#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat
১.
পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙল সিদ্রার। কি ব্যাপার? ঢাকা শহরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙা তো কল্পনাই করা যায়না। অভ্যাসবশত আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যাথায় আহ করে উঠলো। খেয়াল করে দেখে বিছানার রেলিঙ এর সাথে হাতদুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানেও একই অবস্থা। এবার ঘুমটা যেন এক চটকায় ছুটে গেল। চোখ বুলাল চারিদিকে। এটা তো ওর ঘর না, এমনকি কোনদিন এমন আজব ঘর দেখেছে বলেও মনে পড়ছেনা। ঘরের দেয়াল কাঠের, চাল টিনের, মেঝেটা আবার পাকা। কোথায় আমি? এখানে কিভাবে আসলাম? ভাবতে গিয়ে আস্তে আস্তে সবটা মনে পড়তে লাগল ওর।
প্রতিদিনকার মত হেঁটে মাদ্রাসায় যাচ্ছিল সিদ্রা। বাসা থেকে মাদ্রাসা মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা। সকালবেলার মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে ওর বেশ লাগে। বড় রাস্তার ভীড় এড়ানোর জন্য যে শর্টকাটটা ও ব্যবহার করে, সেখানে এই সময়ে কেউ থাকেনা বললেই চলে। যদিও ফাঁকা গলিতে একটু ভয় লাগে, কিন্তু গলিটা পার হতে ১ মিনিটের বেশি লাগেনা। গলিতে ঢুকতেই হঠাৎ একটা গাড়ি এসে ওর একদম গা ঘেঁষে ব্রেক করে। চমকে দাঁড়িয়ে যায় ও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভিং সিট থেকে এক লোক নেমে এসে ওর মুখের ওপর একটা কিছু চেপে ধরে। তারপরেই আর কিছু মনে নেই।
এখন বুঝতে পারছে ওইটা ক্লোরফরম ভেজানো কিছু ছিল। আমাকে কি কেউ কিডন্যাপ করেছে? কিন্তু কিডন্যাপ তো ছোট বাচ্চাদের করা হয়। আমার মত একটা ২০ বছরের মেয়েকে কেউ কেন কিডন্যাপ করবে। তাহলে কি………. ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলো সিদ্রা। শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখে বোরকাটা গায়ে আছে কিন্তু মাথা ফাঁকা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও স্কার্ফটা চোখে পড়লনা। আল্লাহ্ জানে কতজন ওকে এই বেপর্দায় দেখে ফেলেছে, সবার প্রথমে এই চিন্তাই আসল মাথায়। আসবেনা কেন, সেই এতটুকু বয়স থেকে বোরকা পরে। নেকাব পরে ক্লাস ফাইভ থেকে। কোনদিন কোন পরপুরুষ ওর হাতগুলাও দেখেনি, চেহারা তো দূরের কথা! সেখানে ও এই বেশে কোথায় না কোথায় পড়ে আছে ভেবে এই প্রথম কান্না পেল ওর।
