দু মুঠো বিকেল পর্ব ৩+৪

দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_৩
Writer-Afnan Lara
.
“হোয়াট??আর ইউ সিরিয়াস?”
রিহাব ফোন কানে ধরে জানালা খুলতেই দেখলো আঁখি জানালার গ্রিল ধরে সেখানে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,রিহাবকে দেখে মুচকি হেসে সে ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো
.
তুই একটা পাগল!
.
কথাটা বলে রিহাব মুখের উপর জানালাটা অফ করে ফোন রেখে দিলো তারপর তোয়ালে খু্ঁজে ফ্রেশ হতে চললো সে

আমার জানটা রে!!!
.
কে জানটা?
.
মায়ের গলা শুনে আঁখির হাত থেকে ফোনটাই পড়ে গেছে,কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিচ থেকে তুলে নিয়ে সে মায়ের দিকে তাকালো
গোলাপি রঙের সুতির শাড়ী পরা মহিলাটি এগিয়ে এসে আঁখির সামনে দাঁড়ালেন
তার মুখের গঠন পুরোটাই স্পর্শর ছবি এঁকে রেখেছে,স্পর্শ পুরো তার মায়ের মতনই হয়েছে
উনি তার চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে তাক থেকে তেলের বোতল নিয়ে বললেন “কিরে বলছিস না যে?কে জানটা?”
.
না আম্মু,ভুল শুনেছো,আমি জানটা বলিনি
অবশ্য পুরোটা ভুল নয়
আমি মেজান্ডা কালার বলেছিলাম,তুমি সব কেটে কুটে জানন্ডা শুনছো
.
মিসেস রোকসানা মাথা উঁচু করে জানালা দিয়ে রিহাবদের বাসার দিকে তাকালেন,জানালা অফ,এখন খোলা থাকলে তিনি আঁখির কথা বিশ্বাস করতেন না
তাই তেলের বোতলটা আঁখির দিকে এগিয়ে ধরে বললেন”ধর এটা,আর চল আমার সাথে,আমার চুলে তেল লাগিয়ে দিবি,এক টানা ৩টা সিরিয়াল দেখতে দেখতে আমার মাথা ধরে গেছে,আর আসমা কোথায়?রাতের রান্না হয়েছে??তোর বাবা এসেই খেতে বসবে”
.
আসমা আপা তো তরকারি আনতে গেছে
.
কেন?স্পর্শ আজ সকালে বাজার করে নাই?
.
আজকে বাজারে নাকি ভালো সবজি উঠে নাই,ভাইয়া শুধু টমেটো আর ফুলকপি নিয়ে এসেছিলো, ওসব দুপুরের জন্য রান্না করেছিলো আসমা আপা,এখন সব শেষ
.
ওহ!ঠিক আছে
.
মিসেস রোকসানা স্পর্শের রুমে এসে ওর বিছানায় ভেজা শার্টটা দেখতে পেলেন,তার আর বুঝতে বাকি নেই তখন তার ছেলেই এসেছিল, শার্টটা স্পর্শের বারান্দায় গিয়ে টাঙিয়ে দিয়ে নিচে তাকালেন তিনি
স্পর্শ তার বাইকে বসে ৩টা ছেলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে
মিসেস রোকসানা রিমঝিমদের বাসার দিকে একবার তাকালেন চোখ বড় করে
.
আম্মু?তেল গরম হয়ে গেছে,এসো
.
আসছি!
.
মিসেস রোকসানা রিমঝিম আর রিহাবদের পরিবারকে দুচোখে সহ্য করতে পারেন না,কারণ তাদের স্টেটাস মেলে না
তার উপর রিহাবকে তো একদমই পছন্দ করেন না তিনি,রিমঝিমকেও না
অনেক বাড়িওয়ালাই চাইবে না ভাড়াটিয়ার সাথে আত্নীয়তার সম্পর্ক গড়তে,রোকসানা বেগম ও তেমনই,তবে তার মনটা অনেক ভালো,তার ছেলেমেয়েকে যারা ভালোবাসে তিনিও তাদের ভালোবাসেন,খালি একটু টাকার গরম এই আর কি
তার ছেলেমেয়ে যে তার চোখের শত্রুদের ছেলেমেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তা তিনি জানেন না,জানলে আবার বিশ্বযুদ্ধ হবে

স্পর্শ ভাই,এই নিয়ে ৫৭বার তাকিয়েছেন রিম ভাবীর বারান্দার দিকে,আপনার মাথা ধরে যায় না?
