#নূর💔
Writer-Moon Hossain
[Shabnaj Hossain Moon]
#Last_Part_40
মেহেরাব চুপচাপ বসে আছে। মিজানুর সাহেব স্বস্তি অনুভব করলেন। একবার তিনি মস্ত ভুল করেছেন আদরের মেয়ের প্রতি একজনের অন্ধ ভালোবাসা দেখে। আসলামও মোমের জন্য এমন পাগল হয়েছিল মেহেরাবের মতো। দুদিন পর পাগল ভালোবাসাটুকু বোঝা গিয়েছিল। সেটার দুঃখ আজও দুঃখী মেয়েটার চেহেরায় স্পষ্ট। দুঃখ মুছতে না মুছতে মেহেরাব নামের ছেলেটা জবরদস্তিতে দুঃখী মোম কে বিয়ে করলো।একবার তিনি ভুল করেছেন মেয়েকে একজনের হাতে তুলে দিয়ে। ২য় বার এই ভুল করার প্রশ্নই ওঠেনা।এক ফোঁটা দুঃখ তিনি মেয়ের কাছে ঘেঁষতে দেবেন না। মোম কে তিনি নিজের কাছে রাখবেন। মেয়েকে নিজের কাছ ছাড়া করবেন না। একজন ছেলে তার উপর ইংরেজ, তার উপর নাস্তিক বংশধর তার মেয়ে কে অনুমতি বিনা বিয়ে করেছে এই কথাটা মিজানুর সাহেবের মনে পড়লেই শরীরের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। ইচ্ছে করলে মেহেরাব কে তিনি চরম শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু মহানবীর উম্মত বলে দিতে পারছেন না। নিজেকে সামলালেন তিনি। বুদ্ধি দিয়ে যুদ্ধ জয় করা গেলে খামাকা রক্তপাতের দরকার কি। ঠিকঠাক তীর ছূরে দিতে পেরেছেন তিনি। মিজানুর তৃপ্তি নিশ্বাস নিচ্ছেন। এই মুহুর্তে তিনি সামনে বসে থাকা বউয়ের প্রেমে পাগল হওয়া একজন নব মুসলিমের জাল ছিড়েখুঁড়ে বেরিয়ে এসেছেন এবং তাকে জালেও আঁটকে ফেলেছেন। বলতে গেলে শিকার শিকারী হয়েছেন অথবা। শিকারী নিজেই শিকার হয়েছেন।ঠিক জায়গায় চাল টা দেওয়া হয়েছে। মেয়ের বাবাদের একটু আধটু চালবাজ হতে হয় যেন ভবিষ্যতের বিপদ-আপদ থেকে আদরের মেয়েকে রক্ষা করা যায়। যাকে বলে পূর্বপ্রস্তুতি। মনে মনে একটু হাসলেন মিজানুর। মেহেরাব এখনো চুপ করে আছেন দেখে মিজানুর বললেন,
-শোন, মোমের অতীত তুমি নিশ্চয়ই জানো। এরজন্য কিছুটা আমি দ্বায়ী। মেয়েটা অবুঝ কিশোরী ছিলো। কাঁচের টুকরো কে হিরে ভেবে বসেছিল।কাঁচের টুকরো তে শুধু রক্তক্ষরণ হয় হিরের মতো অলংকারে শোভা বাড়ায় না। ছোটবেলায় যে খেলনা টা সন্তানের জন্য ক্ষতিকর সেই খেলনা টা আমাদের সন্তানদের দেওয়া হয়না। দূরে সরিয়ে রাখি নয়ত নষ্ট করে ফেলি।এই একই কাজ যদি সন্তানদের বড় বেলায় করা হয় তাদের পছন্দের ক্ষতিকারক খেলনা টা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে তাহলে আড়ালে লুকানো কষ্ট গুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। আমি এর উল্টো করেছি। ক্ষতিকর খেলনা টা নিজে মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছি। যথা সময়ে তার ফলাফল ভোগ করেছে আমার মেয়েটা। ২য় বার জেনেশুনে তোমার বংশের মতো বংশে মেয়েকে তুলে দিতে পারিনা। মোম নিজ ইচ্ছে তে তোমার সাথে বিয়ের আবদ্ধে আবদ্ধ হয়নি।মোমের জন্মদাতা পিতা এখনো জীবিত। আমি আমার মেয়ের অভিভাবক। আমার অনুমতি নেওয়া হয়নি। এমনকি আমার মেয়ের পর্যন্ত অনুমতি নেওয়া হয়নি।তুমি কি জানো আমার মেয়েটা কত ভালো? নিজের মেয়ে বলে বলছিনা, আমি আমার জীবনে এমন মেয়ে দু’একটা দেখেছি। আমার মেয়ের এতোটুকুও পরিমাণ যোগ্য নও তুমি।তুমি আমার অনুপস্থিততে আমার মেয়ের সাথে বর্বরের মতো আচরণ করেছো। আবার তুমি নিজে কে মুসলিম হিসেবে দাবি করছো?
-কাজটা অন্যায় হয়েছে।
-চরম অন্যায়। তুমি নিজের মতো সবকিছু চালাতে পারও না।
এখন তুমি বলো একজন নাস্তিক বংশধর তোমার মেয়েকে জোরজবরদস্তি মাধ্যমে বিয়ে করতো তাহলে কি করতে?
তুমি কি রাগ করতে না? তাকে তোমার মেয়ের থেকে ক্ষতিকর খেলনা হিসেবে দূরে সরিয়ে দিতে না?
-না।
না শুনে মিজানুর সাহেব নিজেকে সামলালেন। সে তার সিদ্ধান্ত তাহলে ঠিক নিচ্ছে। যে ছেলে তার নিজের মেয়ের সাথে হওয়া অন্যায় মেনে নিতে পারে সে ছেলে আর যাইহোক কারও যোগ্য স্বামী হতে পারেনা।
-ভেবে বলছো তো? তুমি অন্যায়কারী কে ছেড়ে দিতে?
-মার্ডার করতাম।
-মানে?
-কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব তার বংশ যে আমার মেয়ের সাথে এমন করার কথা সপ্নেও দেখবে। তার বংশ নির্বংশ করব।
মিজানুর সাহেব চশমা পড়ে ঠান্ডা গলায় বললেন- কথাটা তুমি সমস্ত বাবার হয়ে ঠিক বলেছো। জানো আমারও কিন্তু তোমাকে কেটে ব্রহ্মপূত্র নদে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তোমার ভবিষ্যতের মেয়ের জন্য এমন মনোভাব। আমার বর্তমান মেয়ের জন্য তাহলে কেমন মনোভাব হতে পারে তোমার ধারণা?
আমার উওর টা আশা করি তুমি পেয়েছো? তোমার বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই তুমি বুঝেছো? এগুলো তোমার কাছ থেকেই পাওয়া কিং ফায়ার না মানে মেহেরাব।
তুমি এখন আসতে পারও। আমি এই সময় বাগানে হাটাহাটি করি। তোমার সাথে খামকা সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
মেহেরাব স্বাভাবিক ভাবে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নিলো।
-গুরুজন হিসেবে একটা উপদেশ ছিল।
মেহেরাব পেছন ফিরে তাকালো।
-ইসলাম যেহেতু কবুল করেছো সেহেতু ইসলামের মর্যাদা রেখো। দ্বীনের পথে চলার চেষ্টা করবে।একদিন নিশ্চয়ই তুমি দ্বীনদার হবে এবং ভালো একজন দ্বীনদার মেয়ের যোগ্য হবে।দরকার পড়লে আমি নিজে তোমার জন্য মেয়ে খুঁজে দেব। আমার অন্ধরমহলে দ্বীনদার মেয়ের অভাব নেই। শোন, মেহেরাব আমি তোমার বিয়ের দায়িত্ব নিলাম। তোমার যাওয়ার ব্যাবস্থা করে রেখেছি। ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে মোম কে তালাক দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাও। পারলে নিজের বংশ কে আসল উপরওয়ালার সন্ধান দিও। তুমি এখন যেতে পারও মেহেরাব৷
মেহেরাব মিজানুরের কামরা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
দালানবাড়ি পুরোটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারে মিজানুরের সিদ্ধান্ত শোনার জন্য সবাই লুকিয়ে রয়েছে। মেহেরাবের আসার অপেক্ষা করছে মোম।
মোম কামরায় ঢুকলো। মোম এখনো জায়নামাজে বসা।
মোম সহজ গলায় বলল- কখন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
মোমের কথা শুনে মনে হতে পারে মোম জানতো সিদ্ধান্ত কি হবে। মেহেরাব গা এলিয়ে দিলো বিছানায়।
মোম জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়ালো। এক গ্লাস পানি দিলো মেহেরাব কে। মেহেরাব উঠে বসলো।
এক চুমুকে পানিটুকু পান করলো। গ্লাসটা নিজ হাতে সাবধানে টেবিলে রাখলো। তৎক্ষনাৎ মোম কে জরিয়ে ধরে বিছানার মধ্যে ধুপ করে পড়ে গেলো। মেহপরাব ঘটনা এমন দ্রুত ঘটালো যে মোম কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না।
মেহেরাব মোম কে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরে আছে। যেন মোম কোথাও চলে যাবে ছেড়ে দিলে।
মেহেরাব মোমের কপালে চুমু দিয়ে বলল- সুইটহার্ট আমার চোখের দিকে একটু তাকাও।
মোম লজ্জা মেশানো দৃষ্টিতে তাকালো মেহেরাবের গভীর নীল সমুদ্রের চোখের দিকে। চোখগুলোর দিকে যে কেউ তাকালে মনে হবে গভীর নীল সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছে।
মেহেরাব মোমের গোলাপি রঙের ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে বলল- সুইটহার্ট আমি এখন তোমার ঠোঁটে গভীর চুমু খাব। আর ইউ রেডি ফর ইউর ফার্স্ট কিস?
”
মিজানুর সাহেব বাগানে হাটাহাটি করছেন। রোজকার মর্নিং ওয়ার্ক। উনার মাথায় নতুন একটা চিন্তা এসেছে। মেহেরাব উনার সিদ্ধান্ত একেবারে চুপচাপ মেনে নিয়েছে। একটু প্রতিবাদও করেনি। দালান বাড়িটার দিকে তিনি তাকালেন। নির্জন গহীন জনমানবহীন দেখাচ্ছে বাড়িটা। বুকের মধ্যে একটা মোচর দিয়ে উঠলো মিজানুর সাহেবের। বড় রকমের ঝড় আসার আগে প্রকৃতি স্তব্ধ নিস্তব্ধ হয়ে থাকে।
মোম আর মেহেরাব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ফজরের নামাজ পড়ে। বারান্দা থেকে ব্রম্মপুত্র নদ স্পষ্ট দেখা যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে নদের শীতল হাওয়া বারান্দায় ভরপুর হয়ে থাকে। মোম আঙুলে শাড়ি পেঁচাচ্ছে মাথা নিচু করে। মেহেরাব হাতে কফির গ্লাস নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মোম কে দেখছে। মেহেরাব গরম কফির গ্লাসের ভেতর মনের ভুলে হাতের আঙুল ডুবিয়ে দিলো। আঙুলে তাপ লাগার কারণে আহ্ করে উঠলো মেহেরাব। মোম তৎক্ষনাৎ মেহেরাবের আঙুল মুখে ভেতর নিয়ে নিলো।
-এবার ঠিক আছে সুইটহার্ট।
মেহেরাব হেঁসে কফিতে চুমুক দিলো।
-আপনার মাথায় দুষ্টুমি ট্রিকসে ভরপুর।
এই ট্রিকস না করলে তুমি কি আমার আঙুলে মুখে নিতে?
