ক্যাকটাস
পর্ব ১২
Writer Taniya Sheikh-Tanishq
ছুটির দিন হওয়ায় শপিংমল আজ খুব সরগরম। কাস্টমারের ভীর বেড়েছে প্রসাধনী সামগ্রীর এই কর্ণারটাতে। সাদা-কালো ছাপার কামিজের উপর কোম্পানির ট্যাগ লাগানো নেভি ব্লু টিশার্ট পরেছে নীরা। উপরে হিজাব বাঁধা পরিপাটি করে। অন্যান্য মেয়েরা একটু আকটু সাজগোজ করলেও নীরা একদম সাদামাটা। সাজের বালাই নেই তার মুখশ্রীতে। বিনম্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। কাস্টমার এগিয়ে আসলেই হাসি মুখে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করছে,
” হাও ক্যান আই হেল্প ইউ ম্যাডাম/স্যার ?”
যেই প্রোডাক্টটাতে কাস্টমার আগ্রহ দেখাচ্ছে সেটা যথাসাধ্য ধৈর্য্য এবং দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করছে নীরা ।মার্কেটিং পেশাটায় এমন। ধৈর্য্য, বাকপটুতা এবং দক্ষতা অপরিহার্য। দ্বিতীয়,তৃতীয়টাতে বড্ড বেশি অভাব নীরার মধ্যে। তথাপি সে আজ বেষ্ট দেখানোর চেষ্টা করছে প্রাণপণে। ম্যানেজার আজ নীরার কর্মচাঞ্চল্য দেখে বেশ অবাক হলো। অন্যদিন কাস্টমারের সাথে কথা বলতে গেলে তার মধ্যে জড়তা লক্ষ্য করা যেত। প্রোডাক্ট সেল করতেও হড়বড়ানি ছিল খুব৷ আজ অনেকটা দক্ষতা দেখাচ্ছে সে। একরাতের ব্যবধানে এতো পরিবর্তন? ম্যানেজার লাঞ্চ টাইমের আগ পর্যন্ত নীরাকে অবজার্ভ করলো। গুরুতর ত্রুটি পাওয়া গেল না অন্যদিনের মতো। ম্যানেজার মনে মনে খুশিই হলো। নীরার এ মাসের পারফরমেন্স যথেষ্ট ভালো না হলে ম্যানেজার তাকে জব থেকে ছাঁটাই করে দেবে বলে মনস্থির করেছিল। তবে এখন কেন যেন ম্যানেজারের মনটা নরম হলো কিছুটা। আরও তো অর্ধেক দিন বাকি মাসের। দেখাযাক কী হয়? ম্যানেজার ভাবনা চিন্তা ভুলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
লাঞ্চ টাইমে কিছু স্টাফ দোকানের ভেতরের ফ্লোরে বসে লাঞ্চ শেষ করছিল আর কিছু ক্যান্টিন গেল। নীরা সহকর্মী শিলাসহ আরও দু’জন মেয়ের সাথে লাঞ্চ করছিল বসে। ইতিমধ্যে ক্যান্টিন থেকে তিন’টে বার্গার নিয়ে সেখানে যোগ দিল তাদেরই আরেক সহকর্মী আরমান। একটা বার্গার নিজের কাছে রেখে বাকি দু’টো নীরা এবং শিলার টিফিন বক্সের ঢাকনার উপর রাখল। নীরা এবং শিলা অপ্রস্তুত হয়ে সমস্বরে বললো,
” এসব কী?”
” বার্গারও চিনিস না তোরা?” আরমান বার্গারে কামড় দিয়ে হাসল। নীরা শিলা একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। শিলা নীরার চাহনী বুঝে কটমট করে চাইল আরমানের মুখের দিকে। বললো,
” তোর চেয়ে ভালো চিনি এসব বুঝলি?”
” তাহলে প্রশ্ন করলি কেন?”
” প্রশ্ন করবো না? তুই এখানে রাখলি কেন?”
” ফটো তুলবো তাই। তোদের খাওয়ার জন্য রেখেছি বলদি। খা চুপচাপ। ” আরমানের ধমকে বলা কথাগুলো শুনে শিলা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওর বাহুতে ঘুষি দেয়। আরমান আহ! করে ওঠে সাথে সাথে৷ বলে,
” গুন্ডি, মারলি কেন?”
শিলা কিছু বলবে তখনই তাকে থামতে ইশারা করে নীরা। আরমানের দিকে তাকিয়ে বলে,
” এসব কী ঠিক আরমান? ক’টাকা বেতন পাস তুই? মাত্র তো সাত হাজার। তোর কাঁধে সংসারের ভার। এসব আজাইরা খরচ করতে নিষেধ করেছি না তোকে?”
” আরে আজাইরা কই? আজ তোর পারফরমেন্স দেখেই তো ট্রিটটা দিলাম। এক রাতে এতো বদলে গেলি কেমনে রে তুই? গতকালও কাস্টমার দেখলে তোতলাতি আর আজ ফ্লুয়েন্টলি কথা বলছিস। আমি তো অনেক খুশি তোর উন্নতিতে। ”
আরমান দ্বিতীয় কামড় বার্গারে দিয়ে ইয়াম, ইয়াম করে। নীরা নিজের খাবারের অর্ধেক ওর দিকে এগিয়ে বলে,
” তোকে কতোবার বলেছি আমার খাবার কিংবা শিলার খাবার শেয়ার করিস। অযথা খরচ করার প্রয়োজন কী বল? তুই সব বুঝেও অবুঝ কেন আরমান?”