হাত পা মোচড়ামুচড়ি করে বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে লাগল সিদ্রা। কিন্তু হাত পায়ে লাল লাল দাগ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপকারই হলনা। বাধ্য হয়ে থামতে হল ওকে। আস্তে আস্তে ডাক দিল, “কেউ আছেন? ……আমাকে খুলে দিননা…..কেউ কি আছেন…..কেউ শুনতে পাচ্ছেন…..প্লিজ আমাকে বাঁচান……” ভয়ে গলার স্বর উঁচু হচ্ছেনা। কেউ আসছেনা দেখে আস্তে আস্তে গলার আওয়াজ বাড়াল সিদ্রা। আরেকবার ভাল করে তাকাল ঘরটার দিকে। ওর নিজের ঘরের চার ভাগের একভাগ ঘরটার সাইজ। মেডিকেলের বেডের মত একটা খাটে ও শোয়া। খাট ছাড়াও একটা সস্তা কাঠের আলমারি আর একটা স্টিলের ট্রাংক চোখে পড়ল। মাথার দিকে আর ডান দিকে ছোট ছোট দুটো জানালা। পাল্লাগুলো খোলা, ঘন সবুজ গাছ দেখা যাচ্ছে, এতই ঘন যে উপরে আকাশও দেখা যাচ্ছেনা। ঘরের একটামাত্র দরজা, বন্ধ।
বাবা-মা আর বোনের কথা মনে পড়ল সিদ্রার। বাসায় নিশ্চয় সবাই খুব টেনশন করছে। আম্মু-আব্বুর প্রেসার নিশ্চয় হাই হয়ে গেছে। চারদিক নিশ্চয় পাগলের মত ওকে খুঁজছে। কিন্তু আমি কোথায়? আমাকে যখন কিডন্যাপ করেছে, তখন কেউ কি দেখেনি, ভাবল ও। কিন্তু ওই সময় রাস্তার ওই অংশটা একদম ফাঁকা থাকে। ভয়ে আর আশংকায় বুক কাঁপতে লাগল ওর।
এসময় হঠাৎ দরজাটা নড়ে উঠল। দুচোখভরা আতঙ্ক নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল সিদ্রা। দরজা খুলে প্রবেশ করল এক অচেনা লোক। গুণ্ডা টাইপের কাউকে দেখবে এমন চিন্তা ছিল ওর। কিন্তু প্রথম দর্শনে লোকটাকে আর যাই হোক, গুন্ডা লাগছেনা। দেখতে ভয়ংকর না হলে কি হবে, লোকটার চোখ দুটোতে যেন রাগ আর কৌতুক খেলা করছে। নিজের অবস্থার কথা স্মরণ হতেই কুঁকড়ে গেল সিদ্রা। বন্দী অবস্থার থেকে ওর বেপর্দা অবস্থা ওকে বেশী পীড়া দিচ্ছে।
“বাহ! ঘুম ভেঙেছে দেখছি।“ কৌতুকের স্বরে বলল লোকটা। লোকটার পেছনে একটা মহিলাও ঢুকল ঘরে, অনেকটা ওর বড় খালার বয়সী। চোখ দিয়ে ইশারা করতেই মহিলাটা এসে ওর হাতের বাঁধন খুলে দিল। উঠে বসেই ও জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কে? আমাকে কেন ধরে এনেছেন?”
“আস্তে…..’ হিশিয়ে উঠলো লোকটা, “এত তাড়া কিসের! সারাজীবন তো পড়ে আছে কথা বলার জন্য”
মাথাটা চোঁ করে ঘুরে উঠলো সিদ্রার। কি বলছে লোকটা! সারাজীবন মানেটা কি!!
২.
“কি বলছেন এগুলো আপনি? সারাজীবন মানে?”
“অত স্বপ্ন দেখার কিছু নাই। ভাবিসনা যে তোকে আমি ভালবেসে বিয়ে করার জন্য তুলে এনেছি। তোর মত মেয়েকে ভালবাসার থেকে একটা সাপকে ভালবাসাও ভাল।”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সিদ্রা। একটা অপরিচিত লোক তার সাথে তুইতোকারি করছে! কিন্তু কেন?
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি কোন অপরাধ করেছি। কি করেছি আমি?”
“তুই জানিসনা তুই কি করেছিস? ন্যাকামো হচ্ছে আমার সাথে? ওই ন্যাকামি দিয়ে তুই তোর প্রেমিকদের ভুলাতে পারবি, আমাকে না”
লোকটার কি মাথা খারাপ নাকি! যে কোনদিন কোন ছেলের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেনা, তার আবার প্রেমিক!!
“আপনি এসব কি বলছেন, আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছিনা। কিসের প্রেমিক!?
