প্রেয়সী পর্ব ৬+৭

প্রেয়সী
প্রেয়সী

৬|
কপালে পট্টি। মুখে থার্মোমিটার নিয়ে আমি বিছানায় আধশোয়া। চেকআপ করে, ডাক্তার আঙ্কেল চলে যাচ্ছেন। সাথে গেলেন চাচ্চুরা আর বাবা। বাকি সকলেই রুমে উপস্তিত। না চাইতেও চোখ যাচ্ছে তন্ময় ভাইয়ের দিক। সে রুমে ঢুকেন নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সাধারণত সে আমার রুমে আসেন না। মনেও নেই সে শেষ কবে, আমার রুমে প্রবেশ করেছেন। রেস্টুরেন্টে তার স্পর্শ, আমাকে তার বাইকে উঠানো, আমার আর তার ছবি ব্যবহার করা। কেমন অদ্ভুত লাগছে। সে কী আমায়। না না। ভাবতেও শরীর শিরশির করছে। আমাকে? আমাকে কীভাবে পছন্দ করবেন। হতেই পারেনা। তাহলে তার এমন করার কারণ? রুবি আপু আছেন, কোথায় তার সাথে তো কখনও এমন করেননি। সে আমায় বোনের চোখে দেখলে কী, কোমরে স্পর্শ করতেন? এভাবে ধীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি’তে তাকাতেন?
ভাবনায় ছেঁদ পড়লো দীপ্তর কথায়,
–‘ বলছি, অরু আপুর বিয়েটা জ্বরের সাথে দিয়েই দাও। তখন হয়তো জ্বরের কিছুটা মায়া হবে, আর অরু আপুকে কয়েকদিন পরপরের জ্বর থেকে মুক্ত দিবে। ‘
রুবি আপু হাসতে হাসতে শেষ। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জোক্স বলেছে দীপ্ত। হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
–‘ বোকা৷ জ্বরের সাথে অরুর বিয়ে দিলে, তখন জ্বর চব্বিশ ঘণ্টাই রইবে। কারণ তখন অরু হবে জ্বরের একমাত্র সুন্দরী বউ। চোখে না হারাবে। ‘
ছোট চাচী ধমকে দিলেন,
–‘ দীপ্ত, পড়াশোনা শেষ হয়েছে?’
–‘ না তো। ‘
–‘ তাহলে মাইর খাওয়ার আগে যা। ‘
দীপ্ত যাচ্ছেনা। বরং আকুতি স্বরে বলল,
–‘ মাত্র রাত বারোটা। সকালে বাকি পড়া শেষ করবো। ‘
–‘ আমি আসছি। যদি দেখি তুই বিছানায় এখনও নেই। দেখবি তোর অবস্থা ‘
দীপ্ত দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে। আর এদিকে আমার খেয়ালই নেই যে, আমি তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকিয়ে। সে ডান ভ্রু উঁচু করে আছে। দ্রুত অন্যপাশে তাকালাম। কী লজ্জাজনক। প্রচন্ড অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত সব অনুভূতি। বুকের ধুকপুক বেড়ে চলেছে। রবিন ভাই যাওয়ার আগে বললেন,
–‘ ঔষধ খা ঠিকমতো জ্বরের রানী। ‘
সে যেতেই তার কিছুক্ষণের মাঝে তন্ময় ভাইও চলে গেলেন।
বড় মা জোরপূর্বক স্যুপ খাওয়ালেন। মা ঔষধ খাইয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে দিলেন। মাথায় হাত বোলানেন,
–‘ ঘুমিয়ে যা। ‘
–‘ ঘুম আসছেনা মা। ‘
–‘ আসবে। কিছুক্ষণ চোখ বুঝে থাক। আমি যাই কাজ আছে। ‘
বলতে বলতে মা চলে গেলেন। অন্ধকার রুমে রয়ে গেলাম আমি আর আমার অদ্ভুত চিন্তাভাবনা, অনুভূতি। চোখের সামনে তন্ময় ভাইয়ের চেহরা, তার চোখ। তার বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা। বৃষ্টির পানিতে তার সর্বমুখ ভিজে থাকা। তার আমার দিক তাকানো। আমাকে ধরা, অযথা শাসন করা। কারও সাথে কথা বলতে না দেওয়া। বাড়িতে ফোন করে জিজ্ঞেস করা, আমি পৌঁছেছি নাকি।
মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরলাম। হয়েছে কী আমার। তন্ময় ভাই? কম্বলে মাথা ঢুকিয়ে ফেললাম। কিচ্ছু ভাববো না। তন্ময় ভাইয়ের নামও নিবো না।

