ইউসুফ চৌধুরী উদ্ভ্রান্তের মত বললেন,’থাকবে? বেশ থাকো।’ তারপর ফ্রেশ হয়ে রহমানকে গাড়ি বের করতে বললেন পুনরায় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। তহুরা বানু এবং সাথী দুজনেই হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। রুমুর যেতে মন চাইছে। কিন্তু বলতে লজ্জা হচ্ছে। তার জন্যই অনিকের এই অবস্থা সেই কথা বুঝতে এই বাড়ির আর কারো বাকি নেই। ইউসুফ সাহেব সেইজন্যই হয়তবা এই সিরিয়াস মুহূর্তেও তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন। শেষমেশ সাথীকে ডেকে বললো,’বাবা একটু বলো না। আমিও তোমাদের সাথে হাসপাতালে যাবো।
ইউসুফ চৌধুরী গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন। সাথী ভয়ে ভয়ে ডাক দিলো,’মামা?’
-‘কিরে?’
কন্ঠস্বরে কোন তেজ নেই ইউসুফ চৌধুরীর। ছেলের দুঃখে কাতর হয়ে আছেন তিনি। পাছে তাকে ধমক খেতে হয় সাথী ইতস্তত করে বললো,’ভাবি হস্পিটালে যেতে চাইছিলেন?’
-‘আমি তো এক্ষুনি যাচ্ছি। তুই থাক, আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি তোর ভাবি রেডি হলে তোদের নিয়ে যাবে।’
রুমু আড়াল থেকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো সে তৈরী আছে। সাথী বলল,’ভাবি রেডি আছেন।’
-‘ঠিক আছে আসতে বল।’
★
সরু দুটো নল অনিকের নাকের ভেতর দিয়ে ঢোকানো হয়েছে। ইমার্জেন্সী কেবিনে অচেতনভাবে পড়ে আছে তার দেহটি। হাতের ক্যানুলা ফিট করা। পরনে হাসপাতালের পোশাক। বাহাত্তর ঘন্টার ডেডলাইন দিয়েছে ডাক্তার। বারোঘন্টা অলরেডি শেষ। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। মেডিকেল বোর্ড বসনো হয়েছে। ইউসুফ সাহেব পাগলের মত একেকবার একেক ডাক্তারের পেছন পেছন ছুটছেন। ঢাকা শহরের বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি যথেষ্ট ক্ষমতাবান এবং ব্যক্তিত্বশালী। খুব কাছ থেকে যারা তাকে দেখেছেন তাদের কাছে তাঁর আজকের এই অসহায় চেহারা সম্পূর্ণ অপরিচিত। গম্ভির, রাশভারী, বলিষ্ঠ স্বভাবের একজন মানুষকে সন্তানের অসুস্থতা কতটা অসহায় করে দিতে পারে ইউসুফ সাহেব তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। পারলে ডাক্তারদের হাতে পায়ে ধরেন তিনি। তার এই একটি মাত্র ছেলে। একে বুকে নিয়েই এত দুঃখ কষ্টের পরেও বেঁচে আছেন তিনি। যতই ছেলের ওপর রাগ থাকুক না কেন অনিকের কিছু হলে তিনি বাঁচবেন না।
রুমু স্থিরদৃষ্টিতে কাচের দরজার ভেতর দিয়ে জ্ঞানহীন, নির্জীব মানুষটার দিকে চেয়ে আছে। এই মানুষটা তার স্বামী! জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে আছে! রুমুর কি খুশি হওয়া উচিৎ? আপদ নিজে থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু কেন সে খুশি হতে পারছে না? তাঁর কারনে মানুষটার এই অবস্থা তাই? তা না হলে কি রুমু কি চাইতো মানুষটা মরে যাক? কক্ষনো না! রুমু কক্ষনো এমনটা চাইতো না। সে এতটাই অমানুষ? না! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল রুমু। ইউসুফ চৌধুরী কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরও পায় নি। হঠাৎ করেই তার দুহাত চেপে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। অশ্রুসিক্ত নয়নে ডুঁকরে উঠে বললেন,’আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি মা। তার শাস্তি আমার অনিক পাচ্ছে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। তোমাকে বাবাকে খবর দাও। আমি তার পা ধরে ক্ষমা চাইবো। তা না হলে আমার ছেলেটা মরে যাবে না।’
রুমু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। ইউসুফ সাহেবকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’আপনি শান্ত হোন বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার জন্যই তো আজকে….!’