.
কি বলিস রিপন??স্পর্শ এই নিয়ে কত কাপ চা খেয়েছে তোর হিসেব আছে??এত চা খেলে মাথা ধরার কোনো চান্স থাকে না
.
আশিক! আমি তাকানোটা কাউন্ট করেছি,চা খাওয়াটা কাউন্ট করিনি
.
স্পর্শ রিপন আর আশিকের গলা ধরে ঘুরিয়ে এনে বললো”আমার জিনিস,আমি একশো বার তাকাবো”
.
আপনার জিনিস তো তার রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ করে রেখেছে
.
আমার বাধ্য তো তাই,আমি ওকে বলেছি রাতে যেন বারান্দায় না আসে,আমার জন্য বিকেল বেলায় আসবে আর ভোর ৫টা বাজে ৫মিনিটে আসবে,আর একটা সময় আসবে সেটা তোদের বলা যাবে না
.
এত বাধ্য করলেন কি করে টিপস দেন,আমরাও এমন করবো তাহলে
.
সেটা আমি নিজেও জানি না রিপন,তবে সে আমাকে শুধু শুধু ভয় পায়,আমি তাকালেও তার হাতের পশম খাড়া হয়ে যায়,এত ভয়ের কি আছে বুঝি না,আমার চোখ দেখ তো তোরা,আমাকে কি বেশি খারাপ লাগে?
.
না তো!ভয়ের কিছুই তো দেখছি না
.
কচু ভয় পায়,এই নিয়ে কতবার ওর হাতে চড় খেয়েছেন জানেন ভাইয়া??
.
ওর হাতের ছোঁয়া পেলে আমার আর কি লাগে,ওর হাতের চড়টাও আমার কাছে ভালো লাগে
তাই সারাজীবন ধরে চড় খেতে পারবো,কোনো সমস্যা নেই
.
এত ভালোবাসা আমরা কই রাখি!আপনার কি মনে হয় এই মেয়েটার যে রাক্ষস বাপ আর ভাই আছে তারা আপনার সাথে ওকে বিয়ে দিতে রাজি হবে কখনও?
.
মরে গেলেও রাজি হবে না,আমি জানি আমি রিমঝিমকে কোনোদিন পাবো না
.
তাহলে এরকম অন্ধ ভালোবাসার কারণ কি ভাই?
.
স্পর্শ রিপনের কাঁধে হাত রেখে হাসলো তারপর আবারও রিমের বারান্দাটার দিকে চেয়ে বললো”ওকে নিজের করে না পাই,প্রতিদিন ৩বেলা ওকে দেখতে তো পাই এর চেয়ে আশির্বাদস্বরুপ আর কি হতে পারে বল!
.
সবকিছুর একটা ভবিষ্যত আছে,তোদের কি ভবিষ্যত?
.
আমি ভবিষ্যত নিয়ে ভাবি না আশিক!
রিম আমাকে পছন্দ করে না,যদি করতো তাহলে আশা বুনতাম আমি
যেখানে রিম নিজে আমাকে ঘৃনা করে সেখানে ওর পরিবারকে মানানোর চেষ্টা আমি করি না
.
আচ্ছা স্পর্শ ভাই আমি একটা কথা বুঝছি না,রিম ভাবীর বাবা আর ভাই আপনাকে পছন্দ করে না কেন?আপনারা তো ওদের চেয়ে হাই প্রোফাইলের
.
স্পর্শ হাসতে হাসতে পিছনে থাকা একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো তারপর শক্ত চোখে নিচে থাকা পাকা রোডটার দিকে তাকিয়ে রইলো
নিরবতা ছেড়ে এবার সে বললো”হাই প্রোফাইল থেকে কি হবে দোস্ত!!তারা মেয়েকে যার হাতে তুলে দেবে তার যে চাকরি নেই”
.
চাকরি দিয়ে কি হবে আপনাদের এত টাকা,সম্পত্তি, আবার চাকরি লাগে নাকি?
.
রিপন তুই চুপ থাক!গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেও স্পর্শ চাকরি কেন করে না সেটাই বুঝতেছি না আমি
.
রিমঝিম আমাকে ভালোবাসলে আমি চাকরিতে জয়েন হবো তার আগে প্রয়োজন নেই
.
এটা রিমঝিম জানে?
