জোড়া শালিকের সংসার পর্ব ২১+২২

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_২১

__’কাকে খুঁজছে আমার খেয়াতরী?’

খেয়া লজ্জায় লাল হয়ে চোখ বন্ধ করলো।

__’সারাদিন কোথায় ছিলে?’

খেয়া তোতলানো স্বরে বলল,

__’কো-কোথায় আবার?বাসায়! বা-বাসায়!’

__’বাসায়?তাহলে আমার সামনে আসছো না কেন?এমন লুকোচুরি খেলার কি মানে?’

__’কি-কিসের লুকোচুরি?’

নির্ঝর খেয়াকে ঘুরিয়ে তার মুখোমুখি করলো।খেয়া চোখ বন্ধ করে আছে এখনো।

__’চোখ খোলো।আমার দিকে তাকাও।’

__’আপনাকে কি কোনোদিন দেখিনি নাকি?দেখেছি তো!এখন চোখ খুলে আবার তাকাতে হবে কেন?’

খেয়ার ধরে রাখা হাতটাতে নির্ঝর একটু চাপ দিল।তারপর বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,

__’আমার দিকে তাকাও খেয়াতরী।নইলে শাস্তি পেতে হবে!ভয়ংকর লোমহর্ষক শাস্তি।’

খেয়া পিটপিট করে কাঁপা কাঁপা চোখের পাপড়ি মেলে নির্ঝরের দিকে তাকাল।নির্ঝরের চোখ দুটো কেমন মায়াকাড়া!কি গভীর সে দৃষ্টি।যে কেউ তার অতলে হারাতে বাধ্য!খেয়াও হারিয়েছে নিজেকে!বড্ড বাজে ভাবে হারিয়েছে!

নির্ঝর ডান হাতটা খেয়ার গালে স্পর্শ করে বলল,

__’এরপর থেকে আমার থেকে পালিয়ে বেড়াবে না।মনে থাকবে?’

খেয়া চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করলো।নির্ঝর তার চেয়ে বেশ লম্বা।নির্ঝরের চোখে চোখ রাখতে হলে তাকে বেশখানি ঘাড় উঁচু করতে হয়।

সে মাথা নিচু করেই ডানে বামে মাথা ঘোড়াল।অর্থাৎ সে আজ থেকে আর নির্ঝরের থেকে পালিয়ে বেড়াবে না।

নির্ঝর তার চিবুক ধরে ফের মাথাটা উঁচু করলো।নিজে ঘাড়টা একটু নিচু করে বলল,

__’ডিনার করেছো?’

খেয়া চটপট বলল,

__’হুঁ।আমি, মিতু আর খালা একসাথে খেয়েছি।’

__’সত্যি বলছো তো।’

__’সত্যি খেয়েছি।আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?দাঁড়ান,এক্ষুণি মিতুকে ডাকছি!নিজে জিজ্ঞেস করুন ওকে।’

বলেই মিতু দৌঁড় দিতে নেয়।নির্ঝর হাত টেনে ধরে।এক টানে আবার নিজের কাছে এনে বলে,

__’সবসময় আমার থেকে পালানোর ফন্দি?আর পারবে না।’

__’ইয়ে মানে,নুহাকে নিয়ে আসি।আমাদের সাথে ঘুমাবে।’

__’ডিনারের সময় নুহার সাথে কথা হয়েছে।পিচ্চিকে বলেছিলাম আমাদের সাথে ঘুমাতে।সে বলেছে,মায়ের সাথে সারা বিকেল ঘুমিয়েছি।রাতে মিতু আন্টির সাথে ঘুমাব।’

খেয়ার আর কথা খুঁজে পায় না।সে চুপ হয়ে যায়।

নির্ঝর এবার খেয়ার সামনে থেকে সরে দরজার কাছে গেল।ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে আবার খেয়ার সামনে এসে দাঁড়াল।কয়েক সেকেন্ড পর চট করে খেয়ার পিছনে গিয়ে দুহাতে তার চোখ ঢাকে।খেয়া চমকে নির্ঝরের হাতের উপর হাত রাখে।বলে,

__’অন্ধ করে দিচ্ছেন কেন?’

__’মাঝে মাঝে ক্ষণিক সময়ের জন্য অন্ধ হওয়া মন্দ নয়।অনেক কিছু আছে যা তুমি চোখ খোলা রেখে দেখতে পাবে না,ফিল করতে পারবে না।একমাত্র বন্ধ চোখেই ফিল করতে পারবে।এখন চুপচাপ সামনের দিকে হাঁটো।’