অথচ, সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। মাথায় তন্ময় ভাইয়ের সবকিছু। হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ দেখছিনা। টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসে, আমি আঁড়চোখে সোফায় তাকালাম। তন্ময় ভাই বসে। ঢাকা যাননি। তার তো যাবার কথা ছিলো। যায়নি কেন?
ভাবনার মাঝে ছোট চাচ্চুর কন্ঠ,
–‘ জ্বর কমেছে অরু? কোনো সমস্যা হচ্ছে? ‘
–‘ জ্বী চাচ্চু। না সমস্যা নেই। ‘
মা আলাদা ভাবে দুধ দিলেন গ্লাসে।
–‘ পুরোটা শেষ কর। দুটো রুটি দিয়েছি। এখানে আবার একটা
রুটি কীভাবে থেকে যায়? তুই খাস কী? না খেয়ে মরবি? ‘
বলতে বলতে মা রান্নাঘরে যাচ্ছেন। আমি অসহায় মুখে আর চোখে খেলার আর দেখলাম।
পরিস্থিতি নির্জন হতেই, বড় চাচ্চু শান্ত স্বরে প্রস্তাবের কথা তুললেন। দীপ্ত, রুবি আপু এরা একদম সোফায় গিয়ে বসেছে, সব শুনবে বলে। অথচ, আমি সব মনোযোগ খাবার প্লেটে দিলাম। আজ আর এগুলো শুনতে মন সায় দিচ্ছেনা।
–‘ পুলিশ অফিসার আশিকুর রহমান। সে কাল বাড়ি এসেছিলো, তার মেয়ের জন্য। ‘
তন্ময় ভাই উঠতে নিচ্ছিলেন, তখনই বড় মা চেঁচালেন,
–‘ তুই কী বিয়ে করবিনা? বয়স কী কম হচ্ছে? তোর বয়সের ছেলেদের, বিয়ে হয়ে বাচ্চাও হয়ে আছে। বাড়িতে সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব আসছে। তোর কী একটাকেও পছন্দ হয়না? নিশি মেয়েটার কোন দিক দিয়ে কমতি? ‘
বড় চাচ্চু, বড় মা’কে কথা বলতে বারন করলেন। সে শান্ত স্বরে আবারও বললেন,
–‘ তোমার কোনো পছন্দ আছে? ‘
তন্ময় ভাই চুপ মেরে গেলেন। বাড়ি আরও থমথমে হয়ে গেলো, বড় চাচ্চু বর্তমান প্রশ্নে,
–‘ তোমার কী অরুকে পছন্দ? ‘
পানি খেতে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। শুধু আমি না সকলেই। চাচীরা, মা রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এলেন। বড় মা আওয়াজ তুললেন,
–‘ এগুলো কেমন প্রশ্ন? ‘
বড় চাচ্চু হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। তাই সকলে অবাক হলেও একটা শব্দ করেননি। এদিকে আমার বুকের ধুকপুক তীব্র। যেকোনো মুহুর্তে হার্টএট্যাক করে ফেলব।
তন্ময় ভাই তখনও অন্যদিকে তাকিয়ে। তার জবাব,
–‘ তেমন কিছু না। ‘
–‘ তাহলে অরুকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে, তো তোমার সমস্যা হবার কথা না। তাইনা? ‘
এবার সে চাচ্চুর দিক তাকালেন। চাচ্চু থামলেন না,
–‘ জবাব দিতে হবে তন্ময়। ‘
তন্ময় ভাই চলে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। বড় মা চেঁচিয়ে ডাকলেন। সে শুনলেন না। এবার বাবা বড় চাচ্চু’কে বললেন,
–‘ এগুলো কেমন প্রশ্ন? ভাই আপনি না জেনে, ‘
চাচ্চু থামিয়ে দিলেন বাবাকে।
–‘ না জেনে কী? সে আমার ছেলে। আমার থেকে ভালো তাকে তার মা’ও চেনে না৷ ‘
আমি উপরে চলে এলাম। অনেক আগেই চলে আসতাম। শুধু সাহস পাচ্ছিলাম না। বড় চাচ্চু এমন কেন বললেন? এখনও বুকের তীব্র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভয়ও হচ্ছে প্রচন্ড।