হাতি দিয়ে টেনে নিলেও নিতে না সুইটহার্ট। বাই দ্যা ওয়ে কফিটা রিয়েলি গরম ছিল কিন্তু জ্বলে যাওয়ার মতো গরম ছিলো না। এতোটুকু গরম সহ্য করার ক্ষমতা আমার রয়েছে যেহেতু এরচেয়ে গরম তোমাকে সহ্য করতে পেরেছি। জ্বলে যাওয়ার ভয় আমার কখনো ছিলো না আর হবেও না সুইটহার্ট।
মোম মুখ বাঁকা করে রাখলো।
-কফিটায় মিষ্টি কম। মিষ্টি কম কফি খেতে ভালো লাগে না। আই ডোন্ট লাইক ইট।
মোম মেহেরাবের হাত থেকে কফি নিয়ে চুমুক দিলো।
-কফিটা যথেষ্ট মিষ্টি।
মেহেরাব হেঁসে কফির গ্লাসে মোমের ঠোঁট লাগানো জায়গায় ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দিলো।
-এবার হয়েছে পারফ্যাক্ট সুইট মিসেস সুইটহার্ট।
মোম মেহেরাবের মাথায় টোকা দিলো।
-মাথায় শুধু আমাকে হারানোর দুষ্টু বুদ্ধির ট্রিকস চলে তাইনা?
-যে যেমন তার সাথে তেমন করতে হয়। সোজা কথায় ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। বাই দ্যা ওয়ে আমার মাথায়
আরও অনেক কিছু চলে। দেখতে চাও কি চলে?
-নো ওয়ে।
-থাকবে কেন? কাছে এসো, দেখাচ্ছি।
-দূর দূর। দূর হোন আমার থেকে।
মেহেরাব মুচকি হেসে মোমের খুব কাছে এলো। মোম মেহেরাবের চোখের দিকে তাকিয়েও তাকাচ্ছে না লজ্জায়।
খুব লজ্জা লাগছে। লজ্জায় মুখখানা লাল টকটকে রুপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে কাল রাতের আচমকা চুমুর কথা মনে পড়লে আরও বেশি লজ্জা অনুভব হয় মোমের।
মোম মেহেরাবের চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। মেহেরাব হাসছে। মোম চোখ বন্ধ করে ফেললো।
-তোমার ঠোঁটের স্বাদটা দারুণ সুইট। ধারণা ছিলো সুইট হবে বাট এতোটা সুইট হবে তা সপ্নের বাহিরে ছিল।
কাল রাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলে কেমন হয় সুইটহার্ট?
লজ্জায় মোমের মরে যাওয়ার উপক্রম।
মেহেরাব মোমের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে যেতেই মোম লজ্জায় মেহেরাবের বুকে মুখ লুকালো।
মেহেরাব হেঁসে মোমের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল- লজ্জা পেলে পৃথিবীর সব মেয়ের সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়ে। আমার সুইটহার্টের সৌন্দর্য আরও বেড়েছে।
মোম আরও শক্ত করে জরিয়ে ধরলো মেহেরাব কে গভীর উষ্ণতায়।
-তুমি কি জানো তোমার ঠোঁটের মিষ্টি থেকে পৃথিবীর অন্যকিছু মিষ্টি হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করিনা? তুমি কি জানো তোমার ঠোঁটের মিষ্টি ছাড়া আমার সবকিছু বিস্বাদ লাগে? তুমি কি জানো তোমার ঠোঁটের ছোঁয়ায় পৃথিবীর সব মিষ্টি দ্বিগুণ মিষ্টি হয়ে যায়?
”
মিজানুর সাহেব চেয়ারে বসে আছে। মেহেরাব উনার সামনে বসে আছে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
-তো তুমি কি রেডি?
-অফকোর্স।
-তাহলে চলো আসল কাজটা সেরে ফেলি।
নাও সাইন করো।
মেহেরাব ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিলো।
মিজানুরের মুখ ভর্তি শান্তির হাসি।
মেহেরাব টুক করে পেপার টা ছিড়েখুঁড়ে কুঁচিকুঁচি করলো।
মিজানুর সাহেবের মুখে অশান্তির ছাপ পড়লো।
-ডিয়ার শশুর বাবা সাহেব। আপনাকে আমার শশুর ছাড়া আর কাউকে শশুর হিসেবে মানতে পারব না। এবং আমার মেয়ের মা আপনার আদরের মেয়ে হবে। আপনি হবেন নানাজান। আপনার মতো নানাজান থাকতে কেউ আমার মেয়ের সাথে অন্যায় করার সাহস পাবে না।
মেহেরাব উঠে দাঁড়ালো। যেতে যেতে বলল- আমার একমাত্র যোগ্যতা আমার ভালোবাসা, সত্যতা এবং আমার সততা। ইসলাম এবং আপনার মেয়ের উপর যা সীমাহীন রয়েছে।আমি আমার দ্বীন হীন বংশ ত্যাগ করেছি। আমার নামে শুরু হবে আমার নতুন বংশ।
আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব মোমের জন্য আর আপনার সিদ্ধান্ত আমার পক্ষে আসার জন্য। আমরা স্বামী স্ত্রী বাঁচলে একসাথে থেকে বাঁচব এবং মারা গেলে একসাথে থেকে মরব ওয়াদা করেছি আল্লাহ কে সাক্ষী রেখে।
মেহেরাব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে মিজানুর সামনে থেকে চলে এলো। মোম পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে ছিলো এতোক্ষণ।
মিজানুর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আজ মোম আর মেহেরাবদের ব্রম্মপুত্র নদে নৌকা বিলাশ। মেহেরাব ঠিক করেছে আজ সারাদিন তারা নৌকায় ঘুরবে যা তাদের জন্য একপ্রকার নৌকা সংসার।
নৌকা তে উঠার সময় মোম বলল- আপনার কি ভয় করছে না?
-না।
-কেন?
-তুমি তো আছো। পড়ে যাওয়ার আগে ধরে ফেলবে। আমার সাপোর্টার।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- আমি নৌকা থেকে পড়ে যাওয়ার কথা বলিনি। বাবা আপনাকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। কি করবেন কিছু ভেবেছেন?
মেহেরাব হাসলো। মোমের হাত ধরে সাবধানে নৌকায় উঠে এলো। মোম কে নিয়ে নৌকার এক কোণে মুখোমুখি বসলো।
-কিছু বলছেন না যে।
-হুঁশশ। কোন কথা নয়। শুনতে পাচ্ছো পানির আওয়াজ?