খেয়া নির্ঝরের নির্দেশ মতো সামনের দিকে পা রাখলো।

বেলকনিতে পৌঁছাতেই নির্ঝর বলল,

__’দাঁড়িয়ে পড়ো।আর আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।কেমন?’

__’হুঁ।’

নির্ঝর খেয়ার চোখের উপর থেকে হাত সরালো।হাতের ডানপাশের দেয়ালের সুইচে চাপ দিতেই পুরো বেলকনি মরিচ বাতির আলোতে ভরে উঠলো।

নির্ঝর নরম গলায় বললো,

__’চোখ খোলো খেয়াতরী।’

খেয়া চোখ খুলল।চোখ খুলতেই এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে গেল যেন।তার চোখের সামনে মরিচ বাতি গুলো কেমন জ্বল জ্বল করছে।আর তার থেকে একটু দূরে টেবিলের উপর খাঁচায় ধরে রাখা দুটো শালিক পাখি।মরিচ বাতির আলো তাদের গায়ের উপর এসে পড়েছে।অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে দেখতে।

পাখি দুটিও মনে হচ্ছে পরম সুখে ঠোঁট নাড়াচ্ছে।সাথে অদ্ভুত রকমের এক শব্দ করছে।কেমন বিষণ্ণ সুন্দর সে ডাক!ভালো লাগা আর খারাপ লাগা একত্রে কাজ করে যেন!

খেয়া কয়েক পা হেঁটে টেবিলের কাছে গেল।চেয়ার টেনে নিরবে বসলো।তারপর হাত দুটো খাঁচার উপর রাখল।পাখি দুটো কেমন চকচকে চোখে তার দিকে তাকাল।পরমুহূর্তে অবিকল মানুষের কন্ঠে বলল,

__’খেয়া!খেয়া!’

খেয়া চমকে উঠলো।শালিক পাখিও কথা বলতে পারে?যদিও সে জানতো শালিক পাখি কথা বলে,কিন্তু এতটা সুন্দর ভাবে যে তা বিশ্বাস হতে চায় না।সে একগাদা প্রশ্ন চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো।

নির্ঝর হাসিমুখে খাঁচার বাইরে থেকে পাখি দুটোর গায়ে হাত রাখলো।মুখে বলল,

__’খেয়া,খেয়াতরী।’

সঙ্গে সঙ্গে পাখি দুটো সমসুরে বলল,

__’খেয়া!খেয়াতরী।’

নির্ঝর চেয়ার টেনে খেয়ার মুখ বরাবর বসলো।মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,

__’তোমাকে প্রথম যখন এ বাসায় নিয়ে আসি সেদিনই নতুন করে মনের গহীনে সংসারের স্বপ্ন জাল বুনি।অনেকটা নিজের অজান্তে।কেন জানি মনে হলো প্রকৃতি চায় তোমার আমার ছোট্ট সংসার।অনেকটা জোড়া শালিকের মতো।সেজন্যই প্রকৃতি নতুন করে তোমার হাত ধরার সুযোগ করে দিয়েছে।

পরের দিন অফিস যাওয়ার পথে গ্রাম্য এক লোকের থেকে পাখি দুটো কিনি।কেমন মায়াকাড়া চোখে আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছিল।দেখে মায়া পড়ে গেল।পরম যত্নে সেগুলো বড় করতে লাগলাম।অফিসে আমার কেবিনের পাশে যে রেস্টের জন্য একটা রুম আছে তার বেলকনিতে রাখতাম এদের।আমি যতক্ষণ অফিসে থাকতাম নিজেই দেখাশোনা করতাম।বাকিটা সময় আমার পিয়ন দেখতো।

ওদের অনেক কষ্টে কথা শিখিয়েছি।অবশ্য বাবা,মা শব্দ দুটো আগে থেকেই পারতো।আমি নতুন করে শুধু নুহা আর খেয়া শব্দদুটো শিখিয়েছি।ভেবে রেখেছিলাম, তুমি প্রথম যেদিন নিজে থেকে আমার হাতে ধরা দিবে সেদিন তোমাকে পাখি দুটো উপহার দিবো।’