লোকটা যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। এগিয়ে এসে ঠাস করে একটা চড় মারল ওর গালে।
“ঢং! ফিডার খাস নাকি!! রাতদিন ছেলেদের সাথে প্রেম করে বেড়িয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কিসের প্রেমিক!!! যেন দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। আমি মিথ্যা কথা একদম পছন্দ করিনা। একেকটা মিথ্যা বলবি তো এভাবেই চড় খাবি” চোখ-মুখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে লোকটার।
ঘটনার আকস্মিকতায় সিদ্রা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর মনে হল ও একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। চোখ খুললেই দেখবে বোনের সাথে বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু চোখটা যে কেন খুলছেনা, আর দেখতে চায়না ও স্বপ্নটা। লজ্জায় আর অপমানে দুচোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল।
“আবার কাঁদছিস! কাঁদ যত ইচ্ছা। কিন্তু ভাবিসনা তোর কান্না দেখে আমি গলে যাবো। অনেকজনকে ভুলিয়েছিস, আর যেন না পারিস, সেজন্যই তো ধরে নিয়ে এলাম। দেখি এবার, গাছগাছালি আর পশুপাখিদের কেমন ভোলাতে পারিস। কিন্তু ওরা মনে হয় তোর রূপ দেখে ভুলবেনা” হো হো করে হেসে উঠলো লোকটা।
আর সহ্য করতে পারলোনা সিদ্রা।
“চুপ করেন!” ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল, ”তখন থেকে কিসব আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছেন!! কার প্রেমিক, কিসের প্রেমিক। আমার কোন প্রেমিক ট্রেমিক নাই। আপনার কথার আগামাথা আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। আপনার কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। আমি এমন মেয়ে নই।“
“নারে, আমার কোথাও কোন ভুল হয়নি।“ ডান হাত দিয়ে ওর গালদুটো জোরে টিপে ধরলো লোকটা, ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো ও।
“তুই যত না না করছিস, আমার বিশ্বাস ততই পাকা হচ্ছে যে আমি ঠিক মেয়েকেই তুলে এনেছি। এবার থাক এখানে, মিস সিদ্রাতুল মুনতাহা”
একদম চমকে গেল সিদ্রা। লোকটা ওর পুরো নাম ঠিক ঠিক বলেছে!
“তোর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে, এবার সেই সব পাপের শাস্তি আমি তোকে দিব। এমন শাস্তি দিব যে তুই কল্পনাও করতে পারছিসনা”
“আপনি ভুল করছেন। আমি……… এই যে, শুনেন, আমার কথাটা শুনেন , এই যে……” ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।
সিদ্রা যেন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মাথা কাজ করছেনা ওর। লোকটা অন্য কারো সাথে ওকে গুলিয়ে ফেলছে, নাকি লোকটা আসলে পাগল! কিসব আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে। রাতদিন ছেলেদের সাথে প্রেম, রূপ দেখিয়ে ভোলানো, ছি!
পায়ে কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল সিদ্রার। মহিলাটা ওর পায়ের বাঁধন খুলে দিচ্ছে। কিন্তু মহিলাটার চোখের দিকে চাইতেই চমকে উঠলো ও। একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে, যেন কোন নোংরা জিনিসে অনিচ্ছা সত্বেও হাত পড়েছে।
“আমাকে প্লিজ ছেড়ে দেন। বাসায় সবাই চিন্তা করছে। ওই লোকটা যা বলছে সেগুলা সত্যি না। আমি ভাল মেয়ে, ওইসব কিছুই আমি করিনি, করতে পারিনা। আমাকে বিশ্বাস করেন প্লিজ।“ মহিলাটার হাত ধরতে গেল ও।
এক ঝটকায় হাত সরিয়ে অগ্নিদৃষ্টি হানল মহিলা ওর দিকে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খাট থেকে নামল সিদ্রা। অনেক্ষণ একভাবে থাকায় পায়ে সাড় পেতে সময় লাগল। নিচে ওর স্কার্ফটা পড়ে থাকতে দেখল। উঠিয়ে নিয়ে মাথায় পরল সেটা। ঘর থেকে বেরোতে যাবে, মহিলাটা আবার ঢুকল, হাতে একটা থালা। ও বের হতে যাচ্ছিল বুঝতে পেরে রেগে গেল মহিলা। ওর হাত ধরে ঘরের ভেতরে টানতে লাগল। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল সিদ্রা, বারবার ছেড়ে দেয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করতে লাগল। মহিলা এক ঝটকা টানে ওকে বিছানায় ফেলল। হাতের থালাটা বিছানায় রেখে হাত নেড়ে আর চোখ ঘুরিয়ে কি জানি বোঝাতে চাইল ওকে।