টুপটাপ, টুপটাপ।
মোম হতাশা গোপন করলো। নৌকা চলছে তার গতিতে। মাঝি হাল টানছে। পানির আওয়াজ হচ্ছে। শীতের সিজন চলে এসেছে অথচ নীল আকাশটা বর্ষার সিজনের মতো
মেঘলা মেঘলা। মনে হতে পারে এখনই বৃষ্টি হবে ঝুপঝুপ।
নদের দু’ধারে সবুজ আর সবুজ। মেহেরাব মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। সাদ সাদা বক।
মোম মেহেরাব কে দেখছে। মেহেরাবের ঠোঁটের কোণে হাসি। সে যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হচ্ছে। তার আনন্দের সীমা নেই বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখে। সে যেভাবে প্রকৃতি দেখছে মনে হতে পারে তার করে চিন্তাভাবনা নেই। নতুন বিয়ের পর শশুর বাড়ি এসেছে। বউ কে নিয়ে ঘুরছে।সে মহা সুখী।
মেহেরাব টলটলে নদের পানি দু’হাতে ছিটিয়ে দিলো মোমের গায়ে। হঠাৎ করে পানি ছিটে গায়ে লাগার পর মোম নৌকা থেকে প্রায় পড়ে গেলো গেলো অবস্থা। মোম শক্ত দুটি হাতের ছোঁয়া অনুভব করলো। তার আর ভয় নেই। তাকে আগলে রাখার মানুষ রয়েছে। মোম ঘাবড়ে গিয়ে এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। মোমের ঘাবড়ে যাওয়া চোখ গুলো দেখতে খুব ভালো লাগছে মেহেরাবের। সে মুচকি হাসলো নিজের মনে।
মেহেরাব মোমের কানেকানে বলল-বাঁচলে এক সাথে থেকে বাঁচব আর মরলে একসাথে থেকেই মরব সুইটহার্ট।
মোম চোখ মেলে তাকালো।
মেহেরাব গলার স্বর কমিয়ে বলল- এখন একটা কাজ করব সুইটহার্ট। তুমি ভীষণ লজ্জা পাবে। আমার কিছু করার নেই। আমি হেল্প লেস। মেহেরাব একটানে মোম কে নিজের হাঁটুর উপর বসিয়ে দিলো।মোম হতভম্ব।
নৌকা যেভাবে দুলছে তাতে মোম অসাবধানতায় পড়ে যেতে পারে। মোম লজ্জায় উঠে যেতে লাগলো। মেহেরাব একটানে আরও শক্ত করে ধরে বসালো মোম কে।
-এটা মাঝ নদ। মাঝি তার বৈঠা নিয়ে অপরপ্রান্তে ব্যাস্ত। আমাদের দিকে তাকানোর মতো কেউ নেই। তোমার লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই। সো চিল ডাউন সুইটহার্ট।
মোম আর আপত্তি করার সাহস পেলো না।
মেহেরাব মোমের কানেকানে বলল-বাঁচলে এক সাথে থেকে বাঁচব আর মরলে একসাথে থেকেই মরব সুইটহার্ট।
সকাল পেরুলো, দুপুর পেরুলো, বিকেল পেরুলো, সন্ধ্যা পেরুলো, এখন রাত। এশারের নামাজের পর ডিনার সারতে বসা হয়েছে। মোম খাবার গরম করছে।মেহেরাব তাকে হেল্প করছে। মেহেরাব হেল্পের নামে মোমের কাজ আরও বাড়াচ্ছে। হাত থেকে একটু আগে গোশতের বাটিটা পড়েছে।
মোম হতাশা গোপন করে বলল- আপনি একটা কাজ করতে পারবেন?
মেহেরাব কাছে এসে বলল- তোমার বলা সকল কাজ করতে পারব। শুধু বলে দেখ।নৌকা থেকে পড়ে যাব? নদে পড়ে যাব? কোন কাজটা করব বলো সুইটহার্ট?
-হাত জোর করছি আপনাকে এগুলোর কিছুই করতে হবে না। ইনফ্যাক্ট কিছুই করতে হবে না। নাথিং।
-তা বললে হবে না। স্ত্রী কষ্ট করবে আর আমি স্বামী হয়ে বসে বসে দেখব? সকল কাজের ভাগাভাগি হবে।
ডিনার শেষ করে মেহেরাব নৌকায় শুয়ে থাকলো একটা হাত পানিতে ফেলে।মাঝি ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। মোম বসে আছে সামনে। মোমের ঠিক মাথার উপরে আকাশে চাঁদ উঠেছে।
চাঁদনি রাত। ঝলমল করছে চারদিক চাঁদের আলোয়। নদের পাড়ের বালুবেলা চিকচিক করছে চাঁদের আলোতে। আকাশে তারার মেলা। দূরদূরান্ত থেকে শেয়ালের হাঁক ভেসে আসছে।নির্জন পরিবেশ।মোম
পাশে। এমন পরিবেশে প্রিয়জন কে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। খুব খুব কাছে। মেহেরাবের মনে অচেনা অন্যরকম এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে যা মোমের বোঝার সাধ্য নেই।মেহেরাব কিছুটা দূরে শুয়ে আছে মোমের থেকে।
নির্জন নদের মধ্যে এসে মোমের অনুভূতি কিছুটা আতংকগ্রস্থ। একটু পর পর সে এদিক ওদিক তাকিয়ে আঁতকে উঠছে। সংকোচে মেহেরাবের কাছেও যেতে পাচ্ছে না। মেহেরাব উঠে বসলো। তার মোমের কাছে যাওয়া উচিৎ।
মোমের গা ঘেঁষে মেহেরাব বসলো। মোম একটু সরে বসলো।
-সুইটহার্ট একটা কথা বলি?
-বলুন?
-তুমি খুব রাগ করবে। তবুও কথাটা বলব।
আচ্ছা আমি কি তোমাকে আজ একটু কাছে পেতে পারি? একটু গভীরে?