__’আপনার কি মনে হয়, আমি আপনার হাতে ধরা দিয়েছি?’

খেয়ার প্রশ্নে নির্ঝর হকচকিয়ে গেল।কিছুটা নিভু নিভু স্বরে বলল,

__’না মানে সেরকম কিছু নয়।আসলে আমার মনে হয়েছে তুমি সত্যি সত্যি আমাকে……’

__’কি আপনাকে?’

__’ভা-ভালোবাসো!’

নির্ঝরের ফেস দেখে খেয়ার বড্ড হাসি পেল।সে নিজেকে সামলে নিল।সে সত্যিই নির্ঝরের হাতে ধরা খেয়েছে।নিজের অজান্তেই তাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।তাকে নিজের একলা রাজ্যের একজন করে নিয়েছে।

সে নির্ঝরের থেকে চোখ সরিয়ে চারপাশে তাকাল।এই মুহুর্তে তার নিজের ভয়ংকর একটা কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে।ইচ্ছে টাকে যতই মাথা থেকে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে ততই যেন তা ঝেঁকে বসছে।শেষ মেষ সব চিন্তা ভাবনার জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের আসন থেকে হালকা উঁচু হয়ে নির্ঝরের বাম গালে গভীর এক চুমু দিল।

তারপর দ্রুত সরে গিয়ে নিজের আসনে বসলো।মাথা নিচু করেই পাখি দুটোকে হাত নেড়ে নেড়ে দেখতে শুরু করলো।

নির্ঝর হা করে খেয়ার দিকে চেয়ে রইলো।খেয়া তাকে নিজে থেকে চুমু দিয়েছে?তাও আবার সজ্ঞানে?তার কয়েক মিনিট লাগলো বুঝতে!

তারপর ঝট করে খেয়াকে জড়িয়ে ধরলো।খেয়া মুচকি হেসে তার পিঠে হাত রাখলো।এই প্রথম সে নিজেও নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরলো।

নির্ঝরের চোখ দুটো কেমন ভরে উঠলো।সে চোখ বন্ধ করলো।সঙ্গে সঙ্গে দু ফোঁটা অশ্রু চোখ বেয়ে গড়িয়ে গালে পড়লো।তার আজ পরম সুখের দিন।সে তার খেয়াতরীকে পাশে পেয়েছে।নিজের করে পেয়েছে।

নির্ঝরের শরীর একটু পর পর কেঁপে উঠছে।খেয়া বুঝতে পারলো নির্ঝর কাঁদছে।কেন জানি সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের চোখও ভরে উঠলো।এতটা সুখ তার কপালে ছিল?সেজন্যই কি জাহিদ তাকে মুক্তি দিয়েছিল?

জাহিদের থেকে মুক্তি না পেলে তো সে কোনোদিন জানতই না এই শহরেই একজন রোজ তার নামে স্বপ্ন বুনে,তাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজায়,দূর থেকে তাকে নিজের কাছে রাখে!তার নামে সকাল, দুপুর,সন্ধ্যা,রাত নামায়!তাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।এই ভালোবাসা এতটা গভীর যে, কোনো কিছুরই সাধ্য নেই সেই অতলে পৌঁছে বিন্দুমাত্র খাঁদ সৃষ্টি করতে!নেই,সাধ্য নেই!

খেয়া দুহাতে নির্ঝরের শার্ট আকড়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়।

মানুষের জীবন এত অদ্ভুত কেন?জীবন নামের পথের হাজারো বাঁক।প্রতিটা বাঁকে বাঁকে একেকটা অদ্ভুত রকমের ঘটনা ঘটে।পুরুষ মানুষ, এই পুরুষ জাতির মধ্যেই কত প্রকারভেদ।একজন সে মা হতে পারবে না বলে ছুঁড়ে ফেলে দিল।আরেকজন সব জেনেও তাকে কুড়িয়ে পরম যত্নে নিজের ভলোবাসা দিয়ে তাকে খাঁটি মুক্তোয় পরিণত করলো।এত অদ্ভুত কেন মানবজীবন?আর এত অদ্ভুত কেন মানুষের ভালোবাসা?

