ক্যাকটাস পর্ব ১০+১১

১০+১১
ক্যাকটাস
পর্ব ১০
Writer Taniya Sheikh- Tanishq

মনুষ্য জীবনের সাথে ঋতুর দারুন এক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ঋতু বদলে কখনো চৈত্র আসে তো কখনো শ্রাবণ। মানুষের জীবন পরিক্রমাও ঠিক তেমনি। কখনো আসে দুঃখ আবার কখনো বা সুখ। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সেই বিখ্যাত চরণ বলি,”কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে? সুখ দুঃখ দু’টোই জীবনের অনিবার্য সত্য। দুঃখ ছাড়া সুখের মধুরতা কোথায়? কোথায় বা এর প্রয়োজনীয়তা তীব্র? দুঃখের চোরাবালিতে পড়লেই তো বোঝে সব সুখ আহরিত করার প্রয়োজনীয়তা৷ বর্ষার করুন ক্রন্দন শেষে পৌষের কুয়াশা উঁকি দিচ্ছে দেশজুড়ে। ভোরের সুমধুর আজানের প্রতিধ্বনিতে পরিবেশে বিরাজ করছে অন্য এক পবিত্রতা। ডাগর হরিনী নয়না এক অষ্টাদশী অপলক চেয়ে আছে সুউচ্চ অট্টালিকার পঞ্চম তলার বারান্দা থেকে। ভাবছে আকাশ এতো শূন্য তবুও সে বিশাল কতো! আর আমার ভেতর নেই কোনো বিশালতা, আছে শুধু সমস্ত জুড়েই শূন্যতার হাহাকার। কুয়াশা কেটে গেলে আকাশটা নীলাকাশ হয়ে উঠবে। নীল আলোর বিক্ষেপণে আকাশের সর্বত্র নীলের ছড়াছড়ি। রঙে রাঙিয়ে উঠবে তার বুক। আর আমার! তানিস্ক

চাদরে জড়ানো গুটিশুটি হয়ে বসে থাকা নীরা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। আজ চারটা মাস হলো দুর্বিষহ জীবন ছেড়ে মুক্ত হয়েছে সে। তবুও ভুলতে পারছে না কিছুই। আহনাফের পরিণতি, আহনাফের শেষসময়ের স্মৃতি তাকে যেমন ব্যথিত করে। তেমনি আহনাফের নিষ্ঠুর আচরণ মনে হতেই মুহূর্তে আবার সব ব্যথা ঘৃণার জলে ধুয়ে যায়। কিছু মানুষ অপছন্দের হয়েও আমাদের জীবনের একাংশ দখল করে নেয়। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে। না যায় ভোলা আর না যায় সহ্য করা। আহনাফের থেকে মুক্তি চেয়েছিল নীরা। মনেপ্রাণে চেয়েছিল মুক্তি। কিন্তু যখন দেখল সে আশা ক্ষীণ, নিরুপায় হয়ে মেনে নিতে চাইল অবশেষে। ভাগ্য বড়ো পরিহাস করলো তার সাথে৷ যা চাইল তা তো পেল, অথচ ততদিনে মনোবল তার ধুলোয় মিশেছে। আত্মীয় স্বজন সবাই পরিত্যাগ করলো নিষ্ঠুরভাবে তাকে। কী দোষ তার? সে তো নিরব ছিল, সয়েছিল। তবুও তাকে নিতে হলো অলক্ষির কলঙ্ক। তবে কী সত্যিই সে অলক্ষুণে, অপয়া! সে ধর্ষিতা হলো তাতেও তার দোষ, সে সব মেনে নিল নিরুপায় হয়ে তাতেও তার দোষ, আহনাফ খুন হলো তাতেও তার দোষ, আহনাফের বাবা পাগল হলো তাতেও তার দোষ, জরিনা খালার মাথা খারাপ হলো তাতেও যে তারই দোষ দিল সবাই। কেউ তার কথা কেন একবারও ভাবলো না? কলঙ্কের বিষ গলায় ঢেলেছে তবুও দোষ কেন তারই বার বার? এ কেমন বিচার সবার? হয়ে দেখো রেপ, তারপর মেনে দেখো তাকে। মন থেকে মেনে নিয়ে দেখাও তার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। আমিও তো দেখি কতোবড় মনের পতিপ্রণা স্ত্রীলোক তুমি। নীরা দাঁত কামড়ে ফুঁসে ওঠে ঐসব মানুষের উপর,যারা ঐদিন সব দোষ তাকেই দিয়েছিল।

” নীরু!”

হাতে টুথব্রাশ আর পেষ্ট নিয়ে এগিয়ে আসে শারমিন। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে সে। নীরাকে খোলা জানালায় ওভাবে কুঁকড়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রুকুঞ্চন করে বললো,

” অসুখ বাধাবি নাকি? এমনিতেই তোর এলার্জি জনিত সমস্যা। তারউপর এভাবে জানালা খুলে বসে আছিস ঠান্ডায়? এই নীরু!”

শারমিন লক্ষ্য করে নীরার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেজাজ চড়িয়ে হাতের টুথব্রাশ,পেষ্ট ফ্লোরে ছুড়ে মারতেই নীরা ভয়ে মুখ তুলে তাকায়। শারমিন চড়া গলায় বলে,

” সমস্যা কী তোর? এতো মরাকান্না কার জন্য করিস? ঐ শয়তানটার জন্য? ”

” আপু এভাবে বলো না। মরা মানুষকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে নেই।” নীরা নাক টেনে টেনে বলে