.
হুম আশিক,সে জানে এই বিষয়টা”
কথাটা বলে স্পর্শ হঠাৎ মুচকি হাসলো বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে
.
কি রে স্পর্শ এমন হাসিস কেন
.
এমনি!!!!

রিমঝিম দরজার নিচ দিয়ে উঁকি মেরে দেখছিল স্পর্শ আছে কিনা তাহলে সে একটু বের হবে,রুমে বসে বসে বোর হচ্ছিলো
তারপর স্পর্শের মুখে হাসি দেখতে পেয়ে তার আর বুঝতে বাকি নেই স্পর্শ ওর চোখজোড়া দরজার নিচ দিয়ে দেখে ফেলেছে
.
নিজের মাথায় এক চড় মেরে রিমঝিম পিছিয়ে গিয়ে বসলো এবার
তারপর নিজেই নিজেকে এক গাদা গালি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলো একেবারে
মা রান্না শেষ করে রিমঝিমকে ডাক দিলেন খাবারগুলো টেবিলে গিয়ে রাখার জন্য,রাত ৯টা বাজে সবাই এবার ডিনার করবে
.
রিম এক এক করে রান্নাঘর থেকে প্লেট,বাটি আনতেছে
রিহাব ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো এবার,তারপর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো”মা জানো!পাশের বাসার আঁখি মেয়েটা আমাকে প্রচুর জ্বালাচ্ছে”
.
রিম মুচকি হাসলো কথাটা শুনে,আরও জোরে হাসি পেয়েছিলো তবে সে একটু চেপে রেখে হালকা হাসলো
.
মা আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন”সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরা কি আরেকজনকে ডিস্টার্ব করা ছাড়া আর কিছু পারে না?”
.
রিমকে কি এখনও জ্বালায়?
.
রিম রুটি নিয়ে প্লেটে রাখতে রাখতে শান্ত গলায় বললো”নাহ”
.
মা রিমের দিকে ব্রু কুঁচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন”জ্বালায় তো,বাসার সামনে থেকে নড়ে না ছেলেটা”
.
রিহাব শক্ত চোখে রিমের দিকে তাকিয়ে বললো”বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাকে বলবি,মেরে ভূত বানিয়ে দেবো,যত বড় লোক বাপের ছেলেই হোক,আমার বোনকে ডিস্টার্ব করলে আমি ছেড়ে দেবো না এত সহজে”
.
বাবা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন”কাকে ছাড়বি না রিহাব?”
.
রিম বাবাকে দেখে হেসে কাছে এসে বাবার হাত থেকে অফিসের ব্যাগটা নিয়ে নিলো,বাবা চেয়ারে বসে পানি নিয়ে খেয়ে বড় করে একটা শ্বাস নিলেন তারপর বললেন”সেই ছেলেটা আবার কি করেছে?”
.
রিম পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে সেটা হাতে নিয়ে মুঠো করছে আবার খুলছে
.
কি করবে আর সারাদিন রিমের বারান্দার নিচে ঘুরঘুর করে
.
রিম তুমি আর বারান্দাটায় যাবা না
.
রিম মাথা নিচু করে বললো”আচ্ছা বাবা ”
.
অতিরিক্ত করলে আমি সফিক ভাইয়ের কাছে নালিশ করতে যাব
.
সেই ছেলেটার জন্য আমার মেয়ে কেন বারান্দায় যাবে না?
.
আমরা মেয়ের মা বাবা,বুঝছো??শুরু থেকেই এত প্যাচাল করলে এই ছেলে যদি উঠিয়ে নিয়ে যায় ওরে তখন কি করবা তুমি?আজকালকার দেশের পরিস্থিতি কেমন সেটা জানা আছে তোমার??
.
উঠিয়ে নিয়ে গেলে তো সেই ৩বছর আগেই নিয়ে যেতো
.
কখন কার মনে কি চলে তা কি জানি আমরা?আর যাই হোক এই ছেলেটাকে আমি আমার মেয়ে জামাই হিসেবে কখনও মানবো না,এমন চাহিয়া থেকে কোনো লাভ হবে না
আমি আমার মেয়ের সাথে একটা ভালো পরিবারের চাকুরীরত ছেলের বিয়ে দেবো
যে এরকম ছেঁসড়ামি করে না অন্তত!
কথাটাগুলো বলে বাবা চোখ থেকে চশমা খুলে চললেন রুমের দিকে
.
