ক্যাকটাস পর্ব ৮+৯

ক্যাকটাস 🌵
পর্ব ০৮
Writer Taniya Sheikh- Tanishq

রাহেলার মুখে সকল কিছু শুনে আঞ্জুর মর মর ধরধর অবস্থা। সে এমনিতেও দূর্বল চিত্তের মেয়েলোক। একমাত্র সন্তানের জীবনে আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে হাত পা ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল। দৃষ্টি জুড়ে আতঙ্ক, মনটায় ধুকপুকানি বাড়ছে। রাহেলা এগিয়ে এসে সান্ত্বনার বাণী শোনাতে লাগল। তাতে কিছুই হলো না৷ আঞ্জুর মাতৃত্ব অশনি সংকেত পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। কোনো সান্ত্বনার বাণীতেই সে ভয় কাটবে না৷ আঞ্জু ফ্যাকাশে মুখে উঠে দাঁড়াল। রাহেলাকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে ছুটে গেল নিজের ঘরে। রাহেলা বেশ চিন্তিত। একদিকে তার ছেলে অপরদিকে ননদের ছেলে। যাবে তো যাবে কোনদিকে? ছেলের পক্ষ নিতে গেলে আরেক বিপদ। ননদাই রইস চৌধুরীকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। ভয়ানক নিষ্ঠুর একটা মানুষ রইস। স্বার্থের খাতিরে রাফসানের ক্ষতি করতে এক সেকেন্ডও ভাববে না সে। রাহেলা বিপদ মুক্তির দুয়া করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলো।

নীরাকে তখনও বুকে জড়িয়ে রেখেছে মেহের। চোখের জল বিরতি দিয়ে দিয়ে গড়াচ্ছে দু’জনের। শারমিনকে জানানো হয়েছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সেও পৌঁছে যাবে এখানে৷ মেহের উঁচু গলায় বাইরে দাঁড়ানো রাফসান কে ভেতরে আসতে অনুরোধ করে। এক ডাকে রাফসান যেতে পারে না। পা দুটো ভারী অনুভব করছে সে। মেহেরের বার বার করা অনুরোধে অবশেষে ভেতরে ঢুকলো রাফসান। রাফসানকে ভেতরে ঢুকতে দেখে ভয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে গেল নীরা। মেহের অভয় দিল। তবুও নীরা স্বাভাবিক হতে পারল না। তার চোখে পুরুষ মাত্রই এখন অমানুষ, পাষণ্ড। রাফাসান স্থির চোখের তারায় নীরাকে দেখছে। তখনই তার মনে পড়ল এই মেয়েকে আগেও দেখেছে সে। তবে আধো আধোভাবে৷ ওই তো যেদিন এ বাড়ি এলো, এই মেয়েই তো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল। রাফসান আহনাফের ক্রুর দৃষ্টি অনুসরণ করেই সেদিন ঘুরে তাকিয়ে ছিল নীরার দিকে৷ তেমন ভালো করে দেখা হয়নি। এক পলকের হঠাৎ অস্পষ্ট দর্শন যাকে বলে তাই হয়েছিল। আর আজ তো সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখছে রাফসান। একটা শীর্ণ দেহি মানবী! যার অঙ্গের মলিনতায় বলে দিচ্ছে তার অত্যাচারের কাহিনি। সৌন্দর্য্যের সবটুকু যেন নিংড়ে নিয়েছে কেউ। আঘাতের অস্পষ্ট চিহ্ন এখনও বিরাজমান ঐ শুষ্ক ঠোঁটের কোনায় কিংবা হাতের ফুলে ওঠা কব্জিতে। রাফসানের কঠিন বুকেও ব্যথার কাঁপন ধরে ঐ ভীরু ডাগর নেত্রজোড়ার দর্শনে।

“দর্শন কতোই হয়েছে নিরবে ভুবন মাঝে
তবুও এই যে দেখা, এতেই যেন আলোড়ন ঘটে হৃদয়ে। ”

রাফসান দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। কোন এক কারনে প্রচন্ড রাগছে সে। এমন রাগ এর আগে কোনোদিন হয়নি রাফসান৷ আজ পুরো পৃথিবী তছনছ করে ভাঙতে ইচ্ছা করছে৷ বুকের ভেতর কী যেন চেপে বসে আছে৷ কী! উফ! অসহ্য সেই অনুভূতি। রাফসান অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে। সকল অনুভূতি ভেতরে চেপে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,

” পুলিশকে মোবাইল করেছ?”

” না তো! এখনই করছি।” মেহের জবাব দিল

” তুমি ওর পাশেই থাকো। আমি বাকিটা দেখছি।” রাফসান আরেক পলক চাইল নীরার মুখের দিকে৷ পাংশু মুখে নিজেকে মেহেরের পেছনে আড়াল করে নিল নীরা। রাফসান বেরিয়ে এলো। তার দমবন্ধ হয়ে আসছে৷ এমন কেন হচ্ছে? রাফসান দু’হাতে চুল মুঠ করে শূন্য আকাশে চেয়ে রয়।

রাহেলা দূর থেকেই ছেলের গতিবিধি দেখছে। ছেলেকে কী করে এসব ঝামেলা থেকে বের করবেন। সেটাই ভাবছেন অদূরে দাঁড়িয়ে। রাফসান ঘাড় ফিরিয়ে মাকে দেখল। তার মায়ের হাবভাব সে ঠিক বুঝেছে। মেজাজ বিগড়ে গেল আরও রাফসানের। মায়ের নির্বুদ্ধিতা ও স্বার্থপরতা তাকে লজ্জিত করল। রাহেলা ছেলের দৃষ্টির ভাষা বুঝে আরও মিইয়ে গেলেন৷ ভেতরে ভেতরে দুঃশ্চিতার শেষ রইল না তার। রইস চৌধুরী কিংবা আহনাফের বিরুদ্ধে লাগা মানেই মৃত্যুকে সেধে দাওয়াত দেওয়া। গতবার হাতে পায়ে ধরে রাফসানের অপরাধ ক্ষমা করিয়েছিলেন কিন্তু এবার কী হবে? গতবারই রইস তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিল ফের রাফসান আহনাফকে আঘাত করলে মাফ পাবে না। রাহেলার শরীর কাঁপতে লাগল। প্রেশার বাড়ছে মনে হচ্ছে তার। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন ছেলের সুবুদ্ধির কামনায়।

মুঠো ফোনের মাধ্যমে স্ত্রীর জানানো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শোনামাত্রই সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন রইস চৌধুরী। তার পরেই আহনাফ ও তার বন্ধুরা। এই বন্ধুরাই কিন্তু সেদিন ধর্ষণ প্রত্যক্ষ করেছে নিরবে। আর বন্ধুকে সাহায্য করতেও চলে এসেছে। তবে এসব বন্ধুত্বের খাতিরে ন। স্বার্থের খাতিরে। আহনাফ বাবার আদেশে নীরা কাছে ছুটে গেল। পথিমধ্যে বাঁধা হয়ে পথ আগলে দাঁড়াল রাফসান। আজকের আগে রাফসানকে ভয় পেলেও আজ আহনাফের ভয় করছে না। প্রতিনিয়ত তার বাবার দেওয়া সাহস তাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে সব তার কাছে তুচ্ছ। রাফসানের ভয় উপেক্ষা করার প্রধান কারন হলো নীরা। কোনোমতেই নীরাকে হারাতে চাইছে না সে। রাফসান অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ানো আহনাফের। আহনাফ ঢোক গিলে দৃষ্টি দরজায় রেখে নীরার নাম ধরে ডাকে। জবাব না পেয়ে আহনাফ এগোতে গেলেই রাফসান দু’হাতে কলার চেঁপে ধরে চড়া গলায় বলে,

” কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

” এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন ভাই?”