” চুপ কর! বেশি জ্ঞান দিবি না বলে দিচ্ছি? তোকে কতোবার করে বললাম, যা মেহুর সাথে বেরিয়ে আয়। না তুই গেলি না। সারাটা দিন বসে বসে মরাকান্না করিস। কেন নীরু? তুই কী ভেবেছিস জীবন এভাবেই চলবে তোর? এভাবে জীবন চলে না নীরা! আমি তোকে এভাবে শেষ হতে দেব না। যেমন টেনে বের করে এনেছি ঐ নরক থেকে। তেমনি এই মুখ থুবড়ে পরা জীবন থেকেও তোকে বের করব৷ এভাবে কান্নাকাটি মোটেও সহ্য করবো না আমি।” চিৎকার করে বলে শারমিন

” আমাকে কেন টেনে আনলে? বিষ দিয়ে আসতে খেয়ে মরে যেতাম৷ এভাবে বাঁচার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। ”

শারমিন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে চড় বসিয়ে দেয় নীরার গালে। নীরা দূর্বল শরীরে উপুড় হয়ে পড়ে। শব্দ করে কাঁদে ওভাবেই। শারমিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বোনকে জড়িয়ে ধরে। থমথমে গলায় বলে,

” আমাকে মাফ করে দে নীরু৷ আমি সব বুঝেও তোকে জোর করছি বার বার। কিন্তু কী করবো আমি? আমার যে তোর কষ্ট সহ্য হয় না আর। এভাবে তোকে কষ্টের সমুদ্রে ডুবতে দিলে আর যে বাঁচাতে পারবো না তোকে। আমি চাই তুই আবার স্বাভাবিক হ। আমাদের আগের হাসিখুশি নীরু হয়ে যা। হবি না নীরু তুই আগের মতো?”

” আমি পারবো না আপু। আমার মনে, শরীরে কোথাও সেই জোর নাই রে আপু। আমি সব হারিয়ে সর্বশান্ত আজ। কিসের জোরে হাসবো আমি? কোন সুখে হাসব আমি আপু?” শারমিনের বুকে ডুকরে কাঁদে নীরা।

” এমন কেন ভাঙছিস তুই? সবকিছুকে অ্যাকসিডেন্ট ভেবে নে। মানুষের জীবনে কী এমন অ্যাকসিডেন্ট হয় না? তাই বলে কী সবাই সেটা নিয়ে শোক করে বসে থাকে? স্ট্রং হ নীরু। নিজের জন্য বাঁচ। বাঁচার মতো বাঁচ বোন।”

” আমার সাথে কেন এমন হলো আপু? আমি কী পাপ করেছিলাম যার কারনে আজ আমি এতোটা নিগৃহীত। আল্লাহ আমাকে বলে দাও! বলে দাও এই ভাঙাচোরা জীবন নিয়ে, এই শরীর নিয়ে কী করবো আমি?” নীরু দু’হাতে খামচে খামচে ক্ষত বিক্ষত করে সমস্ত শরীর। শারমিন বাঁধা দিয়েও ঠেকাতে পারছে না। নীরা মাঝেমাঝেই এমন হাইপার হয়ে ওঠে৷ নিজের ক্ষতি করে বসে তখন। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়ে শারমিনের বুকে। ব্যথায়, যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করে। বাহিরে নিরব হয়ে যায়। ভেতরের যন্ত্রণা, ব্যথা অশ্রু ফোঁটা হয়ে গড়াতে থাকে অবিরত। শারমিন আশা বাঁধে মনে। একদিন এই ভঙ্গুর বীজের খোলস ছেড়ে ভেঙে সাহসী,স্ট্রং একটি নতুন বীজ অঙ্কুরিত হবে। সকল আগত ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করতে পারবে এমন স্ট্রং হবে। যাকে পৃথিবীর কোনো ঝড়েই ভাঙতে পারবে না। সবাই পরাজিত হয় না। কেউ কেউ সময়ের পরিক্রমায় জ্বলে পুড়ে ধারালো হয়ে ওঠে। ভেতর থেকে এতোটা মজবুত হয়। যাকে আঘাত তো করা যায়, কিন্তু ভাঙা আর যায় না। সময় মানুষের বর্তমান কষ্টকে অতীতের স্মৃতিতে কনভার্ট করে৷ Time is the best healer. সময়ের স্রোতে সব ঠিক হয়ে যায় নয়তো ডুবে যায়। শারমিন বোনকে ডুবতে দেবে না।

বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম বহু আগেই পৌঁছে গেছে মেহের৷ অফিসিয়াল জরুরি কাজটা শেষ করে হালিশহর আসতে সন্ধ্যা হলো তার। ঠিকানা অনুসারে বাড়িটির সম্মুখে এসে দাঁড়ায় মেহের। স্পেশালি এখানে আসবে বলেই থ্রিপিছ পড়ে মেহের। নয়ত জিন্স, টপস,কুর্তিই তার নিত্যদিনের পোষাক।নীল,হোয়াইট গোল্ডেন মিশেল রঙের থ্রি পিছ পড়নে, হাতে লাগেজ নিয়ে বাড়িটির সদর দরজায় থামল সে। লেয়ার কাট চুলের পনিটেল আরেকবার ঠিক করে নিল। দীর্ঘ চারমাস পড়ে সামনাসামনি দেখা হবে প্রিয় মানুষটার সাথে। বুকে ভেতরটা হাওয়া লাগা পাতর মতো কাঁপছে। এতো ভীরু সে নয়,তবুও ভয় না সংকোচ কী হবে কে জানে। তাকে ঘিরে ধরেছে। মেহের উপরে উপরে স্বাভাবিকতা এনে কলিং বেলে চাপ দিল। অতিদ্রুতই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক ষোড়শী যুবতি কন্যা। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের মেয়েটি দেখতে দারুন মায়াবী। মেহের হাসিমাখা মুখে মেয়েটিকে বললো,

” কেমন আছো টুসি?”