খেয়ার মনে পড়লো সেদিনের কথা।যেদিন নির্ঝর তাকে নিজের মনের কথা বলেছিল।তাকে ভালোবাসে বলেছিল, তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।

সেদিন সে বেশ ভদ্র ভাবে,বুঝিয়েই নির্ঝরের প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছিল।নির্ঝরের অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য সে এতটা অনুতপ্ত ছিল যে সেই রাতে সে একদম না খেয়ে থাকে।ছোট্ট একটা কথায় জাহিদের সাথেও ঝগড়া করে।কিছু দিন যেতেই সব ঠিক হয়ে যায়।জাহিদের সাথে তার বিয়েও হয়।কিন্তু নির্ঝরের সাথে আর দেখা বা যোগাযোগ হয়নি।

সে ভেবেছিল নির্ঝর এতদিনে হয়তো বিয়ে করে ঘর সংসার করছে।কিন্তু সে যেদিন অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বের হয়,গেটের কাছে হুবহু নির্ঝরের গাড়িটা এক পলকের জন্য দেখে।সেদিন তার বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠে।নির্ঝর তাকে এখনো ফলো করে?কেন করে?

তারপর থেকে সে মাঝে মাঝে নির্ঝরের গাড়িটা এক পলকের জন্য দেখতো।তার নাগাল পাওয়ার আগেই উধাও!

সেজন্য সেদিন ডিভোর্সের পর পার্কে নির্ঝরকে এত বছর পর দেখে সে অবাক হয়নি।উল্টো একরাশ কষ্ট তাকে ছাপিয়ে দিয়েছে।বার বার মনে হয়েছে নির্ঝরের নিখাঁদ ভালোবাসাকে অবহেলা করেই হয়তো তার আজ এই দূর্গতি।নির্ঝর হয়তো তাকে অভিশাপ দিয়েছিল।তার বদৌলতে সে এতবড় শাস্তি পেল!

__’ভালোবাসি খেয়াতরী!ভালোবাসি, ভালোবাসি,ভালোবাসি!’

নির্ঝরের ঘোর মিশ্রিত কন্ঠে খেয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠে।সে ছোট্ট করে বলে,

__’হুঁ।’

__’কিসের হুঁ?আর কিছু বলবে না?’

__’জি নাহ!’

নির্ঝরের হাত দুটো ঢিলে হতেই খেয়া তাকে ছেড়ে দেয়।নির্ঝর তার দুগালে হাত রেখে তার মুখটা উঁচু করে।চোখে চোখ রাখে।দুটো গভীর দৃষ্টি
এক হতেই খেয়া চোখ বন্ধ করে।নির্ঝর মুখটা এগিয়ে তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়।

৩০.

মিতুর আজ মান্থলি টেস্ট পরীক্ষা ছিল।বেশি ভালো হয়নি।কেন হয়নি তা জানে না।প্রশ্ন দেখে সহজ মনে হয়েছিল।কিন্তু লিখতে নিয়েই বিপাকে পড়লো।প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর প্রথম লাইন আর শেষ লাইন শুধু মাথায় আছে।মাঝের লাইন আর মাথায় আসে না।উত্তর অসম্পূর্ণ রেখেই সে মন খারাপ করে ক্লাস থেকে বের হয়েছে।

স্কুলের বিশালাকার মাঠটা পেরিয়ে সে গেটের কাছে পৌঁছাল।লতিফ চাচা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিতু গাড়িতে উঠে মুচকি হাসলো।

__’চাচা,নুহা কি বাসায় নাকি স্কুলে?’

__’নুহা রে বাসায় দিয়া তোমারে নিতে আইছি।’

__’অহ।চাচা,দুপুরে খেয়েছেন তো?’

__’হ মা।খাইছি।’

__’ভালো!’

মিতু বসেছে পেছনের সিটে মাঝামাঝি জায়গায়।সে সরে এসে একদম জানালা ঘেঁষে বসলো।জানালার কাচ তুলে মাথাটা উঁচু করে বাইরে তাকাল।সঙ্গে সঙ্গে তার বিষণ্ণ মন ভালো হয়ে গেল।

তিন মাসের বেশি হতে চললো মিতু এ শহরে এসেছে।এর মধ্যেই শহরটাকে সে বেশ আপন করে নিয়েছে।এই যে,প্রতিদিনের চিরচেনা পথটা,যে পথে সে রোজ আসা-যাওয়া করে,কত আপন মনে হয় পথটাকে!ওই যে মোড়ের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে কত আপন মনে হয়!

সে মুচকি হাসলো।প্রতিটি জায়গাই এমন।এদের নিজস্ব এক ক্ষমতা আছে।মানুষকে বশীভূত করার ক্ষমতা।কত দ্রুত সে মানুষের মনে জায়গা করে নেয়!