আরমান সেকথা এড়িয়ে যায়। শিলা এবং নীরাকে জোর করে বার্গারটা খাওয়ার জন্য। নীরা কিছুতেই খাবে না। শেষে মুচলেকা স্বরুপ আরমানকে ওয়াদা করতে হয় এমন অপচয় নেক্সট টাইম থেকে সে আর করবে না। যদিও আরমান জানে এসব ওয়াদা ফোয়াদা তার জন্য জাস্ট কথার কথা। শিলা ছাড়া বাকিরা ইশরায় টিপ্পনী করে আরমান এবং নীরাকে নিয়ে। তাদের ধারণা আরমান নীরার মধ্যে গভীর প্রেম। শুধু শিলা জানে সবার ধারণা ভুল। তবে হ্যাঁ কোন একসময় আরমান নীরাকে বলেছিল, সে ভালোবাসে নীরাকে। আরমান এখন নীরার কাছে ওয়াদাবদ্ধ। ফ্রেন্ডশিপ ছাড়া ভিন্ন কিছুই আরমান প্রত্যাশা করবে না আর। শিলা জানে আরমান একসময় কতোটা চাইতো নীরাকে। নীরার কালো অতীত জানার পরও সে নীরাকে অসম্মান করেনি। নীরার খুশির জন্যে ওয়াদা করেছিল নীরাকে ঐ নজরে আর দেখবে না সে। তাদের ফ্রেন্ডশিপটা টিকেই আছে ভালোবাসার নিষেধাজ্ঞা মান্য করে। আরমান এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। তাইতো শিলার প্রপোজে সহজে হ্যাঁ করে দিয়েছে। হ্যাঁ এই তিনজন ছাড়া কেউ জানে শিলা এবং আরমান সম্পর্কে আছে। কিছুদিন পর হয়তো বিয়েও করে নেবে তারা। আরমানের মনজুড়ে শিলা বর্তমান তবে নীরাকে সে যথেষ্ট পছন্দ করে, সম্মানের চোখে দেখে। এর ভিন্ন আর কিছু তার মনে এখন আর নেই ভাবলেও ভুল হবে। ভালোবাসা শব্দটা দ্রুতই শেষ হয় না।ঘোর কাটতে কারো বহুবছর লাগে তো কারো চিরজীবন।
নীরা সামান্য একটু ছিঁড়ে খেয়ে বাকিটুকু বার্গার সহকর্মীদের ভাগ করে দেয়। শিলা এবং আরমান অবাক হয় না তাতে। গত তিনমাস ধরে এই মেয়েকে তারা চেনে। চিনলেও ক্ষণে ক্ষণে অচেনা হয়ে পড়ে হঠাৎ নীরা তাদের চোখে। এই যেমন আজ বিস্তর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার মধ্যে। সবার চেয়ে আলাদা নীরা তাদের কাছে। এই খুশি, এই গম্ভীর। কাস্টমার এসে দাঁড়ালে হাসবে তারপর মুখশ্রীতে মেঘের ঘনঘটা। চিন্তায় ডুবে থাকে সর্বক্ষণ। আরমানের এখনও মনে পড়ে প্রথম প্রথম যখন জয়েন করেছিল নীরা তখনকার কথা। বোকা একটা মেয়ে,ভয়ে তটস্থ থাকতো সবসময়৷ কাস্টমারের প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে কেঁদেও ফেলেছে বহুবার। সাথে ম্যানেজারের ধমক আর বাকিদের উপহাসের নজর তো ছিলই তাকে ঘিরে। গতকালও ধমক খেল এতোগুলো কাস্টমার এবং স্টাফের সামনে। বিনাদোষে ক্ষমা চাইতে হলো ঐ বদ, অসভ্য পুরুষ কাস্টমারটার কাছে। নেহাতই আরমানের জব প্রয়োজন ছিল বলে ম্যানেজার এবং ঐ বদ লোকটা পার পেয়ে গেল। আরমান শিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। শিলাও হাসলো লাজুক মুখে।
যথারীতি কাজ পুরোদমে শুরু হলো আবার ওদের। কেউ কারো দিকে তাকানোর অবসর পাচ্ছে না কাস্টমার সামলাতে গিয়ে। নীরা সবেমাত্র একজন কাস্টমারকে বিদায় করে এলোমেলো আইলিনারগুলো সাজাচ্ছিল। একটা নিতে দশটা এলোমেলো করে কেউ কেউ। নীরাকে ধৈর্য এবং বিনম্রতার সাথে সেটা হ্যান্ডেল করতে হয়। হঠাৎ পেছন থেকে মেহেরের কন্ঠস্বর শুনে চমকিত হলো সে। আইলিনারগুলো হাতের মুঠে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মেহেরকে দেখে যতোটা খুশি হয়েছিল,পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখামাত্র দ্বিগুন অখুশি হল সে। মুখ থেকে হাসি গায়েব হয়ে সেখানে ফুটে উঠল একরাশ অস্বস্তি। দৃষ্টি অবশ অবশ লাগলো৷ অনিচ্ছা পূর্বক হাসলো মেহেরের দিকে তাকিয়ে। মেহের আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে বললো,
” কেমন চলছে তোর জব?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো।” নীরা আস্তে করে জবাব দিল।
” রাফসানের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম এদিকটাই। ভাবলাম তোকেও দেখে যায়। তাছাড়া একটু পরই তো তোর ছুটি হবে। একসাথেই যাব তিনজন। তাই এলাম।”
নীরার ঘাম ছুটে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে। রাফসানকে নয় সে যেন আহনাফকে দেখেছে এমনভাবে আতঙ্কিত হলো। নীরা এখন আর আগের মতো অতো দূর্বল নেই। তার মানসিকতা গত দু’বছরে অনেকটাই স্ট্রং হয়েছে। ভেতরের আবেগটা চাপতে তাই তেমন বেগ পেতে হলো না তার। মেহেরের কথা শুনেও রাফসানের দিকে দ্বিতীয়বার তাকালো না সে। কাঁপা হাতে ধরা আইলারগুলো বক্সে রেখে হাত মুঠ করে পেছনে লুকিয়ে মেহেরকে বললো,
” আপু আজ আমার দেরি হতে পারে। এতোক্ষণ অপেক্ষা করবে শুধু শুধু?”