” মেহের আপা?” মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকে ওঠার মতো ঝলকে উঠলো টুসির চোখ,মুখ। খুশিতে চেঁচিয়ে বললো,

” আম্মা দেখে যাও কে আসছে? আল্লাহ গো! আপা আপনি বাস্তবে দেখি চমৎকার সুন্দরী। কি যে খুশি লাগছে আপনাকে দেখে? আম্মা কই তুমি? ও আম্মা!” টুসি মেহেরের নিষেধ উপেক্ষা করেও লাগেজ টেনে আনলো ভেতরে। মেহের টুসির পিছু পিছু এলো। রাহেলা বানু মেহেরকে দেখে কাঁদো কাঁদো অবস্থা। মেহের দু’হাতে জড়িয়ে বসার ঘরেই বসল তাকে নিয়ে। রাহেলা অভিমানি সুরে বললো,

” এই এলি তুই? এই আমাকে বলিস আমি তোর মায়ের মতো? মা’কে এমনি করে ভুলে যায় কেউ? সারাটাদিন তোর পথ চেয়ে বসে আছি আমি। ”

” হ আপা! আম্মা দুপুর পর্যন্ত আপনার জন্য দুনিয়ার রান্না করছে নিজ হাতে। তারপর এইখানে বসে ঐ যে রাস্তার দিকে একবার, ছাঁদে গিয়ে একবার আপনি আসছেন কিনা দেখে। আপনার দেখা না পেয়ে মুখ ফুলিয়ে বসেছিল এতোক্ষণ।”

” চুপ থাক!” রাহেলা মেহেরের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মেহের মুচকি হেঁসে রাহেলার হাত দু’টো মুঠোবন্ধি করে। বলে,

” তোমাকে কথা দিয়েছিলাম না আসব। তাহলে না এসে থাকতে পারি বলো? আর এতো কষ্ট কেন করেছ তুমি? আমি কী অতিথি নাকি?”

” আমি কী বলেছি তুই অতিথি। তুই কী আমার, সেকি আর বলতে হবে মুখে?”

মেহের লজ্জায় মুখ নুয়ে বসে থাকে। টুসি ডায়নিং টেবিলের সামনে থেকে উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করে,

” আম্মা, খাবার টেবিলে সাজাব?”

” হ্যাঁ, খাবার গুলো আগে একটু গরম করে নিস তো মা।”

” আচ্ছা। ”

” টুসিকে খুব ভালোবাসো তাই না আন্টি?”

” হুমম। সেই আটবছর বয়সে রাফসানের হাত ধরে বাড়িতে আসল ও। এতিম মেয়ে। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতো। আমার রাফসানকে তো চিনিসই। পারলে পুরো পৃথিবীর দায়ভার সে নিজ কাঁধে তুলে নেয়। তবে টুসিটা খুব ভালো মেয়ে। আমার খুব খেয়াল রাখে। ও যে আমার পেটের মেয়ে না, সে’কথায় ভুলে বসি মাঝে মাঝে।” রাহেলা রান্না ঘরে কাজকরা টুসির দিকে অপলক চেয়ে আছে। মেহের সেদিকে তাকিয়ে বলে,

” আমাকে এতো ভালোবাসবে তো? নাকি,,?

” নাকি কী হ্যাঁ? তোকে তো মাথায় করে রাখব আমি। তুই আমার পাঁচটা না দশটা একটামাত্র ছেলের বউ হবি।” মেহের লজ্জায় আবার মুখ নুইয়ে ফেলে। রাহেলা ওর থুতনি ধরে তুলে বলে,

” হ্যাঁ মা, আমার ছেলেটাকে কী তুই বলবি না আমি?”

” এই না! না! একদম এসব ওকে বলতে যাবে না কিন্তু। ও নিজে এসে আমাকে বলবে যেদিন সেদিনই সব হবে।”

” যদি না বলে?”

” আন্টি! ” মেহের আতঙ্কে জড়ানো কন্ঠে বলে।চোখে মুখে জল ছলছল তার। রাহেলা ওর মাথায় হাত রেখে বলে,

” আমার ভয় করে রে মা। তোদের এতো নিষেধ করা স্বত্বেও তোরা ঐ অলক্ষুণে মেয়েটাকে নিয়ে এলি। ওদিকে আমার আত্মীয় স্বজন সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আমাদের সাথে। রাফসানকে তো সহ্য করতেই পারছে কেউ। আঞ্জুটা পুত্রশোকে শয্যাশায়ী। স্বামীটাও ওর পাগল হয়ে পাগলা গারদ। সব দোষ যে তোদের দিচ্ছে ও। তোদের নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। সব দোষ ঐ অশুভ, অপয়া মেয়েটার। একদিন আমারও মায়া জন্মেছিল। আজ শুধু অভিশাপ দিতে ইচ্ছা করে। আহারে বেচারা আহনাফ! দেখিস তুই ঐ মেয়ের জনমেই যাবে কাঁদতে কাঁদতে। এতোগুলো জীবন শুধু ওর জন্য নষ্ট হলো। আমার রাফসানকে ওর থেকে দূরে রাখিস মা।”

” আন্টি প্লীজ! এভাবে বলো না ওকে। তুমিও তো মেয়ে। আরেকটা মেয়ের কষ্ট কেন বুঝছ না তা হলে?”