তাকে পুরোটা শেষ করতে না দিয়ে ইউসুফ চৌধুরী বললেন,’তোমার কোন দোষ নেই মা। এসব আমার পাপের শাস্তি। তোমার জীবনটা আমি ধ্বংস করে দিয়েছি।’
অসহায় পিতার আর্তনাদ রুমুর সব রাগ, অভিমান নিমিষেই দূর করে দিলো। সে মনে মনে প্রার্থনা করলো,’হে খোদা। তুমি উনাকে সুস্থ করে দাও। আমি কখনোই তার মৃত্যু সহ্য করতে পারব না।’
★
পনেরো দিন বাদে অনিককে বাসায় নিয়ে আসা হলো। জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত রুমু রোজ হাসপাতালে তাকে দেখতে গেছে। তবে দেখেই চলে এসেছে। যার সাথে থাকবে না তার সাথে মায়া বাড়িয়ে লাভ কি? অনিকের অসুস্থতার খবর টিভি, নিউজপেপার সব জায়গায় ছাপা হয়েছে। রুমুর বাবা আসিফ ইকবাল খবর পেয়ে সস্ত্রীক হাসপাতালে অনিককে দেখতে গিয়েছিলেন। রুমু অবশ্য তখন ছিলো না। থাকলেও হাসপাতালে অন্তত অনিকের ব্যপারে কিছু জানাতো না সে। কারণ বিপদের মুহূর্তে এসব নিয়ে ঝামেলা হলে খুবই বাজে দেখাতো। ইউসুফ চৌধুরী অবশ্য বারবার করে রুমুকে তার বাবার সাথে ফিরে যেতে বলেছিলেন, রুমু যায় নি। অনিকের পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করছিলো।
★
রুমু ভেবেছিলো তার চলে যাওয়ার কথাটা অনিককে জানিয়ে দিয়ে তারপর যাবে। কিন্তু কিসের কি? হাসপাতাল থেকে ফিরে সেদিন দুপুরেই অনিক মদ নিয়ে বসে পড়লো। কারো বাধাই মানলো না। ইউসুফ সাহেব হতাশ হয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে গেলেন। তার নিষেধ কোনকালেই শোনে নি অনিক। রুমুর মেজাজ বিগড়ে গেলো। আশ্চর্য মানুষ তো! নিজের জীবনের মায়াটুকু পর্যন্ত নেই? শরীরের এই অবস্থায় নেশা করতে বসেছে? তাঁর জন্য তার বয়স্ক বাবার কতটা খারাপ অবস্থা হয়েছি সে কি জানে না? ঘরে ঢুকে দেখলো অনিক খাটে বসে গ্লাসে মদ ঢালছে। রুমু গলা খাঁকারি দিলো। অনিক চোখ পিটপিট করে বললো,
-‘কি চাই?’
-‘কিছু না।’
-‘তাহলে আমার ঘরে ঢুকেছো কেন? আমার ঘরে আমার পারমিশন ছাড়া ঢোকা নিষেধ? তুমি কি নতুন এসেছো?’
রুমুর ঠোঁট বাকালো। দু পয়সার মুরোদ নেই, বাপের টাকায় বসে বসে মদ গিলছে তার ঘরে ঢুকতে নাকি আবার পারমিশন লাগবে। কিন্তু পরের কথাটি শুনে অবাক হয়ে বলল,’নতুন মানে?’
অনিক বুঝতে পারলো তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি নতুন কোন মেইড নয়। হয়ত আত্মীয়টাত্মীয় হবে। কিন্তু একে কোনদিন দেখেছে বলে তো মনে হয় না? নেশা এখনো খুব বেশি ধরে নি তার। বললো,’আপনার পরিচয়?’
আকাশ থেকে পড়লো রুমু। বাহ! কার কাছ থেকে বিদায় নেবে বলে অপেক্ষা করছিলো সে? এ তো নিজের বউকেও চিনতে পারছে না। মেজাজ চেপে রেখে বললো,’আমি রুমু।’
-‘কোন রুমু? আমি কি আপনাকে চিনি?’
-‘আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিলো।’
-‘তাই নাকি? বাহ্! বেশ! তুমি তো দেখতে ভালোই সুন্দরী তবে আমাকে বিয়ে করলে কেন? আমার বাবার টাকার জন্য?’