” সমস্যা নেই। আমাদের এখানে কিছু কাজ আছে। তুই নিশ্চিন্তে কাজ শেষ কর। তোকে নিয়েই যাব।” মেহের রাফসানকে এগিয়ে আসতে বলে নীরার আশেপাশে সাজানো প্রোডাক্ট গুলোয় চোখ বুলিয়ে নেয়। নীরার পাশে দাঁড়ানো সেলস গার্লের সাথে কথা বলছে মেহের। মেয়েটির নাম আভা। নীরার চেয়ে বছর দেড়েক বড়। একবছর হলো জবটা করছে সে। নীরার পরিচিত আপু জেনে মেহেরের সাথে বেশ খোশ মেজাজে পরিচিত হলো আভা। মেহের ভালো ব্রান্ডের একসেট মেকাপ ব্রাশ দেখতে চাইলো তার কাছে। মেয়েটি বেশ উৎসাহ নিয়ে সেটা দেখাচ্ছে মেহেরকে।
এদিকে নীরা রাফসানের সাথে একসঙ্গে কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। রাফসানের উপস্থিতিই অপছন্দ করছে সে। হোক রাফসান তার ব্যাপারে মেহেরকে হেল্প করেছিল তবুও অপছন্দ নীরার সে। আহনাফের ভাইকেও নীরা আহনাফের মতোই অপছন্দ করে। শুধু রাফসানকে নয় তার পুরো পরিবারকেই। এদের জন্যেই আজ তার জীবন নরকসম। সে যতোই সব ভোলার চেষ্টা করছে ততই কেন এরা এসে সামনে দাঁড়াচ্ছে? তিক্ততায় ভরে ওঠে নীরার মন। মুখ,চোখে কাঠিন্য চলে আসে।
” কেমন আছো নীরা?” এগিয়ে এসে ভরাট গলায় বললো রাফসান। নীরা গতরাত নির্ঘুম কাটিয়ে মনে মনে নিজেকে শক্ত করেছে,প্রস্তুত করেছিল নিজেকে একা সকল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়ার মানসে। এইক্ষণে তার সব পরিশ্রম বিফলে গেল। আবার ফিরে এলো তার মধ্যে জড়তা। আমতা আমতা করে নত দৃষ্টিতে জবাব দিল,
” জি আলহামদুলিল্লাহ।” রাফসানকে এড়িয়ে সে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” মেহের আপু, কিছু খুঁজছ তুমি?”
মেহের আভার নিকট থেকে পছন্দসই একসেট ব্রাশ নিল। তারপর আবার এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘুরালো। আভা ততক্ষণে অন্য একজন কাস্টমারকে নিয়ে ব্যস্ত। নীরার ডাকে দৃষ্টি ঘোরানো ক্ষান্ত দিয়ে মেহের বললো,
” হ্যাঁ রে! বাট প্রয়োজনীয় জিনিস দেখছি না তো।”
” দেখছ না বলছ? এখানে প্রয়োজনীয় সবই আছে শুধু খুঁজে দেখার মতো দৃষ্টি থাকা চায়। তবে তোমাকে সেই কষ্ট আমি থাকতে করতে হবে না। বলো কী প্রয়োজন আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি।”
” বাহ! দারুন বলেছিস তো। শারমিনের সিদ্ধান্ত তাহলে সঠিক ছিল। তুই অনেকটা ইম্প্রুভ করেছিস কথাবার্তায়। এখন আর ভয়ে ভয়ে কথা বলিস না। চলাফেরাতেও জড়তা কম। গুড! এমন নীরাকেই তো চায় আমরা। কী বলো রাফসান?”
রাফসান নীরার দিকে স্থির চেয়ে মুচকি হাসল মাথা নাড়িয়ে। নীরার অসহ্য লাগছে এই লোকটাকে চোখের সামনে দেখতে। রাফসানের দৃষ্টির দিকে একপলক চেয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল অবজ্ঞায়। রাফসানের মুখখানা সেই মুহূর্তে আঁধারে ঢেকে গেল। তার উন্মীলিত নয়নে বিষাদের ছায়া। মন ব্যথাতুর হয়ে বলে,
” মনপ্রিয়সী! এতো অবজ্ঞা কিসের লাগি?
কোনসে দোষে করলে দোষী?”
সেসময় কিছু কাস্টমার আসায় তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীরা। রাফসানকে খেয়াল করার অবসর কিংবা ইচ্ছা তার মধ্যে একবিন্দুও নেই। মেহের আশপাশের জিনিস দেখায় মগ্ন। সেদিকে তাকিয়ে ফের বললো,
” এই রাফসান, আন্টির জন্য কী নেওয়া যায় বলো তো? টুসির জন্যেও তো কিছু নিতে হবে।”
রাফসানের কোনো জবাব পেল না মেহের। ভ্রুকুটি করে রাফসানের দিকে তাকিয়ে পিঠে হাত রেখে বললো,
” এই!”