” এই এক কথা বলে বলে মাথা খারাপ করছিস তুই আর রাফসান। আমার ঐ মেয়ের নামই এখন সহ্য হয় না। ওকে লাই দিস না। ঘর ভাঙা মেয়ে কখনো কারো ঘর বাঁধতে দেয় না। দূরে থাকবি তুই আর রাফসান ওর থেকে।,,,।রাহেলা নীরাকে নিয়ে সাবধান করতে লাগলো ওকে। মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহেলার কাঁধে মাথা রাখলো।
মনে মনে ভাবল, আন্টি দোষ তো ওর না। দোষ আমাদের সংকীর্ণ চিন্তা ধারার। জোর করে রেপিষ্টকে যারা স্বামী বানাতে পারে। তাদের চোখে আসলেই দোষী নীরা। যে সয়ে সেই কেবল বোঝে। বাকিদের সাধ্য কী তা বোঝার? তারা তো শুধু দোষই দেবে।

খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছিল মেহের। ঘুম থেকে উঠল প্রায় দশটার দিকে। উঠে বসার ঘরে আসতেই জানতে পারল রাফসান এই মাত্র ফিরেছে। রাহেলা একপ্রকার জোর করে মেহেরকে উপরে পাঠিয়ে দিল। দোতলায় একা রাফসান থাকে। নিচতলায় দু’টো রুম। একটাতে রাহেলা আর টুসি থাকে অন্যটা মনে হয় গেষ্টদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দোতলায় দুটো রুম দেখা যায়। রাহেলা আগেই বলেছে ডান সাইডের রুমটা রাফসানের শোবার ঘর আর বামটাতে তার স্টাডি রুম। মেহের কয়েকবার নক করার পরও কেউ খুললো না। অগত্যা লক ঘুরিয়ে নিজেই রাফসানের রুমে প্রবেশ করলো সে। অনুমতি ছাড়া প্রবেশে অস্বস্তি ফিল করছে, আবার রাফসানের রুমে রাফসানের গায়ের সুগন্ধ অনুভব করে শিউরে উঠছে মেহের৷ ডিম লাইটের অনুজ্জ্বল আলোয় রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখে নিল। গোছালো, পরিপাটি রুম। খাটের কোলঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে মেহের চলে এলো ব্যালকনিতে। সামনের ছোটবড় বিল্ডিংএ জ্বলে ওঠা বাতিতে পুরো শহরটা দেখলো একনজর মেহের। ব্যালকনিতে বাহারি ফুল গাছ লাগানো। মেহের হাতে ছুঁয়ে দেখছিল গাছ, ফুল। হঠাৎ কিছু বিঁধলো ওর হাতে। ব্যথায় আহ! করে উঠল মেহের।

” কে ওখান?” প্রশ্নটা করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো রাফসান। মেহেরকে এখানে দেখে বিস্মিত হয়ে বললো,

” আমার লেডি জেমস বন্ড যে। হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ। কখন এসেছ?”

মেহের বরফের মতো জমে গেল ভেজা,এলোমেলো চুলে সদ্যঃস্নাত রাফসানকে দেখে। বুকটা ঢিপঢিপ করছে ওর। হাতের ব্যথা মুহূর্তে গায়েব। রাফসান মুখে সামনে তুড়ি বাজিয়ে ভ্রু নাচাতেই অপ্রস্তুত হাসল মেহের। হাতের ব্যথাটা টনটন করে উঠল ঘোর কাটতে। রাফসান উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কাঁটা ফুটালে কী করে?

” ঐ যে তোমার গাছ ফুটিয়ে দিয়েছে। কী হিংসে। আমি যেন তোমাকে দখল করতে এসেছি। দেখো হিংসে জ্বলে পুড়ে কী করেছে?”

রাফসান মেহেরের কথার ভঙ্গি শুনে হাসল। বললো,

” তা তো করবেই। গভীর প্রেম আমাদের।”

” ইশশ!”

” আর ইশশ টিশশ করো না। চলো এন্টিসেপটিক লাগাতে হবে।”

মেহেরকে বিছানায় বসিয়ে ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলো। মেডিসিন মেহেরের হাতে লাগাতে লাগাতে বললো,

” ক্যাকটাসের কাঁটা ফুটেছে বোধহয়।”

” ক্যাকটাস! কী সাংঘাতিক তুমি। পৃথিবীতে এতো প্লান্ট থাকতে এই বিপদজনক গাছটা লাগানোর শখ হলো তোমার? ”

” মোটেও বিপদজনক নয় ওটা। স্লেফ ডিফেন্ড করে বলেই কী বিপদজনক হয়ে গেল?”

” ধরতে গেলেই কাঁটা ফুটিয়ে দেওয়া সেল্ফ ডিফেন্ড বলছ? আমি কী ক্ষতি করতে চাচ্ছিলাম নাকি?”

” যার যা ধর্ম বুঝলে? আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি হাত বাড়ালে বলেই তো খোঁচাটা খেলে। সে সেধে এসে তো আর খোঁচা দেয় নি।”

” এমন ভয়ানক জিনিস না রাখলেই তো পারো?” মেহের কপট রাগ দেখাল।রাফসান মুচকি হেঁসে ফার্স্ট এইড বক্স নির্দিষ্ট স্থানে রেখে বললো,

” আগে ছিল না। গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফেরার পথে ভ্যানগাড়িতে দেখলাম। জানো মেহের? দারুন একটা সাদা ফুল ফুটেছিল ক্যাকটাসটাতে। কাঁটাযুক্ত গাছেও যে এমন ফুল হয় দেখেই বিস্মিত আমি, সাথে মুগ্ধও বলতে পারো। সব সুন্দর জিনিসই কাঁটা থাকে। এই যেমন গোলাপের কথায় ধরো না।তাই তো নিয়ে এলাম। সব সুন্দর সাথেই কাটা থাকাটা আবশ্যক বুঝলে? নয়তো সুন্দরকে নিরাপত্তা দেবে কী করে? অবলীলায় যে কেউ ছিঁড়ে ফেলতে চাইবে। কাঁটা থাকলে ছিঁড়তে দু’বার ভাবতে হবে। আরও ইন্টারেস্টিং হলো অন্য গাছের মতো রোজ রোজ কেয়ার করা লাগে না। দারুন সহিষ্ণু হয় এরা। মরুভূমির উদ্ভিদ বলেই হয়তো এমন সহিষ্ণু। কেন যেন বিশেষ কারো কথা মনে করিয়ে দেয় ক্যাকটাস আমাকে। যদিও দু’জনই এরা ভিন্ন প্রজাতির। অবস্থানটাও ভিন্ন। তবুও মনে হয় হোক সে ক্যাকটাস নিজের জীবনে কিংবা কেউ আসুক ক্যাকটাস হয়ে তাকে আগলে রাখতে। ঠিক ফুলটার মতো। এখন রোজ রোজ ক্যাকটাসকে দেখলে তার কথা ভাবি। আশ্চর্য হচ্ছো তাই না? আমিও আজকাল হচ্ছি। মানুষের মনের অলিগলিতে কখন কী ঘটে, মানুষ নিজেও হয়তো তার আভাস পায় না। আশ্চর্য কিছু ঘটে যায়। যার কল্পনাও হয়তো করা ছিল না আগে।”