“আপনি কথা বলছেননা কেন? বোবা নাকি!?” মহিলাটা যেন মুহূর্তের জন্য আহত হল ওর কথা শুনে। হাত নেড়ে আবার ইশারা করল আগের মত। মাঝে একবার দড়ি দিয়ে হাত বাঁধার মতও করল। এবার বুঝল সিদ্রা, ঘর থেকে বের হতে চাইলে ওকে বেঁধে রাখা হবে। মহিলা তার মানে আসলেই বোবা, কিন্তু কালা না।
তবে মহিলা ওর বোঝা না বোঝার ধার ধারলনা। অবজ্ঞার একটা দৃষ্টি হেনে মুখ ঘুরিয়ে দরজা টেনে বের হয়ে গেল। ছুটে গেল ও, দরজা ধাক্কাতে লাগল জোরে জোরে, “আমার কথা শুনেন। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দেন। আমি কিছু করিনি, প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করেন, প্লিজ। খালা, আমার কথা শুনেন খালা, আমাকে প্লিজ বের হতে দেন। আমাকে বাসায় যেতে দেন, প্লিজ। আমি কিছু করিনি, আমাকে বিশ্বাস করেন।”
বাইরে তালা লাগানোর শব্দ শোনা গেল। তবু থামলনা সিদ্রা, দরজা ধাক্কাতেই থাকল, সাথে মুখে অনুনয় বিনয় তো আছেই। ওর মনে হচ্ছিল, ও রিকোয়েস্ট করলে, বুঝিয়ে বললেই হয়ত ওর কথা বিশ্বাস করবে। কিন্তু কেউ আসলনা। কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে গেল সিদ্রা। তাও দরজার পাশে বসে গিয়ে আস্তে আস্তে ক্ষীণ স্বরে ডাকতেই থাকল। যখন বুঝল ওর ডাক শোনার মত কেউ নেই, তখন বাধ্য হয়ে থেমে গেল। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা ও, হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল। একটু পর মাথা উঠিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
“আল্লাহ্! আল্লাহ্ গো!! এসব কি হচ্ছে আল্লাহ!!! আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আল্লাহ, তুমি আমাকে বাঁচাও, এ বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা কর তুমি, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা” এভাবে আল্লাহ্কে ডেকে ডেকে কেঁদে চলল সিদ্রা। একটু পরে আব্বু আম্মুর কথা মনে পড়ল, তাতে কান্না আরো বেড়ে গেল ওর। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
(চলবে)
– Farhina Jannat
২.
ঘুম ভাঙ্গল কারো লাত্থি আর চেঁচানতে। কেউ একজন ক্রমাগত লাত্থি মারছে ওকে। সাথে বলছে, “ওঠ! তোকে কি আমি আরামে ঘুমানোর জন্য এনেছি। এ অবস্থাতেও তোর ঘুম আসছে, না?”
শোয়া থেকে তাড়াতাড়ি উঠে গুটিসুটি মেরে দেয়ালের দিকে সেঁটে গেল সিদ্রা। লোকটা ওর মুখের সামনে উবু হয়ে ওর গালদুটো ডান হাত দিয়ে টিপে ধরল।
“তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাকে স্বপ্নে দেখছিলি? আমিও একটু শুনি”
আ! করে অস্ফুট আর্তনাদ করে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল ও, পারলো না। লোকটা এবার মুখ ছেড়ে খাটের ওপর থালার দিকে তাকাল। তারপর বলল,“খাসনি কেন?”
“আমি খাবনা, আমি বাসায় যাব”
হো হো করে হেসে উঠলো লোকটা।
“বাসায় যাবি? এটাই এখন থেকে তোর বাসা। চুপচাপ খেয়ে নে”
“আমি খাবনা” আরো শক্ত কন্ঠে বলল সিদ্রা। নিজের কন্ঠস্বরে নিজেই চমকে গেল ও।
“শোন, ভাল কথা বলছি, যখন খেতে দিব, চুপচাপ খেয়ে নিবি। আমি অবাধ্যতা পছন্দ করিনা”
থালাটা ঠেলে দিল ওর দিকে। অবাক হল সিদ্রা, ওর ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু এমন অবস্থায় মানুষের ক্ষুধা কিভাবে লাগতে পারে, সেটাই ও বুঝতে পারলনা। লাগুক ক্ষুধা, খাবনা আমি, স্থির করল ও।
“আমি খাবোনা। আমি বাসায় যাবো। আমাকে ছেড়ে দেন। আপনি কেন ধরে এনেছেন আমাকে?”