মোম স্বাভাবিক ভাবে হাসলো। মেহেরাবের গালে হাত বুলালো। মেহেরাব সপ্ন দেখছে কিনা জানে না।এতোদিনে মেহেরাবের সুইটহার্ট তাকে বুঝতে পেরেছে। একটু ভালো ব্যবহার করছে। এটা মেহেরাবের কাছে এভারেস্ট জয় করার মতোই জয়। বরং এভারেস্ট জয় করা সহজ মোমের ভালোবাসা জয় করা থেকে।
মেহেরাব আহ্লাদে আটখানা।সে মোমের ভালো ব্যবহারে আবেগে আপ্লুত। মোম তার হাতটা মেহেরাবের কাঁধে রাখলো। মেহেরাবের মুখের খুব কাছে আসলো। মেহেরাব চোখ বন্ধ করে ফেললো। অমনি ঝপাং করে নৌকা থেকে পড়ে গেলো মেহেরাব। মেহেরাবের ঘোর কাটলো। পানি খেয়ে খেয়ে বিশাল অবস্থা।
মোম উঠে দাঁড়ালো। মুখ দিয়ে আহা আহা বলে দুঃখ প্রকাশ করলো।
-এবার খুব কাছে আর একটু বেশি গভীরে পৌঁছেছেন তো?
এই মুহুর্তে গভীর রাতে, গভীর পানিতে আপনার অনুভূতি কেমন তা জানতে চাওয়া আমার নিরীহ মন।
মেহেরাব হতভম্ব।
ফজরের আজানের পর পর যখন চারদিক ফর্সা হতে থাকে আর পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনা যায় ঠিক তখনই মেহেরাব মোমকে নিয়ে মফস্বলে দালানবাড়ি ফিরে এলো।
বৈঠকখানার সামনে বিদেশি মডেলের গাড়ি দেখতে পাওয়া গেলো। কোন বিদেশি মেহমান এসেছে মনে হয়। মোম আগেই
অন্দরমহলে চলে এলো। মেহেরাবের পুরো শরীর ভেজা স্যাঁত স্যাঁতে। ম্যানাজারের ছেলে মেহেরাব কে দেখে বলল- আপনি গোসলঘরে যান।শুকনো জামা কাপড় পড়ে নিন। বড় সাহেব আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন দুলাভাই। (বাংলা)
-কিনু?
-সেটা তো জানি না।
মেহেরাব ভাঙা ভাঙা বাংলাতে কি বলল তা ছেলেটা না বুঝে শুধু মাথা দুলালো।
এই মুহুর্তে মিজানুর খন্দকার বসে আছে এক তুখোর ঘোর নাস্তিকের সাথে। তিনি কখনো নাস্তিক দেখেন নি। আজ পুরোপুরি দেখতে পেলেন।
মিজানুর সাহেবের মনে হচ্ছে তিনি নাস্তিক নাস্তিক গন্ধ পাচ্ছেন ফরেনার কিং লায়ারের শরীর থেকে। তিনি মনে করতে পাচ্ছেন না যে বিধর্মী লোকেদের শরীর থেকে বিধর্মী গন্ধ থাকে নাকি? মনে হয় থাকে।
তার বমি বমি অনুভূতি হচ্ছে। যেকোনো সময় তিনি কাজটা করে ফেলবেন।
মিজানুর সাহেব সব সময় সকলকে সালাম দিয়ে থাকেন দেখা হলে। কথাও শুরু করেন সালাম দিয়ে।
বহু দিনের অভ্যাস। তিনি নাস্তিক কিং লায়ার কে অভ্যাস মতো সালাম দিয়ে নিজেই হতভম্ব।
-আসসালুম আলাইকুম।
-ওলামিলিকুম।
কিং লায়ার ভাঙা ভাঙা বাংলায় সালামের উওর দিলো।
মিজানুর সাহেব নিজেকে সংযত রাখলেন।নাস্তিক তার উপর ফরেনার এক সাহেবের সালামের উচ্চারণ শুনে তিনি কাঁদবেন নাকি বুঝতে পাচ্ছেন না।
তাদের মাঝে ইংরেজিতে আলোচনা হলো এক দফা।
-মহানবী মানব ধর্মের কথা বলেছেন বলে আপনার মতো নাস্তিক কে মফস্বলে, এই দালানবাড়িতে, আমার কামরাতে, আমার সামনে বসার অনুমতি দিয়েছি। মহানবীর কথা তো অমান্য করতে পারিনা।
আপনি দেশের মেহমান হিসেবে বেঁচে যাচ্ছেন ফরেনার সাহেব। আমরা গরীব দেশ হলেও মেহমান কে তার সম্মান দিই তাই আপনি খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করুন। কাল ভোর হওয়ার আগেই ছেলেকে ডিভোর্স পেপারে সাইন করিয়ে সোজা নিজের দেশে জীবন নিয়ে চলে যাবেন। মিজানুর সাহেব গড়গড় করে বমি করে দিলেন কথা শেষ হতেই
-নাস্তিক নাস্তিক গন্ধ বের হচ্ছে আপনার শরীর থেকে। আর সহ্য করতে পারলাম না।কয়েকটা সুগন্ধি সাবান ঢলে ঢলে গোসল করে পরের বার আমার সামনে আসবেন নাস্তিক লোক কোথাকার। আমার লোকেরা ধোপা কে খবর দিচ্ছে। ধোপা এসে আপনাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে যাবে।
কিং লায়ার গলার স্বর বাড়িয়ে বলল- তুমি আমাকে সম্মান করছো নাকি অসম্মান করছো বুঝতে পাচ্ছি না। ভেরি কনফিউজড।
তুমি আমাকে অর্ডার দিয়ে কথা বলার সাহস পেলে কি করে গ্রামের বৃদ্ধলোক? আমি কতদিন থাকব না থাকব তা তুমি বলার কে মূর্খ লোক? দরকার পড়লে আর ফিরে যাব না। সারাজীবন এই দেশে তোমার গ্রামে থেকে যাব।
তুমি তোমার সামান্য গ্রাম নিয়ে অহংকার দেখাচ্ছো কেন? তুমি কি জানো তোমার গ্রামের মতো এরচেয়ে বড় বড় দ্বীপ আছে আমার কয়েকটা।
আমার তোমার পুরো দেশ কেনার ক্ষমতা রয়েছে গরীব জমিদার কোথাকার।
মিজানুর সাহেবের জীবনে তার সামনে কেউ চোখ তুলে দাঁড়াতে পারেনা। আর এই ফরেনার তার উপর নাস্তিক দাঁড়িয়ে নাচানাচি করছে মাথার উপর। আর নামছে না।
মিজানুর সাহেব হতভম্ব।
মেহেরাব আর কিং লায়ার এক কামরায় বসে আছে। মোম পর্দার আড়ালে আছে৷
বাবা ছেলের মধ্যে একদফা হবে আজ।
-তোমাকে চেনা যাচ্ছে না মাই লিটল প্রিন্স।