মেহের ভ্রুকুটি করে চেয়ে আছে রাফসানের বিমুগ্ধ হওয়া মুখটায়। মনের কোনে অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে শেষ কথাগুলো শুনে। তবে কী রাফসানের হৃদয়ে অন্য কোনো নারীর বাস? না! না! কী ভাবছে সে এসব। এমন কিছুই নয়। একটা গাছ নিয়েই হয়তো পরিচিত কাওকে মিলাচ্ছে। সে যে নারীই হবে এমন তো নাও হতে পারে। রাফসান মেহেরের চুপসে যাওয়া দেখে হেঁসে ওঠে। বলে,

” এতোটা গুম মেরে গেলে কেন লেডি জেমস বন্ড? ভয় পেলে নাকি?”

” ভয় কেন পাব?”

” আমিও তো তাই বলি। ভয় কেন পাবে লেডি জেমস বন্ড।” রাফসান উঠে দাঁড়ায়। ব্যালকনির দিকে যেতে যেতে মৃদু স্বরে হেলাল হাফিজের কবিতার চরণ আওড়ায়,

“দারুন আলাদা একা অভিমানী এই ক্যাকটাস।
যেন কোন বোবা রমণীর সখী ছিলো দীর্ঘকাল
কিংবা আজন্ম শুধু দেখেছে আকাল
এরকম ভাব-ভঙ্গি তার।
ধ্রুপদী আঙিনা ব্যাপী
কন্টকিত হাহাকার আর অবহেলা,
যেন সে উদ্ভিদ নয়
তাকালেই মনে হয় বিরান কারবালা।

হয় তো কেটেছে তার মায়া ও মমতাহীন সজল শৈশব
অথবা গিয়েছে দিন
এলোমেলো পরিচর্যাহীন এক রঙিন কৈশোর,
নাকি সে আমার মত খুব ভালোবেসে
পুড়েছে কপাল তার আকালের এই বাংলাদেশে।

বোকা উদ্ভিদ তবে কি
মানুষের কাছে প্রেম চেয়েছিলো?
চেয়েছিলো আরো কিছু বেশি।

চলবে,,,

ক্যাকটাস
পর্ব ১১
Writer Taniya Sheikh-Tanishq

মেহের বিছানায় উবু হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে। মনটা ভীষণ রকম খারাপ তার৷ কাজে মনোযোগ কিছুতেই বসছে না। তবুও জেদ করে লেগে আছে কাজটার পেছনে। এমনই সে৷ বড্ড জেদি আর একরোখা। এই জেদের কারনেই পরিবার থাকা স্বত্বেও আলাদা ভাড়া থাকে ফ্রেন্ডস শারমিনের সাথে। গত পাঁচ বছর ধরে এভাবেই আছে দুজন। এখন তো নীরাও এসে থাকছে। মেহের তখন অনার্স শেষ বর্ষে। তার পরিবারের প্রধান তার আব্বু মাসুদ আহমেদ। গুরুগম্ভীর এবং রাগী ধাঁচের লোক তার বাবা। তাদের বাসার সবাই তটস্থ থাকত বাবার রাগী মেজাজে কারনে। মেহের যতো বড় হয়েছে ততোই ভয়টা কমেছে। ভয় কমার পেছনে অবশ্য কিছু কারন ছিল। তার বাবার কিছু অনৈতিক ব্যাপার স্যাপার যা সে দেখেছিল, শুনেছিল। এই দেখা শোনাতেই ভয় কমে ঘৃণা জন্ম নেয়। ক্রমশ বাবার কথার বিপরীতে সে চলতে থাকে। তার বাবা যদি বলতো উত্তরে যাও মেহের বাবার কথা উপেক্ষা, অগ্রাহ্য করে দক্ষিণে চলে যেত। বাপ মেয়েতে ধীরে ধীরে মনোমালিন্য শুরু হলো। মাসুদ আহমেদ মেয়ের এমন ঔদ্ধত্যে লাগাম টানতে বিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। মেহের সাফ মানা করে দিল। মাসুদ আহমেদ মেয়েকে রাজি করাতে না পেরে চড়ে গেলেন নীরিহ স্ত্রীর উপর। দিনরাত ঝামেলা শুরু করলেন স্ত্রীর সাথে। একবার তো হাতও তুললেন। মেহের কিছুতেই সহ্য করলো না মায়ের অপমান। তীব্র প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল তার মা। মেয়েকে যতোভাবে দূর্বল করার সাধ্য তার ছিল তিনি করলেন। মেহেরের সামনে তার মা দু’টো অপশন রাখলো। হয় সে বিয়েতে রাজি হোক নয়তো তার মা’কে বিষ এনে দিক। মেহের সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারে নি। তার নিষ্ঠুর, স্বার্থপর বাবার জয় তাকে যন্ত্রণায় শেষ করে দিল। মায়ের কারনে মেহের অবশেষে হার মানল। রাজি হতে হলো বিয়েতে। তবে বিয়ে নয় আগে হলো এনগেজমেন্ট। ছেলে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘকায়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের শোয়েব ইব্রাহীমের দিকে সেদিন ফিরেও না তাকায় নি মেহের। শোয়েব ইব্রাহীম কিন্তু প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে যায় হবু স্ত্রীর। তাদের মধ্যেকার কথাবার্তার সম্পর্ক বেশিদূর যেতে পারে নি শোয়েব ব্যাপার মেহেরের তাচ্ছিল্যের কারনে। তাদের এনগেজমেন্টের একমাস না হতেই মেহের সেই সদ্য গড়ে ওঠা সম্পর্কটা ভেঙে দেয়। তখন শোয়েব না জানলেও মেহের জেনে যায় বিয়েতে যৌতুক আদান প্রদান হবে। তার বাবা মেয়ে বিদায় করতে লোন নেবে মোটা অংকের। মেহের আগাগোড়াই অন্যায়ের বিরুদ্ধে চলে। যেখানে অন্যায় দেখেছে প্রতিবাদ করেছে। বাবা,মায়ের সাথে তর্কাতর্কি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে সে। মাসুদ সাহেব মেয়ের সামনে শর্ত রাখে। হয় সে ফিরে এসে বিয়েতে রাজি হোক। নয়ত তাদের চিরতরে ত্যাগ করুক। আত্মসম্মান ও রাগের বশে সেদিন মেহের দ্বিতীয় অপশন চুজ করেছিল। সবাইকে ছেড়ে এসেছিল। শোয়েব সব শুনতে পেরে ছুটে এসেছিল মেহেরের কাছে, ক্ষমা চেয়েছিল। মেহের নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাকে। অনামিকা থেকে আংটি খুলে ছুঁড়ে মেরেছিল শোয়েবের মুখের উপর। শোয়েব টু শব্দটিও করে নি সেদিন৷ মন থেকে যাকে চেনা সম্ভব, অনুভব করা সম্ভব করেছিল মেহেরকে সে। যতোটুকু বোঝার,চেনার চিনেছিল মেহেরকে। তাইতো সেদিন নিরব চলে গিয়েছিল। মেহের ভুলেই গিয়েছিল প্রায় শোয়েবকে। আজ হঠাৎ পাঁচ বছর বাদে কেন দেখা হলো মানুষটার সাথে? মেহেরের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার আজকের পরিনতির জন্য সে শোয়েবকেই দায়ী করে। সে জানে না শোয়েব তারই মতো ভুক্তভোগী। সে তো রাগ ঝেড়েছে,সব ছেড়েছে। শোয়েব যে সব বুকে চেপে আজও নিরব। কেন সে নিরব? মেহের নিজেকেই শুধায়।