সারাদিন বাড়ি শুনশান গেলো। সবাই এতটাই অবাক, কেউ কোনো শব্দই তোলেনি এই বিষয়ে। রাত হয়ে যাচ্ছে তন্ময় ভাই বাড়ি ফেরেননি। বড় মা চিন্তায় শেষ। তার ফোনে কল দেওয়া হয়েছে হাজার বার। রিসিভ হয়নি। আমার নিজেরও বেশ চিন্তা হচ্ছে। রুমে পাইচারী করেছি শুধু। সেদিন আর বাড়ি ফিরেনি সে। পরেরদিন বড় চাচ্চু জানতে পারেন, তন্ময় ভাই ঢাকা চলে গিয়েছেন। বিকেল দিকে ভাইয়ের সাথে কি কথা হয়েছে কে জানে, এরপর থেকে চাচ্চু আর এই পছন্দের ব্যাপারটা তুলেন নি। বরং সবাইকে এই ব্যাপারে কথা বলতে সম্পুর্ন নিষেধ করে দিলেন। এগুলো আমাকে জানালো দীপ্ত। আরও বলল,
–‘ তন্ময় ভাই তোমাকে পছন্দ করেন। আর সেটা বড় চাচ্চু জানেন।
এখন হয়তো এই বিষয়ে কথা আর হবেনা, কারণ তুমি এখনও ছোট। ‘
আমি শুধু অসহায় হয়ে তাদের বক্তব্য শুনে গেলাম। সে কী সত্যি পছন্দ করেন? আমাকে?এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে রেখে? আমার কেমন বিশ্বাসই হচ্ছিলো না।

তন্ময় ভাই বাড়ি ফিরছেন না আজ বিশ দিন হচ্ছে। সে বেশিরভাগ সময় কাজের সূত্রে ঢাকা থাকেন। এক মাস বা দু মাসে পর আসেন। আবার দু’চারদিন থেকে চলে যান। কিন্তু এবার সে রেগে বেরিয়েছে। তাই বাড়ির সকলে চিন্তায়। আবার বাড়িতে ফোনও করেননি। যেটা সে সদা করে থাকেন। এদিকে বড় মা কেঁদে কেটে শেষ। তার কতগা হচ্ছে, বড় চাচ্চু ভুলভাল কথা বলে ভাইয়াকে রাগিয়েছে।
কলেজ গিয়ে সুমনা’র গোয়েন্দাগিরি,
–‘ কীরে তন্ময় ভাই কই? এখনও ফিরেনি? ‘
সুমনার কন্ঠে স্পষ্ট, সে বেশ চিন্তিত। চিন্তিত তো সবাই। তাই না? আমি আমতাআমতা করে বললাম,
–‘ উম, চলে আসবেন। চিন্তা করিস না। ‘
–‘ আসলে একটা কল দিস, প্লিজ। ‘
–‘ হ্যাঁ। ‘
কথা তো দিয়েছি। এখন কল দিবো নাকি শিয়র না। আর কথা বাড়ালাম না। বরং তীব্র বৃষ্টির মাঝে ছাতা হাতে, দ্রুত বাড়ির রাস্তা ধরলাম। বাড়ি চলে যাওয়াই উত্তম। আমার মুখ হচ্ছে কেঁচি। কথা শুরু করলে সব বলে দেই। কখন না কখন এগুলো মুখ থেকে বেরোবে। পরে সুমনার মন ভেঙে যাবে।
অবশ্য কলেজ হতে বাড়ি কাছে। তাই বৃষ্টির মাঝে চলে যাওয়া যায়। মাথায় পৌঁছাতেই দেখলাম তন্ময় ভাই স্টলে বসে। তীব্র বৃষ্টির মাঝে সে স্পষ্ট। সাথে রয়েছে তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। আমাকে দেখে কথা বলা বন্ধ করলেন। ইশারা করলেন ওদিকে যেতে। আমি শ্বাস আঁটকে স্টলের পাশে দাঁড়ালাম। সেখানে বৃষ্টি পরছে না। সে তার হাতের মোবাইলের বাক্স ধরিয়ে দিলেন।
–‘ সবকিছু স্যাট করা। ফোন নাম্বার কাউকে দিবি না। ‘
আমি মাথা ঝাকালাম পুতুলের মতো। হাতে বাক্স নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। সে বললেন,
–‘ দ্রুত যা। বৃষ্টিতে ভিজবি না। ‘
–‘ জ্বী। ‘
আঁড়চোখে তাকালাম। সাহস জুগিয়ে বলেই ফেললাম,
–‘ বাড়ি আসবেন না? ‘
–‘ হ্যাঁ। আসবো। ‘
আমি মাথা দুলিয়ে সামনে এগোলাম। ঠোঁটের কোণে বিশ্ব হাসিটা জেন তার জন্য এই প্রথম। কেমন অনুভূতি হচ্ছিলো তা শব্দে উপস্থাপন করতে পারছিলাম। পেছনে ফিরে তাকে আরেকবার দেখতে চাওয়া আমার মন। অথচ আমি সর্বচ্চ চেষ্টা করছিলাম, যাতে পেছনে না ফিরি। সে নিশ্চয়ই তাকিয়ে। আমি ফিরলে সে দেখে ফেলবে? লজ্জাজনক হবে ব্যাপারটা। কিন্তু মন। তা শুনতে বারণ। হাজার প্রচেষ্টা ব্যর্থ। সেই আমি পরিষ্কার আকাশের নিচে, তীব্র বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার দিক ফিরলাম । ঠিকই সে আমার দিক তাকিয়ে। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার সেই চোখ, যা আমার উপর বিচরণ করছে। আমাকে দেখছে। আমি এবার দ্রুত পায়ে সামনে চললাম। বলা যায় একপ্রকার দৌঁড়িয়ে এসেছি।