রিহাব রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ৬/৭টুকরো করে ফেলেছে তারপর চুপচাপ ডালে চুবিয়ে খাওয়া শুরু করলো
.
তামিম?তুই বুঝি আবার দরজা লাগাস নি!তোর বাবা দেখি দরজা খুলে ভিতরে চলে আসলেন কলিংবেল ও বাজাতে হয়নি তার, এরকম করলে চলে?
.
তামিম তার পুরো চকোলেটটা শেষ করে প্যকেটটা ফেলতে ফেলতে বললো”ছিটকিনি লাগিয়েছিলাম তো”

রিম নিজের রুমে চলে এসেছে,এটা প্রতিদিনকার খবর
প্রতিদিন লোকটাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আলোচনা হয়,একই কথা,সে কখনও আমাকে বিয়ে করতে পারবে না,তার যোগ্যতা নেই হ্যানত্যান!!!
আর আমি ভাবি আমি কি করে এই বন্দি জীবন থেকে বের হবো,আমার আর ভালো লাগে না কিছুু
.
রিম!!তোর জন্য ফোন এসেছে,তমা ফোন করেছে
.
আসছি
.
রিম সোফার রুমে এসে ল্যান্ডলাইনের কলটা রিসিভ করলো ওপাশ থেকে তমা এক চিৎলার করে বললো”দোস্ত!!!কাল আসবি না ভার্সিটিতে?”
.
ভালো লাগে না
.
আসিস প্লিস
.
দেখি আসবো কি আসবো না,মন ভালো না আমার,আজকাল কিছুই ভালো লাগে না
.
স্পর্শ ভাই কি করেছে আবার?
.
উনার নাম নিস না,দিনে ৪৪বার উনার নাম শুনতে শুনতে তেতো ধরে গেছে,এবার তুই বাকি ছিলি
.
তোদের কেমিস্ট্রি টা জাস্ট অন্যরকম
দিনে কয়শ বার তোদের মিট হয়
আহা আহা!!
.
উফ!বাই,আসবো কাল এখন রাখি!
.
রিম ফোন রেখে আবার নিজের রুমে এসে বসে পড়লো বিছানার মাঝখানটায়,পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা জানালাটার দিকে চোখ গেলো এবার তার
বেশ কিছুক্ষন এভাবে তাকিয়ে থেকে রিম পা টিপে টিপে পর্দাটার কাছে আসলো,হালকা ফাঁক করে স্পর্শের রুমের দিকে তাকালো সে
স্পর্শের রুমে আলো জ্বলছে,ফ্যান ও চলছে,এত ঠাণ্ডার ভেতর!অবশ্য এ তো একটা ছাগল,শীতকালে গরম লাগারই কথা তার
রিম এপাশ ওপাশ তাকিয়ে কোথাও স্পর্শকে দেখলো না বলে পর্দাটা আবার টেনে দিলো
স্পর্শ দেয়ালের এপাশে চেয়ারে বসে পা টা টেবিলে তুলে চুপ করে আয়নার দিকে চেয়ে ছিলো,আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো রিম তার রুমের পর্দা সরিয়ে কি বুজরুকি করছে
স্পর্শ হাসতেছে বসে বসে,ঠিক তখনই মা রুমে ঢুকলেন,স্পর্শের মুখে হাসি দেখে মাও হাসলেন তারপর বললেন”কিরে?এমন হাসছিস যে,কি হলো আমিও একটু শুনি”
.
স্পর্শ টেবিল থেকে পা নামিয়ে বললো”রিপনের বলা একটা জোকস মনে পড়লো তাই হাসলাম,বাবা এসেছে?”
.
হঠাৎ তোর বাবার কথা জিজ্ঞেস করছিস যে,তোর বাবা যে প্রতিদিন এত কথা শোনায় তোকে তার পরেও বাবার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে?কিছু লাগবে নাকি?
.
নাহ কিছু লাগবে না,এমনি জিজ্ঞেস করলাম,আজ এখনও ফেরেনি তো তাই
.
ফিরবে,হয়ত কাজ বেশি হয়ে গেছে,চল ডিনার করবি
.
বাবা আসলে করবো
.
মা চিন্তিত হয়ে স্পর্শের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন তারপর বললেন”তোর কি হয়েছে বল তো?আজ তের বাবার প্রতি এত দরদ হচ্ছে কেন?তোর শরীর খারাপ নাকি?এমন উদ্ভট কথা বলছিসই বা কেন?”