“এক কথা বারবার বলতে ভাল লাগেনা আমার। বলেছি তো, কথা বলার অনেক সময় পাবি। এখন আগে খা।“ আবার রেগে যাচ্ছে লোকটা। “নাকি খাবার পছন্দ হয়নি, পোলাও বিরিয়ানি দিতে হবে নাকি তোকে?”
সিদ্রা এবার থালার দিকে নজর দিল। বাসি পান্তা, অর্ধেকটা পেঁয়াজ আর একটা কাঁচামরিচ। পান্তার টক গন্ধ এখান থেকেই পাচ্ছে।
“আমি খাবো না। পোলাও-বিরিয়ানি দিলেও না। আমাকে ছেড়ে না দিলে আমি কিছুতেই খাবো না।“ জেদ চেপে গেছে ওর।
“খাবিনা? দেখি তুই কেমনে না খাস।“ ডাক ছাড়ল লোকটা, “খালা, ও খালা!”
খালা ঘরে ঢুকতেই কৌতুকের স্বরে বলল, “আমাদের সম্মানিত অতিথিকে একটু আপ্যায়ন করেন, খেতে চাইছেনা যে”
মহিলা মাথা ঝাঁকিয়ে ওর সামনে বসল, থালা হাতে নিয়ে ভাত মাখল। লোকমা তুলতেই ও দু হাত দিয়ে পেছনে হটল। মহিলা বাম হাত দিয়ে ওর গাল ধরে মুখ ফাঁক করার চেষ্টা করতেই ও দুহাত দিয়ে মহিলার হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে লাগল। ওদের ধস্তাধস্তি দেখে লোকটা এসে এক হাত দিয়ে ওর দুহাত পেছনে নিয়ে ধরে রাখল, আর আরেক হাতে চুলের মুঠি ধরল, আর মহিলা ওর মুখ ফাঁক করে একগাদা ভাত ঠুসে দিল। হঠাৎ করে টক ভাত গলায় চলে যাওয়ায় ওয়াক করে উঠল ও। থু করে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতেই দ্বিতীয়বারের মত চড় খেল সিদ্রা। এবারেরটা এত জোরে ছিল যে, ওর কান ঝাঁ ঝঁ করতে লাগল। মাথাটাও বোঁ করে ঘুরে উঠলো। রাগের চোটে থু করে ফেলে দিল ভাতগুলা। সাথে সাথে লোকটা ওর দুইগালে কয়টা যে চড় মারল, ও নিজেও বলতে পারবেনা। দুর্বল শরীর আর নিতে পারলনা, জ্ঞান হারাল সিদ্রা।
সিদ্রাকে নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখে হুঁশ ফিরল যেন লোকটার। ছেড়ে দিল চুলের মুঠি আর হাত। খালাকে বলল পানি আনতে। পানি আনলে পুরো জগের পানি সিদ্রার মুখের ওপর ঢেলে দিল। জ্ঞান ফিরতেই হকচকিয়ে গেল ও। এদিক ওদিক তাকিয়ে পুরো পরিস্থিতি বুঝতে খানিকটা সময় লাগল ওর।
লোকটা খালাকে আবার ইশারা করল। খালা এসে ওর মুখে আবার ভাত ঠুসে দিল। আর কোন জোরজবরদস্তি করলনা সিদ্রা, চুপচাপ গিলে ফেলল। আসলে ইচ্ছা না থাকলেও জোর করার মত শক্তি অবশিষ্ট নেই।
পান্তাভাত এর আগে সিদ্রা কখনো খায়নি, তা না। উল্টো আলুভাজি আর মুরগির গোস্ত দিয়ে পান্তা ওর খুবই পছন্দের। বাসায় রাতের খাবারে এ দুটো আইটেমের কোনটা থাকলেই ও আম্মুর কাছে পান্তাভাত রাখার জন্য বায়না করে। কিন্তু এত দুর্গন্ধযুক্ত আর টক পান্তা, মানুষ কেন, কোন পশুও মনে হয় খেতে পারবেনা। অনেক কষ্টে বমি আটকে রাখল সিদ্রা।
আম্মুর কথা মনে পড়তেই চোখ দিয়ে অটোমেটিক পানি বের হয়ে গেল। কারো হাতে ভাত খাইয়ে নিতে সিদ্রা খুবই ভালবাসে। আম্মুর কাছে মাঝেমাঝেই খাইয়ে নেয়ার আবদার করত, আর সবসময় বোনটাও এসে তাল মেলাত। অথচ আজকে ও না চাইতেই ওকে কেউ খাইয়ে দিচ্ছে, কিন্তু দুইটার মধ্যে কতইনা তফাৎ। ওইটাতে থাকে আদর-ভালবাসা, আর এ মহিলার চোখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছেনা।
লোকটার দিকে তাকিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বিছানায় বসে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন কোন সার্কাস পার্টি হচ্ছে, আর সেটা দেখে উনি খুব মজা পাচ্ছেন। একটা ঘুষি মেরে লোকটার নাকমুখ ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ও জানে, ওর দ্বারা এটা করা এককথায় অসম্ভব!