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো রুমুর। বিষের মত ফুটতে থাকতো কথাটা। অনিক আরেক পেগ গিলে বললো,’শোনো তুমি যা করেছো একদম ঠিক করেছো। আমার বাবার প্রচুর টাকা। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এত টাকা। তুমি যদি একবার তাকে পটিয়ে তাঁর মন জয় করতে পারো তবে বৃদ্ধ বয়সে তার এই বিপুল পরিমান টাকা পয়সার মালিক একমাত্র তুমিই হবে। আমার মত মাতালের হাতে তিনি এত কোটি কোটি টাকা দিয়ে যাবেন না। সো ট্রাই টু ইম্প্রেস হিম।’
রুমুর মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। এমন অকালকুষ্মাণ্ড ছেলের সাথে কেন তার জীবনটা জড়ালো? কোন অন্যায়ের শাস্তি সৃষ্টিকর্তা তাকে দিচ্ছেন? অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠলো সে। একরাশ ক্ষোভ ফেটে পড়লো তার কন্ঠে,’ছোটলোক। লজ্জা করে না তোমার এসব বলতে? কোন অধিকারে তুমি আমাকে এসব বলছো? তোমাকে এতবড় স্পর্ধা কে দিলো? নিজের দুপয়সার মুরোদ নেই আমায় জ্ঞান দিতে এসেছে।’
অনিকের মুখটা চুপসে বোকা বোকা হয়ে গেলো। তার সৎপরামর্শের বিপরীতে রুমুর রেগে যাওয়ার কোন যোগসূত্র সে খুঁজে পাচ্ছে না। এই মেয়ে যদি তাকে টাকার জন্য বিয়ে না করে তবে কেন করেছে? স্বেচ্ছায় কোন মেয়ে তার মত মদ্যপ, যা-তা ধরনের ছেলেকে নিজের গলায় ঝোলাবে না। তবে কি ইউসুফ চৌধুরী তার নিষ্কর্মা, বখে যাওয়া ছেলের বাজে ইতিহাস এদের কাছে গোপন করেছেন? আফসোস ফুটে উঠলো তার চেহারায়। চুকচুক জাতীয় শব্দ করে বলল,’আমি বুঝতে পেরেছি ইউসুফ চৌধুরী তার ছেলের ইতিহাস তোমাদের কাছে গোপন করে গেছেম। কিন্তু তোমরাই বা কেমন বলোতো? তোমার বাপ ভাই নেই? তারা কন্যা সম্প্রদানের আগে যাচাই করে দেখবে না কেমন পাত্রে সম্প্রদান করছেন?’
রুমুর কান্না পাচ্ছে। সেই প্রশ্নের উত্তর তার কাছেও ধোঁয়াশা। বাবা কি জেনে শুনে তাকে এই নেশাখোর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে? না বোধহয়। বাবা যদি জানতেনই তাহলে ইউসুফ চৌধুরী কেন বারবার তার বাবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাহলে কি রুমু ধরে নেবে নেহায়েত বন্ধুপ্রীতির কারণেই বাবা তাঁকে অন্ধবিশ্বাস করেছেন?
-‘তোমার বাবা আমার বাবার ছোটবেলার বন্ধু।’
অনিক হো হো হেসে উঠলো। বিশ্রী, কর্কশ, গা-জ্বালানো হাসি। বললো,’তারমান বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে তোমাকে বলির পাঠা করা হয়েছে? ইউসুফ চৌধুরী তাহলে আজকাল মানুষকে ঠকানোও শুরু করে দিয়েছে। বাহ! ভালো! শোনো, তোমাকে একটা পরামর্শ দেই…’
-‘আমি তোমার কাছে কোন পরামর্শ চাইতে আসি নি। আমি কাল চলে যাচ্ছি।’
-‘রাইট ডিসিশন। যাও। যাওয়ার আগে যদি ইচ্ছে হয় আমার কপালে একটা লাথি মেরে যেতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। আচ্ছা, তোমার নামটা যেন কি?’
রুমু হাঁ করে অনিকের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। অনিক লজ্জিত কন্ঠে বললো, ‘না বলতে চাইলে থাক।’
-‘রুমু!’
-‘বাহ! বেশ ভালো নাম। রুমু, চুমু।’
এতক্ষনে নেশারঝোঁক ভালোভাবে চেপে বসেছে। আর চোখ খুলে রাখতে পারলো না সে। এইঅবস্থাতেও একেরপর এক মদ ঢালছে আর গিলছে। রুমু বেরিয়ে গেলো। এই ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ঘৃনা হচ্ছে। তার চেয়ে বেশি ঘৃনা হচ্ছে সামনের মানুষটাকে। এ নাকি তার স্বামী। ছিহ! একে স্বামী বলে স্বীকার করার চেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মরে যাওয়াও অনেক ভালো। তবে রুমু মরবে না। তার সব প্রশ্নের উত্তর না জানা পর্যন্ত সে মরবে না। বাবা কেন তাকে এভাবে ভাসিয়ে দিলো? বন্ধুর প্রতি তার অন্ধবিশ্বাস থাকতেই পারে কিন্তু তাই বলে কি নিজের মেয়ের প্রতি তার কোন কর্তব্যবোধ নেই?
.
.
.
চলবে