.
আরেহ আমার তো ইচ্ছা হতে পারে বাবার সাথে বসে আলাপ করার,সারাদিনে তো এই সময়টাতেই বাবাকে পাই
চলবে♥
দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_৪
Writer-Afnan Lara
.
আচ্ছা তাহলে তোর বাবা যখন আসবে তখন তোকে ডেকে দেবো
.
হুম
.
মা কথাটা বলে চলে গেলেন,স্পর্শ সচরাচর বাবার সাথে তেমন খোলামেলা কথা বলে না এমনকি বাবার সাথে তার সম্পর্কটাও ওতোটা নরম না,বেশ শক্ত টাইপের
তবে আজ স্পর্শ নিজ থেকে বাবার সাথে কথা বলতে চাইছে কারণটা হলো”চাকরি”
স্পর্শ ভেবে নিয়েছে সে চাকরি করবে,রিমঝিম তো মনে হয় না এ জীবনে আর বলবে যে সে আমাকে ভালোবাসে
বলবে কি আর সে তো আমাকে পছন্দই করে না,হয়তবা তার বাবা আর ভাই রাজি থাকলে সে আমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত, কিন্তু আরেকটা কথাও আছে আর সেটা হলো রিম কখনও বাহ্যিকতা দিয়ে মানুষ বিবেচনা করে না
ও আমাকে পছন্দ করলে আমার আমিকেই পছন্দ করবে,চাকরি করলেই যে পছন্দ করবে এমনটা নয়
তাহলে কি করবো?
আসলে এ বিষয় নিয়ে খোলসা করে রিমের সাথে কথা বলা উচিত আমার,ওর কি মত বা ও কি চায় সেটা জানতে হবে
আপাতত চাকরি নিয়ে চিন্তাভাবনা বন্ধ!
.
স্পর্শ খেতে আয় তোর বাবা এসে গেছে
.
স্পর্শ রুমের দরজা লাগাতে লাগাতে বললো”পরে খাবো মা”
.
ওমা!তুই তো বললি তোর বাবার সাথে খাবি আজ,আবার কি হলো?
.
এখন খিধে নেই

আঁখি ডালের বাটিটা নিয়ে আয়
.
আঁখি রান্নাঘরে এসে একটা কাগজের ভেতর আলু ঢুকিয়ে সেটা মুড়িয়ে রিহাবের জানালায় ছুঁড়ে মারলো
রিহাব তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো
কেমন একটা বিকট আওয়াজ পেয়ে সে জানালার কাছে এসে জানালাটা খুললো এবার
ততক্ষণে আঁখি আরেকটা আলু সমেত কাগজ ছুঁড়ে মেরে দিয়েছে
কাগজটা গিয়ে সোজা রিহাবের কপাল বরাবর পড়লো এবার
রিহাব কপাল ঘষতে ঘষতে কাগজটার দিকে তাকালো
.
এই রে মরেছে!!জানালা ভেবে এবার আমার জানটুসের কপালেইই আলু মেরে দিলাম,এখন কি হবে!
.
রিহাব কাগজটা নিয়ে খুলতে খুলতে ভাবলো হয়তবা কোনো প্রেমপত্র হবে
কিন্তু যা ভাবলো হলো তার উল্টোটা
কাগজটা একটা পেপারের টুকরা মাত্র,আর ভেতরে একটা মিনি সাইজের আলু
বড় আলু হলে তরকারিতে দেওয়া যেতো কিন্তু এত ছোট আলু দিয়ে তো ছাতার মাথাও হবে না,পেটের এক কোণায় ও যাবে না এটা
এসব ভাবতে ভাবতে রিহাব আঁখির দিকে তাকালো,আঁখি অসহায় একটা লুক নিয়ে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে
.
রিহাব গাল ফুলিয়ে আলুটা আঁখির গায়ে মেরে জানালাটা আবারও বন্ধ করে দিলো
.
উনি আমার গায়ে আলু মেরেছে??হায় মে মার জাবা
আজ রাত আর ঘুম হবে না আমার
.
আঁখি আপা আপনার ঘুম হবে না কেন?
.
আঁখি আলুটা লুকিয়ে বললো”না আসলে চা বেশি খেয়ে ফেলেছি তো তাই এটা বললাম”
কথা না বাড়িয়ে আঁখি নিজের রুমের দিকে চললো

তোমার গুনধর ছেলের কি খবর?
