##শুধু_তোমারই_জন্য পর্ব ৮
#সাবানা_খাতুন
রিয়া কনকবালার রুমে পায়চারি করছে ।আর বার বার দেওয়াল ঘড়ির দিকে ,একবার মোবাইল ফোনের দিকে একবার দেখছে। উফ… দাদা টা না কি যে করে ।কত করে বললাম তাড়াতাড়ি আসতে ।এখনো আসছে না আর ওদিকে বৌদি হয়তো অপেক্ষা করতে করতে বোর হয়ে গেল। কনকবালা রিয়া কে বলল তুই এত অস্থির কেন হচ্ছিস? দাদুভাই হয়তো কাজে ব্যাস্ত।বলেছিস তো চলে আসবে ,।রিয়া বলল কি জানি সারপ্রাইজ দেবো বললাম দিতে পারব তো? এত কষ্ট করে বৌদি মেকাপ করল সেই কোন সন্ধ্যা থেকে। এখন প্রায় রাত হতে চলল আর কতক্ষন বেচারি অপেক্ষা করবে তুমি বলো? ঠিক এই সময় রিয়ার মোবাইলে অর্নবের কল আসে।রিয়া ফোন তুলতেই ,হ্যাঁ দাদা বল কি বলছিস? অর্নব বলল সরি রে আজ একটা মিটিং এ ফেঁসে গিয়েছি,তোর সারপ্রাইজ টা না, হলে কাল কর আর শোন না আমার বাড়ি যেতে আরো ঘন্টা তিনেক লাগবে।আমার মিষ্টি বোন রাগ করিস না।বলে অর্নব কল কেটে দেয়।রিয়া আর কিছু বলার সুযোগ পায় না, কনকবালা বলল কি বলল দাদুভাই? দাদা বলেছে বাড়ি আসতে আরো ঘন্টা তিনেক লাগবে।সারপ্রাইজ টা যেন কাল দেই, মুখে একটা চুক শব্দ করে রিয়া বলল।কার মুখ দেখে যে সকালে উঠেছিলাম ,এত কষ্ট করলাম সব বিফলে গেল ধুররর…ভাল লাগে না। কনকবালা বলল যা তাহলে কাঁকনকে বলে আয় দাদুভায়ের আসতে দেরি হবে, গোমড়া মুখ করে রিয়া চলে যায়।
রিয়া কাঁকনের রুমের সামনে দেখল দরজা খোলা,অবাক হয়ে রুমে ঢুকে দেখল, চারিদিকে কাগজ ছড়ানো, রিয়া আরো অবাক হয় দেখে যে আলুথালু চুল ও শাড়িও আলুথালু নিয়ে কাঁকন খাটের একপাশে বসে হেঁচকি তুলে নিঃশব্দে কাঁদছে। রিয়া ছুটে গিয়ে বলে বৌদি, ও বৌদি কি হল তোমার কাঁদছো কেনো? কাঁকনের মুখ তুলে রিয়া দেখল চোখের আইলানার আর মাশকারা মিলে মিশে চোখের কোন কালো হয়ে গিয়েছে,গাল বেয়ে কালো জলের ছাপ রয়ে গিয়েছে।একটু আগে যাকে এত সুন্দর করে সাজিয়েছিল রিয়া তার এই রূপ দেখে সত্যি ভয় পেয়ে যায়। ছুটে যায় কনকবালার কাছে। কিছুক্ষন পরে কনকবালা হন্তদন্ত হয়ে কাঁকনের কাছে এসে দেখল একই অবস্থা ,কনকবালা বসে পড়ল কাঁকনের পাশে হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগল কাঁকনকে, বলে উঠল দিদিভাই তোর কি হল তুই এমন হয়ে আছিস কেন? এইবার কাঁকন কনকবালা কে ধরে আরো জোরে কাঁদতে লাগল,রিয়া জল এনে দিতে কনকবালা জল খাইয়ে জিঞ্জাসা করল আরে বলনা কি হয়েছে? কাঁকন একটা পেপার রিয়ার হাতে দিল।রিয়া পেপারটা নিয়ে দেখে একদম চমকে গেল,কনকবালা বিরক্ত হয়ে বলে উঠল কি লেখা আছে ওতে? ডি…ডি.ডিভোর্স পেপার দাদা আর বৌদির নামে আর এটা দুদিন আগে করা।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না দাদা এইরকম করবে, থেমে থেমে বলল রিয়া, কনকবালা ও অনেক অবাক হয়।কাঁকনের কান্না থামছেই না, রিয়া বলল দাঁড়াও আমি দাদাকে ফোন করে
জিজ্ঞাসা করছি কেন এইরকম করছে সে?