বিকেলে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়েছিল উত্তরা। ফিরতি পথে দেখা স্কুল ফ্রেন্ড লামিসার সাথে। লামিসার যাচ্ছিল তার অন্য এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে। এতোদিন পর মেহেরকে পেয়ে কিছুতেই ছাড়ল না সে৷ জোর করে সাথে নিয়ে এলো। সেখানেই হঠাৎ আবিষ্কার করলো শোয়েবকে মেহের। অদূরে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছিল স্থির দৃষ্টিতে। চেহারায় অনেক পরিবর্তন তার। মেহের শোয়েবকে না দেখার ভান করল। কিন্তু আড়চোখে দেখতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেল ঠিক সে। চোখে চোখ পড়তেই মেহের অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে খেয়াল করে তার অপ্রস্তুত হওয়া দেখে এক চিলতে ম্লান হাসি হেঁসে চলে যায় শোয়েব। এরপর সেখানে আর দেখেনি শোয়েবকে সে। খারাপ লেগেছিল। কেন লেগেছিল জানা নেই। সেই খারাপ লাগাটা এখনও রয়ে গেছে। এখনও ঐ চাহনির নানা অর্থ দাঁড় করাতে ব্যস্ত তার মন। দরজায় কলিং বেল বাজতেই উঠে বসল মেহের। বসার ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে দরজা খুলে দিল।

” এক কাপ কফি বানা না দোস্ত? বড্ড মাথাটা ধরেছে।” রুমে ঢুকেই ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে বললো শারমিন।

” ভাল্লাগছে না। নিজে বানিয়ে খা।” মেহের গম্ভীরমুখে চলে এলো রুমে। শারমিন ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। মেহের আবার আগের মতো শুয়ে ল্যাপটপ টিপছে আনমনে। চোখে সেই স্থিরদৃষ্টির গম্ভীরমুখী পুরুষের ছবি। তার ঘোর পুনরায় ভাঙলো মোবাইল রিংটোনের আওয়াজে। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা তার বিষন্ন মনটাকে মুহূর্তে চাঙা করে তুললো। ক্ষণকাল সময় অপব্যয় না করেই চট করে রিসিভ করে কলটা

” হ্যাঁলো ব্যারিষ্টার। চাঁদ আজ কোনদিকে উঠেছে? ”

” মেহের!” মেহেরের বিদ্রুপ বুঝে ভরাট গলায় বললো রাফসান।

মেহের ব্যাগ্রভাবে বললো,
” মেহের কী হুমম? লাষ্ট কবে কল দিয়েছিলে মনে আছে তোমার? ”

” কেন কালই তো কথা হলো আমাদের। ” রাফসান বললো

” ওটা আমার কলে বলেছিলে ওকে? আমি কলের কথা বলেছি মি.কথা বলার কথা বলি নি।”

” ওহ! বোঝয় তো ব্যস্ত থাকি।” রাফসান হাসল

” ব্যস্ত না ছাই। তুমি আসলে আপনই ভাবো না আমাকে।” কপট রাগের আভাস মেহেরের কন্ঠে।রাফসান সেটা বুঝে রাগী ভাব নিয়ে বললো,

” আপন ভাবি না বললে তো? ঠিক আছে বাই। ভেবেছিলাম আগামীকাল তোমার সাথে দেখা করবো। বাট তোমাকে যখন আপনই ভাবি না,তবে দেখা করে কী লাভ তাই না?”