” কেমন ধরনের প্রশ্ন তাই না? কী হয় নীরা তোর?”

” সেটার জবাব না হয় নীরায় তোমাকে দেবে।” রাফসানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু তুলে মুচকি হাসে আহনাফ। আহনাফ রাফসানের রাগী দৃষ্টি উপেক্ষা করে দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,

” নীরা বেরিয়ে আসো। আমাকে রাগালে কী হবে সেটা তোমাকে নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে না নিশ্চয়ই? ”

রাফসান আহনাফের এই কথার ইঙ্গিত বেশ বুঝল। আহনাফকে বিনা সংকেতে চড় দিয়ে বসল সে। আহনাফ ছিটকে সরতে গেলে রাফসান ঘাড় ধরে দেয়ালে ঠেসে ধরে। চিৎকার করে বলে,

” এতোটা অমানুষ কী করে হলি তুই আহনাফ? কেন এতো অধঃপতন তোর?”

রইস চৌধুরী, আঞ্জু ছেলেকে মার খেতে দেখে ছুটে আসে। রইস চৌধুরী গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে ছাড়ায় রাফসানকে। রেগে গর্জন করে বলেন,

” তোমার এতো সাহস রাফসান? ভাবি, সাবধান করেছিলাম আপনাকে আমি। ছেলেকে বুঝান নয়ত ফল ভালো হবে না।”

রাহেলা শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে দু’হাতে জড়িয়ে বলে,

” বাবু শান্ত হ।” রাহেলা রইস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,

” ভাইসাহেব রাগ করবেন না। আমার ছেলেটাকে আমি এক্ষুণি নিয়ে যাচ্ছি। ”

ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

” বাবু চল। চল!”

” তুমি কী মা? আমার মা এতোটা নিষ্ঠুর কী করে হলো? তুমি শুনেছ না এরা কী করেছে এই মেয়ের সাথে। তবুও এমন কথা কী করে বলতে পারো? ”

” আমি তোর মা বাবু। আগে তোর নিরাপত্তা তারপর বাকি দুনিয়ার। আমার কসম লাগে চল তুই এখান থেকে।”

” তোমার সব কথা মানলেও এটা আমি মানবো না মা। নীরাকে এদের কবল থেকে মুক্ত না করে একচুল নড়ব না আমি।”

রাফসান গা ঝাড়া দিয়ে সরে দাঁড়ায় মায়ের কাছ থেকে। রাগে কাঁপছে তার শরীর। রাহেলা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছে। আহনাফ রাফসানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আহনাফকে পারে না খুন করে ফেলতে এই মুহূর্তে রাফসান। চোয়ালের হাড্ডি ওঠানামা করছে রাফসানের। রইস চৌধুরী কিছু বলবে তাকে বাঁধা দিয়ে আহনাফ নীরাকে ডাকে। মেহেরের সাহায্যে নীরা বাইরে এসে দাঁড়ায়। আহনাফ ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে আসে নীরাকে নিজের কাছে। মেহের এগোতে গেলেই আহনাফ তর্জনী উঁচিয়ে থামিয়ে দেয়। বলে,

” আপনি কে আমি জানি না। জানার প্রয়োজনও নেই। ভালোই ভালোই বলছি দূরে থাকুন।”

” দূরে থাকব? কেন? ওহ! যাতে তুমি এই মেয়েটাকে শোষণ করতে পারো?”

” বয়স তো ভালোই হয়েছে তবুও বোঝেন না দেখছি কিছু। স্বামী স্ত্রীর পার্সোনাল ম্যাটারকে শোষন বলা উচিত নয় ম্যাডাম। ভালোই ভালোই বেরিয়ে যান।যান!”

” কেউ কোথাও যাবে না আহনাফ। যদি যাই তবে নীরাকে নিয়েই যাবো।” রাফসান মেহের পাশে দাঁড়িয়ে বলে।

” নীরা কে নিয়ে যাবে? কেন নিয়ে যাবে? এই নীরা তোর কী হয় এরা?” আহনাফ দাঁত পিষে চোখ রাঙিয়ে প্রশ্ন করে নীরাকে। নীরা ভয়ে কাঁপছে। আহনাফ এক হাত দিয়ে শক্ত করে বাহু ঘিরে ধরে নীরার। সবাই দেখল নীরার বাহু আহনাফ প্রচন্ড শক্তিতে চেঁপে ধরেেছে। ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচে ফেলেছে নীরা। আহনাফ নীরার বাহুধরে নিজের শরীর সাথে ঠেসে ধরে ফের জিজ্ঞেস করে,

” বল কী হয় তোর এরা?”

” কি-ছুই হয়-না। ” ভেঙে ভেঙে বললো নীরা। কথাটা বলতে গিয়ে ব্যথার জল গড়ালো দু’চোখ দিয়ে ওর।

আহনাফ মৃদু হাসলো। রাফসান এবং মেহেরের রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে নীরার মাথায় চুমু খেল। বললো,

” বলে দে এদের, নেক্সট টাইম যেন তোর আশেপাশেও না আসে এরা। যদি আশে,,,? আহনাফ নীরার বাহু খামচে ধরতেই নীরা আহ! করে ওঠে ব্যথায়। আতঙ্কে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,

” তোমরা চলে যাও মেহের আপু। আর এসো না। কোনোদিন এসো না। আমারই ভুল ছিল সব। শারমিন আপুকে বলবে আমি ভালো আছি। এটাই আমার নিয়তি। আমি সব মেনে নিয়েছি।সব!” নীরা মাথা ঝুঁকে জোরে জোরে শ্বাস টেনে কান্না নিবারনের বৃথা চেষ্টা করে।

” নীরা ভয় কেন পাচ্ছিস? দেখ সাহস রাখ। পুলিশ আসলো বলে। সব বলে দে বোন। তোর কিছুই হবে না। প্লীজ সাহস কর।”

পুলিশ আসছে শুনে আহনাফ, রইস চোখাচোখি করে। দুজনের মুখ এই মুহূর্তে বিবর্ণ। রইস ইশারায় ছেলেকে স্বাভাবিক হতে বলে অদূরে দাঁড়ায়। আঞ্জু চেঁচিয়ে বলে,

” পুলিশ কেন আসবে? আমার পোলা বিয়া করছে। নীরা এ বাড়ির বউ হয়। সবই তো ঠিক আছে তাইলে পুলিশ আসবে কেন? এই মেয়ে, এই মুহূর্তে বেরোও আমার বাড়ি থেকে তুমি। ভাবি তুমিও চলে যাবা তোমার ছেলেরে নিয়ে এক্ষুনি। আমার পোড়া কপাল। ঘরের শত্রু বিভীষণ সব।”

” আন্টি পুলিশ তো আসবেই। আপনার বা আপনাদের রাগ, হুমকি আমি মোটেও কেয়ার করি না। নীরা পুত্রবধূ আপনার? কেমন পুত্র বধূ তা কী অজানা আছে আর। কাজের মেয়ে বানিয়ে রাখছেন আর আপনার ছেলে,,।ছিঃ! বিবেকের ছিটেফোটা তো নাই ই, লজ্জাও নাই আপনাদের।”

” এতো জ্ঞান ঝাইরো না মেয়ে? কিসের লজ্জা হবে? কী করছি আমরা?”