.
আমার ছেলে?তোমারও তো ছেলে,মাঝে মাঝে একটু মিষ্টি কথাও তো বলতে পারো ওর সাথে
.
কিসের মিষ্টি কথা?সফিক উল্লাহ কখনও বাপের টাকায় খাওয়া ছেলেদের পছন্দ করে না
পাশের বাসার রিহাবকে দেখছো?
সেই ভোর বেলায় অফিসের জন্য বের হয়,আবার রাতে ফেরে,দিনরাত খাটনি করে মা বাবার হাতে টাকা তুলে দেয় আর তোমার ছেলেকে দেখো,আজ পর্যন্ত ২টাকা উপার্জন করেছে??এসব দেখার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে ওকে শিক্ষিত বানিয়েছিলাম আমি??
.
রিহাবের কথা শুনে আঁখি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে এসে কান পেতে ছিলো
.
আমার স্পর্শের সাথে তুমি ঐ রিহাবের মিলাচ্ছো??ও কতই বা পায়,মাসে ২০/২৫হাজার,যেখানে আমার ছেলের মাসিক হাত খরচই ৩০হাজারের উপরে
.
তো?রিহাব কামাই করে টাকা উপার্জন করে আর তোমার ছেলে আমার কামাই করা টাকা খায়,যাকে বলে উড়ায়!
.
কথাগুলো আঁকির ভালো লাগছে আবারও খারাপ ও লাগছে
কারণ এক দিক দিয়ে বাবা রিহাবকে পছন্দ করেন আরেক দিক দিয়ে ওর ভাইয়াকে অপমান করছেন,তাই ওর ভালো খারাপ দুটোই ফিল হচ্ছে
.
স্পর্শ বারান্দায় এসে সিগারেট একটা ধরিয়ে সেটা হাতে রেখে নিচের ফাঁকা রাস্তাটা দেখছে
বাবার চিৎকার স্পষ্ট ওর কানে এসে বিধছে,প্রতিদিন বাবার একটাই কথা, স্পর্শ কেন চাকরি করে না
.
সিগারেটটা আর খাওয়া হলো না,হাতে থেকে থেকেই জ্বলে শেষ হয়ে গেছে
তাই রুমে আসলো সে আরেকটা নেওয়ার জন্যে,সিগারেট টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিতে যেতেই স্পর্শের চোখ গেলো রিমঝিমের রুমের দিকে
তামিম জানালার পর্দার ভিতরে ঢুকে গ্রিল ধরে ঝুলে আছে স্পর্শের দিকে চেয়ে
মুখের ভেতর কিসের যেন একটা সাদা ছোট পাইপ দেখা যাচ্ছে,স্পর্শ ওর দিকে তাকিয়েছে দেখে তামিম মুখ থেকে ললিপপটা বের করলো
.
স্পর্শ এগিয়ে এসে বললো”কিরে শালাবাবু!”
.
তামিম ভ্রু কুঁচকে ললিপপটা মুখের ভেতর আবার পুরে নিলো,এখনও সে গ্রিলে ঝুলে আছে
.
শালাবাবু তোমারে কি তোমার আপু আমার সাথে কথা বলতে মানা করেছে?নাকি কসটিভ গিলে ফেলছো”
.
তামিম এবার হকচকিয়ে ললিপপটা আবার মুখ থেকে বের করে বললো”কসটিভ গেলা যায়?গিললে কি হয়?”
.
স্পর্শ মুখটা গোল করে গ্রিলের সাথে লেগে বললো”কসটিভ গিললে ভালো মানুষ দেখলে কথা বের হয় না মুখ দিয়ে,আর আমার মনে হয় তুমি কসটিভ গিলে ফেলেছো”
.
তামিম পর্দা দিয়ে মুখটা ঢেকে বললো”আমি যে কসটিভ খেয়ে ফেলেছি এটা তুমি জানো কি করে?”
.
স্পর্শ দাঁত কেলিয়ে বললো”এই যে ভালো মানুষ মানে আমাকে দেখে তোমার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না”
.
আমি না ঐদিন হাতে কসটিভ লেগে ছিলো বলে খুলতে পারছিলাম না হাত দিয়ে,তাই মুখ দিয়ে খুলতে গিয়ে গিলে ফেলেছি,এখন আমার কি হবে?