চলবে

® নাবিলা ইষ্ক
৭|
ফোন নিয়ে সোজা মা’র ঘরের দিক রওনা হলাম। তন্ময় ভাই ফোন কিনে দিয়েছেন। সেটা তো দেখাতে হবে। নাহলে পরে আবার এটা নিয়ে কথা উঠবে। ঘরে ঢুকতে নিয়েও ঢুকলাম না, তাদের আলোচনা
শুনে,
–‘ হ্যাঁ, ধরলাম তন্ময় অরুকে পছন্দ করে। বিশ্বাস করে নিলাম।
বড় ভাই মেনে নিবেন। কিন্তু ভাবী? তার একমাত্র ছেলে৷ যেই ছেলের জন্য বাড়িতে প্রস্তাব আসে বড়সড় ঘর থেকে। কাজে পড়ালেখায় সবদিক দিয়ে উন্নত। সেই ছেলের জন্য সে অরুকে চাইবে? হ্যাঁ, ভাবী ভালবাসে অরুকে। কিন্তু সেটা মেয়ের মতো। তার ছেলের বউ হিসেবে সে, অরুকে মন থেকে মানবে বলে মনে হয়না। আমাদের জন্য, ভাইয়ের জন্য মানলেও, সে মনেমনে তার ছেলের জন্য আরও বড় ঘরের মেয়ে চাইবে। ‘
–‘ তোমার ভাবীকে এই মনে হয়? সে অরুর জন্য পাগল। তন্ময়’কে রেখে সে অরুকে দেখেছে। অবশ্যই সে এতে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। ‘
–‘ আমারতো তা মনে হলো না। ‘
–‘ হবে কীভাবে উল্টাপাল্টা ভাবলে। ‘
–‘ তখন দেখলে না, যখন ভাই বলল তন্ময় অরুকে পছন্দ করেন। সে কীভাবে চেঁচালেন। সে একদমই মন থেকে অরুকে নিজের ছেলের বউ মানবে না। স্বামী আর ছেলের খাতিরে মানলেও, মন থেকে না ‘
–‘ তুমি থামবে? ‘
আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে এলাম। রুমে যাবার পথে দেখলাম বড় মা রান্নাঘরে কাজ করছেন। আমার মনে কেমন নিমিষে অন্ধকার ছেঁয়ে এলো। সত্যি কী তাই? মা যা বললেন তা কী সত্যি?
রুমে এসে বিছানায় বসে রইলাম। মন আর সায় দিলো না, নতুন ফোন খুলে দেখার। আমাদের সুন্দর পরিবার’টা কি ভেঙে যাবে?