” এই যে প্রশ্ন করলেন এটাতেই বুঝিয়ে দিলেন কতবড় নির্লজ্জ আপনি। কী করেছেন জানেন না তাই না? আপনার ছেলে এই মেয়েকে রেপ করেছে। জোরপূর্বক তাকে আঁটকে রেখেছেন ভয় দেখিয়ে। আবার বলছেন কী করেছেন?”

” রেপ করছে তো হইছে কী? বিয়ে তো করছে তাই না? এই বাড়ির বউ হয়েই তো কপাল খুলছে ওর। আবার নাটক করা হচ্ছে নাকে কেঁদে। সব চাল এই ফকিন্নিটার। রেপ না ছাই করছে। ইচ্ছা করে আমার পোলার,,, ” আঞ্জুর তির্যক কথা থামিয়ে দেয় মেহের। বলে,

” আপনি কোনোদিন রেপ হয়েছেন আন্টি? ”

মেহেরের প্রশ্ন শুনে আঞ্জু লজ্জায় মুখে আঁচল টানে। রইস চৌধুরী, আহনাফ তেড়ে আসে মেহেরের দিকে৷ রাফসান মেহেরকে প্রোটেক্ট করে বলে,

” এতো কেন রাগছ তোমরা? ও জাস্ট জিজ্ঞেস করেছে। আর তুই আহনাফ, তোর এখন খুব লাগছে তাই না?একজন রেপিষ্টের এতো তেজ কেন? রেপিষ্ট সমাজের কীট। তোর তো লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু দেখ নিজেকে একবার তুই!ছিঃ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম লজ্জা তাদের হয় যাদের ভেতর ঈমান থাকে। তুই তো মুনাফিক। তোর মা’কে কেউ জিজ্ঞেস করেছে বলে এতো রাগ। আর তুই যে কারো মেয়ে,কারো বোনকে কারো ভবিষ্যত মাকে রেপ করেছিস সে বেলায় কী করা উচিত আমাদের? বলুন ফুপা? জবাব দিন। স্ত্রীর বিরুদ্ধে শুনতে পারেন না আর অন্য কারো মেয়েকে নির্দিধায়,,,! ”

রইস চৌধুরী চুপ করে যান। আহনাফ একমুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করে না আর। নীরাকে টানতে টানতে উপরে নিয়ে আসে। রাফসান বাঁধা দিতে গেলে রইস চৌধুরী পথ আগলে দাঁড়ায় আহনাফের বন্ধুদের নিয়ে।
মেহের হাত টেনে ধরলো রাফসানের। বুঝাল রাগের মাথায় ভুলভাল কিছু না করতে। সুপারহিরো কিংবা সিনেমার সুপারম্যান নয় রাফসান। তার শক্তি এদের থেকে কম। পাঁচ ছয়জন তাগড়া পালোয়ানের সাথে লড়াই করা মানেই বোকামি। মারামারি করার দোষে মামলা করে ফাঁসিয়েও দিতে পারে তাকে এরা। যা করার মস্তিষ্ক ঠান্ডা রেখে করতে হবে। রাফসান মাথা ঠান্ডা করতে পারছে না। অস্থির ভাবে পায়চারি করছে আর বার বার দোতলায় তাকাচ্ছে। এই ফাঁকে আঞ্জু হাবুর মাকে বলে রাফসান ও তার মায়ের ব্যাগ পত্তর এনে ছুঁড়ে ফেলে ওদের সামনে। আঞ্জু হাত নাড়িয়ে বলে,

” বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। তোমাদের মতো আত্মীয় স্বজনের আমার দরকার নেই। আর কোনোদিন আসবে না এবাড়ি মুখো।”

” এতো জলদি কিসের ফুপি? আগে পুলিশকে তো আসতে দিন।” রাফসান আঞ্জুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে। আঞ্জু কপাল চাপড়ে বিলাপ করে,

” আরে আল্লাহ রে! আপন মানুষগুলো আজ আমার ক্ষতি করার জন্য উঠে পড়ে লাগছে। পাঁচটা না দশটা না ঐ একটাই পোলা আমার। ও ভাবি মনে মনে এই ছিল গো তোমার? আজ আমার ভাই বেঁচে থাকলে এমনটা করতে পারতে তোমরা? কিসের লোভে আমার সর্বনাশ করতে চাইছ? এমন করেই আত্মীয়তা রক্ষা করলে। আল্লাহ এমন আত্মীয় কাওরে দিও না গো আল্লাহ। ওরে ভাবি রে ছেলেরে উস্কে দিয়ে আমার সংসারে আগুন লাগাইতাছ। আল্লাহ তোমারে কোনোদিন মাফ করত না। ও আল্লাহ! ” রাহেলা দূরে দাঁড়িয়ে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল সে দোষী না। এসবের কিছুই সে জানে না। তবুও তাকে গালমন্দ করছে আঞ্জু। রাফসানের দিকে তাকিয়ে রাহেলা কপট রাগে ফুসছে। কী দরকার ছিল রাফসানের এমন করার? কোথাকার কোন মেয়ের জন্য আপন আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করল। ছেলেকে বুঝিয়েও বুঝাতে পারল না রাহেলা। শরীরটাও ভালোবোধ করছে না। মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বুক চেপে শ্বাস টানছে সে।

কিছু সময় বাদেই নীরার কাজিন শারমিন এসে হাজির। তার পরপরই পুলিশ এলো চৌধুরী বাড়ি। রইস চৌধুরী সম্মানীয় লোক সাথে প্রভাবশালী তো আছেই। এসপি সুজয় সৎ এবং নিষ্ঠাবান একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তদুপরি তাকে উপরমহলের চাপে মাঝে মাঝে অসৎ হতে হয়। এই যেমন এখানে আসার আগেই তাকে বলা হয়েছে কিছুতেই কেস নেওয়া যাবে না। রইস চৌধুরী মারাত্মক লোক। এদিক সেদিক হলেই খুনখারাবি করতে পিছপা হবেন না তিনি। সিনিয়র বুঝিয়েছে সুজয় বাল -বাচ্চাওয়ালা লোক। পরিবারের কথাও তাকে চিন্তা করতে হবে। সে ছাড়া তার পরিবার অচল। তবুও মেহেরকে গোপনে যতোটুকু পারা যায় সাহায্য করবে বলেছে সুজয়। এস পিকে দেখে রইস চৌধুরীর ভেতর কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। কারন তিনি পুলিশ আসবে শুনেই লোক মারফত যা করার করেছেন।রাফসানের অবশ্য সন্দেহ রইস চৌধুরীর এমন আচরনে। রইস সুজয়কে হাসিমুখে চেয়ারে বসতে দিয়ে হাবুর মা’কে চা পানির ব্যবস্থা করতে বলে। সুজয় সাফ মানা করেছে। তবুও রইস তাগাদা দেয় হাবুর মাকে।

রাফসান নিজের পরিচয় দিয়ে সব খুলে বলে এসপি সুজয়কে। সে নিজে নীরার পক্ষ নিয়ে লড়বে বলে জানায়। আঞ্জু সেটা শুনে আবার খেঁপে ওঠে। রইস চৌধুরী বহুকষ্টে স্ত্রীকে ভেতরের ঘরে তালাবন্ধ করে রাখে। ভেতর থেকেও চিল্লানোর আওয়াজ আসছে আঞ্জুর। সুজয় চুপ করে সব শুনলো। সব শুনে এস পি সুজয় নীরাকে ডাকতে বলে। কারন তার স্বীকারক্তি ছাড়া এসব কথা অর্থহীন। মেহের, শারমিন এবং রাফসানের মনে ক্ষীণ আশা জাগল নীরাকে নিয়ে সাথে সংশয়ও। এখন একমাত্র সেই পারবে নিজেকে এই অত্যাচারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে।