” হুমম!” রাফসান এতোক্ষনে স্বাভাবিক হলো। মেহের চোখ ছোট করে তাকে বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে রাফসান। বুঝতে ব্যর্থ হয়ে মেহের কপাল কুঞ্চিত করে বললো,
” ধ্যান কোথায় তোমার?”
” ওহ! আ’ম এক্সট্রিমলি সরি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বলো কী বলছিলে?”
কথাটা শেষ করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রল করছে। এই মুহূর্তে তার অনুভূতিগুলোর লাগাম টানতে হবে। এখানে আসা তার উচিত হয়নি। বুকের মাঝে চেপে রাখা সেই অদ্ভুদ অনুভূতিটা তাকে দেখামাত্রই যে, হৃদয় সমুদ্রে এমন তরঙবলয় তুলবে কে জানত? রাফসানের নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলা জবাব মেহেরের মন খারাপের কারন হয়। রাফসান মোবাইল মনোযোগ দিয়ে ফের একই কথা জিজ্ঞেস করে। মেহের বলে,
” কিছু না যাও।” মেহের মুখ ভেংচে গাল ফুলায়। সে খেয়ালই করলো না রাফসানের সতর্ক দৃষ্টি বার বার একজনের দিকে গিয়ে ঠেকছে। মেহের ভেবেছিল রাফসান তার অভিমান ভাঙাবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না। রাফসান তাকে একপ্রকার উপেক্ষা করে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঝুকে মোবাইল টিপছে। মেহের কপট রাগে ফুঁসতে লাগলো। সে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেল না তার পাশের মানুষটির নির্বিকার ভঙ্গির আড়ালে কী অস্থিরতা ছিল।
নীরা আগত কাস্টমারকে বিদায় করে আবার এসে দাঁড়াল মেহেরের সামনে। বললো,
” স্যরি আপু।”
” স্যরি কেন বলছিস পাগলি? এটা তো তোর ডিউটি।” মেহের বললো
” আচ্ছা কী লাগবে বললে না তো?”
” ওহ হ্যাঁ! আন্টি আর টুসির জন্যে গিফট নিবো ভাবছিলাম। এই ধর, শাড়ি, থ্রি পিছ সাথে এই টাইপ কিছু আরকি।”
” বুঝেছি। ওগুলো ঐ ডানদিকের সেকশনে আছে৷ আসলে আমার সেকশনে শুধু বিউটি প্রডাক্টই আছে।ওটা অন্য একজনের দায়িত্বে। ওয়েট আমি ওকে বলছি তোমাকে দেখিয়ে দেবে।” নীরা উঁচু গলায় আরমানকে ডাকলো। আরমানের অভ্যাস নীরা ডাক দিলেই মজা করে হ্যাঁ জানু বলে। তবে সবসময় নয়। আশেপাশে কেউ না থাকলেই এমনটা বলে। সে মেহের এবং রাফসানকে খেয়াল করে নি বলেই ডাকটা দিয়েছিল। একগাল হেঁসে এগিয়ে আসতেই মেহের এবং রাফসানকে দেখল। মেহের বেশ চটে গেল আরমানের ডাকটা শুনে। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রইল নীরার দিকে। নীরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল তাতে। আরমানকে পিটাতে ইচ্ছা করলো ওর। কতোবার নিষেধ করেছে এমন বাজে মজা না করতে ওর সাথে। একা পাক তার পর সে আজ কড়া কথা শুনিয়ে দেবে। তাতে বন্ধুত্ব না থাকলেও কিছু করার নেই৷ আরমান জিহ্বা কামড়ে নীরার ক্ষুব্ধ দৃষ্টির দিকে চেয়ে সরি বলে। নীরা দাঁত কামড়ে রাগ দমন করে বললো,
” মেহের আপুকে তোমার সেকশনে নিয়ে যাও তো।”
মেহের নামটা শুনে ঢোক গিললো আরমান। ভালো করে মেহেরের দিকে চেয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,
” আসসালামু ওয়ালাইকুম আপু।”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম! কী বললে তখন নীরাকে?” মেহের ভেতরে জমানো রাগটা আরমানের উপর ঝাড়ল।
” আপু ওটা জাস্ট মজা করে বলেছি। উই আর জাস্ট ফ্রেন্ড। ”
” কোনো জাস্ট ফার্স্ট ফ্রেন্ডশিপ করবে না ওর সাথে। নীরা তোকে কি বলেছিলাম? ” মেহের ধমকে ওঠে
” আপু ও ভালো ছেলে। তুমি,,” নীরাকে থামিয়ে দিয়ে মেহের রাগত স্বরে বলে,
” আমাকে ভালো খারাপ চেনাতে আসবি না একদম।”
আরমান প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে যায় নীরার ইশারায়। সে এখন ঝামেলা চাচ্ছে না। এমনিতেই তার ভেতর কী চলছে সেই কেবল জানে। মেহের আপুকে বাসায় গিয়ে খুলে বললে সে নিশ্চয়ই বুঝবে। নীরা মনে মনে নিজেকে তারজন্য প্রস্তুত করে নেয়।আরমানকে যেতে বলে শিলাকে ডাকে নীরা। মেহেরকে শিলার সাথে পাঠিয়ে বুকে হাত রেখে দম ছাড়ে অবশেষে সে। নীরা খেয়াল করেনি রাফসান তখনো সেখানে দাঁড়ানো। এদিকটাই ঘুরতে সামনের একজোড়া জ্বলন্ত চোখ দেখে আৎকে ওঠে সে। তাহলে নীরার শব্দ করে দম ফেলাটা রাফসান দেখেছে? নীরা এদিক ওদিকের গোছানো পণ্য সামগ্রী ফের গোছায় রাফসানকে উপেক্ষা করে। বুকটা ঢিপঢিপ করছে তার। রাফসান চোয়াল শক্ত করে দ্রুত পদে মেহেরের ডাক শুনে সেদিকে চলে যায়। নীরা ঘার বাঁকিয়ে ভ্রুকুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে রাফসানের যাওয়ার পথে চেয়ে।
