জোড়া শালিকের সংসার পর্ব ৫

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৫

খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলতে খেয়া লাফিয়ে উঠল।সামান্য ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতেই দেখে দরজার সামনে নির্ঝর একরাশ অবাকত্ব নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তার চোখে হাজারো প্রশ্নেরা এসে ভিড় জমিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।

খেয়া বাঁধানো ছবিটা শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল।নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।কিন্তু তাতে নির্ঝরের মুখের অভিব্যক্তির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না।

সে নির্ঝরের দিকে তাকিয়েই কয়েক পা পিছিয়ে ছবিটা নির্ঝরের অজান্তে আলমারির বইয়ের ভাঁজে রাখল।তারপর দ্রুত সরে এসে সারারুমে এক পলক নজর বুলিয়ে অযাচিত হেসে বলল,

__’আ-আপনার রুমটা অনেক সুন্দর, না?’

নির্ঝর এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।খেয়ার আচরণ তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।অনেকটা চোর চুরি করার পর আচমকা ধরা পড়লে যেমন হয় আর কি!

সে অবাক হয়েই বলল,

__’রুমটা সুন্দর? ‘

__’জ্বি, অালবাৎ সুন্দর।কি সুন্দর সাজানো,গুছানো।দেয়ালের পেইন্টিং গুলো কি দূর্দান্ত।তাছাড়া পিঙ্ক কালার আমার খুবই প্রিয়!আমার তো দারুণ পছন্দ হয়েছে।’

__’তাহলে আজ থেকে তুমিও এই রুমে থেকো।এতবড় রুমে আরামসে দু-তিনজনের জায়গা হবে।কি বলো?’

নির্ঝর ভ্রু নাচিয়ে বলতে খেয়ার হাসিহাসি মুখটা কালো হয়ে গেল।সে সম্পূর্ণ দৃষ্টি নির্ঝরের উপর নিক্ষেপ করতেই তার মুখটা অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেল।নির্ঝর খালি গায়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।শুধুমাত্র ট্রাউজার পড়া যা সে মাত্র খেয়াল করল।

সে দ্রুত অন্য দিকে ঘুরে নাক ছিটকে বলল,

__’ছি!আপনি খালি গায়ে কেন?এভাবে কেউ খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায়?’

নির্ঝর নিজের দিকে একবার চেয়ে মুখ টিপে হাসল।তারপর বেশ গম্ভীর হয়েই বলল,

__’কই ঘুরে বেড়াচ্ছি!আমি তো আমার রুমেই আছি।তাছাড়া মাত্র শাওয়ার নিয়ে বের হলাম।’

__’ইয়ে মানে,আপনার তো এখন অফিসে থাকার কথা।এখানে কি করছেন?’

__’আজকের মিটিং ক্যান্সেল করা হয়েছে।সেজন্য দুপুরের আগেই শেষ হয়ে গেছে।আমি এক ঘন্টার মতো হলো বাসায় এসেছি।তোমার রুমে দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল বলে ডিস্টার্ব করিনি!’

খেয়া অন্য দিকে তাকিয়েই বলল,

__’অহ।’

__’তুমি হঠাৎ আমার রুমে কি করছিলে?’

__’ক-কিছু না।একটু জাস্ট ঘুরে দেখছিলাম।’

__’বেশ,বুঝলাম এবং মেনেও নিলাম।তা সে কাজটা তো তুমি আমি থাকতেও করতে পারো।তোমার জন্য আমার রুমসহ এ বাসার সবকিছু খোলা।এমনকি আমিও!যখন যা ইচ্ছে করতে পারো।’

খেয়া কিছু বলল না।অন্য দিকে তাকিয়ে এখনো ওড়না পেঁচাচ্ছে হাতে।নির্ঝরের নজর এবার দরজার ছিটকিনির উপর গেল।ভেতর থেকে লক করা।সে খেয়ার দিকে এগিয়ে এসে হেসে বলল,

__’বাই দা ওয়ে,দরজা আটকে দিয়েছো কেন?কোন খারাপ মতলব তো নেই?’

খেয়া চোখ বন্ধ করে ফেলল।একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে সে।কোন কুক্ষণে সে দরজা বন্ধ করতে গিয়েছিল?