রিয়া ফোনটা বের করে ফোন করতে যাবে।কাঁকন ধরে ফেলে বলল তোমাকে আমার দিব্যি তোমরা দুজনে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।কিন্ত বৌদি রিয়া বলল, না রিয়া প্লিজ আমি যা বলছি শোনো,ভুলটা তো আমার আমি অর্নবের মনে কি আছে না জেনে নিজেই ভেবে নিলাম ও আমাকে ভালবাসে কত বোকা আমি।রিয়া আবার বলল প্লিজ একবার জিজ্ঞাসা করতে দাও আমার মনে হচ্ছে কোনো ভুল হচ্ছে।কনকবালা ও বলল একবার ফোন করে জিজ্ঞাসা তো করতে দে। কাঁকন বলল যদি তোমরা আমার কথা না শোনো তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে বলেই কাঁকন বাথরুমে চলে যায়।দুজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
জোরে শাওয়ার ছেড়ে দেয় কাঁকন ,ধুয়ে যাক জলে সব কিছু কারোর দেওয়া আঘাত,বিশ্বাসঘাতকতা আর ঘৃণা।সিঁথির সিঁদুর ঘষে ঘষে তুলল কাঁকন,এটা পরার কোনো অধিকার নেই তবুও পাগলের মতো সিঁথিতে সাজিয়েছে।আয়নায় নিজের মুখ দেখে বলল তুই একজন এমন মানুষ যে শুধু ভালবাসার কাছে ঠকে।চোখের জল আর কলের জল সব এক হয়ে গিয়েছে,চুড়ি খুলে ফেলে দিল এককোণে ঝন্ ঝন্ শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।অনেকক্ষন পর কাঁকন বেরালো ভিজে চুল,শাড়ি নিয়ে, রিয়া ছুটে গিয়ে আলমারি থেকে তোয়ালে বের করে কাঁকনকে জড়িয়ে দিল।রিয়া আর কনকবালা দুজনের খুউব কষ্ট হচ্ছিল কাঁকন কে এইভাবে দেখে।এইবার কাঁকন ধরা গলায় বলল ঠাকুমা তুমি আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলে না আমি এখানে কেন এসেছি?কনকবালা বলল নিশ্চয় দাদুভায়ের কাছে। না… কাঁকন বলল আমার আসার কারন এখানে আমার বাবার খুনি থাকে তাকে শাস্তি দিতে এসেছি। দুজনে বড়ই অবাক হয়ে একসাথে বলে উঠল ..খুনি…. কে? কাঁকন এবার মুখে প্রচন্ড ঘৃণা ও রাগ নিয়ে বলল অর্নব চৌধুরি।
রিয়া আর কনকবালা দুজনেই খুব অবাক হল,কনকবালা জিজ্ঞাসা করল তুই কি বলছিস তুই জানিস তো? কাঁকন বলল আমি জানি তোমরা আমাকে কোনোদিন বিশ্বাস করবে না।আমি এই কথা তোমাদের কোনো দিন বলতে পারিনি। কারন হল একটাই যে আমি যাই বলি না কেন তোমরা আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করবে না। তোমাদের কাছে অর্নব খুব ভাল আর আমার কাছে ও শয়তান। রিয়া বলল বৌদি কথা ঘুরিয়ে না বলে সোজাসুজি বলোনা দাদা কে তুমি খুনি কেন বলছো? কাঁকন বলা শুরু করে।তোমার দাদা আর আমি যখন কলেজে পড়তাম ,তখন আমাদের পাড়ায় বাসা নিয়ে থাকত।একদিন আমি বাড়ি ছিলাম না বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়, রিয়া বলল এটা তো আমরা জানি, কাঁকন বলল আমাকে ছেড়ে আসার পর কি হয়েছিল সেটা জানো ? ডাক্তার এও বলেছিল দ্বিতীয় বার কোনো কারনে যদি বাবা শোক পায় তাহলে বাবাকে আর বাঁচানো যাবেনা। তোমার গুনধর দাদা এটা জানত ,এইবার কাঁকনের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে, আমাকে বাবার সামনে যখন ও বলল, আমার সাথে মিথ্যা বিয়ে করেছে তখন বাবা এটা সহ্য করতে পারল না। কনকবালা অবাক হয়ে বলল কি বলছিস তুই?