চলবে,,,
পর্ব-১৩
Writer Taniya Sheikh-Tanishq
এই শহরের প্রাণচাঞ্চল্যের উত্তাপে ম্লান পৌষ।
এখানে কুয়াশা হারায় অট্টালিকার পাছে, ঠিক আমারই মতো যেন।
হারিয়ে, ফুরিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য বলতে আছে মাত্র এ দেহ।
রাফসান গাড়ি ড্রাইভ করছে। ব্যাক সিটে বসে আছে নীরা। উদভ্রান্ত নজরে বাইরেটা দেখছে সে। এমনভাবে বসে আছে যেন কোনো ভাস্করের নিপুণ হাতের তৈরি এক ছন্নছাড়া মানবীর ভাস্কর্য। সম্পূর্ণই বুঝি তার নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন। এখানে থেকেও সে নেই এখানে।
পাশে বসে মেহের ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছে। একটু পরপর বলছে বুঝেছ না? রাফসান নিরবতা ভেঙে গম্ভীরমুখে ছোট্ট করে বলছে,
” হুম!” তারপর আবার বলে যাচ্ছে মেহের। তার কাজের কথা, তার আসন্ন পোষ্টিংএর কথা সর্বপরি তার বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক কথা। রাফসান শুনছে না এমন নয়। সে শুনছে তবে মনোযোগ তার পেছনে। দৃষ্টিও সতর্কে সেদিকেই বার বার ফিরে ফিরে যাচ্ছে। কী আছে সেখানে পৃথিবীর কেউ না জানুক। কেবল রাফসান তা জানে। কাউকে কী কখনো বলা হবে, এই একপাক্ষিক অব্যক্ত প্রণয়োপখ্যানের আদ্যোপান্ত! হয়তো না, আবার হয়তো বা হ্যাঁ।
“কে বলে ভালোবাসা কেবলই দর্শনে হয়?
এই আমি তো তাকে ভেবে ভেবেই পাগলপ্রায়।”
রাফসান দেখে যাচ্ছে, শুধু দেখেই যাচ্ছে ঐ অস্বচ্ছ কাকচক্ষু। এতো নিষেধ, এতো যে মানা তবুও গ্রাহ্য করছে না মন তার একচুল। এই কী ভালোবাসার অপার ক্ষমতা? এই কী সেই প্রহেলিকা যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। কেন? কেন রে মন? কেন তুই এতো বেয়ারা হলি? কেন সব অসাধ্য জেনেও নিজেকে খোয়ালি ঐ কাকচক্ষুর দূর্ভেদ্য অন্তরালে। পরিনাম জেনেও কেন এ পথে হেঁটে চলেছিস? মৃত্যুকে আলিঙ্গণে ভয় নেই, তবে তাকে পাব না ভাবতেই জগতের সমস্ত ভয় এসে বুকে চেপে বসে। কী যন্ত্রণায় আমার দিবারাত্রি কাটে তা যে শুধু আমিই জানি। লোকে শুনলে হাসবে বলবে,”ত্রিশ পেরিয়েও তুমি এতো বোকা,এতো অধম?”
আমি কী করে বোঝায় তাদের, মনের চোরাবালিতে নিজেকে খোয়ানোর ইতিহাস। সব যদি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, ভেবে চিন্তে তারপর হতো, তবে মজনু মজনু নয় কয়েস রয়ে যেত। গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে শাঁই শাঁই এগিয়ে চলছে। জনবহুল রাস্তার দু’ধার ছেড়ে জনশূন্য ফুটপাথ। সবটা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলছে গাড়ি।
মেহের অনেক্ষণ হলো চুপ করে আছে। সমস্ত মুখ তার বিষন্ন। গাড়ি সিগন্যালে পড়লে রাফসান আরেকবার লুকিং গ্লাসে তাকায়। কোনো হেলদোল নেই ব্যাক সিটে বসা মানবীর মধ্যে। রাফসান তার চোখে নিজের কোনো অস্তিত্বই দেখেনি। দেখবেই বা কী করে? কী হয় রাফসান তার? তেমন কিছুই না হয়েও কিছু। সেই কিছুটাই রাফসানের সকল যন্ত্রণার মূল। এই কিছুটাতেই তাকে বোবা বানিয়ে দেয় নীরার সম্মুখে। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। রাফসান সামান্যের জন্য ধরা পড়ে না নীরার চোখে। নীরার বিরক্ত ভরা চাহনী হঠাৎ তার উপর নিক্ষিপ্ত হয়। দমবন্ধ হতে হতে বাঁচে রাফসান। বড় কষ্টে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে সে। কৈশোরের প্রেমের বাণে বিদ্ধ যুবকের ন্যায় ছটফট করে তার ভেতরটা। রাফসানের খুব ইচ্ছা হচ্ছে আর একটিবার তাকিয়ে তাকে দেখার। এই মুহূর্তে এমন দুঃসাহস দেখানোর অর্থই হলো সর্বনাশকে নিমন্ত্রণ করা। রাফসান দূর্বল চিত্তের কিশোর প্রেমিক যুবক নয়। তার মধ্যে সেই শক্তি আছে যা দ্বারা সহজে না হোক কঠিনে হলেও সব নিয়ন্ত্রণ করা সক্ষম। রাফসান নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হাসল। মেহেরের দিকে নজর পড়তেই ভ্রুকুটি করে বললো,
” কী হয়েছে? ”
মেহের অশ্রু ছলছল বাচ্চা শিশুর মতো তার দিকে তাকায়। যেন এখনই চোখের কোনার বাঁধ ভেঙে জলে ভাসিয়ে নেবে সব। রাফসান নড়েচড়ে বসলো। মেহেরকে এতোটা অসহায় হতে এর আগে দেখেনি সে। স্বভাবতই বিস্ময় তার চোখে মুখে। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে জবাব না পেয়ে। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
” মেহের কী হয়েছে বলো?”