মেহেরাব হাসলো।
-কি আছে টা কি ঐ মেয়ের মধ্যে? মেয়েটা সেকেন্ড হ্যান্ড।
-তোমার ছেলে তো হান্ড্রেড হ্যান্ড। ড্যাড ও তোমার পুত্রবধূ। আমার স্ত্রী। ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে।
-ওর একটা বিয়ে হয়েছিল।
-আমার আগে ওর একশত বিয়ে হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এখন আমার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। এটাই ম্যাটার।
মোমের দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
মেহেরাব বাবার হাত ধরে আকুতি স্বরে বলল- ড্যাড তুমি মম কে এখনো ভালোবাসো। তুমি তো বুঝবে আমার ভালোবাসা। ভালোবাসার সামনে কোন কিছু বড় না।ভালোবাসা সবচেয়ে বড়। আর আমি ওকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।
মোম শশুরের আগমনে সমস্ত আয়োজন নিজ হাতে করলো। যত্নআত্তির চূড়ান্ত করলো। লোক দিয়ে শশুর কে গোসল করালো সুগন্ধি সাবান দিয়ে।বাবা মিজানুরের পাজামা-পাঞ্জাবি শশুর কে পরিয়ে দিলো। নিজে হাতে বাঙালি রান্না করে খাওয়ালো আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে। কিং লায়ার জীবনে এমন সুস্বাদু খাবার কখনো খাননি। তিনি তৃপ্তি সহকারে খেলেন। খাওয়া শেষে দুজন তাকে তেল মালিশ করে দিয়ে গেলেন। তিনি ভরপেট খেয়ে মালিশের আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলো কোরআন তেলওয়াতের আওয়াজে। মোমদের দালানবাড়ি তে দাস মহলের ছোট বড় ছেলেরা কোরআন তেলওয়াত করছে। তিনি শুয়ে থেকে তেলওয়াত শুনলো। আশ্চর্য রকমের শান্তি অনুভব হচ্ছে তার। এমন শান্তি কোনদিনও অনুভব হয়নি। ডলারের উপর শুয়ে থেকেও হয়নি।এমন শুদ্ধ শান্তির অনুভূতি বেঁচে থাকার জন্য আনন্দ।
রাতে মোমের সাথে মেহেরাবের ছাঁদে দেখা হলো।
-হাসছেন কেন?
-হাসি পাচ্ছে তাই হাসছি।
-কেন? আপনার সামনে কোন হাসির উৎস?
-অফকোর্স।
-আমি কি সার্কাসের জোঁকার?
-নাতো।
-বার বার হাসছেন কেন?
-আচ্ছা যাও হাসব না। এবার কাঁদব।
সত্যি সত্যি মেহেরাবের মুখটা নিমিষেই কাঁদো কাঁদো ভাব হলো। যে কোন সময় মেহেরাব কেঁদে ফেলবে এমন সিচুয়েশন।
-তোমাকে একটা কথা বলব বলেছিলাম।
-সময় হলে বলবেন বলেছিলেন। এখন সময় হয়েছে?
-হ্যাঁ। আচ্ছা তোমার বাবা মেয়ের প্রতি অন্যায়কারী লোক কে যদি ক্ষমা না করে আর তাকে তোমার স্বামী হিসেবে মেনে না নেন তাহলে কি তুমি তোমার বাবার বিরুদ্ধে যাবে? তোমার স্বামীর হাত ধরতে পারবে?
মোম চুপ করে আছে।মেহেরাব হতাশা গোপন করে বলল,
– সুইটহার্ট বলো তুমি কি আমার হাত ধরবে? এই অবুঝ নব মুসলিম কে সঠিক নূরের পথ দেখাতে তার হাত ধরবে?
-উওর টা আপনি জানেন।
-তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
-না।
মেহেরাব স্বাভাবিক ভাবে বলল- আমি জন্ম থেকে একা ছিলাম, এখনো একাই আছি। একাকীত্ব বড় কষ্টদায়ক সুইটহার্ট।
ফজরের আজানের সুরেলা আওয়াজে মেহেরাবের বাবার দিন শুরু হলো।উনার পরনে মিজানুরের পাজামা-পাঞ্জাবি।পোশাকের জন্যই হোক বা মুসলিম দেশের পরিবেশের জন্যই হোক তার মন একেবারে শীতল।
মুসলিম দেশ সম্পর্কে কোন আইডিয়া নেই তার। ফজরের আজান, নামাজের জন্য কুয়ো তোলায় লাইন ধরে দাড়িয়ে অজু করা। ছোটদের মক্ততবে যাওয়ার জন্য ইমামের হাদিস বলে বলে মাইকিং।মাথায় টুপি পড়ে মক্তবে যাওয়া। মক্তবে ছোটদের উচ্চস্বরে আরবি হরফ বলা।এসব কিছু তিনি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। বড় শান্তি পেলেন।
সকাল ১০ টায় দালানবাড়ি থমথমে ভয়ংকর রুপ ধারণ করলো। মেহেরাবের বাবা মেহেরাব কে নিয়ে রেডি হয়ে আছে। ১২টায় লন্ডনের ফ্লাইট। মিজানুরের কামরায় শেষ দফা মিটিং চলছে। মোম পর্দার আড়ালে আসিয়া বিবির সাথে অবস্থান নিয়েছে।
মিজানুর গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন- সাবধানে যাবেন। দিনকাল বড় মন্দ।
মেহেরাবের বাবা বলল- উপরওয়ালা থাকলে কোন ভয় নেই। কথা শুনে সবাই হতভম্ব।
মিজানুর কে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন- আমি রেডি।
-ফ্লাইটের জন্য?
-ইসলাম কবুল করার জন্য। ওভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। আমি এখন ইসলাম গ্রহণ করব। জোহরের নামাজ পড়তে যাব। তারপর দুপুরে বৌমার হাতের সুস্বাদু রান্না খাব।ভরপেট খেয়ে তেল মালিশ নিতে নিতে ঘুমুব। তারপর কোরআন তেলওয়াত শিখতে বাচ্চাদের কাছে যাব। আমার পরিকল্পনা কেমন সবাই বলো তো?