গাড়ি বাসার সামনে থামতে মিতু ব্যাগ হাতে নেমে গেল।কলিং বেলে একবার চাপ দিতে তার মা এসে দরজা খুলে দিল।সে ভিতরে প্রবেশ করে ড্রয়িং রুমে তাকাতেই দেখে রাহাত বসে আছে।রাহাতের এক হাত দূরে নির্ঝর ভাই বসে আছে।সে ভয়ে কেমন কেঁপে উঠলো।রাহাত এখানে কি করছে?তার জন্য এসেছে?ছি!নির্ঝর ভাই, খেয়া আপা জানলে কি ভাববে তারা?

সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে রাহাতের দিকে চেয়ে রইলো।

খেয়া রান্নাঘরে পায়েস রান্না করছিল।মিতুর বাসায় ফেরার খবরে সে ড্রয়িং রুমে আসলো।

__’মিতু,তু……….’

মিতুর চোখ বরাবর খেয়া তাকাতেই সেও চমকে উঠল।রাহাত নামের ছেলেটা এখানে কেন?নির্ঝরকে কোনো প্রশ্ন করেছে তার ব্যাপারে?সে তো পুষ্প নয়!

খেয়ার হাতের চামচটা পড়ে যেতেই মৃদু শব্দ সৃষ্টি হলো।সেই শব্দে রাহাত,নির্ঝর দুজনেই তাদের দিকে তাকাল।
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_২২

খেয়ার হাতের চামচ নিচে পড়ে যেতেই মৃদু শব্দ সৃষ্টি হলো।সেই শব্দে রাহাত,নির্ঝর দুজনেই তাদের দিকে তাকাল।

রাহাত হাত নেড়ে হাসিমুখে বলল,

__’আরে খেয়া যে!কেমন আছো?’

খেয়া আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলো।রাহাত আবার আজকে তাকে খেয়া বলে সম্বোধন করছে?তাহলে কি নির্ঝরের সাথে তার কথা হয়েছে?সে মৃদুস্বরে বলল,

__’জ্বি ভা-ভালো!আপনি?’

__’অনেক ভালো।এদিকে আসো!মিতু তুমিও আসো তো। বসো আমার পাশে!’

মিতু ঝট করে বলল,

__’আমি এখানেই ঠিক আছি।’

পরমুহূর্তে মিতু, খেয়া একে অপরের দিকে তাকায়।খেয়া মিতুকে ফিসফিস করে বলল,

__’এই মিতু!তোমাকে রাহাত চিনে নাকি?মনে তো হচ্ছে অনেক ভালো করে চিনে!’

মিতু আমতা আমতা করে বলল,

__’হ্যাঁ!না মানে আপা,ওই তো আমাদের কলেজের সিনিয়র।তোমায় বলেছিলাম না সেদিন!’

__’অহ!মনে পড়েছে।’

মিতু কথা ঘোরানোর জন্য বলল,

__’আপা,নুহা কোথায়?’

__’মাত্র ঘুম পারিয়ে নিচে নামলাম।’

মিতু আর কিছু বলে না।মানে কোনো কথা খুঁজে পায় না।

খেয়া মাথা সামান্য কাত করে নির্ঝরের দিকে তাকালো।নির্ঝর এতক্ষণ চুপচাপ মুখ টিপে হাসছিল।সে হেসেই বলল,

__’খেয়া,এ হচ্ছে রাহাত!আমার ওয়ান এন্ড অনলি ফ্রেন্ড বলতে পারো।তবে আমার বাসায় তার যাতায়াত অনেক কম।ম্যাক্সিমাম সময় আমার অফিসে আসে।সেখানেই হাসি তামাশা করি আমরা।তোমার ব্যাপারে ওকে কিছু বলার সময় হয়ে উঠেছিল না।সেজন্য সেদিন হুট করে নুহার স্কুলে তোমায় দেখে চিনতে পারেনি।তবে সেদিনই ও আমাকে ফোন দিয়ে তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।আমি সব বলে দিয়েছি।বুঝতে পেরেছো?’