” তুমি ঢাকা আসছ? ও মাই গড! আগে বলো নি কেন?” উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায় মেহেরের কন্ঠে।

” বলার চান্স দিলে কবে? তুমি কাওকে কথা বলতে দাও কখনো?”

” স্যরি!”

” রাখো তোমার স্যরি। বাই।”

” এই এই।”

” কী?”

” একদম কল কাট করবে না বলে দিলাম। স্যরি বললাম তো! আসলে মনটা ভালো ছিল না। তাই,,! মেহের থেমে গেল। রাফসান হাসি হাসি মুখে বললো,

” বুঝেছি। তা ম্যাডামের মন খারাপ হওয়ার কারনটা কী জানতে পারি? ছেলেঘটিত কিছু?”

” এই ব্যারিস্টার! বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। আচ্ছা ধরো হলোই ছেলেঘটিত। হিংসে হচ্ছে তাতে?”

” হিংসে! নো ওয়ে। আমি তো খুশিতে ড্যান্স করবো। আফটার অল আমার লেডি জেমস বন্ডের বিয়ে বলে কথা।”

” আমার বিয়ে হলে খুশি হও তুমি?” মেহের উঁচু গলায় বললো

” তো কী অখুশি হওয়ার কথা? ফ্রেন্ডের বিয়েতে খুশি হব না?”

রাফসানের হেঁসে হেঁসে বলা কথাটা মেহেরকে আঘাত করে। রাগে দাঁত চেঁপে চুপ হয়ে যায় মেহের। মোবাইলের ওপাশে মেহেরের সাড়াশব্দ না পেয়ে রাফসান হ্যাঁলো হ্যালো করে। অগত্যা কল কাট করে ফের কল করে রাফসান। মেহের রাগে, অভিমানে গাল ফুলিয়ে কল কাটের শেষ মুহূর্তে রিসিভ করে কালে তোলে মোবাইল। এবারও চুপ সে। রাফসান বেশ অবাক হয় ওর এমন আচরণে। কিছুটা বিব্রত স্বরেই বলে,

” মেহের তুমি বিরক্ত হলে বলো কল কাট করছি।”

” না তেমন কিছু না।”

” আমি কী এমন কিছু বলেছি যার কারনে কষ্ট পেলে তুমি?”

” আরে না!” মেহের অনিচ্ছা পূর্বক হাসল। রাফসান কথা বাড়াতে চাইল না আর। তার ধারণা মেহের আফসেট হয়েছে। কেন হঠাৎ আফসেট হলো কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে সে। মনের ভাবনা একপাশ করে রাফসান স্বাভাবিক গলায় বললো,
” কাল কী দেখা হচ্ছে আমাদের? ”

” অবশ্যই।” মেহের হাসল এবার।

আরো দু’এক কথা বলে কথা শেষ করে দু’জন। মেহেরের মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল। দু’টো বছর কেটে গেছে তবুও কেন রাফসান তাকে বুঝল না? নাকি বুঝেও সে হেয়ালি করে। মেহেরের মনের অবস্থা কেন তাকে নাড়া দেয় না? কেন সে বন্ধুত্বের সীমার বাইরে তাকে ভাবতে পারল না আজও? মেহের বালিশে মুখ গুঁজে নিরবে অশ্রুবিসর্জন দেয়।

শারমিন অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার তৈরিতে লেগে গেছে। নীরা বাসায় থাকলে তাকে এই ঝামেলা পোহাতে হয় না। আজও নীরা অভার টাইম করছে। যেদিন ক্লাস করে সেদিন জবে ওভার টাইম করা লাগে ওর। আজ ইম্পোর্টেন্ট ক্লাস ছিল বলেই দেরিতে অফিস যেতে হয়েছে। সুতরাং টাইমটাও পূর্ণ করতে হবে ওভার টাইম করে।

শারমিন তরকারি বসিয়ে দু’কাপ কফি হাতে মেহেরের রুমে ঢুকলো। মেহের গোমড়া মুখে ল্যাপটপে খটখট আওয়াজ তুলে কাজ করছে। শারমিনকে রুমে ঢুকতে দেখে ম্লান হাসল সে। শারমিন কফির কাপ এগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,

” মন খারাপ কেন?”

” কই না তো।”

” ঢং করিস না। কী হয়েছে বল?” শারমিন পাশে বসে বললো

” আরে জাস্ট মুড অফ।” মেহের ল্যাপটপে দৃষ্টি অনড় রেখে কফিতে চুমুক দেয়। শারমিন এক চুমুক দিয়ে কফির কাপের কোনায় আঙুল নাড়াচাড়া করে বলে,

” তোর ব্যারিস্টারের কী খবর?”

মেহের এবার মুখ তুলে চায় শারমিনের দিকে। চোখ ছোট করে শারমিনের বাহুতে চড় মেরে বলে,

” তুই শুধরাবি না। শকুনের কান তোর। সব শোনায় লাগবে তাই না?”

” অবশ্যই। ইহা আমার বান্ধবীগত হক। বল কী বললো?”

” কাল আসবে বললো।”

” এখানে?”

” এখানে আসতে তো চায় না। তবে এবার আর ছাড়ছি না বুঝলি? যতো টাকি মাছের মতো ফসকানোর চেষ্টা করুক। টেনে টুনে এবার আনবোই আনবো।”

” দেখিস অঙ্গ প্রতঙ্গ যেন অক্ষত থাকে। তোর বলে ভরসা কম আমার। দেখা গেল টানতে টানতে হাত পা বেচারার নাই হয়ে গেল।”

” কুত্তি!”

মেহের কুশন ছুঁড়ে মারে শারমিনের দিকে। শারমিন তড়িৎ গতিতে দৌড়ে দরজার কাছে চলে আসে। এক চোখ টিপে হাসতে হাসতে বলে,

” বল তো কাল ঘরটা ফুলে ফুলে সাজিয়ে রাখব।”

” শারমিন! তোকে কিন্তু,,?