__’দরজা খুলে দিচ্ছি! ‘

একটানা বলে দরজার দিকে দৌঁড় দিতেই নির্ঝর তাকে হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে আনল।নির্ঝরের গভীর দৃষ্টি খেয়ার চোখে পড়তেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

সে রীতিমতো কাঁপছে।ছোটাছুটি করতে করতে কোনোরকমে বলে,

__’ছেড়ে দিন!’

নির্ঝর এক হাত খেয়ার কোমড়ে দিয়ে আরো কাছে টেনে আনে।খেয়ার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

__’এত তাড়া কিসের?আমি তো তোমার কাছে যাইনি!এতগুলো দিন একসাথে থাকার পরো তোমার থেকে নিজেকে কতটা দূরে রেখেছি।এর জন্য যে কি পরিমাণ জ্বালা সহ্য করছি ও তুমি বুঝবে না।নিজে থেকে কেন আসো আমার কাছে?এসেই পালাই পালাই করো?’

__’ভুল হয়ে গেছে আমার।আর আসবো না!ছেড়ে দিন।প্লিজ!’

__’ভুলের মূল্য দিতে হবে যে।নইলে তুমি সেইম কাজটা আবার করবে।আবার ক্ষণিক সময়ের জন্য আমার কাছে আসবে।বলো,কিভাবে মূল্য দিবে?’

খেয়া শব্দ করে কেঁদে দেয়।নির্ঝরের হাত ঢিলে হয়ে আসে।তার চোখের কোণেও অশ্রু এসে ভিড় জমায়।

__’কান্না করবে না একদম।কত বার বলেছি আমার সামনে চোখের জল ফেলবে না, মনে থাকে না?’

খেয়া আরো জোরে কান্না করে দেয়।নির্ঝর বাম হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে তাকে ছেড়ে ওয়ারড্রব থেকে সাদা শার্ট বের করে গায়ে দেয়।

কয়েক মিনিট নিরবতার পর শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে খেয়ার দিকে না তাকিয়ে বলে,

__’ল্যাবে একজন মহিলা এসিস্ট্যান্ট লাগবে।আমি ভাবছি যে এই কাজটা তোমাকে দিয়ে করাবো।আমি অন্য কোনো মেয়ের সাথে এডজাস্ট করতে পারবো না।তুমি হলে ভালো হবে।আমরা বন্ধুমানুষ।আশা করি, তুমি রাজি হবে।

এরজন্য তোমাকে মান্থলি একটা এমাউন্ট দেয়া হবে।তুমি রাজি না হলে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, তোমাকে শুধু শুধু আমি বাসায় বসিয়ে রাখতে পারবো না।’

খেয়া নিঃশব্দে হেঁটে দরজা খুলে বের হয়ে যায়।সে যাওয়ার পরেই নির্ঝর অশ্রু সিক্ত নয়নে তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

খেয়াকে না দেখলে তার ভালো লাগে না।অফিস,ল্যাবের কোনো কাজে মন বসে না।সারাক্ষণ বাসায়, খেয়ার কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে।তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে সবসময় চোখের সামনে রাখবে।

এর জন্য প্রয়োজন হলে খেয়াকে কিছু কঠিন কথাও শোনাবে!

৭.