জরিনা বাসায় ছিল না। পুলিশ আসার কিছুক্ষণ পরই সে বাড়িতে ঢোকে। ঢুকেই সবার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে ঘটনা। জরিনার মুখের ভাব বোঝা গেল না এই মুহূর্তে। চুপচাপ এক হাঁটু তুলে সিঁড়ি কাছে বসে আরামে পান চিবুচ্ছে সে। তাকে এমন আয়েশি ভঙ্গিতে পান খেতে দেখে রাগ হলো রইসের। ধমকে বলে উঠল,

” বসে আছিস যে। যা নীরাকে ডেকে আন। আর শোন! আহনাফকে আসতে নিষেধ করিস। যা ওঠ।”

রইসের ধমকানিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না জরিনার ভাব ভঙ্গি। বরং আরও আয়েশি ভাব এলো তার মধ্যে। ধীরে সুস্থে গুন গুন করতে করতে উঠে গেল দোতলায়। রইস কপাল কুঁচকে বসে রইল সেদিক তাকিয়ে।

জরিনা দরজায় নক করতে গিয়েও থেমে যায়। ভেতর থেকে নীরার গোঙানি আর থেকে থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসছে৷ জরিনার মুখের ভাব বদলে গেল সেই মুহূর্তে। চোখ মুখ কঠিন থেকে কঠিনতর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনল আহনাফের কর্কশ আওয়াজ। সে বলছে,

” তুই আমার খাঁচার পাখি নীরা। যতোদিন আমি মুক্ত না করবো, পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই তোকে মুক্ত করে। পুলিশ আসলে কী বলবি বল? সত্যিটা বলবি? বলে দেখিস তো? তোর যে পরিণতি হয়েছে তোর বোনেরও তাই হবে। আমার বন্ধু মিজানের সেই লাগছে নীলাকে। আমি বললে কালই তুলে নিয়ে আসবে। বল নিয়ে আসব?”

” আপনার পায়ে পড়ি। এমনটা করবেন না। আমি কাওকে কিছুই বলবো না। আমার বোনের ক্ষতি করবেন না। আপনার পায়ে পড়ছি। ” নীরার কন্ঠস্বর দূর্বল শোনালো। কথা বলতে তার মনে হয় কষ্ট হচ্ছে। জরিনারও কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে নীরার কান্না শুনে। আহনাফের গলার স্বর আবার শোনা গেল। নরম সুরে বললো,

” আমার পায়ে নয় তোকে তো বুকে রাখতে চাইরে। তুই ই এমন কাজ করিস বারবার যে বাধ্য হয়ে এতো কষ্ট দেই। আয় আদর করে দেই। আয়। আচ্ছা বলতো পুলিশ আসলে কী বলবি?”

” কিছুই বলবো না।”

” কিছুই কেন বলবি না? কিছু তো বলতেই হবে। আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি কী বলতে হবে। বলবি তুই আর আমি পরস্পরকে ভালোবাসি৷ দুজনের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছে। আমি তোকে কতো ভালোবাসি সেসবও বলবি? বলবি না?”

” হ্যাঁ বলবো।”

” এই তো আমার লক্ষি বউ।”

জরিনার আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল না। ধুপধাপ শব্দে দরজা বারি মারল অনবরত। দরজা খুললো নীরা। প্রচন্ড জ্বরে ভুগলে মানুষ যেমন কাঁপে। তেমন করে কাঁপছে তার শরীর। মুখটা লাল হয়ে আছে। সমস্ত দেহ কাপড়ে ঢাকা। নয়ত ঠিক দেখত সবাই, কী করেছে এই বন্ধ ঘরে আহনাফ তার সাথে। জরিনা না দেখেও বুঝল সব। কোনো কথায় বলতে পারল না জরিনা। বিছানায় শুয়ে মোবাইলে ব্যস্ত আহনাফ। মুখে তার হাসির ফোয়ারা। জরিনা শিকারী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ে রইল ওর দিকে। আহনাফ একবারও এদিকে দৃষ্টি ফিরালো না। নীরা মুখ নুইয়ে রেখেছে। বড়োসড়ো ঘোমটা টানা মুখের উপর। জরিনা আবার আগের মতো গুনগুন করছে আহনাফের দিকে চেয়ে। এবার অপার্থিব সুর তার কন্ঠে। নীরা নিজের কষ্টে এতোটা ডুবে গেছে যে, জরিনার ভয়ানক সুরের দ্যোতনা তার কানে গেলেও মগজে ঢুকলো না। হাত ধরে ধীরে ধীরে নামিয়ে নিয়ে এলো নীরাকে জরিনা। কারো নজর তার উপর পড়ার আগেই আড়ালে চলে গেল সে।

মেহের কিংবা শারমিন কারো কাছেই নীরা গেল না। অবগুন্ঠের আবডালে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে পুলিশকে আহনাফের শেখানো বুলি শোনালো সে। পুলিশ এসপি সুজয় তার শরীরের এমন দূর্বস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে নীরা ছোট্ট করে বলে সে অসুস্থ। জ্বর তার শরীরে। সুজয়ের অনুমতিতে উপরে চলে আসে নীরা। মেহের, শারমিন পিছু ডাকলেও সাড়া দিল না নীরা৷ সে যে বড় অসহায়। দোতলায় উঠে মুখ করতলে ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে আসে তার শরীর কান্নার তোড়ে।

এসপি সুজয় হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় মেহেরের দিকে। তার আর কিছুই করার নেই বলে চলে যায় সে। রইস চৌধুরী লোকলস্কর লাগিয়ে জোর করে বের করে দেয় শারমিন মেহের,রাফসান এবং রাফসানের মা রাহেলা বানুকে। রাহেলা বানুর শরীর প্রথম থেকেই খারাপ ছিল। এখন চূড়ান্ত খারাপ হলো। মাথা ঘুরে অচেতন হয়ে পড়লেন। দ্রুত তাকে হসপিটালাইজড করা হলো। রাফসান, মেহের কিংবা শারমিন সবাই দুশ্চিন্তা করছে নীরাকে নিয়ে৷ রাফসান বাঘা বাঘা লোকদের চেনে।কিন্তু পরিচিত লোকদের ধরেই বা করবে কী? নীরা যেখানে সব মেনে নিল ভয়ে। তাকে তো এখন পাওয়ায় যাবে না নাগালে। রাফসান মায়ের অসুস্থার চিন্তায় থেকেও নীরাকে নিয়ে ভাবছে। বার বার নীরার অব্যক্ত বেদনারা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।

রাত দশটা বেজে বিশ মিনিট। রইস চৌধুরী নিজ কক্ষে পায়চারি করছে। আঞ্জুকে ঘুমের ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। পাশের বিছানায় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে আঞ্জু। রইস চৌধুরীর চোখে ঘুম নেই। তার ঘুম কেড়েছে নীরা। এই মেয়ে তার ছেলের জীবন সংকটের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ হোক, কাল হোক এই মেয়ের কারনে তার ছেলের জীবনে বিপদ নেমে আসবে। রাফসান চুপ করে থাকবে না। কিন্তু কী করবে রইস এই পরিস্থিতিতে। একঘন্টা পায়চারি শেষে আহনাফকে কল করে নিজ কক্ষে ডেকে আনেন তিনি। আহনাফকে বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। রইস চৌধুরী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের হাসিমাখা মুখখানা অবলোকন করে। আহনাফ ভ্রুকুটি করে বললো,

” কী হয়েছে আব্বা? ওভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”

” কিছু না আব্বা। শোনো আব্বা, তোমার কোনো ভয় নেই। কোনো ভয় পাবা না। আব্বা তোমার কিছুই হতে দেবে না।”

” আমি জানি আব্বা। তাই তো এতো সাহস দেখাতে পারলাম তখন৷ সত্যি বলতে রাফসানকে একটুও ভয় করছে না এখন আমার।” আহনাফ হাসছে। রইস ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেও হাসেন৷

” কেন ডেকেছিলে বললে না তো? আর এখনও জেগে আছ কেন তুমি?”