খেয়ার বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল।সে বড় করে শ্বাস নিল।যাক,বাবাঃ!এর সাথে তাহলে পুষ্পর কোনো সম্পর্ক নেই।সে তো পুরোদস্তুর ভয় পেয়ে গেছিল।

সে মাথা নেড়ে বলল,

__’হুঁ!’

তারপর রাহাতের দিকে চেয়ে বলল,

__’রাহাত ভাই,আজকে লাঞ্চ আমাদের সাথে করবেন।চলে যাবেন না কিন্তু।আমি আসছি।’

খেয়া মিতুকে ফ্রেশ হতে বলে রান্নাঘরে ঢুকলো।

মিতুর কেমন জানি লাগছে।গলা বার বার
শুকিয়ে আসছে।মনে হচ্ছে এক সাগর পানিতেও এ পিপাসা মিটবে না।বড্ড ক্লান্ত লাগছে।বুক ধড়ফড় করছে।সে কি অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যাবে?

রাহাতের এই অসময়ে এ বাসায় আগমনই বলে দিচ্ছে কিছু একটা হতে চলেছে!

কোনোরকমে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো সে।এলোমেলো ভাবে পা ফেলে ড্রয়িং রুমের পাশ দিয়ে নিজের রুমে যেতে নিতেই নির্ঝর বলল,

__’মিতু!’

মিতু দাঁড়িয়ে পড়ল।মুখে বলল,

__’জ্বি,দাভাই!’

__’আজ একসাথে লাঞ্চ করবো আমরা।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাও।’

__’জ্বি দাভাই।’

৩১.

রাহাতের মুখে মিতুর ব্যাপারে সব শুনে নির্ঝর প্রথমে দারুণ চমকে যায়। রাহাত মিতুকে ভালোবাসে?কিন্তু রাহাত আর মিতুর বয়সের ডিফারেন্স তো অনেক বেশি।

রাহাত সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মিতুকে বিয়ে করবে বলে জানায়।আপাতত নির্ঝরই খেয়ার গার্ডিয়ান।নির্ঝর তবুও জমিলা খালা আর মিতুর মতামত নেয়।তারা রাজি হতেই নির্ঝরও রাজি হয়ে যায়।তবে তাতে বাঁধ সাধে খেয়া।

খেয়ার চিন্তার কারণ মিতু অনেক ছোট।সে বলে,মিতুকে যদি রাহাত ভাই বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে মিতুর কলেজ পাস অবধি অপেক্ষা করতে হবে।এতে করে মিতুর প্রতি রাহাতের ফিলিংস টা কতটা গভীর তারও প্রকাশ হয়ে যাবে।রাহাত তাতেই খুশিমনে রাজি হয়ে যায়।

বেলকনিতে পাখিদের খাবার দিতে দিতে এসব চিন্তা করে নির্ঝর।চুড়ির মৃদু ঝংকারে চোখ তুলে সামনে তাকায়।খেয়া হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।খেয়ার মুখে গোধূলি বেলার আবছা লাল রং এসে পড়েছে।কি সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে!এই মেয়েটা কি প্রতিটা সেকেন্ডে নিজের মায়া দিয়ে তাকে ঘায়েল করবে?

নির্ঝরের হার্টবিট বেড়ে যায়।যতবার সে খেয়ার ওই চোখে চোখ রাখে ততবারই কি যেন হয়ে যায়।মেয়েটা তাকে সত্যি সত্যি বশ করেছে নাকি?নাহ!সে সহজে খেয়ার চোখে চোখ রাখবে না।নইলে যখন তখন ওই কাকচক্ষু নদীর গভীরে ডুবে যেতে তীব্র ইচ্ছে হয়।

খেয়া এগিয়ে এসে তার পাশে বসে।হাসিমুখে বলে,

__’আচ্ছা, পাখি দুটোকে যদি খাঁচা থেকে ছেড়ে দিই,মানে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করি তাহলে পালিয়ে যাবে না?’

খেয়ার গা থেকে চিরাচরিত সেই মিষ্টি গন্ধটা এসে নির্ঝরের নাকে লাগে।বসন্তের মাতাল হাওয়ার মতো কেমন মাতাল করে দিতে চায় তাকে।কালবৈশাখীর অগোছালো ঝড়ো বাতাসের মতো তাকেও কেমন এলোমেলো করে দেয়।

সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে।খেয়া তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে তার আরো কাছে এগিয়ে আসে।কপালে হাত রেখে চিন্তিত গলায় বলে,