দুপুরে দীপ্ত এসে দরজা টোকাচ্ছে। গোসল দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম খেয়ালই নেই। দরজা খুলে দিতেই বলল,
–‘ ঘুম আর ঘুম৷ এতো ঘুম পাও কই। ‘
–‘ তুইও ঘুমা। ‘
–‘ এহ! আমার স্কুল আছে দ্যান প্রাইভেট। স্কুল আর প্রাইভেটের হোমওয়ার্ক। কত কাজ। ‘
আমি ওর ঝাকড়া চুলগুলো দু’হাতে ধরলাম। সযত্নে তা গুঁছিয়ে দিতে দিতে বললাম,
–‘ বেবিট্যাক্সি, একঘন্টা ঘুমোলে তোর পড়াশোনা পিছু হবেনা। বরং আরও মন ফুরফুরে হবে। ‘
–‘ তুমিই করো মন ফুরফুরে। আমার তো মন বহুত ফুরফুরা। বিয়ে খাবো। তোমার আর তন্ময় ভাইয়ার। আহা। ‘
গাল দুটো আমার গরম হয়ে উঠছে। কোনোভাবে জবান দিলাম,
–‘ অসভ্য। অযথা কথা বলবিনা। ‘
–‘ অযথা কী? চাচ্চু বলেছেন, তন্ময় ভাইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হলেই, বিয়ের কথা ভাববেন৷ ওয়াহ। ভাইয়ার শেষ হতে মাত্র বছর। ধিংকাচিকা নাচ হবে। ‘
হঠাৎ দীপ্ত চেঁচাল ,
–‘ ফোন? ওয়াও। ‘
বলতে বলতে ফোন বক্স থেকে বের করলো।
–‘ ইশ! কী সুন্দর। তন্ময় ভাই দিয়েছেন? ‘
ছেলেটা এতো বুঝদার। তা বলার বাহিরে।
–‘ লেটেস্ট মডেল। উফ, আমাকে গেমস খেলতে দিবে? ‘
–‘ অবশ্যই। ‘
দীপ্ত ফোনে ওয়াইফাই’র প্যাসওয়ার্ড টাইপ করছে। নির্ঘাত এখন গেমস ডাওনলোড দিবে। আমি ফ্রেস হতে গেলাম। ইশ৷ আমার অর্ধেক ঘুমটা। ঘুম সম্পুর্ন না হলে মাথা ধরে। এই-যে আপাতত মাথা ঘুরছে। কোনোভাবে ফ্রেস হয়ে, ঘুমঘুম চোখ নিয়ে বেরোলাম। দীপ্ত তাড়া লাগালো,
–‘ চলো। খেতে ডাকছেন। ‘
নিচে নেমে সর্বপ্রথম চোখ গেলো সুমনার দিক। এ কখন আসলো? মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। অযথা। বড় মা আমাকে দেখতেই বললেন,
–‘ বস অরু। দ্রুত খেয়ে শেষ কর। আজ আমার সাথে শপিংয়ে যাচ্ছিস। রুবিও যাবে। ‘
চেয়ারে বসতে বসতে বললাম,
–‘ হঠাৎ। ‘
রুবি আপুর জবাব,
–‘ আইরিনের জন্মদিন পার্টি। তন্ময় ভাইয়াকে জোরপূর্বক এনেছেন। একদম মিস দেওয়া যাবেনা। ‘
আচ্ছা। আইরিন হচ্ছে তন্ময় ভাইয়ার মামাতো বোন। খুবই ভদ্র।
কয়েকমাস আগে এসেছিলো। খুবই বনে ওর আমার আর রুবি আপুর সাথে। দীপ্ত আর ওর তো লেগেই থাকে। দুজন দুজনের দুশমন যেন।
আমি আঁড়চোখে তাকালাম। তন্ময় ভাই খাচ্ছেন। এদিকসেদিক তাকাচ্ছেন না। সুমনা সদার মতো তার পাশে। মেয়েটা বারবার তাকাচ্ছে ভাইয়ার দিক৷ খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে আজ আর হাসি আসছেনা। বরং বিরক্তি আর ভয় জাগছে। সুমনা যদি জানে, তন্ময় ভাই আর আমার ব্যাপারটা? ও কীভাবে নিবে? তন্ময় ভাইয়ের প্রতি ওর অনুভূতি তো অপরিসীম। আমিতো সাক্ষী। বারবার তাকে দেখার প্রচেষ্টা। তার কন্ঠ শোনার প্রচেষ্টা। কীভাবে কি হবে?
তন্ময় ভাইয়ার হঠাৎ কন্ঠে কেঁপে উঠলাম। তার হঠাৎ কন্ঠ একদমই আশা করিনি,
–‘ খাচ্ছিস না যে? ‘
ডাইনিংের সকলেই আঁড়চোখে তাকিয়ে, আবারও খাওয়াতে মনোযোগী হলেন। ও আচ্ছা। মহারাজ ড্রাইভিং করবেন। তাই তার এতো তাড়া। সেও যাচ্ছেন তাহলে। এদিকে ডান পাশের রুবি আপু, তন্ময় ভাইকে খোঁচাচ্ছেন। আর বিরবির করে কীসব বকছেন। আর হাসছেন। অথচ সে রুবি আপুকে কিছুই বলছেনা। বলবে কী, দুটো একই বয়সের তাই তাদের যায়ও ভালো।
সুমনার চোখে চোখ পড়তেই ও ইশারা করছে। আমি বুঝেও না বুঝার মতো খেতে লাগলাম। আমার আর এগুলো নিতে আর দেখতে ভালো লাগছেনা। কেন? জানি না। কিন্তু অন্য মেয়েদের আর তন্ময় ভাইয়াকে একসাথে আর ভাবিনা। ভাববো না।
সুমনা নিজেই বলল,
–‘ উমম আমিও যেতে চাই, যদি সমস্যা না হয়। ‘
বড় মা হাসলেন,
–‘ সমস্যা কীসের আসবে। ‘
সুমনার ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। ও ধীরে তন্ময় ভাইয়াকে বলল,
–‘ তন্ময় ভাই, তোমার সমস্যা হবেনা তো ? ‘
তন্ময় ভাই হতে কোনো জবাব নেই। সে খেতে ব্যস্ত। সুমনা জবাব না পেয়েও হাসছে। হাসবেই তো। তার সাথে ঘুরবার রাস্তা যে পেয়েছে। হু৷ আমার আর যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না।