অর্নব যাওয়ার একসপ্তাহ পর ।বাবার দ্বিতীয় আ্যটাক হয়, আটমাস বুঝলে আটমাস হেঁচকি তুলে কাঁকন। কোমায় ছিল আমার একমাএ অবলম্বন ।আমার তো আর কেউ ছিল না একমাএ বাবা ছাড়া সেও চলে গেল আটমাস পরয় রিয়ার চোখে জল কনকবালা চুপ হয়ে শুনছেন, কাঁকন কাঁদছে আর বলছে, এর একাংশ দায়ি আমিও,অর্নবের বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারিনি।লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম,বাবা এটা দেখত, কিছু বলতে পারত না একমাএ মেয়ের কষ্ট তার বুক কে আঘাত হানে।কতটা কষ্ট নিয়ে আমার বাবা পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছে ,সে অনুমান তোমাদের নেই, আমিও এখন নিঃস্ব আমার আর কিছুই রইল না।বাবার তাজা শরীরটা চিতার আগুনে পুড়তে দেখলাম, বলো আমার মনে কতটা কষ্ট হয়েছে? আমিতো নকল বিয়ে বলে জানতাম।বাবার উকিল বন্ধুই বলল অর্নব ওনার কাছে বিয়ের পেপার বানিয়েছিল,আর বাইরে থাকার কারনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।বাবার দাহ কাজের দিন আমাকে বললেন সব কথা, আজকে বাবা যদি জানত আমাদের বিয়ে নকল নয় আসল তাহলে আজ উনি হয়তো বেঁচে থাকতেন।
আমি এখানে কোনোদিন ও আসতাম না যদি না শুনতাম ওর এনগেজমেন্ট ,আমাকে কাঁদিয়ে আমার শেষ অবলম্বন কে কাড়িয়ে ও সুখ পেতে চাইছিল ,তাই ওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এখানে এলাম।কিন্তু তোমাদের দেখে আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম,ওকে তো আমি ভালবাসতাম। তাই ক্ষমা করে দিয়েছিলাম,কিন্ত এখন পুরানো ঘৃণাটা আবার ফিরে এসেছে।কনকবালা বলে উঠল সামান্য কারনে আজ পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেল।রিয়া বলল দাদা অজান্তে এত বড় পাপ কাজ করল,শুধুমাএ মিথ্যা অহংকার আর ইগোর জন্য ,আমিতো ভাবতেই পারছিনা,রিয়ার ও রাগ হচ্ছে অর্নবের উপর, কাঁকনের চোখে শুধুই আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই,এইবার বলল আজ থেকে অর্নব চৌধুরি শুধু আমার শত্রু ছাড়া আর কিছু নয়।কনকবালা যাওয়ার আগে বললেন ,দেখ আমি তোকে কিছু বলব না শুধু একটা কথা ঘৃণা বেশি হওয়া ভাল না,যাতে তোর সব বলি হয়ে যায়।
কাঁকন কাপড় চেঞ্জ করে জানালা থেকে বাইরের চাঁদনি রাত দেখছিল,এটা যেকোনো কাপলের স্বপ্ন ,কিন্ত কাঁকনের মনে এখন অর্নবের প্রতি একটা ভীষণ তম রাগ সৃষ্টি হচ্ছে ।অর্নব রুমে ঢুকে দেখল কাঁকন জানালার বাইরে কি যেন দেখছে, কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল ,তুমি এখনো ঘুমাও নি কেনো? কাঁকন বলল তোমার জানার প্রয়োজন নেই,অর্নব অবাক হল হঠাৎ কাঁকন এত রুক্ষ ভাবে জবাব দিচ্ছে কেনো। আবার জিজ্ঞাসা করল ,কি হল বলবে তো ।কাঁকন এইবার অর্নবের দিকে ঘুরে বেশ কড়া গলায় বলল, আমি কি তোমার কেনা গোলাম ,তুমি যা বলবে তাই করতে হবে,কি ভাবো নিজেকে,আমার জীবন টা শেষ করে নিজে সুখ পেতে চাও ।আমি কি করব ,করব না সব কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে,অর্নব এবার কাঁকনে মুখ টিপে জড়িয়ে ধরে দেওয়ালে ঠেসে ধরে কাঁকনের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল একদম চুপ,তখন থেকে শুনছি ,আমি এমন কি জিজ্ঞাসা করলাম যে তুমি ফুলনদেবি হয়ে গেলে।
এই আকস্মিকতায় কাঁকন একদম হকচকিয়ে যায় একটা আলাদা শিহরন খেলে গেল দুজনের শরীরের মধ্যে যেন বেশি ভোল্টের কারেন্ট শক,অর্নব ও ভাবতে পারেনি সে এরকম করতে পারে,অর্নব একদম কাঁকনের শরীরের কাছাকাছি লেপ্টে আছে,কয়েকমিনিট দুজন চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে ।অর্নবের চোখে কাঁকন একটা অন্য ধরনের কিছু দেখে সেটা মনে হয় ভাল লাগা।প্রেমিকের চোখে প্রেমিকার যে অনুভূতি ,অর্নবের চোখে কাঁকন তা দেখে রোমাঞ্চিত হয়,কাঁকন ও নরম হয়ে পড়ে অর্নবের চাহনিতেয় কিন্ত পরক্ষনেই তার মনে পড়ে যায়,একটু আগের কথা,নিজেকে আর সে ঠকাতে দেবে না অর্নবের কাছে।অর্নব হয়তো আবার ভালবাসার নাটক করছে তার সাথে, তাই অর্নবকে দূরে সরানোর জন্য গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে অর্নবকে এক ধাক্কা দেয় কাঁকন।অর্নব পেছন হেলে টাল সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়ে মেঝেতে কাঁকনের এইরূপ রুদ্র মূর্তি দেখবে সে আশা করেনি,হতভম্বের মতো কাঁকনের দিকে তাকিয়ে থাকে অর্নব।
চলবে…….