__’আপনি এমন করছেন কেন?অসুস্থ লাগছে?বলুন কি হয়েছে আপনার?’

নির্ঝর চট করে মাথা পেছন দিকে সরিয়ে নেয়।তোতলানো স্বরে বলে,

__’এ-একটু পিছিয়ে বসো তো!পি-পিছিয়ে বসো।সামান্য দূরে গিয়ে বসো।’

__’কেন?দূরে বসবো কেন?’

__’তোমার গা থেকে মারাত্মক স্মেল আসছে।’

খেয়া ভ্রু কুঁচকে নিজের গা শুকেঁ।তারপর চিন্তিত স্বরে বলে,

__’কিন্তু আমি তো দুপুরে শাওয়ার নিয়েছি।এখন সবেমাত্র বিকেল।আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?এই দেখুন,আমার চুলও ভেজা।’

খেয়া এক গাছি চুল পেছন থেকে এনে নির্ঝরের নাকের সামনে ধরে।নির্ঝর কয়েক সেকেন্ড তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। খেয়া এত বোকা কেন?

কয়েক সেকেন্ড পর খেয়াকে এক টানে কাছে নিয়ে আসে।তাকে জড়িয়ে তার ঘন চুলে মুখ ডুবায়।খেয়া কেঁপে উঠে।

নির্ঝর ভেঙে ভেঙে বলে,

__’আমি অন্য গন্ধের কথা বলেছি বোকা!বুঝতে পেরেছো?নাকি আরো বুঝাতে হবে?’

__’ন–না!ছাড়ুন!দূরে গিয়ে বসছি।’

নির্ঝর উত্তর দেয় না।বেশ কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়।খেয়া মাথা নিচু করে কয়েক হাত দূরে বসে হাত বাড়িয়ে দেয়।

নির্ঝর মুচকি হেসে খেয়ার হাতের উপর হাত রাখে।

খেয়া বাম হাতে শালিক দুটোকে নাড়া দেয়।বলে,

__’এবার বলুন তো!পাখি দুটোকে ছেড়ে দিলে কি পালিয়ে যাবে?’

__’উড়ে পালাবে না।পোষমানা পাখি!’

__’আপনি এতটা নিশ্চিত কিভাবে?’

নির্ঝর খেয়ার দিকে চেয়ে বলল,

__’তুমি কি পরীক্ষা করতে চাচ্ছো খেয়া?খাঁচা খুলে দিলে পাখি দুটো উড়ে যায় কি না?পোষ মানে কি না?’

__’আপনি ঠিক ধরেছেন।আমি একটা ক্ষুদ্র পরীক্ষা করতে চাই।পাখি দুটোকে ছেড়ে দিতে চাই।পোষ মানলে হয়তো কাছাকাছি থাকবে।আপনি রাজি আমার প্রস্তাবে?’

নির্ঝর হেসে বলল,

__’আমি বেশ বুঝতে পারছি কেন তুমি খাঁচা খুলে দিতে চাইছো।তোমার মন অনেক নরম।তুমি হয়কো পাখি দুটোর বন্দী দশা দেখে কষ্ট পাচ্ছো।ঠিক আছে।যাও পাখিদুটোর শিকল খুলে দাও।তবে আমার মন বলছে,ওরা আবার আসবে।আমাদের কাছাকাছি থাকবে।’

খেয়া সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে নির্ঝরের হাত ছেড়ে খাঁচার শিকল খুলে দিল।জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে শালিক পাখি দুটোকে উড়িয়ে দিল।

তারপর ঘুরে নির্ঝরের দিকে তাকাল।নির্ঝর উঠে এসে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে তার পাশে দাঁড়াল।দুজনে একসাথে পাখিদুটোর দিকে তাকাল।পাখি দুটো উড়ে বেশদূর যায় নি।গেটের ডানপাশের দেয়ালের পাশে যে বড় কাঁঠাল গাছটা আছে,তার ডালে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।বেলকনি থেকে স্পষ্ট সব দেখা যাচ্ছে।

নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পাখি দুটোকে মুক্ত করতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছে।নির্ঝরের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।

খেয়া ঘাড় ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকাতেই সে কাছে টেনে নিল।কপালে আলতো করে চুমু দিল।

৩২.

মিতু কলেজের গেট থেকে ভেতরে উঁকি ঝুঁকি দেয়।রাহাত আছে কি না চেক করে।সে এই সকাল সকাল বেলা ছেলেটার সামনে পড়তে চাচ্ছে না।যতসব উদ্ভট কথা বলে তার পৃথিবী উল্টাপাল্টা করে দিতে ওস্তাদ এই ছেলেটি!