” রাফসান!” মেহের আছরে পড়ে তার বুকে। দু’হাতে গলা জড়িয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। পেছনে বসা নীরা উৎকন্ঠিত মেহেরের কান্নাকাটি দেখে। রাফসান অস্বস্তি অনুভব করছে। নীরাকে এক পলক দেখলো সে। নীরা উদ্বিগ্ন হয়ে আছে মেহেরের দিকে চেয়ে। আচ্ছা একটু হিংসা সৃষ্টি হলে কী হতো তার মনে? রাফসান মনে মনে হাপিত্যেশ করে। রাফসান মেহেরকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। মেহের বোতলটা কোলের মধ্যে নিয়েই নাক টানে। নীরা মুখ এগিয়ে বলে,
” আপু কী হয়েছে? ”
” আব্বু স্ট্রোক করছে,,!” মেহের থেমে যায়। জানালার বাইরে তাকিয়ে চোখ মোছে সে। ঘুরে রাফসানকে বলে,
” আমাকে যেতে হবে রাফসান।”
” অবশ্যই যাবে। চলো আমিও যাব।”
” স্যরি! তোমাকে নিতে পারব না। আমার পরিবারকে তো চেনোই তুমি। প্লীজ কষ্ট নিয়ো না। আমি নিরুপায়। ” মেহের রাফসানের হাতটা নিজের হাতে নেয়। রাফসান নীরাকে দেখে আড়চোখে৷ সে শুধু মেহেরের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। রাফসানকে দেখলে বুঝি ভস্মীভূত হয়ে যাবে। রাফসানের অনুরাগ হয়। রাফসান মেহেরের হাতটা শক্ত করে ধরে আশস্ত করে বলে,
” পাগলি তুমি? রাগ করব কেন? যাও। তবে প্রমিস করো গুরুতর সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। জানাবে তো?”
” হ্যাঁ! ” মেহের আবার গলা জড়িয়ে ধরে রাফসানে। রাফসান মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়। মেহের রাফসানকে অনুরোধ করে রাতটা বাসায় থেকে যেতে। সে না থাকলেও শারমিন এবং নীরা তো আছেই। রাফসান রাজি হচ্ছিল না। এমনিতেও সে নীরার আশেপাশে থাকলে তাল হারাচ্ছে। রিস্ক নেওয়া মানেই দূর্ঘটনা ঘটে যাবে। কতোক্ষন নিজের মনকে বাঁধা নিষেধের বেড়াজালে আঁটকে রাখতে পারবে সে? নীরা মানেই তার জন্য ঘূর্ণিঝড়। তার উপস্থিত সব এলোমেলো করে দেয় রাফসানের। যতো দূরে থাকা যায় ততোই ভালো। যন্ত্রণা হোক তবুও সেটা মধুর। মুখোমুখি হলেই আকাঙ্খা বেড়ে যায়। যা পাওয়ার নয় তার আকাঙ্ক্ষা করা বোকামি। মেহের বার বার অনুরোধ করায় অনিচ্ছা স্বত্বেও রাফসানকে রাজি হতে হলো। তবে শুধু রাতটা থাকবে বলে৷ সকালেই সে চলে যাবে। মেহের ধন্যবাদ দেয় কথা রাখার জন্য। নীরার কাছে এসে বলে দেয় রাফসানের খেয়াল রাখতে৷ নীরা নিতান্তই অনীহা মনে মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বলে। মেহেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নীরার জানা নেই। সে শুধু করুন চোখে চেয়ে রয় মেহেরের যাওয়ার পথে। মেহের মোবাইলের ম্যাসেজ বক্স অপেন করে। একটু আগে ওর ছোট ভাই মাহাদি টেক্সট করেছিল। হসপিটালের নাম,ঠিকানাও দিয়েছে খবরটা জানিয়ে৷ মেহের ঠিকানা দেখে আরেকদফা চোখের জল ফেললো। হাঁটতে হাটতে বনানীর ওভার ব্রিজে উঠে গেছে সে।কল লিস্টে গিয়েই দেখলো পনেরো টা মিসড কল মাহাদির। মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় কিছুই টের পাই নি সে সময়মতো। হঠাৎ মোবাইল অন করতেই টেক্সট চোখে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিল তার পৃথিবী। বাবার সাথে যাই হোক সে তো বাবা ছিল। মেহের তার হাত ধরেই চলতে শিখেছে। সেই বাবার কিছু হওয়া মানেই মেহেরের পৃথিবী শূন্য হয়ে যাওয়া। দূরে থাক তবুও বেঁচে থাকুক বাবা। মেহের কাঁপা হাতে ভাইকে কল করে। ডিটেইলসে সব শুনতে শুনতে বাসে উঠে বসে সে।
সিগন্যাল ছেড়েছে, গাড়ি আবার চলছে। নীরা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মেহেরের জন্য খারাপ লাগছে ওর। মনে মনে প্রার্থনা করছে যেন সব ঠিক হয়ে যায়। সুস্থ হয়ে যায় মেহেরের বাবা। রাফসান একমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। নীরার উপস্থিতি ভেতরটা তোলপাড় করলেও বাহিরে সে নির্বাক, স্থবির।