সবাই একসাথে বলল- সুবহানাল্লাহ!
দালানবাড়ি তে উৎসবের ধুম পড়ে গেলো। মফস্বলের সমস্ত লোকজনেরা ভীড় করলো। মিজানুর ময়মনসিংহের নামীদামী বাবুর্চি খবর দিয়েছে। কয়েকটা গরু জবাই দেওয়া হচ্ছে। বাড়িটা সাজানো হচ্ছে। রাতে দু’পক্ষের মতামতে মোম আর মেহেরাবের নতুনভাবে বিয়ে পড়ানো হবে বর কনের সাজে।
মেহেরাব কে মিজানুর দালানবাড়ি থেকে একটু দূরে বাংলোতে রেখেছে। সেখান থেকে হাতি চড়ে বর সেজে মোম কে বিয়ে করতে আসবে মেহেরাব। বাংলো তে যাওয়ার আগে মেহেরাব মোম কে বলেছিল- সুইটহার্ট আমাদের সকল কষ্ট গুলো তাহলে সুখে পরিণত হচ্ছে।
মোম লাজুক ভাবে বলল- ইনশাআল্লাহ।
-একটা কথা শোনার জন্য আমার মন হাহাকার করে সবসময়। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? ভালোবাসি কথাটা একবার বলে আমার অশান্ত হৃদয় শান্ত করে দাও।
মোম অস্ফুট স্বরে বলল- আজ রাতে বলব। সবুরে মেওয়া ফলে।
মেহেরাব একটু হেঁসে বলল- আমি এই যাব আর আসব। আজ তুমি বলবে আর আমি শুনব।
বিয়ে বাড়ি হৈচৈ উৎসবে মুখরিত। মিজানুর আর মেহেরাবের নব মুসলিম বাবা মহা আনন্দে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাবুর্চির রান্না গুলো টেস্টিং করে নম্বর দিচ্ছে টেস্ট অনুযায়ী। মোম বউ সেজে বসে আছে। টুকটুকে সুন্দরী দেখাচ্ছে।মেহেরাবের চোখ আঁটকে যাবে দেখে। মেহেরাবের তখনকার অনুভূতি কথা মনে করে করে মোম আরও বেশি লজ্জায় লাল টকটকে হতে থাকলো। মেহেরাব শেরওয়ানি পড়ে বর সেজেছে।তাকে দারুণ দেখাচ্ছে।মোম কে আজ পুরোপুরি পাওয়া হবে।আর কোন ভয় নেই। গ্রামের ছেলেরা হাতি নিয়ে তৈরি হয়ে আছে মেহেরাবের অপেক্ষায়। হঠাৎ লোডশেডিং হলো। মফস্বলে যা প্রায়ই হয়। পুরো মফস্বল অন্ধকার হয়ে গেলো। তাতে বিয়ে বাড়ি আরও জমজমাট হলো। মোম একা বসে আছে। আলোর ব্যবস্থা করতে সবাই বাহিরে।বারান্দায় খুটখুট আওয়াজ হচ্ছে। মোম কি দেখে আসবে আওয়াজ কিসের?
মেহেরাব বাংলোর পেছন থেকে বের হয়ে আসলো আওয়াজের উৎসের কাছে। সামনে কি যেন ভীড়ের মতো। সমস্যা হলো নাকি? একজন প্রকৃত মুসলিম সমস্যা দেখলে অবশ্যই তা সমাধান করার দায়িত্ব নিতে হবে। ভীড় ঠেলে মেহেরাব ভেতরে আলামিন কে দেখতে পেলো। আলামিন কে মারধর করা হচ্ছে। আলামিন মেহেরাব কে দেখে জরিয়ে ধরলো আর বলল- আপনি এখানে কেন? আজ আপনার বিয়ে। চলে যান এখুনি।
মেহেরাব তাকে শান্তনা দিয়ে বলল- হোক বিয়ে। তোমাকে এখানে ফেলে যাব না। আমি একজন মুসলিম। তুমি আমার ভাই। তোমাকে সাথে নিয়ে তবেই যাব। ভীড়ের মধ্যে কে একজন বলল- জোচ্চোরের ভাই জোচ্চোর। একটা কেও আস্তো যেতে দেব না। কিছু বুঝে উঠার আগেই লোকেদের সাথে হাতাহাতি শুরু হলো মেহেরাব।মোমের মফস্বলের লোকজনের গায়ে আঘাত করা ঠিক হবে না। হাজার হলেও সে মফস্বলের জামাতা। সবাই কে বুঝিয়ে বল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে মেহেরাবের। মেহেরাব সবাই কে বোঝাতে লাগলো আর সবাই যে যার মতো আঘাত করতে থাকলো। আলামিন অনুনয়-বিনয় করে চিৎকার করছে। আজ আমার ভাইয়ের বিয়ে। আল্লাহর দোহাই সে কিছু জানেনা। তাকে ছেড়ে দিন। মেহেরাব একসময় সবাই কে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে গেলো। কেউ থামছে না আঘাত করা থেকে। মোম আওয়াজের উৎস খুঁজতে খুঁজতে ছাঁদে চলে এলো। অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে।
-আসসালামু আলাইকুম প্রিয়তমা। সালামের উওর দিতে হয়। জানোনা?
মোম ঘোমটা টেনে দিলো।
-আপনি এখানে?
-আমার তো এখানেই থাকার কথা। তোমার মেহেরাব যেখানে থাকার কথা সেখানেই তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মোম কাঁপা কাঁপা গলায় বলল- উনি কোথায়?
আমি উনার কাছে যাব।
মোম চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই আসলাম মোমের শাড়ির আঁচল স্পর্শ করলো।
-খবরদার তুমি এখান থেকে যাবে না। গেলে খুব জঘন্য আচরণ করা হবে তোমার সাথে।
-আঁচল ছাড়ুন। আপনার সাহস দেখে আমি অবাক। লুকিয়ে অন্ধকারে এসে আমাকে শাসাচ্ছেন। ক্ষমতা থাকলে আমার বাবা আর স্বামীর মুখোমুখি হোন।
-উফফ,তোমার এই রুপ দেখে আবারও আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম।
মোম আসলামের গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারলো।
-অন্যের বউয়ের সাথে প্রেমালাপ করছেন আপনার লজ্জা নেই?