সুমনা বারবার বলছে,
–‘ আমাকে তন্ময় ভাইর পাশে বসতে সাহায্য করিস। প্লিজ। প্লিজ। প্লিজ অরু। ‘
আমি শক্ত মন নিয়ে তৈরি হচ্ছি। এ কিধরনের জ্বালা। না পারছি বলতে আর না পারছি সইতে।
ভেবে রেখেছি গাড়ির পেছনেই বসব। সুমনা কেমন বারবার বলেছে। মেয়েটা কষ্ট পাবে। অথচ, গাড়ির সামনে যেতেই বড় মা বললেন,
–‘ সামনে বস। ‘
আঁড়চোখে সুমনার দিক দেখলাম। বেচারি ইশারা করেই যাচ্ছে। আমি ইনিয়েবিনিয়ে বললাম,
–‘ বড় মা। মাথা প্রচন্ড ধরেছে। ভাবলাম তোমার কাঁধে মাথা রেখে যাবো। ‘
বড় মা’র মন গলে গেলো।
–‘ আচ্ছা আয়। তাহলে রুবি যা তন্ময়ের পাশে বস। ‘
সুমনাকে রাস্তা না দিয়ে রুবি তন্ময় ভাইয়ের পাশে বসলেন। কি আর করার। সুমনা ভাঙা মন নিয়ে পেছনে বসলো। আমি বড় মা’র কাঁধে মাথা রেখে, চোখ বুঝে। ওদিকে রুবি আপু তন্ময় ভাইয়ের ক্লাস নিচ্ছেন,
–‘ বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে আমাদের তন্ময়ের। বাহ। ‘
তারপর সুমনা’কে ইঙ্গিত করে বলল,
–‘ সুমনা জানো কী হয়েছে? আমার হ্যান্ডসাম ভাইয়ের জন্য আবারও প্রস্তাব এসেছে। তাও অফিসারের মেয়ে। ‘
বলেই হাসতে লাগলো। আঁড়চোখে দেখলাম সুমনার মুখ একটুখানি। আমি ভাবছিলাম, আবাদ বেশি না বলে ফেলে রুবি আপু।
এদিকে এতক্ষণ পর মহারাজ কথা বললেন,
–‘ ধাক্কা দিয়ে ফালাই দিয়ে চলে যাব। ‘
রুবি আপু হাসছে,
–‘ বড় মা আছেন। তুর কল্লাডা চিপে দিবে। ‘
এবার সবাই হাসলো তন্ময় ভাই বাদে। খসরু ।