” চিন্তা হচ্ছে তোমার জন্য আব্বা।”

” চিন্তার কোনো কারন নেই আব্বা। সব ঠিক হয়ে গেছে।”

” চিন্তার আসল কারন তো এখনও রয়ে গেছে আহনাফ। তোমার কাছে আজ একটা জিনিস চাইব। দিবা আব্বা?”

” কী চাও!”

” নীরাকে মেরে ফেল আব্বা। ও বেঁচে থাকলেই বার বার তোর উপর বিপদ আসবে। ওকে মেরে ফেললে কারো সাহস হবে না তোর ক্ষতি করার।”

” আব্বা!”আহনাফ বিস্মিত চোখে চিৎকার করে ওঠে।

” আমি অনেক ভাবছি আব্বা। এটাই একটা উপায় আছে। আজ ওর মৃত্যুর পর কালই তুমি বিদেশ যাইবা কয়েকবছরের জন্য। কেউ জানতে চাইলে বলবো তোমরা বিদেশ গেছ। রাফসান ধীরে ধীরে ভুলে যাবে। না ভুললেও ক্ষতি নেই। ওর কী সাধ্য ও নীরাকে খুঁজে পাবে। এরমধ্যে আমিও সিস্টেম করে সবাইকে জানিয়ে দেব নীরা অসুস্থ হয়ে মরে গেছে। ওর বাপ মাকে ভয় দেখালে তারাও তাই বলবে। রাফসান হাজার চেষ্টা করলেও তোমার কিছু করতে পারবে না তখন৷ তোমার বিপদ কেটে যাবে একেবারে। রাজি হও আব্বা।” চাপা স্বরে ছেলের নিকটে দাঁড়িয়ে বলে রইস।

আহনাফ নির্বাক হয়ে রইল।নীরাকে সে সত্যিই ভালোবাসে। হয়তো কষ্ট দিয়েছে রাগের বশে নীরাকে । তাই বলে মেরে ফেলবে এমন কথা স্বপ্নেও আহনাফ ভাবে নি। আহনাফ কিছুতেই রাজি হতে চায় না। কিন্তু আব্বার অনুরোধ এবং যুক্তি অগ্রাহ্য করতেও পারল না। হা না কিছু না বলেই অশ্রুসজল চোখে বেরিয়ে আসে আহনাফ।

দোতলায় নিজের রুমে এলো আহনাফ। বিছানায় শোয়া নীরার মুখশ্রীতে পূর্ণ চাঁদের আলো পড়েছে। কী মায়াবী ঐ মুখখানা! আজই কী শেষ তবে তার এই মায়াবতী দর্শন। আর কী দেখবে না? আর কী ভালোবাসার অনলে জ্বালাবে না সে নীরাকে? কী জীবন তার! জোর করে হাসিল তো করলো কিন্তু পেল না নীরাকে। নীরা যে আজও তাকে ঘৃণা করে। হয়ত মৃত্যুর সময়ও ঘৃণা করবে। চিরকালের জন্য নয়ন মুদবে তাকে ঘৃণা করে। আহনাফ চলে আসে কড়িডোরের কাছে। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে হৃদপিণ্ড জ্বালাতে ব্যস্ত সে। আকাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে ধোঁয়া ছাড়ে। বিরবির করে বলে,

” এ দেহ বাঁচাতে এই মনকে আজ মরতে হবে। নিষ্ঠুর ভাবে মরতে হবে। হায় অদৃষ্ট আমার! এ কী বিষম যন্ত্রণা বুকজুড়ে আজ।”
ক্যাকটাস🌵
পর্ব ০৯
Writer Taniya Sheikh -Tanishq

শুল্ক পক্ষের চাঁদ আকাশে৷ রাত হয়েও আঁধার নয় আলোয় ভাসছে পৃথিবী। স্নিগ্ধ কোমল আলোয়৷ রাফসান হসপিটালের করিডোরের রেলিং ঠেঁসে দাঁড়ানো। বগল দাবা হাতদুটো, চাঁদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ, পা দু’টো ক্রস করা।

” ঘুমাবে না?”

মেহের মলিন মুখে এসে দাঁড়াল রাফসানের পাশে। রাফসান ওভাবেই বললো,

” ঘুম আসছে না। মা ঘুমিয়েছে?”

” হুমম। ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। একটা কথা বলি ব্যারিস্টার?”

” হুমম।”

” তুমি বরং ফিরে যাও আন্টিকে নিয়ে। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়িও না। আর তাছাড়া,,, ” মেহের মুখ ঘুরিয়ে চাইল রাফসানের দিকে। রাফসান জ্বলন্ত চোখে ফিরে তাকাল। বললো,

” তাছাড়া কী মেহের? ”

” আন্টি কেমন হাইপার হয়ে উঠছে বার বার। প্লীজ তার কথার অবাধ্য হয়ো না আর। চলে যাও।” মেহের মৃদু স্বরে বললো

” জাস্ট স্টপ ইট মেহের। এ বিষয়ে একটা ওয়ার্ডও শুনছে চাচ্ছি না এই মুহূর্তে আমি। প্লীজ,,,!”

” আন্টির কন্ডিশন কিন্তু খারাপ হতে পারতো। কেন বুঝতে চাইছ না? তার তুমি ছাড়া কেউ নেই। তোমার চিন্তায় বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে তার। আন্টির উল্টো পাল্টা একটা কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে?”

” নীরার কিছু হলে তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে? তোমার কথা কেন বলছি? মেহের আমি কোনোদিন পারবো না ঐ মেয়েটার কিছু হলে।” পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো রাফসান

” কিছুই হবে না ওর। আহনাফ যাই করুক খারাপ কিছু করবে না ওর সাথে। সো রিলাক্স। আর হ্যাঁ ভেবো না নীরাকে ঐ আহনাফের আশায় ফেলে রাখবো৷ জাস্ট কথার কথা বললাম। যে করেই হোক সময় সুযোগ বুঝে ঠিক ঐ জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করবো আমি ওকে। তুমি প্লীজ নিজেকে এসবে জরিয়েও না।”

” কথা শেষ তোমার? স্ট্রেঞ্জ তুমি,তোমরা। আহনাফ ওর সাথে খারাপ কিছু করবে না। ওয়াও! দারুন বলেছ তুমি।” তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রাফসান

” রিলাক্স রাফসান! তুমি যেটা মিন করছ। আমি তেমন করে বলতে চায়নি।আমি জাস্ট,,, ” মেহের থেমে যায়। রাফসান উঁচু গলায় বলে,