আসলাম রাগান্বিত হয়ে আঁচল টেনে মোম কে আরেকটু কাছে আনার চেষ্টা করলো।
-লজ্জার তুমি দেখেছো কি? আজ দেখাব তোমাকে?
চিৎকারে কাজ হবে না প্রিয়তমা।তুমি একেবারে ছাঁদের কর্ণারে। তোমার পেছনে খাদ।সামনে আমি। আমার অনুমতি ছাড়া তুমি যেতে পারবে না।বিয়ে বাড়িটা হৈচৈ উৎসবে মুখরিত। মোমের সাথে আসলামের চিৎকার, চেঁচামিচি, ধস্তাধস্তির আওয়াজ কেউ শুনলো না। মোমের শরীর লাল টকটকে রক্তে রক্তাক্ত।শরীরের হাড়গোড় ভেঙ্গে চেহেরা পাল্টে গিয়েছে।
সুশ্রী মুখখানা থেঁতলে একাকার। তাকে চেনা যাচ্ছে না।জোরজবরদস্তির একপর্যায়ে পা পিছলে মোম ছাঁদ থেকে নিচে পড়ে যায়।নিচে পড়ে যাওয়ার বিকট আওয়াজ হলো। ছাঁদের উপর আসলাম মোমের রক্ত মাখা শাড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভীড় ভেঙে যে যার মতো চলে গেলো। মেহেরাবের শরীর রক্তাক্ত। শেরওয়ানি ছিড়েখুঁড়ে একাকার।শরীরের এক অংশও বাকি নেই যেখানে আঘাতের চিহ্ন নেই।মোম কে বউ সাজে কেমন লাগছে তা দেখতে ইচ্ছে করছে মেহেরাবের। ইচ্ছে পূরণ হলো না। কালেমা পাঠ করতে করতে আলামিনের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো মেহেরাব। আলামিন চিৎকার করে কাঁদছে। যারা অবিশ্বাসী ও ইসলাম বিদ্বেষী, মৃত্যুর কঠিন ও মূমূর্ষু সময়ে তারা ঈমান ও কালেমার অবিচলতা থেকে রঞ্চিত হয়। ঈমানহীন হওয়ার কারণে তারা কালেমা উচ্চারণ করতে পারে না। এটা সমাপ্তিকাল মন্দ হওয়ার নির্দশন।
কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার শেষ বাক্য হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (আবু দাউদ)
সত্যবাদী মুমিন ব্যক্তি ব্যতিত কেউই মৃত্যুর সময় তাওহিদের কালেমা উচ্চারণ করতে পারবে না। বিশেষ করে দুনিয়ার জীবনে যারা যে কাজে ব্যস্ত থাকবে। পরকালের মৃত্যুর সময়ও তারা সে সব কথা ও চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। কালেমা পড়ার নসিব হবে না।।
চারদিক আলোময় হয়ে উঠলো। মোমের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে।মোম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় আবিস্কার করলো সে মেহেরাবের প্রেমে পড়েছে।মেহেরাব তার আশেপাশে এখানে কোথাও রয়েছে তা মোম অনুভব করতে পাচ্ছে। মেহেরাবের প্রশ্নের উওরটা মোম মনে মনে দিলো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি প্রিয়তম।আচ্ছা মেহেরাব কি কোন ভাবে মোমের উওরটা শুনতে পাচ্ছে? তার অনুভূতি টা কেমন হচ্ছে?
💔শেষকথাঃ বিয়ে বাড়িটা মরা বাড়িতে পরিণত হয়েছে। খুশির আমেজ কান্নার আমেজে পরিণত হলো। আসলামের জায়গা পাগলাগারদে।মোমের শোকে সে উন্মাদ। মিজানুর ছেলেমেয়েদের অকাল মৃত্যুতে স্তব্ধ।মেহেরাবের বাবা তাকে সামাল দিচ্ছেন। মোম মেহেরাবের দাফন কার্যের পর মিজানুরকে নিয়ে সৌদিআরবে হজ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেহেরাবের বাবা। অকালে মৃত্যু বরণ করা দূর্ভাগা স্বামী স্ত্রীর খাটিয়া কবরস্থানে যাওয়ার পথে মফস্বল টা আশহাদু_আল্লাহ! আশহাদু_আল্লাহ! উচ্চারণে মুখরিত হয়ে উঠলো💔
[সবাইকে কাঁদনোর জন্য দুঃখীত। পৃথিবীর একমাত্র শুদ্ধ সহীহ্ কিতাব হলো আসমানী কিতাব।আসমানী কিতাব ছাড়া পৃথিবীর কোন লেখাই শুদ্ধ হতে পারেনা। অবশ্যই ভুল ভ্রান্তি থাকবে তবুও আমি চেষ্টা করেছি শুদ্ধ করে লিখতে। আমার শারীরিক-মানসিক দুই অসুস্থতায় রয়েছে তাই মাথা হয়েছে এলোমেলো। মাঝে মধ্যে সৃতি শক্তি লোপ পায় মনে হয় আমার। তাই হয়ত সৃতি শক্তি লোপ পাওয়ার কারণে গল্পে নানান কিছু ভুল হয়েছে।মাথা ব্যাথার সমস্যার জন্য কোন রকম লিখে শেষ করে দিলাম। হাদিসগুলো রেফারেন্স সহকারে দিয়েছি হয়ত প্রাসঙ্গিক বিচ্যুতি ঘটেছে।আর হ্যাঁ আমাকে যত ইচ্ছে তত উপদেশ দিতে পারেন।নিজেদের মতো মন্তব্য করবেন অবশ্যই ভদ্রভাবে।যাইহোক,ভুল হলে মাফ করে দেবেন নিজ গুনে কারণ মাফ করা বড় মনের পরিচয়। মহা নবীর উম্মতেরা অবশ্যই বড় মনের]
❤আল কুরআনের ৮১টি উপদেশবাণীর ১টি বাণীঃ
৪০। বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ নিয়ে বিতর্ক করো না। [সূরা নিসা ৪:১০৫]
#আল্লাহ_হাফেজ (সমাপ্ত)💔