খাওয়া শেষ হতেই লোকটা খালার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই খালা বের হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই হাতে করে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ঢুকলে লোকটা বলল, “মেঝেটা পরিষ্কার কর। এবারের মত শাস্তি মাফ করলাম। এরপর সময়মত না খেলে আর কথা না শুনলে তোর কপালে বহুত দুঃখ আছে।”
এমনিতে যেন কত সুখে আছি! ভাবল সিদ্রা। তর্ক করতে ইচ্ছে করছে ওর, কিন্তু চড়-থাপ্পড়্গুলোর কথা মনে পড়তেই চুপচাপ ন্যাকড়াটা নিয়ে মেঝেটা মুছে দিল। লোকটা আবার ওর গায়ে হাত দেক, চায়না ও। মুছার পর খালা ন্যাকড়াটা নিয়ে চলে গেল। লোকটা উঠে দাঁড়াল।
“আজকের মত তোর শাস্তি এটুকুই। রাতে খাবার দিবে, খেয়ে নিবি। কাল থেকে শুরু হবে তোর নতুন জীবন!”
দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই ডুকরে কেঁদে উঠল সিদ্রা। কাঁদতে কাঁদতে ওই বেশেই সেজদায় পড়ে গেল, আর আল্লাহর কাছে কাঁদতে শুরু করল। এটা ওর বহুদিনের অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই ও একটু চাপা। সবার সাথে তেমন মিশতে পারেনা বলে বন্ধুত্ব্বও হতনা সহজে। এমনকি আপন বোনের সাথেও মন খুলে কথা বলতে পারতো না, কারণ দুইজনের প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। তখন থেকেই মনের কথা আল্লাহর সাথে শেয়ার করা শুরু। মাদ্রাসায় কিংবা অন্য কোথাও, কেউ কিছু বললে বা করলে তখনকার মত নিজেকে সামলে নিয়ে বাসায় এসে সোজা জায়নামাজ নিয়ে বসে যেত। কখনো মোনাজাতে কখনো সেজদায়, কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ্র কাছে বিচার দিত। এজন্য বোনের কাছে কাঁদুনি বুড়ি উপাধি পেয়েছে।
যখন বুঝতে শিখল যে কারো খারাপ চাইতে নেই, তখন থেকে শুধু নিজের কষ্টগুলোই বলতো, অভিযোগ করতো না। আর যে ওকে কষ্ট দিয়েছে, তার হেদায়াতের জন্য দোয়া করতো। কারণ একবার আল্লাহকে সবকিছু খুলে বলার পর আর কোন কষ্টই যেন থাকতো না। বড় হয়ে কয়েকটা বান্ধবী হলেও আল্লাহর সাথে কথা বলার এই অভ্যাস ওর থেকেই গেছে।
হঠাৎ খেয়াল হল সিদ্রার, নামাজ! কালকে থেকে পুরো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অলরেডি কাজা হয়ে গেছে। জানালার আলো অনেক কমে গেছে, তার মানে আর দেরী করলে আজকের যোহরও কাজা হয়ে যাবে। তলপেটেও চাপ অনুভব করল, বাথরুমে যাওয়াও দেখি ফরজ, ভাবল ও।
আবার দরজা ধাক্কানো শুরু করল সিদ্রা। “খালা, আমি বাথরুমে যাবো, দরজা খুলেন। খালা, ও খালা!”