” আমি জাস্ট হোয়াট মেহের? আহনাফ কে বিশ্বাস করতে বলো তুমি? ওর জন্মের পর থেকে চিনি ওকে আমি। ও নিজেকেও ওতোটা চেনে না যতোটা ওকে আমি চিনি। ওর মগজ নষ্ট করে ফেলেছে ওর বাবা মা আহ্লাদে, আস্কারায়। তুমি জানো! আমার মনে হয় আহনাফ এখনও দৃঢ় মনে কিছুই চিন্তা করতে পারে। রাগ উঠলে ও ভালোমন্দ জ্ঞান সব ভুলে যায়। আমার ফুপা ফুপি ছেলেকে অমানুষ করে ফেলেছে মেহের। আহনাফ নিজের স্বত্বাকে ভুলে বসেছে। জন্মের পর প্রতিটি মানুষ নিষ্পাপ হয়ে জন্মায় সাথে অসহায়। এই অসহায় শিশুগুলোকে সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক পিতা মাতার উপর অর্পন করেছেন। কিন্তু দেখো কিছু পিতা মাতা কী করে! তারা নিজ হাতে বিপথে ঠেলে দেয় সন্তানদের। সন্তান কষ্ট পাবে,কাঁদবে এটা তাদের সহ্য হয় না। স্বাভাবিক তারা পিতা মাতা, তাদের অন্তর সন্তানের জন্যে পুড়বে। কিন্তু তাই বলে সন্তানের ক্ষনিক হাসির জন্য বিপথ দেখাতে হবে? এটা কী দায়িত্বের খেলাপ করলো না? দায়িত্বের খেলাপ করলে খেসারতও তাদেরকেই দিতে হবে৷ আজ যার খুশির জন্য খারাপ জিনিসটাও তার সহজলভ্য করে দেওয়া হচ্ছে। তাকে বোঝানো হচ্ছে সে যা খুশি করতে পারে,চাইতে পারে,ভোগ করতে পারে। হোক সেটা অন্যায়। একদিন এই সকল অন্যায়,অনিয়ম তাদের সন্তানকে গ্রাস করবে। সেদিন হাজার চেষ্টা করেও ঠিক হবে না কিছু। গাছ একবার নুয়ে গেলে সোজা করা কঠিন মেহের। ছাঁচ থেকে একবার মাটি পুড়ে ঘড়া হয়ে আসলে তাকে ভিন্ন কিছু বানানো সম্ভব ই নয় আর। সম্ভব করতে গেলেই ভাঙতে হয়, চূর্ণ বিচূর্ন করতে হয়। এটা কী সম্ভব ঐ পিতার মাতার জন্য? কুমোর যা অবলীলায় পারে, পিতা মাতা তা সহজে পারে না। মমতা তাদের পারতে দেয় না। আজ আহনাফ সৎ নয়, রেপিষ্ট। কার দায় এটা? কিছু সন্তান স্বভাব দোষে দুষ্ট আর কিছু পিতামাতার আদরে স্বভাবটাই হারিয়ে বসে। আহনাফ দ্বিতীয় প্রজাতির জীব৷ তার অপরাধের অর্ধেকাংশর দায় আমার ফুপা ফুপির। সময় ক্ষমতা দেখে না মেহের। সময়ের এক ফোঁড় অসময়ে দশ ফোঁড়। কর্মফল এড়ানোর সাধ্য না আমার আছে না তোমার। আহনাফ বুঝবে কী না জানি না। তবে ভাই হিসেবে ওকে সঠিক পথ দেখানোর দায় আমি এড়াতে পারবো না৷ নীরার পরিনতি আমাদের দায়িত্ব হীনতার ফল। কী করে এভাবে ফেলে যায় তবে ওকে বলো?” রাফসান শ্বাস ফেললো এতোক্ষনে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ রইল সেসময়। নিরবতা ভেঙে রাফসান শীতল গলায় বললো,

” আ’ম সরি মেহের। ওভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি তোমার উপর। রাগ করো না। ”

” ইটস ওকে রাফসান। ভুলটা আমারই ছিল। আন্টিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে খুব আমার।” মেহের মুখ নামিয়ে বললো

” ডোন্ট ওয়ারি। মা’র কিছুই হবে না।” রাফসান মৃদু হাসলো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে চেয়ে রইল আকাশে।

মেহের মুখে তুলে চাইল রাফসানের সামনে ফেরানো মুখটায়। অপলক তাকিয়ে আছে রাফসানের সুন্দর মুখখানার দিকে সে। চাঁদের আলোও বুঝি আনন্দিত ও মুখে পড়েছে ভেবে৷ মেহেরের খুব হিংসে হলো চাঁদের আলোর উপর। কেন হলো হিংসে? মেহের লজ্জায় আরক্ত হয়ে মুখ নামিয়ে নিল। ২৭টি বসন্ত পার করে এসেছে। কভু সে বসন্ত দোলে নি মনে।অথচ আজ! আজ সমস্ত বিগত বসন্তেরা নানা রঙে রূপে আলোড়িত করছে হৃদয়। অনেক কথায় বলার ছিল সবই ভুলেছে মেহের। তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সবটা ভুলে গেল। নারী স্বত্বার আস্বাদ অনুভব করছে এই ক্ষণে সে। তার নারীত্ব বুঝি ধন্য হবে এই পুরুষের একটু ভালোবাসায়।একটু! না না। এই পুরুষের মনের রাজ্যের একছত্র সম্রাজ্ঞী হবে সে। অন্য কারো প্রবেশাধিকার মোটেও বরদাস্ত করবে না। একচুলও না। মেহের করিডোরের লোহার রেলিংটা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে৷ লজ্জা রাঙা মুখটা সামান্য উন্নত করে আরেকবার চাইল রাফসানের মুখের উপর৷ বুকটা বুঝি তড়িৎ গতিতে ধড়ফড় করছে। মেহের চাঁদে দিকে তাকিয়ে মনে মনে অনুযোগ করল

” আমার এই সর্বনাশ তোর কারনে হলো আজ। ব্যারিষ্টারের প্রেমে মাঝ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে ভাসা মনটা নিয়ে কোথায় যাবো আমি এখন? বল আমায়! সর্বনাশি পূর্নিমার আলো। সব দোষ তোর এই রাতের।”

দু’টো মানুষ পাশাপাশি অথচ মন দু’দিকে বেঁকে গেছে৷ এতো কাছে তবুও বোঝে না কেউ কারো মন। এজন্যই বলে বুঝি বিচিত্র, বড় বিচিত্র এ মানব মন।

[ এর পর পাঠকরা নীরার নিজ বর্ণনা পাবেন না। তার স্বীয় বর্ননার স্থানে তৃতীয় পক্ষ বর্ননা করবে]
নীরাকে দুবাহুর মাঝে খুব আবেশে বেঁধে আছে আহনাফ। চক্ষু ছলছল। পাছে নীরা বুঝে যায়, সেই কারনে নীরার হাড্ডিসার সিনার উপর মুখ লুকিয়ে আছে সে। পৃথিবীটা আজ বড় নিষ্ঠুর, নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে আহনাফের কাছে। নিজেকে তারচেয়েও বেশি হীন,অপদার্থ মনে হচ্ছে। মৃত্যুকে এতো ভয় কেন তার? কেন সে বাস্তবতা মেনে মাথা নত করতে পারছে না ন্যায়ের সম্মুখে। জীবনে করা সকল অন্যায়,অপরাধ আজ তাকে হীন,ভীত করে তুলছে। মূল্য দিতে হবে প্রিয় মানুষটার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। চিরজীবনের জন্যে বিদায় দিয়ে। আর এই উষ্ণ আবেশ সে পাবে না। আহনাফ ঘুমন্ত নীরার ওষ্ঠ পাগলের মতো চুম্বন করতে থাকে। নীরার আতঙ্কিত ঘুমজড়ানো ভীরু নেত্র পল্লবের মাঝের দৃষ্টি ফাঁকে ফাঁকে সে দৃশ্য দেখছে। আহনাফ আজ ব্যথা দিল না শুধুই ভালোবাসলো তাকে। যেন সারাজীবনের ভালোবাসা একবারে উজাড় করে দিল। নীরার চোখে আজও জল এলো, তবে কষ্টের নয় অন্য এক অনূভূতির। আহনাফকে সে ঘৃণা করে। মনে প্রাণে ঘৃণা করে। আজ বিকালে যা করেছে তারপর তো আরও৷ আজ হঠাৎ নীরার মন অকারণেই আশা বাঁধতে চাইলো। এভাবে ঘৃণার খেলায় লাভ তো কিছুই নেই। মানুষ ভুল করে। আহনাফও করেছিল। সেকি সব ভুলে একটিবার ক্ষমা চাইতে পারতো না নীরার কাছে? নীরা কী ফিরিয়ে দিত? দিলে আবার ক্ষমা চাইতো। একবার,দুইবার একসময় ঠিক ক্ষমা করে দিত। কিন্তু কই! একবারও তো ক্ষমা চাইলো না সে। বরং বার বার আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে তুললো তাকে। এই কী তার ভালোবাসার নমুনা? এমন করেও বুঝি কেউ ভালোবাসে? এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো। একবারে মেরে ফেলুক আহনাফ তাকে। তাতেও যে তার শান্তি। এমন ভালোবাসার মরিচিকায় তো থাকতে হয় না তবে আর।