নীরার প্রচন্ড রকম অস্বস্তি হচ্ছে এই লোকের সাথে একা বাড়ি ফিরতে। আবার থাকবেও নাকি আজ! কবে যে একটা ভালো জব হবে আর এই সব অতীত পিছু ছাড়বে? নীরা আজকাল স্বার্থপর ভাবনা ভাবে। নিজেকে ছাড়া কিছুই তার ভাবনায় আসে না। তার কেউ কোথাও নেই। নিজেকে বাঁচাতে তাকে সব ভুলে সামনে এগোতে হবে। এসব লোক, তাদের ঘেরা অতীত সব উপেক্ষা করবে সে। এই লোকের থাকা না থাকায়, তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগের উদয় হতে দেওয়া যাবে না আর। নীরা মনোযোগ ক্যারিয়ারের ভাবনায় ডোবায়। আজকের মতোই ভালো দক্ষতা দেখাতে হবে তাকে৷ এটাই তার লক্ষ্য হবে,ভিন্ন কিছু নয়।
বাসায় পৌঁছে নীরা ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। সারাদিন কর্মব্যস্ত থেকে এ’সময় বড্ড টায়ার্ড হয়ে যায়। রান্নাঘরে ঢোকার মন মানসিকতা থাকে না৷ অন্যদিন সকালে রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায় কিংবা শারমিন, মেহের মন মতো রান্না করে। রাতে এসে খুব একটা রান্নার ঝামেলা পোহাতে হয় না। কিন্তু আজ ঝামেলা হচ্ছে এই লোকটার কারনে৷ অতিথি আপ্যায়ন সওয়াবের কাজ। নীরার তাতে সমস্যা নেই। তবে এই লোক কিংবা তার পরিবার অতিথি হয়ে আসলে ঘোর সমস্যা নীরার জন্য। তাদের খাওয়ানোতে বিন্দুমাত্র রুচি কাজ করে না নীরার ভেতর। রাগে দাঁত কামড়ে ভাত বসায় চুলায় নীরা। মাংস চপিং বোর্ডে উপর কাটছে মনমরা হয়ে। সময় বুঝি এভাবেই বদল হয়৷ একদিন রাফসান নীরার রান্না খেতে চায়নি, আর আজ নীরা খাওয়াতে চাচ্ছে না।
শারমিন এখনও ফেরেনি দেখে নীরার আরও বেশি রাগ হচ্ছে। যদিও এসব রাগ,বিরক্তি শুধুই মনে মনে।বাহিরে সে স্বাভাবিক। যা যুদ্ধ হয় তার মনেই হয়। বাহিরে তার আঁচ পাওয়া ভার। নীরা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে রুমে দিকে অগ্রসর হয়।
” নীরু!” নীরা শান্ত বাচ্চার মতো নত মুখে ঘুরে দাঁড়ায় রাফসানের ডাকে।
” এই আপনি আমাকে নিরু কেন বললেন? নিরু আমাকে আপন লোকেরা বলে। আপনি ডাকলে নীরা ডাকবেন নয়তো না ডাকবেন।”
মনে মনে ভীষণ রেগে বললেও সামনে শীতল কন্ঠে বলে,
” জি বলুন!”
” আমার মোবাইল টা অফ হয়ে গেছে। চার্জ শেষ। চার্জার হবে?” রাফসান চঞ্চল চোখে এদিক সেদিক চেয়ে বললো। চশমার ফাঁকে সে চোখের ভাষা বোঝা সহজ কথা নয়। নীরাকে তার ব্যাকুল মন ভাবতে চাইলেও সে সেই সুযোগ তেমন দিচ্ছে না। বড় শক্ত শাসনে রেখেছে মনকে। নীরা দৃষ্টি তুলে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” আমি দেখছি আছে কী না?”
নীরা বাটনওয়ালা স্বল্পদামি মোবাইল সেট ব্যবহার করে। তার মোবাইল চার্জারে হবে না বিধায় শারমিনের চার্জার নিয়ে এলো। রাফসান হাত বাড়িয়ে চার্জার নিতেই নীরার হাতে স্পর্শ হলো সামান্য। দুজনই ঝটকা মেরে হাতটা নিজের কাছে নিয়ে এলো। নীরা গটগট করে হেঁটে চলে আসে রান্না ঘরে। রাফসান স্যরি বলার অবসর টুকুও পেল না। মেহেরের রুমে ফিরে এলো রাফসান। চার্জার অন করে বিছানায় গা এলিয়ে বসলো। চশমাটা খুলে রাখলো সাইড টেবিলের কোনে। কপালে আঙুল ঠেসে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।
শারমিন ফিরল রাত করে। এসে রাফসানকে দেখে সে’কী খুশি। এতোক্ষনের পিনপতন নিরবতা নিমেষে গায়েব৷ শারমিনের হাসি আর কথার ঝরনায় মুখরিত বসার ঘরটা। তবে মাঝে মাঝে নিরব হয়েও যাচ্ছে ওরা মেহেরের বাবার কথা ভেবে। রাফসান ইদানিং কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে বোধহয়। শারমিন হঠাৎ কথাটা বলে হাসল। রাফসান হেঁসে বললো,
” কথা বলা কমায় নি বরং কথায় আজকাল খুঁজে পাচ্ছি না বলার মতো।”
শারমিন গম্ভীর মুখে বলে,
” ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার তো? আপনি কী জানেন এসব কিসের লক্ষণ?”
” না!”