.
আমার সাথে ঠিকমত কথা বললে তোমার কিছু হবে না
.
তামিম বোকার মতন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কিসব ভাবতে থাকলো
রিমঝিম পানির বোতল নিয়ে রুমে এসেই দেখলো তামিম স্পর্শের সাথে কথা বলছে,এটা দেখে ওর মাথা চড়ক গাছ
হনহনিয়ে এসে সে তামিমের হাত ধরে ওকে জানালার কাছ থেকে নামালো,স্পর্শ দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে
রিমঝিম ওর দিকে তাকিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে পর্দা টেনে দিয়েছে
.
তারপর তামিমের দিকে তাকিয়ে বললো’তোকে বলছি না ঐ লোকটার সাথে কথা বলবি না?”
.
স্পর্শ পর্দার ফাঁক দিয়ে রিমের দিকে তাকিয়ে আছে,রিমের হাত দেখা যায় শুধু
.
আপু ভাইয়াটা আমাকে বলতেছিলো কসটিভ খেলে নাকি ভালো মানুষের সাথে কথা বলার সময় মুখ দিয়ে কথা বের হয় না
.
রিমঝিম কপালে চাপড়িয়ে বললো”যা ঘুমাতে যা,গাধা কোথাকার!”
.
বড় আপুর বকুনি খেয়ে তামিম মাথা চুলকাতে চুলকাতে মায়ের রুমের দিকে চলে গেলো
.
রিমঝিম রুমের লাইট অফ করে নিজেও শুয়ে পড়েছে
.
স্পর্শ ঘড়ির দিকে তাকালো একবার,১২টা বাজতে ২ঘন্টা বাকি আর
প্রতিদিন রাতে ঠিক ১২টায় রিমঝিম বারান্দায় এসে দাঁড়ায়,স্পর্শ তখন থাকে না বলে সে শান্তিতে নিজের বারান্দা বিলাস করে
কিন্তু সে জানে না যে স্পর্শ প্রতিদিন এসময়টায় ওরই অগোচরে ওকে দেখে,আজ পর্যন্ত সে জানে না স্পর্শ ওকে এসময়ে লুকিয়ে দেখে
.
রিমঝিম কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে,ঠিক ১২টায় যখন পুরো মহল্লা ঘুমিয়ে পড়বে তখন সে এক কাপ চা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসবে,এসময়টা শুধু তারই
নাহলে এসময়ে কে চা খাবে?ঘুমাতে হবে তো নাকি?
রিমঝিম মাঝরাতে চা খেলেও ওর ঘুম ভালো হয় তাই তো তার এমন অভ্যাস
.
ঠিক ১২টা বাজে,রিমঝিম হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে, সাথে একটা ছোট্ট টুল,ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই কোথাও
সবাই ঘুমে হয়তবা জেগে আছে কেউ শুধু রুমের লাইটটা অফ তাদের
রিম চায়ের কাপটা রেলিংয়ের উপরে রেখে চুলগুলোকে নাড়তে নাড়তে কোণায় এসে দাঁড়ালো,কি সুন্দর কোথাও কেউ নেই
কত ভালো লাগছে,রিম চায়ের কাপটা নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে চুলগুলো নড়াচড়া অফ করে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো এবার
কৌতুহলবশত স্পর্শের রুমের দিকেও তাকালো সে
তাদের আর স্পর্শদের বাসার দূরত্ব শুধু ২হাতের,একজন চিকন মানুষ ও এই ফাঁক দিয়ে ঠিকটাক পার হতে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ,তাই রিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্পর্শের বারান্দাটা একদম নিখুঁত ভাবে দেখতে পায়
মুখ উঁচু করে সে স্পর্শের বারান্দাটা দেখছে
স্পর্শের বারান্দাটা গরুর হাটকেও হার মানাবে,কিরকম আগোছালো লোকটা!
প্যান্ট, শার্ট সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে তাও বারান্দায়,বারান্দা হলো মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার একটা উত্তম জায়গা,এখানে সে একা থেকেও ভালে থাকতে পারে আর এই লোকটাকে দেখো!
খবিশ একটা!
রিম আরেকটু সরে দাঁড়িয়ে চা শেষ করে কাপটা একপাশে রেখে দিলো,তারপর বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে টুলটা টেনে বসেছে এবার
.