সে সাবধানে ভেতরে পা রাখলো।ওড়না দিয়ে মাথা,মুখ পুরো ঢেকে আশপাশে তাকাতে তাকাতে সামনে হাঁটলো।

রাহাত আর তার বিয়েটা একদম পাকাপোক্ত হয়ে গেছে।রাহাতের বাড়ির লোকজন এসে বেশ কিছুদিন আগে তাকে আংটি দিয়ে গেছে।সে যে কাজের লোকের মেয়ে তাতে তারা অনাগ্রহ দেখায়নি।তাকে খুব সাদরে গ্রহণ করেছে।এজন্য মিতু সবার উপর কৃতজ্ঞ!

মোটামুটি এক বছর পর বিয়ে!এই এক বছর মানুষটাকে সহ্য করতে হবে।কেন জানি মানুষটার সবকিছু সহ্য করতে অনেক ভালো লাগে।

মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ক্লাসের দরজার সামনে গিয়ে সে বড় করে শ্বাস নিল।এ যাত্রায় বেঁচে গেছে।রাহাতের সাথে দেখা হয়নি।রাহতের সাথে দেখা হলেই সব গুছিয়ে রাখা কথাবার্তা অগোছালো হয়ে যায়।সে লজ্জায় পড়তে চায় না।

খুশিমনে ক্লাসে পা রাখতেই চোখ বড়সড় হয়ে গেল।রাহাত শ্রেণিকক্ষের ডায়াসের উপর দাঁড়িয়ে আছে।তাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। মিতু ফুঁটো বেলুনের মতো চুপসে গেল।

রাহাত এগিয়ে এসে বলল,

__’রাগিনী আমার!শুভ শুভ্র সকাল।’

মিতু কিছু না বলে বেঞ্চে বসলো।রাহাত তার মুখ বরাবর বসে বলল,

__’রাগিণী শোনো!সিরিয়াস কথা বলছি।আসলে আমার কয়েকদিন পর ফাইনাল এক্সাম।এবার ভাবছি বেশ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিবো।তারপর বাবার বিজনেসে একটু সাহায্য করবো।দেন তোমায় বিয়ে করবো।তুমি একটু আমার জন্য প্রে কোরো,যাতে কৃতকার্য হতে পারি।’

__’আপনি পড়া পারেন কিছু?’

__’আরে!তুমি আমাকে চিনলে না।আমার মতো ছেলেদের পড়তে হয় নাকি!তোমার স্বামী চ্যালচ্যালাইয়া পাস করে যাবে।’

মিতু গোল গোল চোখে তার দিকে তাকাল।তার বড্ড হাসি পাচ্ছে।খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে।সত্যিই সে মানুষটাকে তীব্র পছন্দ করে ফেলেছে।

মিতু কিছু বলতে নেয়।সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যাগে রাখা ফোনটা বেজে উঠে।আজ ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গিয়েছিল।

সে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলো তার মা ফোন দিয়েছে।তার মা কেন ফোন দিয়েছে?তাও এই অসময়ে?

রাহাতের দিকে এক পলক চেয়ে কল রিসিভ করলো।

__’হ্যালো,মা!বলো!’

__’মিতু,তোর খেয়া আপারে হাসপাতালে নিয়া হইছে।তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়তো!’

মিতুর বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো।সে ভয়ার্ত গলায় বললো,

__’কেন?কি হয়েছে মা?’

__’সকালবেলা সিঁড়ি থেইকা মাথা ঘুইরা পইড়া গেছে।তাও ভালো!নির্ঝর বেটা বাড়িতেই ছিল।তুই আয়!’

ফোন কেটে যেতে মিতু কান থেকে নামায়।রাহাতের দিকে চেয়ে বলে,

__’আমাকে এক্ষুণি হসপিটালে যেতে হবে।’

কেন?কার কি হয়েছে?কে অসুস্থ?এসব প্রশ্নের মধ্যে না গিয়ে রাহাত বলে,

__’চলো!আমিও সাথে যাচ্ছি।’

মিতু কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।

(চলবে)

আসসালামু আলাইকুম।আর মাত্র তিন পর্ব!লাস্ট থ্রি পার্ট!ইনশাআল্লাহ তারপরেই শেষ।🙂
(চলবে)

আসসালামু আলাইকুম।🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here