” প্রেমে পড়ার লক্ষণ! ” বলেই শব্দ করে হাসে শারমিন। রাফসান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তবে কী তাকে দেখলে আন্দাজ করতে পারছে সবাই? না! না! তা কী করে সম্ভব? রাফসান অনিচ্ছা পূর্বক হাসল। বললো,
” আমি তো জানতাম প্রেমে পড়লে মানুষ বকবক করে, কারনে অকারনে। আর তুমি বলছ ভিন্ন কথা?”
” সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয় নাকি?”
” আচ্ছা! ” রাফসান ভ্রু তুলে মুচকি হাসল। হঠাৎ ভাবল শারমিন মজা করছে হয়তো তার সাথে। তাতেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
” হুম!” শারমিন সূক্ষ্ম চোখে রাফসানকে দেখলো। তার আজ পাকা ধারণা হয়ে গেল, শুধু মেহের নয় রাফসানও হাবুডুবু খাচ্ছে ভালোবেসে৷ অথচ কেউ কাউকে কিচ্ছুটি বলছে না। দু’টো এক ধাঁচের। এক ধাঁচের লোকদের প্রেম না করাই ভালো। বিপরীতে আকর্ষণ বিকর্ষণ সবই যথার্থ হয়। আলাদা রকমের এক্সাইটমেন্ট কাজ করে বিপরীত প্রেমে।
কথা বলার একফাঁকে নীরাকে কফি দিতে বলে শারমিন। নীরা রান্নাঘরেই ছিল। মাংসটা প্রায় হয়ে এসেছে। মাছটাও রান্না শেষ। মাংস রান্না হতেই চুলায় দুধ বসিয়ে দেয়। ততোক্ষণে আরেকবার ডাক পড়ে তার বসার ঘর থেকে। নীরা মাথায় ওড়নাটা টেনে ধীর পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। শারমিন হাসিমুখে বললো,
” ভাইয়ের সাথে কথা বলেছিস?”
শারমিনের প্রশ্নের জবাবে কী বলবে ভেবে পেল না নীরা। চুপ করে রইল কথা খুঁজতে গিয়ে। রাফসান বুঝল নীরার দিকে একপলক তাকিয়ে। শারমিনকে বললো,
” হ্যাঁ হয়েছে।”
নীরা চোখ তুলে তাকিয়ে রইল রাফসানের দিকে৷ রাফসান শারমিনের দিকে মুখ করে বসা। নীরাকে চুপ দেখে শারমিন বললো,
” আমার বোনটা বোকার জাহাজ বুঝলেন ভাই। এতো বুঝায় একটু চালাক,চতুর হ। বোঝেই না। আমার অফিসে লোক নেবে। মার্কেটিং বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে এমন মেয়েদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একবার ভেবেছিলাম ওর সিভিটা স্যারকে দেব। পরে দিলাম না। ভাবলাম আরও মাস দুয়েক থাক এখানে। শিখুক কিছু। ভালো করেছি না রাফসান ভাই?”
” হ্যাঁ তুমি তো ওর বোন। যা করবে ভালোই হবে। তবে আমার মতে ও ভালো করে পড়ালেখাটা কন্টিনিউ করলেই বেশি ভালো হয়।”
” পড়ালেখা তো ছাড়ছে না। ওটাও করছে পাশাপাশি এটাও করুক। বুঝেনই তো সব। আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। শীঘ্রই হয়ে যাবে। ওর কী হবে ভাবলেই মাথা ঘোরে আমার। একে তো বোকা তারউপর বিধবা। কী হবে ওর? জীবনটাই শেষ হয়ে গেল অকালে। বিয়ে দিতে গেলেও কতো কথা হবে সবই তো জানেন। মেয়েমানুষের কপাল একবার ভাঙলে জোড়া লাগেনা সহজে। ওর কপাল তো ভাঙার সাথে সাথে পোড়াও।” শারমিন স্থির চোখে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রয়।
রাফসানের কলিজা মনে হয় কেউ খামচে ধরল। দাঁত পিষে,হাত মুঠ করে চোখের পাতা ফেললো সে। নীরার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দু’চোখের কোনা ভরে উঠলো নোনাপানিতে। যা ভাবতে চায় না তাই বার বার ওর সামনে আসে। কান্না গলা অব্দি এসে ঠেকেছে বিধবা শব্দটা শুনে। সে বিধবা! এই যে অমোঘ সত্য তার জন্য! এমন কারো বিধবা যে বেঁচে থাকতে তাকে শান্তি দেয় নি। মরেও গিয়েও সমাজের চোখে ছোট করে গেছে। এতোটাই ছোট যে সবাই তাকে হেয় করে। তার মূল্য যেন ঐ সধবা ট্যাগেই ছিল৷ বিধবা, ডিভোর্সী এদের তো সমাজের লোকে রিজেক্টেড বলে উপহাস করে। চার বিয়ে সুন্নত শুনলেই কেউ কেউ সগৌরবে হাসে। বিধবা,ডিভোর্সী বিয়ে করা সুন্নত শুনলে পরক্ষণে নাক সিটকায়। নীরা এখন আর নাক সিটকানির ভয় করে না। তার কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই। এই মূল্যহীন জীবনের বোঝা সে একাই টেনে যাবে। আমৃত্যু বয়ে বেড়াবে নিয়তির দেওয়া ঘা। নীরা টালমাটাল পায়ে চলে আসে রান্না ঘরে। হাঁটু মুড়ে বসে নিরবে কাঁদে অপমানে পিষ্ট হয়ে,
“” শূন্য সব শূন্য। যা আছে ধরা মাঝে তার সবই অমূল্য। একা আমিই শুধু বিনামূল্য।”
চলবে,,,.