বিবস্ত্র দু’টি দেহ পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আদি মানব মানবি যেমন ছিল। লজ্জাহীন,সংকোচহীন। কোনো ক্লেশ নেই আছে শুধু ভালোবাসার অতৃপ্ততা। ঐটুকু পেলেই বুঝি সার্থকতা এ দুটি জীবের। দুজনে বেখবর দুজনার মনের গহীনের ঝড়ের। একজন তবুও নিরাশায় আশা বেঁধে আছে। অপরজন তো সেটাও জলাঞ্জলি দিয়েছে বহুক্ষণ পূর্বে। তার জন্য এই অন্তিম ক্ষন অনেক দামি।

ঘড়ির পেন্ডুলাম ডং ডং করে জানান দিল সময় হয়েছে অন্তিম সময়ের। দু’টি জড়ানো দেহের একটি আতঙ্কিত মুখে ধড়ফড়িয়ে উঠল। অপরজনের চোখে কৌতূহল। তার কৌতূহল বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য হলো না৷ আহনাফ এলোমেলো ভাবে কী যেন খুঁজছে। নীরা চাঁদর জড়িয়ে বসে দেখছে ভ্রুকুটি করে। কেমন যেন লাগছে আহনাফকে তার। এমন তো কখনো করে না সে। ভয় লেশমাত্রও থাকে না যখন এ ঘরে আহনাফ থাকে। তবে কী হলো এখন? ফ্লোরে ছড়ানো কাপড় পড়ছে অস্থির হাতে। মৃগী রোগীর মতো অস্থিরতা তার মধ্যে। ঘামছে প্রচন্ড তার কপাল।

আহনাফের কলিজা বুঝি কামড়ে ধরেছে কেউ। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? কেন? না সে পারবে না। কিছুতেই পারবে না নীরাকে হারাতে। সে ভালো হয়ে যাবে। নীরার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইবে। অনেক ব্যথা দিয়েছে আর দেবে না। কোনোদিনই না। তার দোষে কেন নীরা কষ্ট পাবে। দোষ তো সব তার। হ্যাঁ সব পাপ তার। তবে প্রায়শ্চিত্তও তারই হওয়া উচিত। আহনাফ সকল বাধা নিষেধের সাথে মনে মনে যুদ্ধ করে অবশেষে জয়ী হলো। পূর্নিমার আলো তার মনের সকল আঁধার দূর করল এক নিমেষই। সে সব হারাতে রাজি তবুও তার নীরাকে নয়। অশ্রুসজল চোখে নীরার দিকে ঘাড় ঘুরে তাকায় আহনাফ। নীরা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আহনাফকে দেখছে। তার আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে দ্বিগুন আলোয়। সেই আলো ডগমগ করলো হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনে। বড় বেসুরো লাগলো এই সুরও আজ দুজনের কাছে।

আহনাফ কল রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে তার আব্বা রইস চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললো,

” সব রেডি। বাড়ির পেছনের জঙ্গল মাড়িয়ে চলে এসো রোডে।”

” আব্বা একটা জরুরি কথা ছিল। প্লীজ বাসায় এসো।”

” আহনাফ! সব কথা পরে। যা বলেছি তাই করো। রাস্তা নির্জন এই মুহূর্তে । ভোর হওয়ার আগেই যা করার করতে হবে। তাড়াতাড়ি এসো।”

আহনাফকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে কট করে লাইনটা কেটে দিল রইস। আহনাফ চিন্তায় পড়ল। সকল চিন্তা নিমেষে কেটে গেল বিছানায় বসা চাঁদ মুখখানা দেখে। সে ভেবে নিল এই চাঁদ কোথাও যাবে না। যা বলার,করার সেই করবে। আহনাফ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে নীরার পাশে বসল। নীরার কপালে চুমু খেয়ে বললো,

” ঘুমিয়ে পড়।” আহনাফ বিছানা ছেড়ে উঠতেই নীরা হাত টেনে ধরল। উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,

” কোথায় যাচ্ছেন এতোরাত্রে? আমাকে একা রেখে যাবেন না প্লীজ।”

” এক্ষুনি আসছি। ভয় নেই। কিছুই হবে না তোর। কিছু হতেই দেব না আর আমি। ঘুমিয়ে পড়।”

নীরা আহনাফের কথা মানতে শুয়ে পড়ে৷ চোখ মেলে চেয়ে দেখে আহনাফের যাওয়া। বাইরে থেকে দরজা ভিরিয়ে দেওয়ার সময় আহনাফ মুচকি হাসল। নীরাও হাসল প্রত্যুত্তরে। আহনাফ দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়। নীরা ভাবছে এমন করেই যদি আহনাফ প্রতিদিন প্রতিক্ষণ তাকে ভালোবাসতো। পরক্ষনেই নিজের দুর্ভাগ্যকে পরিহাস করে বললো,

” এতো আশ না রাখ মন। আশা ভাঙার জ্বালা যে বড় কষ্টের।”

গায়ে কাপড় জড়িয়ে উঠে জানালা ধরে দাঁড়ালো সে। কী মিষ্টি পরিবেশ বাইরে। ঘন ঝোপঝাড় আর ঐ যে বাঁশ ঝাড় তার মাথার উপর জ্বলছে রুপালি চাঁদ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নীরা। ভাবছে তার জীবনে এমন আলো কেন নেই? কী এমন পাপ করেছিল সে জীবনে? কেন এমন দুর্দশা এই ললাটে তার? সবার মতো স্বাভাবিক কেন হলো না তার জীবন? অজান্তেই চোখ বেয়ে জল গড়াল দু’ফোটা। চোখ মুছে বাড়ির নিচে তাকাতেই চমকে উঠল সে। ঝোপঝাড় মাড়িয়ে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে অদূরের রাস্তার দিকে। কে? স্বগতোক্তি করল নীরা৷ ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝল ওটা আহনাফ। চাঁদের আলোয় এখন অনেকটা স্পষ্ট তার অবয়ব। কিন্তু আহনাফ জঙ্গলাকীর্ণ ঝোপঝাড় মাড়িয়ে যাচ্ছে কোথায় এতো রাতে? তার যাত্রাপথে দৃষ্টি অনড় রাখল নীরা।

পায়ের তলায় শুকনো পাতা পড়তেই খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে শব্দ হচ্ছে। এদিকটায় রাতে কখনোই আসা হয়নি আহনাফের। জীবনটাই এমন, যা হয় নি পূর্বে তাই হবে ভবিষতে।মানিয়ে চলতেই হবে। আহনাফের ধ্যান ধারণা একরাতেই বিস্তর পরিবর্তিত হলো। ভালোবাসার শক্তি বুঝি একেই বলে। জোস্নার আলোতে পথ চলতে সমস্যা না হলেও কেমন গা ছমছম করছে আহনাফের।
পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফুঁকতে ফুঁকতে এগিয়ে যাচ্ছে সে। বাঁশ ঝাড়ের সন্নিকটে এসে থমকে দাঁড়ায় আহনাফ। পাগলিনী বেশে এলো চুলে বাঁশ ঝাড়ের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে জরিনা। তাকে দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে হাত দুয়েক দূরে থামল। জরিনাকে এসময় এই বেশে দেখে কপাল কুঞ্চিত করে আহনাফ বলে,

” খালা তুমি এতো রাতে এখানে?”