দরজা খুলে যেতেই উঠে দাঁড়াল সিদ্রা। খালা ওর দিকে তাকিয়ে যেন বুঝার চেষ্টা করল, ও নাটক করছে নাকি সত্যি বলছে। কিন্তু সিদ্রার ঠোঁট কামড়ে বাথরুম চেপে রাখার চেষ্টা দেখে যেন বিশ্বাস করল, হাত শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে আসল ওকে।
ঘরের বাইরে একটা বারান্দার মত। একপাশে চালা আর কাঠ দিয়ে ঘেরা। সেখানে চুলা আর হাঁড়ি-পাতিলসহ রান্নার জিনিসপত্র রাখা। আর ও যে ঘরে ছিল তার পাশে আরেকটা ঘর। এছাড়া আশেপাশে আর কোন ঘর নেই। চারিদিক তাকিয়ে ঘন গাছপালা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলনা সিদ্রা। এমনকি সূর্যের আলোটাও ঠিকমতো আসছেনা। কোথায় আছি আমি? ঢাকায় থাকার কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনা। গাজীপুর কি, নাকি আরো দূরে কোথাও!
মহিলা ওকে নিয়ে আসল চালার পেছনদিকে। সেখানে চালার তৈরি আরেকটা ছোট ঘর দেখা গেল। ভেতরে ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে দিল মহিলা। এত ছোট আর নোংরা বাথরুম কোনদিন দেখেনি সিদ্রা। একটু আগে খাওয়া টক পান্তা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোনমতে সামলাল ও নিজেকে। একটা বালতিতে পানি আর একটা মগ রাখা। কোনমতে নিজের কাজ শেষ করে বাইরে এসে বুকভরে দম নিল ও।
মহিলাকে বলল, “আমি অজু করব, ভাল পানি কোথায় পাবো?”
মহিলা ওর কথা শুনে একটা তাচ্ছিল্যমার্কা হাসি দিয়ে ওকে রান্নার জায়গায় টেনে আনল। সেখানে রাখা ড্রাম থেকে পানি দিল ওকে। একজন গায়রে মাহরাম (যাদের সাথে পর্দা ফরজ) ওর গায়ে হাত দিয়েছে ভেবেই গা কেমন ঘিনঘিন করছিল সিদ্রার। গোসল করলে ভাল হত। কিন্তু ড্রামে পানির পরিমাণ দেখে, আর নামাজের কথা ভেবে বাদ দিল গোসলের চিন্তা। অজু করা শেষে পশ্চিম কোনদিকে জিজ্ঞেস করল ও। মহিলা আবার সেই একই হাসি দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। মহিলার বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য দেখে আবার জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হল,
“আপনারা কি চান বলেনতো? আমি বুঝতে পারছিনা, এমন কেন করছেন আপনারা আমার সাথে? আমি কি একটা ক্রিমিনাল নাকি!” মহিলা কিছু বললনা, কিন্তু চোখের দৃষ্টি এত ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে ভয় পেল সিদ্রা। মহিলা ওর হাত ধরে জোরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর যথারীতি দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।
বাপরে বাপ! এই বয়সেও মহিলার গায়ে কি জোর, কি খায় কে জানে। নিজের চিন্তার ধরণ দেখে মনে মনে হাসল সিদ্রা। বন্দীখানায় বসে, যে ওকে বন্দী করে রেখেছে তার খাওয়ার কথা চিন্তা করছে! এও সম্ভব!!
যাকগে, আগে নামাজটাতো পড়ি, ভাবল ও। বোরকা খুলে স্কার্ফটা মাথায় পেঁচিয়ে খালি মেঝেতেই দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে যোহর, আর তারপর সিরিয়ালি কাজা নামাজগুলো আদায় করল। তারপর হৃদয়ের সমস্ত আকুতি নিয়ে এ বিপদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করল সিদ্রা। মোনাজাত শেষে সবসময়ের মত এত হালকা লাগল ওর, মনে হল আল্লাহ্ ওর সব টেনশন দূর করে দিবেন। কিন্তু বেচারি সিদ্রা! ও জানেনা, আল্লাহ্র পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা!!