__’বাবাই, আজ আন্টি নিতে আসলো না কেন?’

__’আজ আমার অফিস নেই।আমি ফ্রি আছি।সেজন্য আমি আমার মামণিকে নিতে আসলাম।কেন সে খুশি হয়নি?’

নুহা মুখ ফোলায়।ফোলা ফোলা মুখেই নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

__’হ্যাঁ,খুশি হয়েছি।তবে আন্টি আসলে আরো বেশি খুশি হতাম।’

__’কেন, মা?বাবাই তোমাকে ভালোবাসে না?’

__’হুঁ,বাসে তো।বাবাই আমায় অনেক ভালোবাসে।নাও,তুমি এবার মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাও।আন্টি বলেছে,গাড়ি চালানোর সময় কথা বলতে হয় না।’

__’তোমার আন্টি আর কি কি বলেছে মা?’

__’আন্টি একবার বলেছিল, নুহা তোমার বাবাই একটা শয়তান!’

নির্ঝর চমকে বলে উঠে,

__’সে কি!কি সাংঘাতিক কথা।মা,তুমি সত্য বলছ?’

__’হুঁ। শুধু একবার বলেছিল। পরে অবশ্য বলেছিল, এমনি বললাম।তোমার বাবা অনেক ভালো মানুষ।সবাইকে কত্ত সাহায্য করে।’

__’আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

নুহা চোখ বন্ধ করে। তার চোখের সামনে আন্টির চেহারা ভেসে উঠে।সে মিটিমিটি হাসে।

নির্ঝর গম্ভীর হয়ে গাড়ি চালায়।যদিও খেয়া আগের থেকে অনেক সহজ হয়েছে তবুও খেয়া আর তার মাঝে বিস্তর দুরত্ব রয়েছে।সে যতই চেষ্টা করছে, দূরত্বটা কমিয়ে বিন্দুর আকার দিতে ততই যেন তা বেড়ে চলছে।

খেয়ার ডিভোর্সের প্রায় তিন মাসের বেশি হতে চলল।আর কত সময় নিবে খেয়া স্বাভাবিক হতে?সে কবে তার মনে জায়গা করতে পারবে?নাকি কোনোদিনও পারবে না?নির্ঝর বড় করে শ্বাস নেয়।

রাতের বেলা খেয়ার রুমে সে আর নুহা শুয়ে আছে।নুহা তার মাথাটা খেয়ার হাতের উপর রেখেছে।দুহাতে খেয়ার ওড়না মোড়াচ্ছে।

খেয়া চোখ বড় বড় করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে নুহাকে গল্প শোনাচ্ছে।তার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে।নুহার সাথে থাকলেই সে শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যায়।

সে বড় হয়েছে ইয়াতিম খানায়।সেখানে কেউ তাদের গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়নি।তবে মাঝে মাঝে তাদের ইয়াতিম খানায় এক বয়স্ক মহিলা আসতো। যিনি রোজ মঙ্গলবারে বিকেলে সবাইকে এক করে গল্প শোনাত।তার মুখে শোনানো গল্প গুলোই সে নতুন করে নুহাকে শোনায়।তার প্রচুর ভালো লাগে।

খেয়া ওয়াশরুম সোজা উপরে দেয়ালে লাগানো দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়।ঘড়ির কাঁটা বারোটার কাছাকাছি।কিন্তু নুহা আজ ঘুম আসছে না।অন্যান্য দিন এগারোটা বাজার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে।

সে নুহার পেটে হাত রেখে বলে,

__’পিচ্চি আজ ঘুমাচ্ছে না কেন?ঘুম আসছে না?’

নুহা উঠে বসে।খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

__’আন্টি আমি এক্ষুনি আসছি।এই যাবো আর আসবো।’

বলেই একদৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নির্ঝরকে টানতে টানতে রুমে ঢুকে।খেয়া দরজার দিকে এক পলক চেয়েই দ্রুত উঠে বসে।গায়ের ওড়না ঠিক করে সরে দাঁড়ায়।

নির্ঝর এক নজর খেয়ার দিকে তাকিয়ে এক হাঁটু মুড়ে বসে নুহার গালে হাত রেখে বলল,

__’নুহা মা,আমায় এ রুমে নিয়ে আসলে কেন?আর তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন?এত রাত অবধি বাচ্চাদের জেগে থাকতে নেই।’

__’বাবাই,আজ তুমি আমাদের সাথে ঘুমাবে।আমরা তিনজন একসাথে ঘুমাবো।কি মজা!কি মজা!’

নির্ঝর, খেয়া একত্রে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

__’কি!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here