জরিনার হাত দু’টো পেছনে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে অপলক তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। চোখ দু’টো যেন কোঠর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলে বাঁচে। দাঁত কপাটি বিশ্রী ভাবে বের হয়ে আছে জরিনার। আহনাফের বুক ধ্বক করে উঠল তা দেখে। আমতা আমতা করে উচু স্বরে ফের জিজ্ঞেস করলো,

” বলো কী করছ এখানে?”

” মাতায় যন্ত্রণা করে রে বাপ। ঘুম আহে না। তোর ভাইডা খালি জ্বালায়।” জরিনা ঘাড় নাড়িয়ে নেকিসুরে বলে।

” ভাই, কার ভাই?”

” কেন তোর। আপন না তয় সৎ। হোক সৎ তাও তো ভাই হয় ক বাপ?”

” তোমার মাথায় আবার সমস্যা দেখা দিছে দেখছি। কী সব উল্টা পাল্টা কথা বলো।যাও বাড়ি যাও।”

” ধমকাইস না রে বাপ। আমারে ধমকাইতাছোস শুনলে রাগ হইব ঐ। আমি কতো বুঝাইতাছি বুঝতাছেই না। সব্বনাশ করবো বইলা তেজ কইরা আছে।”

” কার কথা বলো? ”

” কেন জানোস না? আমার মানিক। ঐ আমারে ঘুমাইতে দিতাছে না রে বাপ। খালি জ্বালাতাছে। টাইন্যা ধইরা এইহানে নিয়ে আইছে। ঐ জিনিস চাইতাছে বার বার।”

” বুঝছি। যাও ঘরে যাও এখন। পরে সময় করে ডাক্তার দেখিয়ে আনবো তোমারে। যাও ঘরে যাও।”

আহনাফ হাতের আধাপোড়া সিগারেট নিচে ফেলে পায়ে পিষলো। জরিনার পাশ কেটে সামনে হাঁটছে আবার সে। খালার মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হয়েছে ভেবে খারাপই লাগলো আহনাফের। মানিক মরেছে সেই কবে। বয়সে মানিক আহনাফের দুই বছরের ছোটো ছিল। মানিক যখন পানিতে ডুবে মরে তখন আহনাফ ছিল পাঁচ বছরের শিশু। মানিককে নিয়ে কোনো স্মৃতিই তার মনে নেই। বড় হয়ে খালার এমন পাগলামো দেখে দেখেই মানিকের কথা শুনেছে সবার কাছে। উদ্ভট আচরণ করে হঠাৎ হঠাৎই খালা। মাথা চূড়ান্ত খারাপ হলেই বটি নিয়ে তেড়ে আসতো তাদের দিকে। সবাই মিলে হাত পা বেঁধে রাখতো তখন। তারপর একাই আবার স্বাভাবিক হয়ে যেত। ডাক্তার মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে বলেছিল। আহনাফরাই গড়িমসি করেছে এ ব্যাপারে। আজ হয়ত আবার তেমন অবস্থা হয়েছে। কথাটা ভাবতেই আহনাফের ভয় ভয় লাগলো। আহনাফের ভয় আরও বেড়ে গেল পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ শুনে। আহনাফ ঢোক গিলে দ্রুত পা চালায়। পেছনের পদধ্বনিটিও তেমন দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। হঠাৎ আহনাফ দূর থেকে আসা অস্পষ্ট কারো চিৎকার শুনতে পেল পেছনে৷ সে ধীর গতিতে হেঁটে শুনতে চাইল সেই চিৎকার স্পষ্টভাবে। ক্রমশ পরিষ্কার হলো সেই চিৎকারের গলা। একি! এ যে নীরার গলা। আহনাফ পেছনে ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে প্রবল বেগে উড়ে এসে ধারালো কিছু তার গলায় এসে বিঁধলো। হাঁটু ভেঙে ধপাস হয়ে পড়ল আহনাফের ছিন্ন মস্তকহীন দেহ শুকনো পাতার আবর্জনার উপর।

এ দৃশ্য দেখামাত্র চিৎকার করে অদূরেই জ্ঞান হারালো নীরা। জরিনা উন্মাদিনীর বেশে আহনাফের ছিন্ন ধড়ের ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত দু’হাতে নিয়ে উল্লাস করছে। সামনে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে,

” ও মানিক খুশি হইছোস তো? এবার আর রাগ হইবি না তো মায়ের উপরে? দ্যাখ,দ্যাখ রইস্যার বংশ নির্বংশ হইছে। জালেমের বংশ নির্বংশ কইরা দিছি। এহন আমার কাছে তুই আয় মানিক। ও মানিক আয় আয়। ”

নীরার চিৎকারে বাড়িতে থাকা আড়তের লোক দুজন ছুটে আসে। এমন লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড দেখে ভীত সন্ত্রস্ত তারা। একজন দ্রুত মোবাইল করে জানালো রইস চৌধুরীকে। আঞ্জুকে ঘুম থেকে উঠানো হলো। আঞ্জু ছুটে এসে সেখানেই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে পড়ে সন্তানের নির্মম মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। তার শরীর পাথুরে মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে আছে শোকে। রইস চৌধুরী ছুটে এসেছে ততোক্ষণে ঘটনাস্থলে। যা ভেবেছিল নীরার সাথে করবে তা যে তার চোখের মনির সাথেই হলো। একি ভাগ্যের পরিহাস। সন্তানের দ্বিখন্ডিত দেহ দেখে গগনবিদারী আর্তচিৎকার করে ওঠে রইস। আহনাফের রক্তে রঞ্জিত জরিনার অট্টহাসি তাকে দিকবিদিকশূন্য করে তোলে। আবজর্নার উপর পড়ে থাকা বটি তুলে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে কোপাতে থাকে জরিনাকে সে। জরিনা হাসতে হাসতে প্রাণ ত্যাগ করে। রইস তবুও থামে না। ভয়ে ধারের কাছেও ঘেঁষে না কেউ। রইস চৌধুরীর বোধশক্তি বুঝি শূন্যের কোঠায় নেমেছে। না হুশ আছে, না খেয়াল কোনোকিছুর।

ভোরের আলো ফোটার পূর্বেই পাড়া,মহল্লা শোকাচ্ছন্ন আহনাফ এবং জরিনার মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে। সবাই ছুটে এলো সচক্ষে দেখার অভিপ্রায়ে। চৌধুরী বাড়ির পেছন প্রাঙ্গনে লোকে লোকারণ্য। যা ছিল এতোদিন এই চারদেয়ালে বন্দি ; সবই দিনের আলোয় উদ্ভাসিত হলো আজ। সত্যিই সত্য চাপা রাখা সহজ নয় বটে।

চলবে,,,
চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here