মেহের লজ্জায় ঠোঁট টিপে হাসে। শারমিন ততোক্ষণে গুনগুন করতে করতে চলে এসেছে রান্নাঘরে। রাত ন’টা কিছুক্ষণ পরই নীরা ফিরলো। বিধ্বস্ত চেহারা। এমনিতেই সে নরম ধাঁচে গড়া। অতিরিক্ত প্রেশার পড়লে তার অবস্থা এমন ঝড়ের কবলে পড়া পথিকের মতো হয়ে যায়। তাছাড়া অতীত ক্ষতের যন্ত্রণা তো আছেই। রুমে ঢুকতেই শারমিন জিজ্ঞেস করে,

” এতো দেরি হলো যে আজ তোর?”

” ম্যানেজার সবাইকে দেরিতে ছেড়েছে। কাস্টমার ছিল তখনও কিছু।” নীরা মৃদু স্বরে বললো

” বকেছে নাকি আজও? মুখটা ওমন মলিন কেন?”

” দুপুরে লাঞ্চ করা হয়নি। কলেজ থেকে বেরিয়ে সোজা কাজে গিয়েছিলাম। মলে ভীর ছিল আজ খুব৷ তারউপর,,,? এতোটুকু বলেই লম্বা শ্বাস নিল নীরা। শরীরের দূর্বলতা গলাতেও জেঁকে বসেছে।

” তারউপর কী?” শারমিন প্রশ্ন করে

” একটা কাস্টমার বাজে ভাবে ডিস্টার্ব করছিল। আমি ম্যানেজারকে বলায় উল্টো ঝারি খেয়েছি। আমার কিছুই ভালো লাগে না। আমার মতো অর্কমাকে দিয়ে কিছুই হবে না রে আপু। সব কিছুতেই ব্যর্থ আমি। কিছুই ঠিকমতো হয় না আমার দ্বারা। যতো সমস্যা আমাকে ঘিরেই হয়।” নীরা করতলে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে। শারমিন ধমক দিয়ে বলে,

” এতো অল্পতেই প্যানপ্যানানি কেন তোর নীরু? সবাই কী সব শিখে জন্মায়? ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে তবেই সামনে এগোতে হয়। এই তুই তিনমাস আগেও কী ভেবেছিলি জব করতে পারবি? কিন্তু আজ করছিস তো? দ্যাখ চাকরী পাওয়া এতো সহজ না। ম্যানেজার মেহেরের পরিচিত বলেই জব টা তুই পেলি। নয়ত সামান্য এইচএসসি পাসে চাকরী পাওয়া সহজ না। আমি নিজেও প্রথম ঢাকা এসে এই সেলস গার্লের পেশায় ঢুকেছিলাম। এখন দেখ আমাকে? মাস গেলে ত্রিশ হাজার টাকা, পদোন্নতিও বেড়েছে। তোকেও এমন হতে হবে। যদি অন্য জব পাস তো ভালো। নয়তো এটাতেই অভিজ্ঞতা বাড়াতে থাক। এই জবের মাধ্যমেই আত্মপ্রতিষ্ঠিত করবি তোর সব ক্ষেত্র। বোকা,সহজ সরল, ঘরকুনো হয়ে থাকলে সারাজীবন লাথি উষ্টা ছাড়া আর কিছুই পাবি না কারো কাছে। জীবন তোকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছে। তারপরও যদি এমন হতাশ হয়ে পারব না, হবে না আমার দ্বারা এসব বলিস তবে তোর বিষ খাওয়া উচিত। কথা কানে ঢুকছে তোর?”

নীরা বিষন্ন মুখখানা নত করে বসে আছে। শারমিনের সব কথা তীরের মতো তাকে বিদ্ধ করে। তার অসহ্য লাগে সবকিছু মাঝে মাঝে। অন্য সবার মতো চঞ্চল, স্পষ্টভাষী নয় সে। এই জবে টিকতে তাকে কী পরিমান কষ্ট করতে হচ্ছে কেবল সেই জানে। সেলসগার্লের জব সহজ নয় তার জন্য। একটা প্রডাক্ট দেখাতে গেলে যে পরিমান দক্ষতা দেখানো প্রয়োজন তার তা নেই। তবুও ম্যানেজার তাকে জবে বহল রেখেছে শুধু মাত্র মেহেরের কথা রাখতে। ম্যানেজার ভেতরের ক্ষোভটা আজকাল প্রায় ধমক দিয়ে নেয়। নীরা বোঝে ম্যানেজার তাকে বাদ দিতে চেয়েও পারছে না। নীরাও তাকে কাজ দেখিয়ে খুশি করতে পারছে না। আবার জব ছাড়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। শারমিন তাকে কিছুতেই এই জব ছাড়তে দেবে না। কারণ শারমিনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। বিয়ে হয়ে গেলে নীরার কী গতি হবে? এসব চিন্তায় মাঝে মধ্যে ঘুম হয় না নীরার। জীবনের প্রতি পদে পদে কাটা বিছানো। পায়ের তলা শক্ত না করলে যে চলছেই না আর তার। শারমিন নানাভাবে তার এমন দূর্বল স্বভাবের জন্য তিরস্কার করে যাচ্ছে। নীরা জানে এই তিরস্কার তাকে ছোট করার জন্য নয়। মজবুত করার জন্য এই আঘাত গুলো শারমিন তাকে করে তার দূর্বল মুহূর্তে। নীরা উঠে গোসল খানায় ঢুকলো। চোখের পানি শাওয়ারের পানিতে মিলেমিশে একাকার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটু মুড়ে বসে রইল শাওয়ারের নিচে সে। নিজেকে তৈরি করতে হবে তাকে। সংগ্রামী জীবন পেয়েছে সে। সংগ্রাম ছাড়া ঠিকে থাকতে পারবে না এই পৃথিবীতে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here