রিমঝিমদের বাসার থেকে একটু দূরে যে ল্যাম্পপোস্টটা আছে তার পিছনের দিকটায় অন্ধকার,আর সেই অন্ধকারে কেউ একজন বসে আছে,তার চোখ রিমের দিকে,যেন এ প্রথম সে মানুষটাকে দেখছে এতটা মুগ্ধ হয়ে
.
স্পর্শ মুচকি হেসে ঠাস করে নিজের গালে নিজেই একটা চড় মারলো,এই নিয়ে ২০টা মশা কামড়িয়েছে ওকে
বেছে বেছে গালেই কামড়ায়,আজ আসার সময় কয়েল আনলাম না কেন,ভুলে গেছি বলে এখন ১ঘন্টা ধরে মশার কামড় খেতে হবে,শান্তিতে রিমকে দেখতেও দিচ্ছে না মশাগুলো
স্পর্শ ল্যাম্পপোস্টটার পিছনে থাকা একটা ভ্যানের উপর বসে রিমঝিমকে দেখে যাচ্ছে
.
রিম টুল নিয়ে বসে আছে চুপচাপ,হুদাই এখানে বসে থাকতে তার ভালো লাগে,তবে ৩বছর ধরে স্পর্শের জ্বালাতনে তার প্রাণপ্রিয় বারান্দাটায় তার বসাই যেন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে,তাই তো রিম বেছে বেছে এ সময়টায় নিজের বারান্দা বিলাস করতে আসে
একটা পিঁপড়াও থাকে না এসময়ে
.
রিম গালে হাত দিয়ে তার বারান্দায় থাকা গোলাপ গাছটার দিকে চেয়ে আছে
তার হাতে কখনও গোলাপ গাছ টিকে না,দুদিন পরই মরে যায় বলে গোলাপ গাছ রাখা ছেড়ে দিয়েছে সে,তবে অনেকদিন আগে ভার্সিটি থেকে আসার পথে সে তার বারান্দার নিচে একটা গোলাপ গাছের ঢাল পেয়েছিলো,সেটা কুড়িয়ে এনে এমনিতেই টবে গেঁথে রেখে দিয়েছিলো সে
ঢালটায় একটা গোলাপ ছিল বলে সে ঢালটা উঠিয়ে এনেছে,মাঝে মাঝে পানিও দিতো,ওমা ২মাস পর সে দেখলো কুড়ি বের হচ্ছে, ব্যাস দেখতে দেখতে এখন গোলাপ ও ফুটেছে,এবং মজার ব্যাপার হলো গাছটা ১বছর হতে চললো এখনও মরেনি,রিম তো নিজেকে অলক্ষী বলছিল এতদিন এখন এটা দেখে প্রমাণ হলো যে সে লক্ষী
.
আসলে ঢালটা স্পর্শ এনে রেখেছিলো রোডের উপর
কারণ সে জানতো রিমের গোলাপের অনেক শখ,নিজের একটা গোলাপ গাছ রাখা তার আরও বিরাট শখ,সমস্যা ছিল তার হাতে গোলাপ গাছ টিকতো না,কিন্তু তাও সে প্রতি শীতকালে গোলাপ গাছ কিনতো একটা করে
১মাস পর সেটা মৃত পুরোপুরি
রিম প্রতিবার ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতো গাছগুলোর জন্য
তাই স্পর্শ গোলাপের বাগান খুঁজে একটা টব এনেও রেখেছিলো রিমের বারান্দায়,রিম সেটা দেখে বুঝেছে স্পর্শ রেখেছে তাই সে সেটা ফেলে দিয়েছিলো তাও স্পর্শের বারান্দায়
তাই শেষমেষ স্পর্শ একটা গোলাপ গাছের তাজা ঢাল কেটে আনলো, গোলাপের ঢাল যদি তাজা হয় তাহলে সেই ঢাল রোপন করলে কুড়ি বের হবে
আর তাই হলো,স্পর্শ ঢালটা রেখে যাওয়ার পর রিম সেটা নিয়ে রোপন করলো আর কুড়িও বের হলো,রিম ৭দিনে ৫দিন পানি দিতো,তাই স্পর্শ মনে করে বাকি ২দিন পানি দিতো রিমের মনে থাকতো না বলে
গাছটা দুজনের যত্ন পেয়ে এখন বেশ ভালোই আছে,তা দেখে রিম মহা খুশি আর তার খুশি দেখে স্পর্শ আরও খুশি।।
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here