শপিংয়ে আমি বড় মা’র সাথে হাঁটছি। রুবি আপু পাশে। তন্ময় ভাই পেছনে তো সুমনাও পেছন পেছন ৷ দেখা গেলো বড় মা প্রথমে বাড়ির বাচ্চাদের জন্য শপিং করলেন। পাঁচ ছয়টা ড্রেস নেওয়া হয়েছে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। সাথে দীপ্তর জন্য ও।
এখন বড়দের জন্য কেনাকাটা বাকি। বড় মা বললেন,
–‘ তোরা কী নিবি? পছন্দ করছিস না যে? ‘
বড় মা রুবি আপুকে ড্রেস নিয়ে দিলেন পছন্দের। আমি না করে দিলাম। আমাকে দিলে সুমনার কী হবে? বারবার বলার পরও কিছুই নিলাম না। বড়দের জন্য কেনার ক্ষেত্রে অন্যদিকে যেতে হচ্ছে।
হঠাৎ তন্ময় ভাই ডাকলেন।
–‘ অরু। ‘
আমি দ্রুত পেছনে ফিরলাম,
–‘ জ্বি? ‘
সুমনা তন্ময় ভাইয়ের সাথে ছিলো। রুবি আপু সুমনার হাত ধরে বলল,
–‘ সুমনা চলো ড্রেস কালেকশন দেখি। ‘
পেছন রয়ে গেলাম আমি, একা তন্ময় ভাইয়ার সাথে। সে বললেন,
–‘ আয়। ‘
বাধ্য মেয়ের মতো তার পিছু যাচ্ছি। কামিজ কালেকশনের দোকানে থামলেন। গলা আমার শুঁকিয়ে কাঠ।
–‘ পছন্দ কর। ‘
হাজার কষ্টে আওয়াজ বের করলাম,
–‘ উম, লাগবেনা। ‘
সে আর জিজ্ঞেস করেননি। বরং নিজেই কিছু কামিজ দেখাতে বললেন। পাশে আরও কাস্টমার এসেছে। খেয়াল করতেই,
সে আমার বাহু ধরে তার দিক টেনে নিলেন। কাঁধ হতে আর হাত নামাননি। সেভাবেই ড্রেস পছন্দ করছিলেন। আমি শুধু আঁড়চোখে তার দিক তাকাচ্ছিলাম। বুকের মাঝে তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার অজান্তেই।

ফিরবার পথে সুমনা ভাইয়ার পাশে আগে বসেছে। উফ মেয়েটা। রুবি আপু আমার দিক চোখ রাঙাচ্ছেন। আমি কি করলাম? অবশ্য সে সুমনাকে তেমন পছন্দ করেন না। তার উপর যেভাবে তন্ময় ভাইয়ের পাশ হতে নড়ছে না। আবার মধ্য রাস্তায় সুমনা আইসক্রিমের এর স্বর তুলল। তন্ময় ভাই সকলের জন্য আনলেন।
এদিকে বাড়ি ফিরতেই রুবি আপু আমাকে তার রুমে টেনে নিয়ে গেলেন।
–‘ তুই জানিস না তন্ময় কেমন? ও কথা বলেনা বলেনা, বললে খেয়ে দিবে। সুমনা কীরকম করছিলো দেখেছিস? তুই কীভাবে ওকে সুযোগ দিস, তন্ময়ের পাশে থাকার? ‘
–‘ ও বারবার বলছিলো। ‘
–‘ ও বললেই হচ্ছে? তুই তন্ময়ের হাতে থাপ্পড় খেয়ে সোজা হবি। দেখে নিস। ‘
উহ। এখন সব আমার দোষ।

চলবে।

® নাবিলা ইষ্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here